যদি_জানতে পর্ব ১

আমার বিয়ের তিনদিন আগে আমার হবু স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যায়।আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমারও ইচ্ছে ছিলো,আমার স্বপ্ন ছিলো বিয়েতে এটা পড়বো,বিয়েতে ওটা করবো।আর আমাদের চার বছর প্রেম করার পর বিয়ে হচ্ছিল তাই স্বপ্ন আর ইচ্ছেটা বেশীই ছিলো।কিন্তু সবার সব স্বপ্ন আর ইচ্ছে তো পূরন হয়না,আমারও হলো না।ও ছেড়ে চলের যাওয়ার কারণটা আমার এখনো অজানা।হাজারবার জানতে চায়লেও সে কোনো উত্তর দেয়নি।
তারপর থেকে সমাজের চোখ আমাকে কেমন করে দেখতে লাগলো,কানাকানি শুরু করে দেয়।হাজারটা কথা বের করে আমার বিয়ে ভেঙে যাওয়া নিয়ে।আমার পরিবারের কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও সমাজের অনেক মাথা ব্যাথা।
আমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর,তেমন কোনো ভালো পরিবারের ছেলে পক্ষ আমাকে দেখতে আসেনি।আজকে আবার একটা ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে।শুনেছি ছেলেটা দেখতেও যেমন সুন্দর তেমন পরিবারটাও খান্দানী।

কালো কালার শাড়ি পড়ে,হালকা সাজগোজ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।তখনই আম্মু রুমে আসলো….
-“তোর হয়নি এখনো??ঐদিকে ছেলে পক্ষ কখন থেকে বসে আছে”
-“আমার হয়ে গেছে আম্মু”
আমি আম্মু’র দিকে তাকাতেই আম্মু মুগ্ধ নয়নে আমার দিকে তাকায়।তারপর চোখ থেকে একটু কাজল নিয়ে আমার কানের পিছনে টিকা দিয়ে বলে….
-“কারো নজর না লেগে যায়”
-“আর কার নজর লাগবে?যাদের নজর লাগার তাদের তো আরো তিনবছর আগেই লেগেই গেছে”
একটু তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে কথারা বলায় আম্মু আর কিছু বললো না।আমার মাথায় ঘোমটা টা টেনে নিয়ে ওদের সামনে নিয়ে গেল।
আমি সালাম দিলাম,ওনারা আমাকে বসার অনুমতি দেওয়ায় আমি বসলাম।আমার পাশে এসে বসলো মহিলাটা তারপর খুব যত্নসহকারে আমাকে দেখলো।ওনার কথা বার্তায় বুঝা গেল ওনি যথেষ্ট ভদ্র আর ভালো মহিলা।তারপর আমাকে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো।
আমি নিজের রুমে এসে,জানালার পাশে দাড়িয়ে আছি।যতদূর চোখ যাচ্ছে ততদূর কল্পনার জাল বুনছি।আচ্ছা ভাগ্য কেন এমন হয়?কেন এক মুহুর্তে সব উল্ট পাল্ট করে দেয়?কিন্তু তার কোনো উত্তর মিললো না।বুক ছিড়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে আসলো।
একটু পর আম্মু রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো।আমি যতটুকু ভাবলাম ততটুক হলো আমার বিয়ে হবে না বলে হয়তো কান্না করছে।আমি আম্মুকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললাম….
-“আম্মু,তুমি কান্না করছো কেন?এটা তো নতুন কিছু না।সমাজের চোখে আমি একজন দাগী মেয়ে,যাকে বিয়ের তিনদিন আগে তার হবু বর ছেড়ে চলে গেছে।আর যাই হোক,তার সবকিছু জেনে কোনো ভালো পরিবারই চায়বে না তাদের ঘরের বউ বানিয়ে নিতে।”
-“নাহ,এমন কিছু না।এটা আমার আনন্দের কান্না,তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।ওরা তোর সব অতীত জেনেই তোকে তাদের বাড়ির বউ বানিয়ে নিবে।”
আম্মুর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।আমার এতবড় একটা দাগ থাকা স্বত্বেও ওনারা আমাকে বউ বানাবেন।আম্মু আমাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে বললো….
-“আজকে সন্ধ্যায় তোর বিয়ে,আমি জানি তুই একটু অবাক হবি কিন্তু ওনারা দেরী করতে চাচ্ছেন না।তাই আজকেই বিয়েটা করে ফেলবে।আর ওনারা কোনো ফাংশন করতে চাচ্ছেন না,ওনারা বলছেন,বিয়েতে যেন তোর বাবা তেমন কোনো খরচ না করে।খেজুর খেয়ে সুন্নতী বিয়ে পড়াতে চাচ্ছেন।তাই আজকে সন্ধ্যাতেই শুভ কাজটা সেরে ফেলতে চাচ্ছেন।তোর কি মত?”
-“তুমি আর আব্বু মিলে যেটা ঠিক করবে,ঐটাই আমার মত।”
আমার কথা শুনে আম্মু চোখের পানি মুছে,আমার কপালে চুমু খেয়ে চলে গেলেন।

সন্ধ্যায়….
আমার বিয়ের খবর পেয়ে,আশে পাশের বাসার কতগুলো মহিলা এসেছে।তাদের মুখে এখন কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হচ্ছে অথচ কালকেও ওনারা আমার নামে কু কথা বলছিল।যায় হোক,আমার ফুপাতো বোন আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে।লাল বেনারসি,চোখ কাজল,মুখে ম্যাক আপ তার সাথে ঐ মহিলার বিয়ে যাওয়া এক গাদা জুয়েলারি।মাথায় বেলী ফুলের গাজরা টা দিতে দিতে রিদি(ফুপাতো বোন)বললো….
-“আহিন আপু,তোমাকে কি বলবো?জিজু এত সুন্দর আর এত হ্যান্ডসাম।আমি তো প্রথম দেখাতেই ক্রাশ,যেমন ফর্সা,তেমন লম্বা তেমনই বডি”
-“তুই কখন দেখলি?”
-“একটু আগেই তো এসেছিল,তোর টিকলি টা দিতে।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না।রিদি নিজের মতো করে বকবক করতে লাগলো।তার বকবকের মূল বিষয় হচ্ছে মিস্টার শাহরিয়ার।যার সাথে আমার আজকে বিয়ে হবে।কি অদ্ভুত যার সাথে আমার বিয়প হবে তার নাম ছাড়া আর অন্যকিছুই জানি না।একটা বার চোখের দেখাটাও দেখা হলো না।যদিও আজকে আমাকে দেখতে আসার সময় এসেছিল কিন্তু আমি কারো মুখের দিকে তাকায়নি।

কিছুক্ষণ পর ওনারা চলে আসলেন।আমাকে তাদের মাঝে নিয়ে যাওয়া হলো।আমরা দুজনের সামনে বসে আছি শুধু সামনে একটা সাদা পর্দা ধরা।কাজী সাহেব যখন আমাকে বললো”বলো মা,কবুল”তখন আমার বুক ধরপর করতে লাগলো।মনে হতে লাগলো আমি আমার বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি,আর কখনো তাদের কে কাছে পাবো না।কখনো আম্মুকে জড়িয়ে ধরে নিজের মনের কথাগুলো,কষ্ট গুলো শেয়ার করতে পারবো না।চোখের কোণে আমার পানি জমে গেল,তখনই আম্মু আমার কাঁধে হাত রাখলো।আমি ওনার দিকে তাকালে ওনি আমাকে ইশারা করে কবুল বলার জন্য, আমিও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তিনবার বলে উঠলাম….
-‘কবুল,কবুল,কবুল’
আমি এই ইহকালের জন্য শাহরিয়ারের হয়ে গেলাম।আমার কবুল শুনে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।সাথে সাথেই আমাদের মাঝখানের পর্দাটা সড়িয়ে দেওয়া হলো।আমি ওনার দিকে তাকিয়ে চোখ সরাতে পারছি না।কালো কালার শেরওয়ানি,কালো পাগাড়ি’তে ওনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।রিদি যেমনটা বলেছিল তার চেয়েও অনেকগুন বেশী সুন্দর।আমি নিজের চোখকে ততক্ষণ সরাতে পারছিলাম না যতক্ষণ রিদি আমাকে কানে কানে না বললো…
-“আহিন আপু,কি করছো?চারপাশে মুরুব্বীরা আছে,এভাবে তাকিয়ে থেকো না।মানছি তোমার তাকিয়ে থাকা হালাল,তাই বলে সবার সামনে এভাবে লাজ লজ্জা ভুলে গিয়ে নয়!!”

রিদি কথাটা বলে একটু শয়তানি হাসি দিল।আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাকে বিদায় দিবে।আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে খুব জোরে জোরে কান্না করতে লাগলাম।আব্বু নিজেও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো।আম্মু এসে একটু ঝাড়ির শুরু বললো…
-“কি শুরু করেছো বাপ মেয়ে দুজন?আজকের দিনে কেউ কান্না করে নাকি!!!তোমার মেয়ে তো আর সারাজীবনের জন্য….
আম্মু আর কিছু বলতে পারলো না,তার আগেই ওনি নিজেও কান্নায় ভেঙে পরলো।আমাকে গাড়ির ভিতরে বসিয়ে দিয়ে।আব্বু শাহরিয়ার’কে বললো…
-“বাবা,তুমি তে সবই জানো!আমি আমার মেয়েকে কখনোই কষ্ট পেতে দেয়নি।ঐদিনের পর থেকে আরো বেশী আগলে রেখেছি,আমার বিশ্বাস তুমিও আমার মেয়েকে আগলে রাখবে।কখনো কোনো কষ্ট আর বিপদ আসতে দিবে না,সবসময় ওর পাশে ছায়ার মতো থাকবে।আমি এই বিশ্বাস রেখেই আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম।”
আব্বু এই কথা বলে আবার কান্না করতে লাগলো,শাহরিয়ার কি বললো তা আমি বুঝতে পারেনি।ওনি গাড়িতে আমার পাশে এসে বসার সাথে সাথেই গাড়ি চলতে শুরু করলো।

চলবে!!!!

#যদি_জানতে
Part: 01
Written by: Shawon

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here