মেঘের উল্টোপিঠ পর্ব -০৪

#মেঘের_উল্টোপিঠ
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
[পর্ব-০৪].

ভোরের দিকে জ্বরের প্রকোপ কমতেই তন্দ্রাছন্ন আভাসটা নিমিষেই মিটে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই পর্দার আড়ালে স্পষ্টত দেখা মিলল পূর্বের অবয়বের। পূর্বের রাতের কিছু বিশেষ কথা স্বরণ করে আমি চটজলদি বিছানা ছেড়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। পূর্ব তখন পুশআপে ব্যাস্ত ছিলেন। ঝলমলে রোদের হলদেটে আলো পূর্ণরূপে পড়েছে পূর্বের পিঠে। মৃদু পরিমাণের ঘামগুলো রোদের রশ্মিতে চকচক করছে। সুঠাম দেহের আনাচে – কানাচে রোদের রশ্মি যেনো হামাগুড়ি খাচ্ছে।

পরিশেষে নেত্রপল্লব বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করি। যা বলতে এসেছি তা বলার তুমুল প্রয়াসে, বর্তমান অনুভূত হওয়া অদ্ভুত অনুভূতিগুলো কে দূরে ঠেলে দেই। আলত পায়ে এগিয়ে পূর্বের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পূর্ব পুশআপ করা বন্ধ করে দেয়। আমার দিকে রাশভারী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুভ্র রঙের টাওয়াল দিয়ে তার সুদর্শন মুখশ্রীর নোনা ঘামগুলো কে মুছে নিয়ে বললেন,

‘ এতো ছটফটে কেনো তুমি? হু?’

পূর্বের কথা বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলি,

‘ মানে কি?’

‘ কাল রাতে জ্বরে পুড়েছো। ভোর হতেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে, রেস্ট না করে এখানে কি? এখনি রুমে যাও দোল! ‘

তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলি,

‘ আপনি কাল সারারাত ঘুমোননি কেনো? আমার সেবা করার দরকার কি ছিলো? আমার জ্বর এমনিতেই কমে যেতো! ‘

পূর্বের মুখশ্রীতে ক্ষনিকের জন্য ভড়কানো ভাবটা দেখলাম। তা দেখে নিভৃতে ফিচেল হাসি দেই! পূর্ব যে কাল সারারাত জেগে আমার সেবা করেছে তা সম্পর্কে তেমন নিশ্চিত ছিলাম না। মধ্যরাতের দিকে আলত করে নেত্রপল্লব উন্মুক্ত করতেই আবছা আলোয় খেয়াল হয়েছিলো পূর্ব আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন। পরবর্তীতে কি হয়েছিলো জানা নেই। কিন্তু বর্তমানে চতুরতার সাথে বলা কথাটি যে পূর্ণরূপে সত্যি! তা প্রমানিত করছে পূর্বের মুখশ্রীর হাবভাব!

পূর্ব তার হাতের টাওয়াল সোফায় ছুঁড়ে মেরে ত্রস্ত পায়ে আমার নিকট এগিয়ে আসলেন। মূর্হতে হকচকিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে মিশে যেতেই পূর্ব তার দু’হাত আমার দুপাশে রেখে মাথা নিচু করে ঝুঁকে ভ্রু কুঞ্চিত করেন! ঠোঁট বাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললেন,

‘ চালাক হয়ে গিয়েছো! আমার সাথে চালাকি করো? যেই মেয়ে জ্বরের ঘোরে নিজের নাম অব্দি ভুলে যায় সে এতকিছু খেয়াল করেছে? হাউ ফানি!’

নিজেকে আর সংযত করা হলোনা। কৌতূহল নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলি, ‘ আপনি আমার ব্যাপারে এতকিছু কিভাবে জানেন? আমার পারসোনাল হ্যাবিট সম্পর্কে অবগত হলেন কি করে? আপনি তো আমায় চিনেন না বলা চলে। ‘

পূর্ব ঝুঁকে আমার কানের নিকট তার ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে নেন। ফিসফিস করে ফিচেল কন্ঠে বললেন,

‘ আমি আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে অতোটা অবগত নই যতোটা না ‘ তার ‘ সম্পর্কে অবগত! ‘

পূর্বের কথা বলার সময় তার ওষ্ঠাধর বারংবার আমার কান কে এসে মৃদু স্পর্শ করছিলো। ব্যাপারটা আমার জন্য শ্বাসরুদ্ধকর! অস্বস্তিময়! তার ওপর তার হিসহিসিয়ে কথা বলা। কাঁপুনি তৈরি করে যেনো তার এই কথা বলার ধরন, আচার-আচরণ! লম্বা শ্বাস টেনে রুদ্ধ কন্ঠে বলি,

‘ আমার সম্পর্কে এতকিছু জানার কারণ?ডু ইউ লাইক মি? আপনি তো আপুর এক্স! আমার সাথে আপনার সম্পর্ক দুলাভাই- শালী টাইপ ছিলো যখন আপনি এবং আপু রিলেশনে ছিলেন। এক্স গার্লফ্রেন্ড এর বোনকে নিয়ে এতোকিছু অবগত হওয়ার কারণ? আর আপনার ওয়াইফ তো আমি দু’দিনের। ‘

পূর্ব ওষ্ঠাধরের স্বাভাবিক আকার পরিবর্তন করে হাসলেন। মনে মনে নিশ্চিত তিনি বুঝতে পারছেন আমি তাকে কথার প্যাচে ফেলতে চাইছি। পরিশেষে তিনি আমার থেকে খানিক দূরে গিয়ে ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মৃদু কন্ঠে বললেন,

‘ আমি যে তুমি সম্পর্কে জেনেছি এটা তো বলিনি। আমি আমার কথার মধ্যে ‘ তার ‘ উল্লেখ করেছি।এটা নিশ্চয়ই তোমাকে সম্মোধন করা হয়নি। ‘

পূর্ব হেলতে – দুলতে ওষ্ঠাধর দ্বারা শিষ বাজাতে বাজাতে বেলকনি থেকে চলে গেলেন। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। এই লোক এতো ত্যাড়া কেনো?কোনো প্রশ্নের আজ অব্দি ঠিকঠাক উত্তর দিলোনা।অদ্ভুত লোক! বড্ড বেশী অদ্ভুত! তার ব্যাবহার, কথা সবকিছু মূল রহস্য প্রমাণ করে দিচ্ছে কিন্তু তবুও অযথাই দেদারসে মিথ্যা রটিয়ে বেড়াচ্ছে।

___________________________

মুখশ্রী পাংশুটে, কুঁচকে নিয়ে থম মেরে বসে আছি। আমার ঠিক ডান পাশেই পূর্ব বসে! মনোযোগ সহকারে ল্যাপটপে দৃষ্টি ছুড়ে কিছু টাইপিং করছেন। তার মাঝে এক প্রকার ডোন্ট কেয়ার ভাব বিদ্যমান! তার পাশে যে স্বয়ং একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ বসে সেদিকে তার খেয়াল নেই। অথবা আমি তার পাশে বসে তাও বোধহয় ভুলে পগারপার!

তার প্রতি আমার এ মূর্হতে বিশাল বিরক্তির কারণ হচ্ছে তিনি আমায় বাসায় যেতে দিচ্ছেন না। অযথা অযুহাত দেখিয়ে বলছেন যাওয়ার দরকার নেই। সকালের দিকে ব্রেকফাস্টের পর্বের সমাপ্তি টেনে রুমে এসে বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনি তার আগমন ঘটে! ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আমার হাবভাব পর্যবেক্ষণ করে বললেন,

‘ কোথায় যাচ্ছো?’

ব্যাগ হাতে নিয়ে আমি নম্র কন্ঠে বলি,

‘ বাসায় যাচ্ছি! আংকেল আন্টি আসলে বলবেন আমি তখন আসবো। ‘

‘ বাসায় যাওয়ার দরকার নেই এখন। আব্বু আম্মু এসে পড়বে। তাছাড়া এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি বাহিরে বের হবে? মাথা ঠিক আছে নাকি? ‘

তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে মৃদু কন্ঠে বলি, ‘ ঠিক আছি আমি! একদম ফিট। কিছু হবেনা বাহিরে বের হলে। বৃষ্টিও তো নেই বাহিরে। ‘

পূর্ব আমার কথার পরিবর্তে সটান ‘ না ‘ বলে দেন।অতঃপর তিনি আম্মুকে ফোন করে আমার অগোচরে এমনভাবে ব্রেইন ওয়াশ করেন যে আম্মু ফোন দিয়ে বলছে চার পাঁচদিন থেকে বাসায় আসতে। পূর্বের আম্মুরও একই বার্তা! পরিশেষে পূর্বের ওপর হটাৎই সন্দেহ চেপে বসলো। খানিক ভীতির নিভৃতে আগমন ঘটলো। শুকনো ঢোক গিলে সন্দিহান কন্ঠে বলি,

‘ আচ্ছা আপনার মতলব কি বলুন তো! আমাকে বাসায় যেতে দিচ্ছেন না কেনো? আমি কি আমায় বিক্রি করে দিবেন নাকি? নাকি নারী পাচারকারীর হাতে তুলে দিবেন? সত্যি করে বলুন তো! আপনাকে আমার বড্ড সন্দেহ হচ্ছে। ‘

পূর্ব ল্যাপটপের থেকে ধীরস্থির রূপে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকান! তার মুখশ্রীতে আমার কথার কোনো প্রভাব ফেলেনি বোঝাই যাচ্ছে। তিনি অত্যান্ত বিরক্তি নিয়ে বললেন,

‘ ডাফার গার্ল! তোমার কোনো আইডিয়া আছে তুমি এসব কি বলছো? এসব ষ্টুপিড কথাবার্তা মাথায় আসে কি করে? ‘

‘ তাহলে আমায় যেতে দিচ্ছেন না কেনো? আমি তো সুস্থই! যেতে না দেয়ার কারণ কি?’

পূর্ব নিজের স্থান হতে কিছুটা সামনে এগোলেন! আমি পিছে যেতে নিলে তিনি তার শক্ত হাত দ্বারা আমার হাত আঁকড়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,।

‘ তোমাকে আমি এখানে আঁটকে রেখেছি কেনো জানো দোল? তোমায় আঁটকে রাখার মূল কারণ রোমান্স করা। আফটার অল একটা মাত্র বউ, নতুন বিয়ে করেছি তার সাথে রোমান্স না করলে চলে নাকি?’

বলে ভ্রু নাচালেন। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়! রাশভারী লোকটার এই রূপ মেনে নেয়া আমার পক্ষে কষ্টসাধ্য! নিজেকে ধাতস্থ করে রুষ্ট কন্ঠে বলি,

‘ একদম এসব চিন্তা মাথায় আনবেন না আপনি। আমার কাছে আসলে আপনাকে খুন করে ফেলবো! এখনো আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মানিনি। ‘

পূর্ব আমার হাত এক ঝটকায় ছেড়ে দেন। উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বললেন,

‘ রিলাক্স! আমি তোমায় ততক্ষণ অব্দি টার্চ করবোনা যতক্ষণ না তুমি আমায় মন থেকে মেনে নিচ্ছো। আমার ওপর এতটুকু ট্রাস্ট রাখো। ‘

পূর্ব এক মূর্হতও আর দাঁড়ালো না। তার কন্ঠনালি কাঁপছিলো তা হুট করেই মনে হলো। শেষে বলা তার কথাগুলো আমার কাছে ভিষণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো।

_________________________

পুরো সকালে পূর্বের আর দেখা মিললো না। আমিও আর নিচে যাইনি। আজ শুক্রবার! এইদিন তিনি রোগী দেখেন না। বাসাতেই আছে নিশ্চয়ই! শুক্রবার উপলক্ষে মেডিকেল বন্ধ! ক্লাসও নিতে যাননি তা নিশ্চিত! বাসাতেই থেকে একবারও আমার সামনে এতো সময়ের ব্যাবধান হলো তবুও আসলেন না কেনো? যদিও এটা আমার জন্যই স্বস্তিকর! তিনি না থাকলে নির্দ্বিধায় নিজের কর্ম সম্পাদন করতে পারি। তিনি সামনে থাকলে কেমন সঙ্কোচ কাজ করে!

কিন্তু অদ্ভুতুরে ব্যাপার হচ্ছে হটাৎই ভিষণ পূর্বকে মিস করছি! তাও আমি! ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক আমার নিকট। যেই লোকের দূরে থাকা সর্বদা কাম্য করি, সে যখন আমার হতে দূরেই তখন তাকে আমি মিস করছি? অদ্ভুত!

ব্যাকুলতা কন্ট্রোল করতে না পেরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে আসি। পুরো বাসায় শূন্যতা বিরাজমান! এই বাসায় সার্ভেন্ট নেই নাকি? নিচ তলার সবগুলো রুমে চক্কর দেয়ার পর ফলাফল শূন্য! পূর্ব উধাও যেনো! কিচেনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় টুংটাং শব্দে থমকে দাঁড়াই। উঁকি দিতেই দেখা মিলে পূর্বকে। কিচেন এপ্রোন পরে সবজি কাটছেন।এই দৃশ্য দেখার পর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। চোখ কচলিয়ে পুনরায় দৃষ্টি দিতে একই দৃশ্য দৃশমান হলো। তড়িৎ বেগে গিয়ে পূর্বের সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি মাথা তুললেন! মুখশ্রীতে কাঠিন্য ভাব বিদ্যমান! আমায় দেখার পর তা খানিক শিথিল হলো।

পূর্ব সবজিগুলো পাশে থাকা কাচের বাটিটায় রেখে দৃষ্টি সেদিকে নিক্ষেপ করে বললেন,

‘ কিছু বলবে?’

‘ আপনি এখানে কি করছেন?’

পূর্ব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ কেনো দেখছো না কি করছি? ‘

পূর্বের প্রশ্নের প্রতিত্তুরে জবাব দেই, ‘ দেখছি কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছেনা আরকি! এত বড় ঘরের ছেলে কিনা কিচেনে রান্না করছো। গড! ভাবা যায় এসব?’

সবজি কাটা শেষ করে পূর্ব কাচা মাংসের বাটি সামনে এনে বললেন,

‘ বড় ঘরের ছেলের যে রান্না করতে পারবে না এটা কি কোনো বইয়ে লেখা আছে? বড়, ছোট বলতে কিছু নেই। এটা যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এখন সমাজ সেটাকে উল্টো দেখলে কি করার?’

প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমি চটপট কন্ঠে বললাম,

‘ রান্না কি করে শিখলেন? আপনার আম্মুর কাছ থেকে। ‘

‘ হু বলা যায়! কানাডায় একা ছিলাম। ওখানে বাহিরে খেতে হতো। বাহিরের খাবার তেমন একটা ভালো লাগতো না। তাই আম্মুকে ফোন করার রান্না কিভাবে করবো তা জেনে নিজে রান্না করে খেতাম। ‘

অতঃপর নিশ্চুপতা! খানিক বাদে আমি বলি,

‘ আপনাকে হেল্প করি?’

পূর্ব তৎক্ষনাৎ কাঠ কাঠ কন্ঠে বললেন,

‘ একদম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো নয়তো রুমে যাও। ‘

পূর্বের আদেশ শুনলাম না। তিনি যখন রান্নায় ব্যাস্ত তখন আমি নিজ হতে ছুরি দিয়ে বাকি সবজিগুলো কাটতে নিলেই হাত কেটে যায়। ‘ উহ্’ শব্দ করে উঠলে পূর্ব চটজলদি আমাতে দৃষ্টি দেন। রক্তাক্ত আঙুল দেখে তার নেত্রপল্লবের সাদা অংশ রক্তিম বর্ণ ধারণা করে! ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে চিবিয়ে বললেন,

‘ মানা করেছিলাম আমি! কেনো কথা শোনোনা?’

প্রতিত্তুরে কিছু বলা হলোনা। তিনি আমার হাত টেনে ধরে রুমে নিয়ে আসেন। ফাস্ট এইড বক্স এনে কাটা স্থান পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেন। খেয়াল হয় তার নেত্রপল্লব এখনো রক্তিম রূপে ধারণ করে আছে। আমি কাচুমাচু করে বলি,

‘ আপনি কি আমার ওপর বেশ রেগে আছেন?’

পূর্ব কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘ হ্যা রেগে আছি! ভিষণ রেগে আছি তোমার ওপর। এতোটাই রেগে আছি যে তোমায় এখন শাস্তিস্বরূপ চু-মু দিতে ইচ্ছে করছে! ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here