মেঘের ভেলায় চড়ে পর্ব -২২+২৩

#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Part_22
#Ariyana_Nur

দিপা বেগম কিচেনে কাজ করছে।কাজ করছে বললে ভূল হবে।কাজ করছে কম হাড়ি-পাতিলের উপর মেজাজ দেখাচ্ছে বেশি।এতোদিন যেখানে রাই আর কাজের লোককে দিয়ে বাসার সব কাজ করিয়ে নিজে রাণীর মত সারাদিন শুয়ে বসে থেকে হুকুম চালিয়েছে সেখানে এখন সংসারের সব কাজ নিজে একা করতে গিয়ে সে পুরোই হাপিয়ে উঠছে।

—কি পোড়া কপাল আমার।আমার সাথেই এটা হওয়ার ছিলো।আল্লাহ কি একটুও আমার কপালে সুখ লিখে নাই।আগে যখন কাজের লোক ছিলো তখন একের পর এক কাজ চাইতে দরজায় হামলে পরত। এখন এতোদিন ধরে কাজের লোকের খোজ করছি একটাও পাচ্ছি না।সব কয়টা কাজের লোকের দেমাগ বেড়ে গেছে।একেকজন বড় লোক হয়ে গেছে।আমার ভাগ‍্যই খারাপ তা না হলে কি এতো ভালো কাজের লোক কেউ হাতছাড়া করে।সব দোষ ঐ মুখপুড়ি রাই এর বাচ্চার।নিজের বাপ,মা কে তো খেয়েছেই সাথে আমার সংসারটাকে গিলে গেছে।আমি সহ‍্য করলেও আল্লাহ সহ‍্য করবে না।মিলিয়ে নিস আমার কথা।আমায় যেমন পুড়াচ্ছিস না দেখবি তুই ও একদিন এই থেকে বেশি পুড়বি।শান্তি হবে না তোর।রাস্তা রাস্তায় ঠোকর খেয়ে মরবি।এরকম বেহায়া, কুলাঙ্গার,মুখপুড়ি মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো।

ফাহাদ অনেক্ষন আগেই কিচেনের দরজায় এসে দাড়িয়ে দিপা বেগম এর কথা শুনছিলো।দিপা বেগম এর কথা শুনে তার রাগ উঠলেও আজ আর রাগ দেখালো না।যা করবে সব ঠান্ডা মাথায় করবে। দিপা বেগম এর কথার মাঝেই ফাহাদ ফোড়ন কেটে বলে উঠল,

—তার জন‍্যই কি নিজের মেয়ে থাকতেও সবার কাছে মৃত বলে বেড়াও।

হঠাৎ ফাহাদ এর কথা কানে যেতেই দিপা বেগম এর হাত থেকে খুনতি টা নিচে পরে গেলো।দরজার দিকে তাকাতেই ফাহাদ কে দেখে দিপা বেগম ভূত দেখার মত চমকে উঠল।দিপা বেগম কাপাকাপা গলায় বলল,

—ফাহাদ বাবা তুই এখানে?

—কেন আসতে বারন নাকি?

ফাহাদ এর সোজাসাপ্টা উওর শুনে দিপা বেগম শুকনো ঢোক গিলে বলল,

—সেকি কথা বারন হবে কেন?হঠাৎ এলি তো তাই।তুই কি আমায় কিছু বললি?

—কেন?তুমি কি কিছু শুনেছো?

দিপা বেগম আমতা আমতা করে বলল,

—না মানে ঐ কাজের ধ‍্যানে ছিলাম তো তাই খেয়াল করিনি।কিছু বলেছিস কিনা।
তাই জিগ্যেস করলাম আরকি।

ফাহাদ গ‍্যাস এর চুলোটা বন্ধ করে দিপা বেগম এর দু’হাত চেপে ধরে বলল,

—রাখো তো সব কাজ।নিজের হাতের দিকে দেখেছো?কাজ করতে করতে কেমন হয়ে গেছে।

—আমি কাজ না করলে কে করবে বাবা।আমার সংসার আমারই তো সব করতে হবে।

—কেন কাজের লোক কোথায়?

দিপা বেগম আফসোসের সুরে বলল,

—আর বলিস না বাবা।মনজুর মা যাওয়ার পর একটা কাজের লোকও পাইনি।বাসায় না থাকুক ছুটা কাজ করে দিয়ে যাবে তার জন‍্যও লোক পাই না।

—চিন্তা করো না ফুপি কাজের লোকের ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে।একজনের জায়গায় দু’জন রেখে দিব।দরকার হলে তারা তোমার সব করে দিবে।মুখে খাবারটা পযর্ন্ত তুলে দেওয়ার ব‍্যবস্থা করে দিব।তার পরেও তোমার এই মমতাময়ী হাত দিয়ে কোন কাজ করতে দিব না।

ফাহাদ এর কথা শুনে দিপা বেগম খুশি হয়ে বলল,

—সত‍্যি বাবা তুই আমার জন‍্য এতো চিন্তা করিস?তোর কথা শুনে খুশিতে আমার চোখ ভিজে উঠল।

কথাটা বলেই চোখের কোনে পানির ছিটে ফোটা না থাকা সর্তেও চোখের জল মোছার ভান করল।

ফাহাদ দিপা বেগম এর কাজ দেখে মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

—এটা কোন কথা বললে ফুপি?আমি তোমার চিন্তা না করলে কে করবে শুনি।তুমি ছাড়া কেই বা আছে আমার বল?কাজের চিন্তা তুমি বাদ দাও কাজের লোকের ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে।আর যদি না পাই তাহলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবো তোমার সেবা করানোর জন‍্য।তার পরেও তোমার এই হাত দিয়ে কাজ করতে দিবো না।

—আমার বাবাটা এতো ভাবে আমার কথা।একেবারে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে ফুপির সেবা করার জন‍্য।তা মেয়েটা কে শুনি দি- মানে ঐ মাহি?যাকে হাসপাতালে দেখেছিলাম?

ফাহাদ বাকা হেসে বলল,

—সেটা সময় হলেই বুঝতে পারবে।এখন তাড়াতাড়ি আমার পছন্দের খাবার রান্না কর তো।অনেক ক্ষুধা লেগেছে।শেষ বারের মত তোমার হাতের রান্না খেয়ে নেই আর কখনো তোমার হাতের খাবার খেতে পারবো কিনা কে জানে।

ফাহাদ এর কথায় দিপা বেগম কেমন যেন রহস্য রহস‍্য গন্ধ পাচ্ছে।দিপা বেগম কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলল,

—এমন কথা কেন বলছিস বাবা?

ফাহাদ হেসে বলল,

—ঐ এমনি বললাম আরকি।

দিপা বেগম মুখটা মলিন করে বলল,

—এমন কথা আর বলবি না বাবা। আমি যতদিন বেচে থাকবো ততদিন তোকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবো।

ফাহাদ তাড়া দিয়ে বলল,

—পরের টা পরে দেখা যাবে এখন যাও তাড়াতাড়ি রান্না কর।তোমার হাতের রান্নার কথা শুনেই জিভে জল চলে আসছে।তর সইছে না আর।

ফাহাদ এর থেকে নিজের রান্নার প্রশংসা শুনে দিপা বেগম খুশিতে গদগদ করতে করতে রান্না করতে চলে গেলো।ফাহাদ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে মনে মনে বলল,

—যতখুশি শেষ বারের মত রান্না করে নাও ফুপি।আর রান্না করার সুযোগ ভবিষ্যতে নাও পেতে পারো।তুমি যেই খেলা শুরু করেছো সেটা আমি না হয় শেষ করব।

___________

প্রতিদিনের মত আজও তীব্র দেড়ি করে বাসায় ফিরল।মনের মাঝে এক আকাশ অভিমান এসে ভর করার কারনে সেদিনের পর থেকে তীব্র রাইকে এড়িয়ে চলে।দরকার ছাড়া কোন কথা বলে না।তাছাড়া রাই এর সামনে দাড়ানোর সাহসও তীব্র পায় না।রাই এর মলিন মুখটা দেখলে নিজেকে কেমন নিজের কাছেই ছোট মনে হয়।যাকে আগলে রাখবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে আজ সেই তার চোখের সামনে তাকে বাচাতে গিয়ে এতো বড় একটা কান্ড করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে ভাবতেই তার বুক চিড়ে দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়ে আসে।তীব্র সব সময় এই কাজ সেই কাজের অজুহাত দিয়ে রাই এর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়।তীব্র নিজের রুমের সামনে এসে চাপিয়ে রাখা দরজা টা আস্তে করে খুলে রুমে প্রবেশ করল।রুম পুরো ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে রয়েছে।তীব্র নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনের ফ্ল‍্যাস অন করে আস্তে আস্তে পা ফেলে সুইচ বোর্ডের সামনে গেলো।সুইচ চেপে হালকা নীল স‍্যাডের ড্রিম লাইটা অন করল।বিছানার দিকে তাকাতেই তার সারাদিনের ছটফট করতে থাকা প্রানপাখিটা একেবারে শান্ত হয়ে গেলো।রাই বিছানায় জড়সড় হয়ে বাচ্চাদের মত বেঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে।তীব্র রাই এর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই রাই এর দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।রাই এর ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের তৃষ্ণার্ত চোখের জ্বালা মিটাতে লাগল।রাই এর মুখের উপর কিছু অগোছালো চুল পরে আছে।যা ফ‍্যান এর বাতাসের তালেতালে মৃদু নড়াচড়া করে রাই এর ঘুমের ব‍্যাঘাত ঘটাচ্ছে।যার কারনে রাই ঘুমের মাঝেই একটু পর পর চোখ মুখ কুচকাচ্ছে।তীব্র রাই এর কাহিনী দেখে মৃদু হেসে আলতো হাতে রাই এর মুখের উপর পরে থাকা চুল সরিয়ে দিয়ে রাই এর কপালে আদর একেঁ দিল।মাথা উচু করতেই রাইকে তার দিকে ড‍্যাবড‍্যাব করে তাকিয়ে তাকতে দেখে তীব্র হকচকিয়ে গেলো।তড়িঘড়ি রাই এর সামনে থেকে সরতে নিলেই রাই খপ করে তীব্রর কলার চেপে ধরল।রাই এর কাজে তীব্র আরেক দফা অবাক হল।তীব্র কিছু না বলে রাই এর হাত থেকে নিজের কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই রাই তীব্রর কলার টান দিয়ে তীব্রকে অনেকটা নিজের দিকে নিয়ে এল।

—সারাদিন আমার থেকে দূরে থেকে রাতের বেলা চোরের মত রুমে এসে আদর দেখানো হচ্ছে?

রাই এর রাগি গলার কথা শুনে তীব্র ছটফট বন্ধ হয়ে গেলো।রাই এর দু’পাশে দু’হাত রেখে হাতের উপর ভর দিয়ে শান্ত চোখে রাই এর দিকে তাকিয়ে রইল।ড্রিম লাইটের আলোতেও রাই অভিমানে ভীর করা চেহারায় দেখতেও তার অসুবিধা হল না।রাই তীব্রকে চুপ করে থাকতে দেখে পূনরায় বলল,

—কথা বলছেন না কেন?কোথায় ছিলেন সারাদিন?নিজে সারাদিন বাইরে থেকে শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আমার খোজ খবর নেওয়ার জন‍্য বার বার বাসায় ফোন করে বাসার লোকদের মাথা খাওয়ার মানেটা কি?

রাই এর এই রুপ যেন তীব্রর হজম হচ্ছে না।তীব্র রাই এর কথার উওর না দিয়ে ডান হাত দিয়ে রাই এর কপালে,গালে ছুইয়ে দেখে নিলো জ্বর আছে কিনা।তীব্র এতোক্ষন ভেবেছিলো জ্বর এর ঘরে হয়তো রাই এমন ব‍্যবহার করছে।কিন্তু না রাই এর শরীরে জ্বরের ছিটে ফোটাও নেই।তাহলে হঠাৎ রাই এমন ব‍্যবহার করছে কেন?তীব্র কপালে ভাজ ফেলে নরম গলায় বলল,

—কি হয়েছে তোমার?এমন বিহেব করছো কেন?

তীব্রর এই শান্ত গলার কথাটা যেন রাই এর রাগ আরো বেড়ে গেলো।তীব্র নিজে এমন অদ্ভুত বিহেব করে উল্টো রাইকে জিগ্যেস করছে সে কেন এমন বিহেব করছে।না চাইতেও রাই এর চোখে নোনা জলে টুইটুম্বুর হয়ে উঠল।রাই এর গলা দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না।কেমন যেন সব গলার মধ‍্যেই আটকা পরে যাচ্ছে।রাগে দুঃখে রাই তীব্রর কলার ছেড়ে দিয়ে তীব্রকে হালকা ধাক্কা দিয়ে নিজের সামনে থেকে সরিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো।কেন যেন সে তীব্রর এই অবেহেলা গুলো নিতে পারছে না।তীব্রর অবেহেলাগুলো তার ভিতরটা ভেঙে চুড়ে আসছে।অবহেলাই যখন করবে তাহলে কেন কেয়ার, ভালোবাসা দেখিয়ে মায়া বাড়িয়েছিলো?একবার মায়া বাড়িয়ে তারপর অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেওয়া যে কত কষ্টের সেটা কিভাবে প্রকাশ করবে সেই ভাষা রাই এর জানা নেই।রাই এর কাজে তীব্র বোকা বনে গেলো।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাই এর দিকে।রাই এর ছলছল চোখ তার চোখ থেকে এড়ায় নি।তীব্র মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক করতে লাগল,নিজে অনুতপ্ত করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আমার চাঁদকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম নাতো?
#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Part_23
#Ariyana_Nur

ঘুমের মধ‍্যেই রাই এর মনে হচ্ছে সে শূন‍্যে ভাসছে।তারপরেও চোখের মধ‍্যে রাজ‍্যের সব ঘুম ধরা দেবার কারনে চোখ মেলে আর নিজের অবস্থান দেখতে ইচ্ছে হল না।কিছুক্ষন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও যখন নিজেকে শূন্যে ভাসমান অনুভব হল তখন রাই পিটপিট করে চোখ খুলে নিজের অবস্থান বুঝার চেষ্টা করল।রাই কারো কোলে অবস্থান করছে।লোকটি রাইকে কোলে তুলেই উপরের দিকে উঠছে।নিজেকে অবস্থান বুঝতে পেরেই রাই এর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।চোখ মুখে চলে এল ভয়ের ছাপ।রাই গগন ফাটানো চিৎকার দেওয়ার আগেই একটা ভাড়ি কন্ঠে ভেসে এল,

—প্রথমেই নিজের বাসায় রাত বে-রাতে ঢোকার কারনে চোর বানিয়েছো।চিৎকার করে এখন কি মার খাওয়াতে চাও?

গলার আওয়াজ শুনে তীব্রকে চিনতে রাই এর একটুও অসুবিধা হল না।বরং তীব্রর কথা শুনে রাই এর মেজার আরো চটে গেলো।রাই হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো তীব্রর কোল থেকে নামার জন‍্য কিন্তু তীব্রর সাথে পেরে উঠল না।তীব্র রাইকে নিয়ে ছাদে উঠে ছাদের একপাশে চলে গেলো।সিমেন্ট দিয়ে বানানো বেঞ্চে রাইকে বসিয়ে দিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,

—বাপরে তুমি এতো ভাড়ি!আমার মনে হচ্ছে তোমায় কোলে করে এতোটুকু এসেই অর্ধেক ওজন কমে গেছে।দেখতে শুটকি দেখলে কি হবে ওজনে মিনি হাতি।

তীব্রর কথা শুনে রাই চোখ রাঙিয়ে তীব্রর দিকে তাকালো।কড়া কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও মনের মাঝে আকাশ সমান অভিমান বাসা বাধার কারনে মুখ ফুটে আর কিছু বলল না।বসা থেকে উঠে হাটা ধরতেই তীব্র রাই এর হাত ধরে বলল,

—আরে আরে কোথায় যাচ্ছো?এতো কষ্ট করে তোমার মতো ময়দার বস্তা দেহটাকে এতোগুলো সিড়ি বেড়ে উপরে নিয়ে এসেছি কি এভাবে চলে যাওয়ার জন‍্য?

তীব্রর মজাকরা কথা শুনে রাই এর চোখ ছলছল করে উঠল।সে না হয় এই কয় দিন শুয়ে বসে থেকে একটু মোটা হয়ে গেছে তাই বলে তীব্র তাকে এভাবে বলবে?রাই ঝাড়া দিয়ে তীব্রর হাত ছাড়িয়ে ধুপধাপ পা ফেলে নিচে যাওয়ার জন‍্য অগ্রসর হতে লাগলো।রাই কিছু বোঝার আগে তীব্র পূনরায় রাইকে কোলে তুলে নিয়ে এসে বেঞ্চে বসিয়ে দিল।এবার আর রাইকে বসা থেকে উঠার সুযোগ না দিয়েই তীব্র রাই এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরল।তীব্রর কাজে রাই স্টেচু হয়ে গেলো।একটু পর নিজেকে স্বাভাবিক করে মুখে কিছু না বলে তীব্রকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করলো কিন্তু তীব্রর সুঠাম দেহটাকে চুল পরিমানও নাড়াতে পারলো না।রাই তীব্রর সাথে না পেরে নিজের থেকে থেমে গিয়ে চুপকরে বসে রইল।তীব্র এতোক্ষন চোখ বন্ধ করে ছিলো।রাই কে শান্ত হতে দেখে তীব্র চোখ মেলে তাকালো।রাই এর চোখের কোনে জমে থাকা জল নিজ হাতে মুছে দিয়ে কোমল গলায় বলল,

—প্রথমেই সরি বলছি ঐ মায়াবী চোখের কোনে জল আসার কারন হওয়ার জন‍্য।
আমার অভিমানি চাঁদ কি এই অধম বান্দার সরি একসেপ্ট করে তাকে ক্ষমা করবে?

রাই তীব্রকে দু’হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরানোর চেষ্টা করে তেজি কন্ঠে বলে উঠল,

—কিসের সরি?লাগবেনা আমার আপনার সরি।এতোদিন কষ্ট দিয়ে দূরে সরিয়ে রেখে এখন আসছে সরি বলতে।সরুন আপনি আমি রুমে যাবো।

তীব্র রাই এর দু’হাত নিজের দু’হাতের মাঝে নিয়ে মোলায়েম গলায় বলল,

—আমি দূরে দূরে ছিলাম বিধায় কষ্ট হয়েছে বুঝি?

তীব্রর কথা শুনে রাই এর চোখ দিয়ে বুরবুরিয়ে জল গড়িয়ে পরল।কি পাষাণ লোক নিজে দূরে সরিয়ে রেখে কষ্ট দিয়ে এখন জিগ্যেস করছে কষ্ট হয় কিনা?
রাই কিছু না বলে মুখ ঘুড়িয়ে বসে রইল।তীব্র রাই এর মুখটা নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বলল,

—আমি দূরে দূরে থাকলে তুমি কেন কষ্ট পাও?কে হই আমি তোমার?

রাই কিছুক্ষন অস্রুভেজা নয়নে তীব্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

—তাই তো কি হন আপনি আমার?আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক কি আছে?শুধু মাত্র কাগজ কলমে নামের স্বামী,স্ত্রী সম্পর্ক ছাড়া।সরি আমি ভুলে গিয়েছিলাম নিজের সীমানার কথা।তাই তো ভূল করে উল্টা রিয়েক্ট করে ফেলেছি।আসলে আপনার দয়া-মায়া,করুনা পেয়ে এটা ভূলে গিয়েছিলাম যে আমি আপনার জীবনে ঊড়ে এসে জুড়ে বসে আপনার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি।

কথাগুলো বলে রাই একটু থামলো।দু’হাতে নিজের চোখের জল মুছে তারপর আবার বলল,

—সমস‍্যা নেই যেমন ঊড়ে এসে আপনার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি তেমনি ঊড়ে চলে গিয়ে আপনাকে মুক্ত করে দিব।আপনার জীবন থেকে একেবারের জন‍্য চলে যাবো অন‍্য কো….।

তীব্র মজা করে কথাগুলো বলাতে রাই যে কথাগুলো উল্টো দিকে নিবে তা তীব্রর জানা ছিলো না।তীব্র রাই এর কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে রাই কে ধমক দিয়ে থামিতে দিয়ে রাই এর কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসল।দু’হাতে রাই এর বাহু চেপে ধরে রাগি গলায় বলল,

—কোথায় যাবে তুমি?হ‍্যা কোথায় যাবে?দু’লাইন বেশি না বুঝলে হয় না।ভূলেও যদি আমায় ছেড়ে যাবার কথা আরেক বার বলো তাহলে দেখো আমি কি করি?

রাই অভিমানী গলায় বলে উঠল,

—কেন থাকবো আপনার কাছে?কে হই আমি আপনার?কিছু হই না আমি আপনার।চলে যাবো আমি।থাকবো না আপনার কাছে।আপনি অনেক খারাপ।শুধু শুধু আমার সাথে রাগ করেন।আমায় বকা দেন।ইচ্ছে হলে কাছে এসে মায়া দেখান আর ইচ্ছে হলে দূরে ঠেলে দেন।

(কথাগুলো বলতে বলতে রাই ডুকরে কেদে উঠল)

তীব্র তার অভিমানী চাঁদ এর দিকে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে রইল।চাঁদের আলোতে তার অভিমানী চাঁদ এর কন্দনরত চেহারা দেখে তার হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হতে লাগলো।বুকের মধ‍্যে চিনচিনে ব‍্যাথা অনুভব করতে লাগলো।যে ব‍্যাথা শুধু তার অভিমানী চাঁদই সারাতে পারবে। তীব্র আর এক মুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে রাইকে জড়িয়ে ধরল।এমন ভাবে নিজের বক্ষ পিঞ্জরে আটকালো যাতে সে কখনো পালিয়ে না যেতে পারে।রাই প্রথমে তীব্রর কাছ থেকে ছোটার জন‍্য ছটফট করলেও পর মুহূর্তে তীব্রর বক্ষ পিঞ্জরে নিজের মাথা গোজার ঠাই পেয়ে সব অভিমান চোখ দিয়ে জল হয়ে গলে পরতে লাগলো।তীব্র রাই এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রাইকে শান্ত করতে লাগলো।রাই কিছুটা শান্ত হতেই তীব্র মোলায়েম গলায় বলল,

—এমন কথা আর বল না চাঁদ।তোমাকে হারানোর কথা শুনলেই আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগে।তুমি জানোনা চাঁদ তুমি আমার জন‍্য কি?তুমি আমার কাছে আল্লাহ দেওয়া সেরা উপহার।আমার অসম্পূর্ণ জীবনকে সম্পূর্ন করার মাধ‍্যম।আমার সুস্থ ভাবে বেচে থাকার একমাত্র সম্বল।আমার আধার জীবনের এক ফালি আলো নিয়ে আশা চাঁদ।তোমাকে হাড়িয়ে হয়তো বেচে থাকবো কিন্তু সেটা মৃত ব‍্যাক্তির ন‍্যায়।আমার সুস্থ ভাবে বেচে থাকার জন‍্য তোমাকে চাই।আমার আধার জীবনে আলোর রশ্নির জন‍্য তোমাকে চাই।বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার জন‍্য তোমাকে চাই।পারবে না চাঁদ জীবনের শেষ নিশ্বাস পযর্ন্ত এই অসম্পূর্ণ আমিটার সাথে থেকে আমার সম্পূর্ন করতে?

তীব্রর বক্ষ পিঞ্জরে মাথা রেখে রাই এতোক্ষন তীব্রর কথা শুনছিলো।তীব্র কথা শেষ হতেই রাই তীব্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেদে উঠল।রাই এর না বলা কথার মাঝেই তীব্র তার উত্তর পেয়ে গেলো।মুহুর্তেই ঠোটের কোনে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি।

_________

চেয়ারের সাথে হাত পা বাধা অবস্থায় বসে আছে ছন্মবেশি মাহি। ইলেকট্রিক শর্কড খেতে খেতে তার অবস্থা কাহিল।তার মুখামুখি পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে চেয়ারে বসে রয়েছে ফাহাদ।মুখে রয়েছে তার বাকা হাসি।ফাহাদ মাহির ক্লান্ত মাথা মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার শুরে বলল,

—জান!তোমায় এমন দেখা যাচ্ছে কেন?খুব তো বলেছিলে আমার সব পাগলামো তোমার ভালোবাসা দিয়ে ঠিক করে দিবে।দু’দিনেই কি আমার ভালোবাসার টর্চারে হাপিয়ে উঠেছো?

ফাহাদ এর কথা শুনে মাহি ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে ফাহাদ এর দিকে তাকালো।দূর্বল গলায় বলল,

—জীবনে যদি কোন পাপ করে থাকি তার মধ‍্যে সব থেকে বড় পাপ করেছি তোর মত একটা সাইকোকে ভালোবেসে। নিজের প্রতি নিজেই এখন আমার ঘৃণা হচ্ছে।কিভাবে পারলাম আমি তোর মত একটা নর পশুকে ভালোবাসতে।

মাহির কথা শুনে ফাহাদ আট্টহাসিতে ফেটে পরল।হাসতে হাসতে বলল,

—চোরের মুখে ধর্মের কাহিনী।আমি না হয় নর পশু তুই কি তাহলে?তুই তো আমার চাইতেইও নিকৃষ্ট।আমি যতই খারাপ হই না কেন যতই পাপ করি না কেন তোর মত মানুষ মারার মত পাপ আমি কখনো করিনি।

ফাহাদ এর কথা শুনে মাহি চমকে উঠল। অবিশ্বাস্য নয়নে ফাহাদ এর দিকে তাকিয়ে রইল।ফাহাদ মাহির ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

—আমার জান পাখির শ্রদ্ধের শুভ্রাকাঙ্খী বলে কথা। আমায় তো খবর রাখতেই হয় বল?

#চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here