#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ ত্রিশ
-” নাম কি তোমার?” রোমানা চৌধুরী তুলতুলকে জিজ্ঞেস করলেন। তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। জ্ঞানের ফিরলে সে নিজেকে একটা রুমের বিছানায় আবিষ্কার করে। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে সে। তার যতটুকু মনে পড়ে সে ক্লাসরুমে ছিল আর রাফসান এসে তার সামনে বসে তাকে নিঃশ্বাস নিতে বলে, এরপর তুলতুলের আর কিছুই মনে নেই। সে উঠে বসে, মাথার পেছনে ব্যাথা হয়ে আছে, গলা চেপে ধরার কারনে ব্যাথায় ঢোক চিপতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থেকে সে উঠে বাইরে যেতে চায় কিন্তু তার আগেই রোমানা চৌধুরী রুমে ঢোকে। এতে তুলতুল বিছানায় বসে পড়ে আবার। রোমানা চৌধুরী এসে তুলতুলের পাশে বসে। আর তুলতুল ভয়ে দূরে সরে যায়। রোমানা চৌধুরী অনেক ফর্সা, তারউপর মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, সাদা শাড়ি পরনে। তুলতুলের ভয় লাগলো কোনো ভূতটুত নয় তো আবার? সে ভয়ের দৃষ্টি নিয়ে রোমানা চৌধুরীকে আবার পরখ করলো। এখন যদি এত সুন্দর রূপ থেকে পেত্নী রূপ ধারন করে তার ঘাড় মটকাতে আসে তখন কি করবে সে? এতোক্ষণ ধরে জবাবের আশায় তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল রোমানা চৌধুরী, কিন্তু তুলতুল কোনো উত্তর দিল না দেখে সে বিরক্ত হলো। সে একটু জোরে জিজ্ঞেস করলো
-” এই মাইয়া কথা কও না ক্যান? নামডা কি তোমার?” রোমানা চৌধুরীর জোরে কথা বলা শুনে তুলতুলের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো, চোখ ছলছল করছে। তা দেখে রোমানা চৌধুরী একটু নরম হলেন। মেয়েটা হয়তো তাকে ভয় পাচ্ছে, যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। সে আস্তেই তুলতুলকে জিজ্ঞেস করলেন
-” তোমার কি খারাপ লাগছে? নাকি তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো কোনটা? যদি ভয় পেয়ে থাকো তাহলে বলবো ভয় নেই আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।” রোমানা চৌধুরীর কথা শুনে তুলতুলের মুখ হা হয়ে গেলো। সে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকালো। এতক্ষণ তো কেমন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিল আর এখন একলাফেই শুদ্ধ ভাষা বলছে? অদ্ভুত! সে যদি শুদ্ধ ভাষা পারে তাহলে ওভাবে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে কেন তা তুলতুল ভেবে পেল না।
-” আবির! ওই আবুল্লে কই তুই? এইহানে আয় জলদি।” রোমানা চৌধুরী কথায় আবির দ্রুত রুমে প্রবেশ করে বললো
-” কি হয়েছে দাদী চিৎকার করো কেন? ও কি কিছু করেছে? শাস্তি দিতে হবে?”
-” থাপড়ায় কান গরম করে দিমু। সবসময় মানুষরে শাস্তি দিতে দিতে মাথায় ওইডাই ঘুরে তাই না? তোরে ডাকছি ক্যান শুন, ও মনে হয় আমারে দেইখা ভয় পাইতাছে, তুই ভালো করে বল আমি কে? আর ভয় যেনো না পায়।”
-” ওহ আচ্ছা বলছি।” তারপর তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বললো
-” এই তেলুতেলু, ইনি হচ্ছে রাফসান ভাইয়ের দাদী আর আমারো। সো তাকে তুমি ভয় পেয়ো না। তুমি এখন রাফসান ভাইয়ের বাড়িতে আছো। বুঝেছো?” আবিরের কথায় তুলতুল রাগী চোখে ওর দিকে তাকালো যেন এখুনি গিলে খেয়ে ফেলবে। আবির তা দেখে বলে
-” কি তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
-” আপনি আমার নাম কি বললেন?”
-” নাম যা তাই বললাম। আর কি বলবো?”
-” আপনি আমাকে তেলুতেলু বলেছেন কেন? আমার নাম তুলতুল তেলুতেলু নয়।” তুলতুল চিল্লিয়ে বললো। তার নাম নিয়ে কেউ উল্টা পাল্টা বললে তার প্রচুর রাগ হয়। আর রোমানা চৌধুরী হতভম্ব হয়ে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে আছি। এ মেয়ে এতক্ষণ কথাই বলছিল না আর এখন রীতিমতো চিৎকার করছে। আর আবিরেরই বা কি দরকার এতো সুন্দর একটা নামকে এভাবে পচা পানিতে ডোবানোর? সে তার পাশে থাকা আবিরে পেটের সাইটে দুম করে একটা দিল। আর আবির লাফিয়ে ওঠে বলে
-” কি করলাম আমি, মারছো কেন? আর এইযে তোমার নাম আমি এইটাই জানতাম, তাই এটাই বলেছি ইচ্ছা করে এমন করিনি। সো দোষ আমার না তেলুতেলু। আর একবার যখন ডেকেছি এখন থেকে এটাই ডাকবো আমি। হুহ্!” বলে আবির ঝটপট বের হয়ে গেলো, নাহলে এখানে থাকলে চিৎকার শুনতে হবে আর মার খেতে হবে। এদিকে তুলতুল মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। সে কিছুতেই নিজের নামের ব্যাপারে উল্টো পাল্টা মেনে নেবে না। রোমানা চৌধুরী তুলতুলের গাল ফুলানো দেখে হাসলো। তারপর ওকে বললো
-” তো তোমার নাম তুলতুল?” তুলতুল মাথা নাড়লো।
-” কিসে পড়?”
-” এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবো।”
-” তাহলে তো তুমি একবারেই পিচ্চি। ভাবতে হচ্ছে!” রোমানা চৌধুরীর কথায় তুলতুল বললো
-” কি ভাববেন?”
-” হু? ও কিছু না। তুমি তো দেখি অনেক দূর্বল হয়ে গেছো, এটা খেয়ে নাও তো দেখি।” বলে রোমানা তুলতুলের হাতে স্যুপের বাটি ধরিয়ে দিলেন। তুলতুল তা দেখে নাক সিটকালো, স্যুপ তার কখোনোই ভালো লাগে না। কিন্তু এটা খাওয়া ছাড়াও উপায় নেই, তরল খাবার ছাড়া গলা ব্যাথার জন্য অন্য কিছু খেতে পারবে না। তাছাড়া তার ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর, সকালে খেয়ে বের হয়েছিল এরপর আর কিছু খায়নি সে। তাই আর কিছু না বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে খেতে লাগলো। কিছুটা খেয়ে সে আর খেলো না, ভালো লাগছে না। বাড়ি যেতে হবে তার, না জানি কি অবস্থা হয়েছে বাড়িতে তাকে না পেয়ে। তুলতুল রোমানা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো
-” আমি বাড়ি যাবো। রাত হয়ে গিয়েছে। ”
-” নাহ, এখন নয় আরো পরে যাবে।” তার কথা শুনে তুলতুল উত্তেজিত হয়ে বলে
-” আমাকে বাড়ি যেতে হবে। সবাই চিন্তা করছে, নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবাই জেনে গেছে কলেজে হামলা হওয়ার কথা। আমি বাড়ি যাবো যাবো।”
-” এই মেয়ে চিন্তা করো না, তোমার বাড়িতে আমি জানিয়ে দিচ্ছি। ” বলে ফোন তুলতুলের কাছে দিয়ে নাম্বার উঠাতে বললো। তুলতুল কিছু চিন্তা করে তিয়াসের নাম্বার উঠিয়ে দেয়। রোমানা চৌধুরী ফোন দেয়।
এদিকে তিয়াস অস্থির হয়ে তুলতুলকে খুঁজে যাচ্ছে। ছোটাছুটি করছে সে ভালোই কিন্তু তুলতুলকে পায়নি। লোকও লাগিয়েছে যখন শুনেছে কলেজে হামলা হয়েছিল। কিন্তু তুলতুলকে কেউ বলে কলেজ থেকে বের হতে দেখেনি। সে একবার খুঁজে গিয়েছে কলেজ থেকে পায়নি, তারপর লোক লাগিয়েছে। কিন্তু নিজেকে শান্ত করতে পারছে না দেখে সে আবার কলেজে যায়, যদি ভয়তে কোনো ক্লাস রুমের ভেতর পড়ে থাকে। এজন্য আবার ভালো করে খুঁজতে যায়। কিন্তু কলেজে ঢোকার সাথে সাথে তা ফোন বেজে ওঠে। সে দ্রুত নাম্বার না দেখেই রিসিভ করে বলে
-” হ্যালো! তুলতুলকে পেয়েছিস?”
-” আগে ভালো কইরা নাম্বার দেখ ব্যাটা পরে তুই-তোকারি করবি। আর তুলতুল আছে আমার কাছে।”
তিয়াস অবাক হয়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। সে আবার বলে
-” হ্যালো, আপনি কে বলছেন? আর তুলতুল কোথায় ওকে দিন।”
-” আমি কেডা এইটা জানা লাগবো না এখন, তোমার বোন বাড়ি গেলেই তার কাছ থেইকা শুইনো। আর তোমার বোন ভালো আছে, কয়েক ঘন্টা পরে পাঠায় দিবোনে। নেও কথা কও।”
-” হ্যালো ভাইয়া।” তুলতুল কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো।
-” বোন তুই কোথায়? ঠিক আছিস? কেউ কি তোকে ধরে নিয়ে গেছে? বল আমি একটাকেও ছাড়বো না। কোথায় আছিস তুই।” তিয়াস তুলতুলের কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনে অস্থির হয়ে বলে। তার বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে, এতক্ষণ ধরে তুলতুকে খুঁজছে কিন্তু কোথাও পায়নি।ভয়ে তার অবস্থা খারাপ। তুলতুল নাক টেনে বলে
-” আমি ঠিক আছি ভাইয়া। আমার কিছু হয়নি, একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছি।”
-” কি হয়েছিল তোর?”
-” আমি বাড়ি এসে বলবো। তোমরা চিন্তা করো না ঠিকাছে?”
-” তুই সত্যিই ঠিক আছিস তো নাকি কারো ভয়ে বলছিস?”
-” না আমি সত্যিই ঠিক আছি। কারো ভয়ে বলছিনা। দেখবে আমি কিছুক্ষন পরে তোমার সামনে থাকবো। চিন্তা করো না। এখন রাখি।” তুলতুলের কথায় তিয়াস পুরোটা বিশ্বাস না করলেও কিছুটা করেছে। সে ফোন পকেটে রেখে কলেজ থেকে বের হলো। মনের ভেতর এখনো সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই তাকে অপেক্ষা করতে হবে। এই অপেক্ষা জিনিসটা সবসময় বিরক্তি লাগে তিয়াসের। সে বিরক্তি, কিছুটা সন্দেহ আর বোনের চিন্তা নিয়েই বাড়ির দিকে রওনা হলো। মা-বাবা হয়তো চিন্তা করছে তাদের বলতে হবে।
.
তুলতুল ফোন রেখে রাফসানের দাদীর দিকে তাকালো। তিনি তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-” চিন্তা কইরো না, রাফসান তোমাকে দিয়া আসবো।” তুলতুল মাথা নাড়ায়। রোমানা চৌধুরী তুলতুলকে জিজ্ঞেস করে সে কেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তুলতুল কলেজের ঘটনা খুলে বলে। আর রোমানা চৌধুরী হায়হায় করে বলে
-” কেমুন বজ্জাত মানুষ! ঠিক করছো একদম ওই পশুটারে মাইরা। রাফসানরে কমু ওরে ধইরা যেনো আরো শাস্তি দেয়।” তারপর তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বলে
-” তো রাফসান তোমারে কখনো বকা দেয় না তাইনা? আর তোমারে সবসময় আগলাইয়া রাখে তাইনা।” রোমানা চৌধুরীর কথা শুনে তুলতুল চোখ মুখ কুঁচকে বললো
-” একদম না! উনি আমাকে একদম দেখতে পারে না। প্রথম যেদিন ওনার সাথে দেখা হয়েছিল ওইদিন ওনি আমার গলা রিভলবার দিয়ে চেপে ধরেছিল। তারপরের বার গুলি করে ওভাবেই ফেলে রেখে গিয়েছিল, আমার গলাও ওনি চেপে ধরেছিল, জোরে থাপ্পড় মেরেছিল আর সাথে বকা আর ধমকি ফ্রী। ওনি আমাকে একদম পছন্দ করে না, আমার চেহারা বলে ওনাকে অনেক জ্বালায়। ওনার সামনে যেতে মানা করে সবসময় আমাকে আরো কতোকি।” তুলতুল ঠোঁট উল্টো বললো। কথা গুলো বলার সময় সবকিছু তার চোখের সামনে ভাসছিল। সবমনে করে তার হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে মন চাইছে। রোমানা চৌধুরী রাফসানের কান্ড শুনে মনে মনে রেগে গেলেন। তার নাতি একনাম্বারের অপদার্থ হচ্ছে। একটা পিচ্চি মেয়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করেছে। ওকে তো পরে দেখে নেবে কিন্তু তা তুলতুলকে বুঝতে দিল না। সে মিষ্টি হেসে বললো
-” আচ্ছা আমি রাফসানরে বইকা দিমু নে। ঠিকাছে? যাতে কখনো আর তোমারে না বকে।” তুলতুল হাসলো তাতে রাফসান বকা খাবে শুনে। তারপর রাফসানের দাদীকে জিজ্ঞেস করলো
-” আমি আগের বার এসে দেখিনি কেন আপনাকে?”
-” আমি থাকি গ্রামের বাড়িতে। প্রতিমাসে এইহানে আইসা থাকি নাতির কাছে কিছুদিন। তো তুমি কি এর আগেও আইছিলা?”
-” হুম, ওনার লোকজন আমাকে হুমকি দিয়ে তুলে নিয়ে এসেছিল।” তুলতুল বললো।
-” কতবড় আকাইম্মা। সবগুলারে টাইট দিমু আমি।” তুলতুল বললো
-” আমি আপনাকে দাদী ডাকলে কি আপনি রাগ করবেন?” ওর কেন জানি ওনাকে দাদী ডাকতে মন চাইছে। খুব ভালো কথা বলতে পারে। রাফসানের মতো গাম্বু না। হুহ্! রোমানা চৌধুরী তুলতুলের কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-” তোমার যেইটা ডাকতে ভালো লাগবো আমারে ওইটাই ডাইকো, আমি রাগ করমু না। তোমার অভিযোগ আর ঠোঁট ফুলানো একদম মিনির মতো। আর চোখ গুলোও।” তুলতুল অবাক হয়ে বললো
-” মিনি কে?” রোমানা চৌধুরী এতে হকচকিয়ে উঠলেন এতে। তার হুঁশ হয় এতে সে কি বললো। তিনি জোর পূর্বক হেসে বলেন
-” না, কেউ না। তুমি রেস্ট করো, কিছুক্ষন পরে রাফসান তোমারে বাড়ি দিয়া আইবো।” বলে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেলেন আর তুলতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
রাফসান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। ভেতরে তার অস্থিরতা কাজ করছে। নামটা শুনেই তার সব স্মৃতি এক এক করে সামনে চলে আসছে। কিন্তু সে কিছুই মনে করতে চাইছে না। নিঃশ্বাস আটকে আসছে তার। চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে অপারগ। এই যন্ত্রণার কি কোনো ঔষধ আছে? না নেই। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেট টান দিল। দাদী না থাকলে এতক্ষণে সে ড্রিংকস করতে বসে যেতো। যাতে ভেতরের কষ্ট কিছুটা হলেও কমে, কিন্তু তা এখন সম্ভব নয়। তার দাদী এসব দেখলে বোতল তার মাথার ওপর ভাঙবেন। আগেরবার এমন ভাঙতে গিয়েছিল রাগ করে, রাফসান দৌড় দিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। তাকে যতই ভালোবাসুক কিন্তু সে যদি নিজের ক্ষতি হবে এমন কাজ করে তাহলে আর রক্ষা নেই তাকে লাঠি নিয়ে মারতে আসে। এতবড় হবার পরও মনে হয় সে কয়েকটা বারি খেয়েছে। ভাবতে ভাবতে তার রমের দরজা ধরাম করে শব্দ হয়ে খুলে গেলো। এতে রাফসান দ্রুত তার রুমে ঢুকে দেখে তার দাদী লাঠি নিয়ে তার দিকে তেড়ে আসছে। রাফসান চট করে রুমের অপর প্রান্তে দৌড় লাগালো আর বললো
-” বুড়ি কি হয়েছে? তুমি আমাকে মারতে আসছো কেন? কি করেছি আমি? আরে আজব! কিছু বলেও না সমস্যা কি? ভালো লাগছে না আমার।” রাফসান রুমের এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছে তো আবার ওপাশ থেকে এপাশে আসছে। আর রোমানা চৌধুরী একহাতে লাঠি নিয়ে আরেকহাত দিয়ে শাড়ি একটু উঁচু করে রাফসানের পেছন পেছন যাচ্ছে, যাতে পড়ে না যায় কাপড়ে বেঁধে। আজ এটাকে কয়েক ঘা তিনি দিবেন।
-” এত্ত সাহস তোর? ফুলের মতো মাইয়াটারে তুই থাপ্পড় মারছোস, গলা চাইপা ধরছোস, সাথে বলে থেরেটও দিছোস? মাইয়া মানষেন গায়ে হাত তুলোস, কোন ধরনের পুরুষ মানুষ হইছোস তুই। আজকা তোর পিডের ছাল তুলমু আমি খাঁড়া তুই।” রোমানা চৌধুরী রাফসানের পিছে পিছে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বললো। আর রাফসান চিল্লিয়ে বলছে
-” তোমাকে কে বললো? নিশ্চয়ই ওই মেয়েটা তাই না? ওকে তো আমি দেখে নেব। বাঁচিয়েছি আমি ধন্যবাদ না দিয়ে আবার বদনাম করছে।”
-” ওই তুই কি কইলি? আবার তুই ওর সাথে উল্টা পাল্টা করবি তাইনা? তোর হাত ভাইঙ্গা রাইখা দিমু আমি।” বলে সে রাফসানকে ধরার জন্য ছোটে। আর রাফসান তো এদিক ওদিক যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ইদুর আর বিড়ালের খেলা। রাফসান দাদীকে মানানোর জন্য বললো
-” দাদী! আমার ময়না দাদী। তোমার নাতি কি এরকম করতে পারে বলো? কক্ষনো না। মেয়েটা তোমাকে মিথ্যা বলেছে। হে হে হে।” বলে সে দরজার দিকে এগোতে লাগলো যাতে বের হতে পারে। আর রোমানা চৌধুরী তেড়ে আসতে আসতে বললো
-” কি কইলি? ওই মাইয়া মিথ্যা কইছে? আমি কি তোরে চিনি না বাটপার? তোরে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।” রাফসান যেই দরজা দিয়ে বের হতে যাবে তখনি তিনি তার হাতের লাঠিটা রাফসানের দিকে ছুড়ে মারে আর সেটা পেছন থেকে দৌড়রত রাফসানের পায়ের ওপর লাগে। সে হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। তারপর দাদীর দিকে একবার মুখ ফুলিয়ে তাকায়, এতে রোমানা চৌধুরী আরো তেড়ে আসে আর রাফসান দৌড় দেয়। কি লজ্জার কথা যাকে সবাই ভয় পায় সে তার দাদীর মারের ভয়ে ইঁদুরের মতো দৌড়েছে এতক্ষণ। মানসম্মান সব শেষ হয়ে যাবে কেউ তা জানলে। তার তুলতুলের ওপর মেজাজ খারাপ হলো। মেয়েটা দাদীর কাছে কথা লাগিয়েছে। রাফসান সোজা তুলতুল যেই রুমে আছে সেই রুমে গেলো। তারপর এক ঝটকায় তুলতুলকে টেনে তুললো। তুলতুল এতক্ষণ আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে ছিল। হঠাৎ রাফসান এমন টান দেওয়ায় সে চমকে ওঠে। রাফসান রাগী দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে তার হাত পেছনে বাকিয়ে বলে
-” এই মেয়ে দাদীকে এসব বলেছ কেন? আমাকে বকা খাওয়াতে চাও তাই না? ফাজিল মেয়ে কোথাকার। একদম মাথায় চড়ে বসেছে কয়েকদিন ভালো ব্যবহার..” রাফসান আর বললো না তুলতুলের দিকে তাকিয়ে। তুলতুলের চোখ এতক্ষণে পানিতে টলমল করছে। বর্ষা কালে যেমন নদীতে পানি টাইটুম্বুর হয়ে থাকে তুলতুলের চোখও তেমন হয়ে আছে। চোখের পলক ফেললেই যেনো গড়িয়ে পড়বে। সবসময়ই রাফসান তাকে কথা শোনায় একটু ভালো করেও কথা বলে না আবার বলে ভালো ব্যবহার করেছে। খারাপ লোক! রাফসান তুলতুলের সেই পানি ভর্তি চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার রাগ কেন জানি অটোমেটিক ভাবে কমে গেছে। তুলতুলের গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বললো
-” হাত ছাড়ুন ব্যাথা লাগছে।” রাফসান ভ্রু কুঁচকে তাকলো। তারপর তুলতুলের হাত হালকা করে ধরলো যেনো ব্যাথা না পায়, কিন্তু হাত ছাড়লো না। রাফসান নজর পড়ে তুলতুলের গলায়, হাতের ছাপ বসে গিয়েছে, গলা লাল হয়ে আছে। রাফসান তুলতুলের গলার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর নিজের অজান্তেই সে লাল হওয়া জায়গায় হাত বুলায়, আর তুলতুল কেঁপে উঠে রাফসানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে গলায় হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে রাফসানের দিকে তাকায়। কি হলো এটা? নাকি সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে? তার স্বপ্ন কি এত খারাপ? নাকি সব সত্যি? রাফসান তার গলায়.. তুলতুলের হেঁচকি উঠে যায়, সে দ্রুত টেবিলে থাকা পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিলে ফেলে। তারপর আবার হাবলার মতো চোখ মুখ করে রাফসানের দিকে তাকালো, গালে তার এখনো চোখের পানি রয়েছে, চোখের পাপড়ি গুলোও ভেজা ভেজা। রাফসান কিছুই বললো না এতক্ষণ, শান্ত ভাবে তুলতুলকে দেখছিল, তুলতুল তাকালে সে ভাবলেশহীন ভাবে রুম থেকে বের হয়ে যায় কিছু না বলে। আর ভাবতে থাকে সে এমন কেন করলো?
_______________
রাত অনেক হয়েছিলো। পুরো রাস্তা নির্জন, কোথাও কেউ নেই। তারপর আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পুরো রাস্তা আলোকিত দেখা যাচ্ছে আবার কিছু জায়গায় ল্যাম্পপোস্ট না থাকায় গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সামনেটা শুধু দেখা যাচ্ছে আর চারপাশ অস্পষ্ট। গাড়ি চলছে অনেকক্ষণ ধরে। তুলতুল বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাচ একটু নামিয়ে রাখার জন্য বৃষ্টির ছিটেফোঁটা তার মুখে এসে পড়ছে। জিনিসটা তুলতুলের ভালো লাগল। সে খুশি হয়ে বাইরে বৃষ্টির দিকে মন দিল পাশে যে কেউ আছে সে খেয়াল তার নেই। তাই বুঝি পাশের মানুষের তুলতুলের খুশি পছন্দ হলো না, সে জানালার কাচ সম্পূর্ন তুলে দিল। তুলতুল রাফসানের দিকে রাগী চোখে তাকালো। কিন্তু রাফসান সেদিকে না তাকিয়ে একমনে গাড়ি চালাতে লাগলো, এমন ভাব যেন সে কিছুই করে নি আর কিছুই জানে না। তুলতুল মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলো। কিছুক্ষন পরে আঁড়চোখে রাফসানের দিকে তাকালো। খাম্বু একটা কেমন করে ভাব নিয়ে রয়েছে। হুহ্। তখন রুম থেকে বের হওয়ার পর তুলতুলের সাথে আর কোন কথা বলেনি এমনকি তাকায়ও নি। দাদী বলায় তাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছে, গাড়িতেও কোন কথা বলেনি। তুলতুলের ও ঠেকা পড়ে নি সেও এই গুন্ডার সাথে কথা বলবে না ঠিক করেছে। অনেকক্ষন পরে গাড়ি থেমে যায়। তুলতুল বসে ঝিমাচ্ছিল, গাড়ি থেমে যাওয়ার সে সজাগ হয় পুরোপুরি। কিছুক্ষন বসে থাকে, ভাবে যে রাফসান গাড়ি থামিয়েছে কেন? আশেপাশে অন্ধকার হওয়ায় কোথায় আছে বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ির হেডলাইট ও অফ করা। তুলতুল রাফসানের দিকে তাকায় সে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে তুলতুলের দিকে। তুলতুল কিছু জিজ্ঞেস না করে রাফসানের এমন ভাবে তাকানো কারন ভাবতে লাগলো।এবার রাফসান আরো বিরক্ত হয়ে বললো
-” নামছো না কেন? সমস্যা কি?”
-” বাড়ি এসে গেছি?”
-” তোমার বাড়ির একটু সামনেই গাড়ি রাখা স্টুপিড।”
-” তো আপনি বলবেন না যে এসে গিয়েছি?”
-” আমাকে কি তোমার ড্রাইভার মনে হয়? যে গাড়ি থামিয়ে বলবো “ম্যাম আমরা এসে গিয়েছি, ওয়েট আমি আপনার পাশের ডোর খুলে দিচ্ছি ” এমন মনে হয় তোমার? ”
-” আজব আমি এমন কোথায় বললাম? বেশি বোঝে।” তুলতুল বিরবির করে বলে। সে গাড়ি থেকে বের হয়। এখনো বৃষ্টি পড়ছে, তুলতুল শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দেয়, কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া মাটিতে স্লিপ কেটে পড়ে যেতে নিলে চোখ বুঁজে মা বলে চিৎকার দেয়। কিন্তু সে ব্যাথা পায় না তাই চোখ খুলে। চোখ খুলে সে রাফসানের মুখ দেখে। বৃষ্টিতে রাফসানের চুল ভিজে পানিগুলো তার মুখ বেয়ে পড়ছে। রাফসান রাগ করেই তুলতুলকে সোজা করে দাড় করিয়ে কোমর থেকে হাত সরিয়ে ধমক দিয়ে বলে
-” মাথায় বুদ্ধি, সুদ্ধি কিছু নেই তোমার? বৃষ্টির ভেতর পিচ্ছিল রাস্তায় এভাবে কেউ দৌড় দেয়? এখনি তো পড়ে হাত-মুখ ভাঙতে। গাধী কোথাকার। যাও বাড়ি যাও।” বলে হাত দিয়ে সামনের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দেয়। বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গিয়েছে সে, তুলতুল নিজেও ভিজে গিয়েছে। সে পেছনে ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রাফসানের দিকে তাকায় সে ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, তুলতুলের তাকানো দেখে সে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসলো। তুলতুল কাঁচের ভেতর দিয়ে রাফসানের চেহারা দেখতে পায়, রাফসান একবার তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়। তুলতুল গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, গাড়ি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে সে গেট ঠেলে বাড়ির ভেতর ঢোকে। তার হার্ট বিট করছে দ্রুত। আজকে কেন জানি রাফসানকে বিরক্তি, আর অসহ্য লাগছে না, বরং ভালোই লাগছে কেনো তা জানে না। হয়তো তাকে বাঁচিয়েছে বলেই নাহলে অন্যকিছুই বা কি আর হবে?
চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।