মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৩

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ তিন

–তোরা কার খপ্পরে পড়েছিস বললি?

দিয়া আর তুলতুল পেছনে তাকিয়ে দেখে প্রান্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখে সন্দেহর দৃষ্টি নিয়ে। তুলতুল উঠে দাড়ায়। দিয়া কোনোরকমে উঠে দাড়ায়। সে এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পা দুটো এখনো কাঁপছে। দিয়ার এই অস্বাভাবিকতা চোখ এড়ালো না প্রান্তর। প্রান্ত ওদের দিকে এগিয়ে আসে আর প্রশ্ন করে-

–তোদের দুজনকে এমন লাগছে কেন? মনে হচ্ছে কোনো যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরেছিস। আর দিয়া তোর পা কাঁপছে কেন এভাবে? আবার বললি তোরা কার খপ্পরে পড়েছিলি? কি লুকাচ্ছিস তোরা? কোনো ঝামেলা পাকিয়েছিস নাকি? সত্যি কথা বল।

–প্রান্ত ভাইয়া শুধু ঝামেলা কেন মহাঝামেলা পাকিয়ে রেখে এসেছি আমরা। শুধু এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছি।দিয়া বিড়বিড় করে বললো।

এই কি বিড়বিড় করছিস? জোরে বল প্রান্ত ধমক দিয়ে বলে।

–ভাইয়া ও এমনি অন্য কিছু বলছিল। আর আমরা দুজন কারো খপ্পরে পড়ি নি। পড়া থেকে বেঁচে গিয়েছি। আজ রাফসানের দলবল এসেছিল বাজারে এটা শুনে আমরা দোকান বন্ধ করে দৌড়ে চলে এসেছি। তাই আমাদেরকে এমন লাগছে। হেহেহে। তুলতুল জোরপূর্বক হেসে বললো।

কিন্তু প্রান্ত মনে হয় তুলতুলের কথা ভালো করে বিশ্বাস করলো না। কেমন টুকুর টুকর করে দুইজনকে দেখছে। এরা যে কোনো ঝামেলা ছাড়া এসেছে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রতিদিনই কিছু না কিছু উল্টো পাল্টা করে আসে। আজও হয়তো করেছে কিন্তু বলছে না। প্রান্তর এমন করে তাকানো দেখেই বুঝতে পারলো তুলতুল যে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সত্যি বললে দেখা যাবে তাকে অনেক দিন বাহিরে যেতে দেবে না কলেজে ক্লাস ও করতে দেবে না। তাই ও কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো-

–তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে না ভাইয়া? তোমার কি মনে হয় আমরা সবসময় গড়বড় করি? কখনো ঝামেলা ছাড়া বাড়ি আসিনি? এমন বলতে পারলে? আমরা তো বড় হয়ে গিয়েছি এখন তো কিছু করি না তারপরও তোমরা সবাই এমন করো। আমি থাকবো না তোমাদের সাথে।
প্রান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এখন আর কিছু বললে নিশ্চয়ই চিল্লিয়ে কান্না করবে। আর রুমে দরজা দিয়ে বসে থাকবে। তাই ভেবে আর কিছু জিজ্ঞাস করলো না।বললো-

–না না আমি কি তোকে অবিশ্বাস করতে পারি। তুই তো অনেক ভালো মেয়ে। তোর মতো আর কেউ হতেই পারে না। তাই না দিয়া। এখন তোরা দুজনই বাড়ি চল। সকালে তো খেয়ে যাসনি। চাচি রান্না করেছে। অনেক কষ্টে মানিয়েছি। একটু রাগ কমেছে। চল চল। প্রান্তর কথা শুনে ওরা দুজন বাড়ির ভেতরে গেলো।

প্রান্ত তুলতুলের চাচাতো ভাই। ওদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট লাগে প্রান্তদের বাড়ি যেতে। তুলতুলদের থেকে প্রান্তদের অবস্থা অনেক ভালো। প্রান্ত মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে এবছর। তার ইচ্ছা কলেজের প্রফেসর হবে কিন্তু তার বাবা তা চায় না। তার বাবার কথা ছেলে তার ব্যবসায় বসবে। কিন্তু প্রান্ত তাতে মোটেই রাজি না। সে নিজেই কিছু করতে চায় বাবার ব্যবসায় সামলাবে না। এতে বাবার সাথে রাগারাগি হয়। আর সেও চটে গিয়ে কোন কাজ না করে ঘুরে বেড়ায়। বাবা যতদিন না মানবে সে এটাই করবে। তার ধারণা এতে তার বাবা মানবে। ছেলে পড়াশোনা করে ঘরে বসে থাকবে এটা নিশ্চয়ই তিনি চাইবে না। প্রান্ত এজন্য বেশির ভাগ সময়ই তার বাবার সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করে। এতে কাজ না হলে সে তার বাবার কথা না শুনেই কলেজে জয়েন করবে।

তুলতুলরা ভেতরে গিয়ে দেখে তার মা তার ছোট ভাই তাওহীকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। তার বড় ভাই তিয়াস টেবিলে বসে রয়েছে রেডি হয়ে। সামনে খাবার রাখা নিশ্চয়ই খাবার খেয়ে প্রতিদিনের মতো আজকেও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে। চাচা তাকেও প্রান্তর মতো তার ব্যবসায় দেখতে বলেছে কিন্তু ইনিও রাজি না। তিয়াস কে দেখে দিয়া ঘুরে চলে যেতে চায় আর ওমনি তুলতুল ওর হাত পেড়ে ধরে। দিয়া কেমন মুখ কাঁচুমাচু করে তাকায় তুলতুলের দিকে কিন্তু তুলতুল তাতে পাত্তা দিয়ে দিয়ার হাত ধরে টেবিলের সামনে গিয়ে বলে –

–হাই তিয়াস ভাইয়া, হাই মা, হাই তাওহী, হাই প্রান্ত ভাই কেমন আছো তোমরা? আমাকে চেন? আমি এ বাড়ির মেয়ে তুলতুল। আর ও আমার বেস্টু দিয়া। তিয়াস ভাইয়া সুন্দর না?

তিয়াস চোখ গরম করে তাকালো। অন্যরা নিজের কাজে ব্যস্ত। এটা প্রতিদিনের ঘটনা। তুলতুল বাড়ি এসে সবাইকে হাই জানাবে তারপর নিজের পরিচয় দিবে। তুলতুল দিয়াকে সাথে নিয়ে টেবিলে বসে বললো- ক্ষুধা লেগেছে। দিয়ার তিয়াসের সামনে থাকতে অস্বস্তি লাগছে। তারপরও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। তুলতুলের মা আফসা বেগম বললেন – মহারানী আজ এতো তাড়াতাড়ি বাড়িতে কেন? কলেজে মিস দিয়েছিস নাকি আজকে? আর তোর গলায় কি হয়েছে? দাগ কেন? তারপর হাতমুখ না ধুয়ে খেতে বসেছিস কেন?
মায়ের কথায় তুলতুল চুপ হয়ে রইলো। তার এখন কিছু না বলাই ভালো। মায়ের সামনে মিথ্যা বলতে গেলেই ধরা পড়ে যায়। তাই আফসা বেগম কে পাল্টা প্রশ্ন করল –

— মা তোমার রাগ কমেছে? বাবা তোমার রাগ ভাঙিয়েছে ফোন দিয়ে তাই না? এজন্যই তো তুমি রান্না করেছ। সকালে বললে যে আর রান্না করবে আমি তো ভাবলাম আজ আর খেতে পাবো না।
প্রান্ত রাগী ভাবে তাকিয়ে আছে তুলতুলের দিকে সে এতো কষ্ট করে চাচির রাগ ভাঙিয়েছে। এই মেয়ে আবার শুরু করলে তো মুশকিল। কিন্তু না আফসা বেগম রাগ না করে সবাই কে খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন।

আকাশে চাঁদ উঠেছে। হালকা বাতাস বইছে। তুলতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে। আকাশে কালো কালো কিছু উড়ো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারা নেই আকাশে। কিন্তু চাঁদ কি সুন্দর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষন পর পর উড়ো কালো মেঘ এসে চাঁদটা কে ঢেকে দিচ্ছে। তখন তুলতুল অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কখন মেঘ গুলো চলে যাবে আর সে চাঁদটা কে দেখতে পাবে। প্রত্যেক বার মেঘ সরে যাবার পর চাঁদ টা কে আরো সুন্দর লাগে। তুলতুল ভাবছে চাঁদটা কি আস্তে আস্তে আরো সুন্দর হচ্ছে? কিন্তু না চাঁদ যেমন তেমনই থাকছে। শুধু হঠাৎ আসা মেঘগুলোর চাঁদটা কে ঢেকে দিয়ে অন্ধকার করে দেয়। আবার যখন সরে যায় তখন চাঁদের আলো একটু একটু করে দেখা যায়। মনে হয় এখই চাঁদটা আাকাশে উঠছে। মানুষের জীবনও তেমনি হঠাৎ আলোকিত হয় আবার হঠাৎই অন্ধকারে ডুবে যায়। কারো জীবনে অন্ধকার ছাপিয়ে আলোকিত হয়, আবার হয় কারো না। তুলতুল এতোক্ষণ কথা গুলো ভাবছিলো। তার হাতে একটা ছবির ফ্রেম। যেটা খুব যত্ন করে আগলে ধরে রেখেছে।

তুলতুল রুমে গিয়ে দেখে তাওহী তার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। একে আর উঠানো যাবে না। তুলতুল হাত থেকে ছবির ফ্রেম টা ড্রয়ারে রেখে বিছানায় বসতে যায় আর তখনই তার হাত লেগে ওয়াটার পট পড়ে যায়। এটাকে কলেজে যাওয়ার সময় নেয়নি আজ। তাহলে এর ঢাকনা খোলা রেখেছে কে? তুলতুল পেছনে ঘুমন্ত তাওহীর দিকে তাকায়। এটা নিশ্চয়ই ওর কাজ। মেঝেতে সব পানি পড়ে আছে। রাতে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য উঠে পানিতে পা দিলে স্লিপ খেয়ে পড়ে যাবে। কি করবে ও এখন? রুমের বাইরে থেকে পানি মোছার কিছু আনতে পারবে না। কারন মা- বাবা হয়তো বসে টিভি দেখছে। এখন তাদের সামনে যেতে চাচ্ছে না তুলতুল। তাহলে কি করবে সে? আইডিয়া।

তুলতুল আস্তে আস্তে গিয়ে শব্দহীন ভাবে রুমের দরজা খোলে। দরজা খুলে দেখে দরজার সামনে পাপোষ রয়েছে। সে একটু পা বাড়িয়ে পাপোষ টা টেনে নিয়ে আসে রুমে। এরপর পা দিয়েই পাপোষ টা পানির উপরে টেনে দেয়। কিছুক্ষন রেখে দেয় তারপর হাত দিয়ে উঠিয়ে দেখে পানি শুষে নিয়েছে। এবার সে পাপোষটা কে আগের জায়গায় রেখে আসতে পারে। হিহিহি সে কতো সহজে সমাধান করে ফেলেছে। গুড গার্ল। তুলতুল পাপোষ টা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় রেখে আসার জন্য। পেছনে ঘুরে দেখে তিয়াস ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে-

–হাই ভাইয়া। কিছু লাগবে? হেহে

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here