#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
২৬.
মুনিরা ওপাশ থেকে কল কেটে দিলেও রাইয়্যান পুরো তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কয়েক মুহূর্ত যেন নড়তে চড়তে ভুলে গেল ও। কি মেয়েরে বাবা, এতো পুরা সিদ্রার অপজিট। হুম, চ্যাটের কথার ধরণের সাথে এই মেয়ের কথার হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে, যার এক কণাও সিদ্রার সাথে পাওয়া যায়নি।
সিদ্রার জ্বর ভাল হওয়া আর খালাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে রাইয়্যান। তারপরেই আর দেরী করেনি, ফ্লাইট ধরে সোজা ঢাকায় চলে এসেছে। এবার সব রহস্যের জবাব নিয়ে তবেই ফিরবে ও। আর সবকিছুর চাবি রয়েছে ওই মুনিরার কাছে।
সেক্রেটারিকে দিয়ে মুনিরার ব্যাপারে সকল খবর নিয়েছে ও, কিভাবে চলাফেরা করে, কাদের সাথে মিশে সবকিছু, সাথে যোগাড় করেছে ওর ফোন নাম্বার। তাতেই ডায়াল করছে ও সকাল থেকে আর এইমাত্র কথা শেষ করল।
“মে আই কাম ইন স্যার” সেক্রেটারির গলার আওয়াজ ভাবনার জগত থেকে ফিরিয়ে আনল রাইয়্যানকে।
“ইয়েস, কাম ইন” মুনিরার জুতার বাড়ির কথা শুনে শকড হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রাইয়্যান, এখন বসল আবার।
সেক্রেটারি কাছে এসে বলল, “স্যার, একটা ইনফরমেশন দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার কাছে তেমন জরুরী মনে হয়নি, কিন্তু আপনার কাছে হতেও পারে”
“কি?”
“ওই মেয়ের একটা জমজ বোন আছে, প্রায় আড়াই মাস ধরে নিখোঁজ, নাম সিদ্রাতুল মুনতাহা”
“হুম জানি আমি, এক সেকেন্ড! কি বললা তুমি!?” উত্তেজনায় আবার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল রাইয়্যান, “জমজ বোন!? তুমি শিওর?”
“জ্বী স্যার, ওর ফ্যামিলি সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছি যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন তাই। ওর বাবা……”
“আচ্ছা, ফাযিল কাকে বলে?”
“স্যরি স্যার!?” হতভম্ব দেখাল সেক্রেটারিকে।
“আরে, ওই যে মাদ্রাসার পড়ার লেভেল আছে না, ফাযিল টাযিল কি কি যেন। সেখানে ফাযিল কোনটা?”
“ও আচ্ছা, ওইটা অনার্স স্যার। দাখিল এসএসসি, আলিম এইচএসসি, ফাযিল অনার্স আর কামিল মাস্টার্স” গড়গড় করে বলে গেল সেক্রেটারি।
“শিট শিট শিট! অন্তত এটাও যদি জানা থাকতো আমার!!” দুম করে টেবিলে একটা কিল বসাল রাইয়্যান। “মুনিরা অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে তাইনা?”
“জ্বী স্যার, ঢাকা ইউনিভারসিটিতে, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট”
“শিট! আগে কেন আমি ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে খোঁজ নিইনি, তাহলে তো অনেক আগেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যেত”
“এনি প্রবলেম স্যার?”
“নো থ্যাংকস, তুমি এখন যেতে পারো”
“ওকে স্যার”
লেট মি বি ক্লিয়ারড ওয়ান বাই ওয়ান। বোরকা নেকাব পরলেও মুনিরা তুলনামূলক আধুনিক, ছেলে ফ্রেন্ড আছে, নিয়মিত ফেসবুক ব্যাবহার করে, এক্সট্রোভার্ট। তাহলে তো ফারহানের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে এই মেয়েই যায়, সিদ্রা কোনভাবেই না। আর বোনকে বোনের থেকে বেশি আর কেউই চিনবেনা। মুনিরা যখন বলেছে সিদ্রা ফেসবুক ব্যবহারই করেনা, সেখানে ছয়মাস ধরে ফেসবুকে প্রেম করে গেল আর ওর চোখেই পড়লোনা, এটা ইম্পসিবল! আর জেনে থাকলে বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা এমন অবস্থায় সেটা লুকানোর প্রশ্নই উঠেনা। তার মানে চ্যাটে সিদ্রার নাম দিয়ে নিজের ব্যাপারে যাকিছু বলেছে, সেগুলো সব আসলে মুনিরার ক্যারেক্টার, আর বোনের নামে যেটুকু বলেছে, সেগুলো আসলে সিদ্রার সম্পর্কে ছিল, আর আমি গাধা সেটা ধরতেও পারিনি! তার প্রমাণ তো পেয়েছিও আমি। “আমার ফেভারিট বিরিয়ানি আর মুনিরার ফ্রাইড রাইস” এমনটাই লেখা ছিল চ্যাটে। কিন্তু ফ্রাইড রাইস দেখে সিদ্রার চোখ আনন্দে নেচে ওঠা আর জ্বরের মুখেও অতটা খেয়ে নেয়াই প্রমাণ করে ফ্রাইড রাইস ওর কতটা পছন্দের!
টেবিলে সজোরে একটা ঘুষি মারল রাইয়্যান। এত কেয়ারলেস আমি কিভাবে হলাম! মেয়েটার ফ্যামিলি সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে শুধু চ্যাটিং এর ইনফোর উপর ভিত্তি করে আমি ওকে কিডন্যাপ করে ফেললাম! হাউ কুড আই? অবশ্য তখন জানলেও বা কি হতো, তখন তো আর এসব মাথায় আসতোনা। কিন্তু পরে সিদ্রাকে দেখার এবং চেনার পর তো কনফিউশন ক্লিয়ার হয়ে যেতো, অন্তত এত দেরী তো হতোনা। যাক, যা হবার হয়ে গেছে, দেরীতে হলেও প্রকৃত সত্যটা জানা গেছে, আসল দোষী যে সিদ্রা নয় মুনিরা, এতে আর সন্দেহ নেই। এবার তোমাকে সিদ্রাকে মুক্তি দিতে হবে রাইয়্যান!
মুক্তি দিতে হবে!? বুকের বাঁ পাশটা যেন মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল ওর। মুক্তি দেয়া মানে তো সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলা!! ওকে হারিয়ে ফেললে আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো?
ফারহানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়াই তো ছিল এখন আমার জীবনের একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ। তাহলে কি এখন সিদ্রাকে ছেড়ে দিয়ে মুনিরাকে তুলে নিয়ে যাবো? নাহ! যে মেয়ে তার নিজের মায়ের পেটের বোনেকে এভাবে ফাঁসাতে পারে, তাকে দেখতেও আমার রুচি হচ্ছেনা।
আর তাছাড়া এতে সিদ্রা অনেক কষ্ট পাবে, ও সবকিছু জেনেও চুপ করে ছিল নিশ্চয় ওর বোনকে সেফ রাখার জন্য। আমি ওকে এমনিতেই অনেক কষ্ট দিয়েছি, এটুক নাহয় আর না দিলাম। রইল বাকি আমার প্রতিশোধ, এই আড়াই মাসেই ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। সিদ্রাকে যত কষ্ট দিয়েছি, সব এখন আমার কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। ফারহান, ভাইরে, ক্ষমা করে দে ভাই, আমি পারলামনা তোর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু, সিদ্রাকে ছেড়ে দিলে আমার কি থাকবে, আমার তো কেউ থাকবেনা।
আচ্ছা, আমি যে সত্যটা জেনে ফেলেছি, সেটা তো আর সিদ্রা জানেনা। ওকে যদি না বলি তাহলে? আমি যদি ওকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিই? তাহলেই তো ও আর আমাকে ছেড়ে কোনদিন যেতে পারবেনা।
“কিন্তু খাঁচায় বন্দী পাখি নিয়েই বা তুমি কি করবে রাইয়্যান? সারাজীবনের জন্য ওর মুখের হাসি কেড়ে নিতে চাও তুমি?” ওর ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো।
“কেড়ে নিব কেন? আমার কি টাকার অভাব আছে নাকি? পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওর পায়ের নিচে এনে দিব আমি, হাসি এমনিই ফুটবে” জবাব দিল রাইয়্যান।
“স্বাধীনতার থেকে বড় সুখ আর কিছু হয়না রাইয়্যান, সেটা বাদ দিয়ে যাই এনে দাও ওর মুখের হাসি তুমি ফেরাতে পারবেনা” সেই কন্ঠটা আবার বলে উঠলো।
“কিন্তু ওকে ছাড়া আমি যে বেঁচে থাকতে পারবো না” চেয়ার ছেড়ে নিচে অসহায়ের মত বসে পড়ল রাইয়্যান। ওর মনে হচ্ছে ও অথৈ সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে, একটামাত্র কাঠের টুকরা বেঁচে থাকার অবলম্বন, সেটাও ভেসে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।
***
বাগানের দোলনাটায় দোল খাচ্ছে সিদ্রা, কিন্তু মন ওর দোল খাওয়ায় নেই। সেদিনের কথা মন থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছেনা ও। জ্বরের সময় প্রলাপ বকলেও পুরোপুরি বেহুঁশ তো আর ছিলনা। লোকটার চোখেমুখে ওর জন্য উদ্বেগ, জ্বর কমানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা, সবই আবছা আবছা মনে পড়ছে, কিন্তু এসব তো বিশ্বাস করার মত নয়। এই লোক আমার জন্য এতকিছু করেছে, আমি স্বপ্ন দেখিনি তো? এমনটাই ভেবেছিলো ও প্রথমে। কিন্তু স্বপ্ন যে দেখেনি তার সবথেকে বড় প্রমাণ হল ঘুম ভেঙে নিজের ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করা।
মনের মধ্যে চলছে চরম দোটানা। লোকটা ওকে অত জ্বরের সময় সেবা করে বাঁচিয়ে তুলেছে বলে কৃতজ্ঞ হবে নাকি অচেতন অবস্থায় লোকটা ওকে কতটা বেপর্দা অবস্থায় দেখেছে সেটা নিয়ে রাগ হবে যেন ঠিক করতে পারছেনা।
অবশ্য রাতের বেলা গিয়ে খালার ঘরে শোয়ার জন্য লোকটাকে এত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, ওকে দরজা ভেঙে বের করতে হয়েছে, সেজন্য লোকটার ভয়ংকর একটা রিএকশন এর জন্য অপেক্ষা করছিল সিদ্রা, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে কিছুই করেনি লোকটা। জাস্ট একবার জিজ্ঞেস করেছিলো, ও কেন রাতের বেলা উঠে খালার ঘরে গিয়ে দরজা আটকেছিল। কোন উত্তর দেয়নি ও। কিভাবে বলতো, আপনার ভয়ে গিয়েছি! লোকটা অবশ্য আর জোরাজুরি করেনি, হয়ত অসুস্থ বলে ছেড়ে দিয়েছে, পরে কখনো আবার ধরবে।
কিন্তু কি করতো ও? সেদিন রাতে এত প্ল্যান পরিকল্পনার পরেও প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল ওর, কিন্তু এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো যায়না দেখে ঘুমাতে ভরসা পাচ্ছিলোনা। তাই খালার ঘরে গিয়ে শুয়েছিল। ভেবেছিল, ফজরের পর আবার চলে আসবে উপরে, লোকটা জানতেও পারবেনা। কিন্তু জ্বর এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে যে সবকিছু ভজঘট হয়ে যাবে, ও স্বপ্নেও ভাবেনি।
শুধু কি এটুকুই, দুপুরে বুবুর বাসা থেকে আনা ভাত তরকারি খেতে পারছিলোনা দেখে লোকটা স্যুপ বানিয়ে খাইয়েছে ওকে। আবার রাতের বেলা খালাকে দেখে আসার পথে বাইরে থেকে ফ্রাইড রাইস নিয়ে এসেছিল, যদিও মুখে স্বাদ ছিলনা, তবু প্রিয় খাবার বলে অনেকটা খেতে পেরেছে। কিন্তু লোকটা কিভাবে জানলো ফ্রাইড রাইস আমার প্রিয়!? মুনিরা কি প্রিয় খাবারের কথাও নিজেরটা না বলে আমারটা বলে রেখেছে নাকি!?
কিন্তু উনার মত মানুষ, যিনি কিনা আমাকে এত ঘৃণা করেন, তিনি আমার জন্য এতকিছু কেন করলেন? উনার ভেতরে একটা নরম মন আছে, যাতে আছে তার কাছের মানুষগুলোর জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা, বুঝতে পারে সিদ্রা। শুধু কি কাছের মানুষ, চা বাগানের প্রত্যেকটা শ্রমিককে উনি কি পরিমাণ ভালবাসেন নিজের চোখে দেখেছে ও। এইতো সেদিন, এক শ্রমিকের ছেলে পাহাড় থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলল, উনি এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিলেন যেন উনার নিজের ছেলে। তারপর বুবুর কাছে শুনেছে, ছেলেটাকে নাকি উনি রক্তও দিয়েছেন। একই মানুষ, একদিকে একজনের জীবন বরবাদ করছে, অন্যদিকে আবার প্রাণপণে আরেকজনের জীবন বাঁচাচ্ছে। এমন দ্বৈতসত্ত্বা এর আগে কখনো দেখেনি সিদ্রা। অবশ্য এ ক্ষুদ্র জীবনে কয়টা মানুষকেই বা দেখেছি আমি! অসুস্থ অবস্থায় আমাকেও নিশ্চয় একটা মানুষ হিসেবেই দেখেছে, নিজের ভাইয়ের হত্যাকারী হিসেবে নয়, সেজন্যই করেছে অতকিছু, এর বেশি কিছু নয়।
খালা এসে জোরে একটা দোল দিতেই চিন্তার জাল ছিন্ন হল সিদ্রার। হাসিমুখে খালার দিকে তাকাল ও। খালা ইশারায় জিজ্ঞেস করল, বুবুর ওখানে যাবে কিনা। সম্মতি জানাল সিদ্রা, উঠে দাঁড়াল রেডি হওয়ার জন্য।
বুবুর বাংলোয় গিয়ে বিস্মিত হল সিদ্রা। কোন রোগী নেই, বুবু বাগানে বসে বসে বই পড়ছে।
“কি ব্যাপার বুবু? আজ তোমার ছুটি নাকি?” বুবুর পাশে বসতে বসতে বলল সিদ্রা।
“হ্যাঁ রে, আজ ওদের বাৎসরিক উৎসবের দিন, আজ কেউ ইমার্জেন্সি ছাড়া আসবেনা”
“তাহলে তো আজকে বুবুর গল্প শোনার পার্ফেক্ট সময়, কি বলো?”
“কিসের গল্প?”
“ভুলে গেলে তো? তুমি না বলেছিলা সময় করে বলবা”
“ও আচ্ছা, ওই কথা, অত বিশেষ কিছুনা। শুধু শুধু তোর মনটা খারাপ হয়ে যাবে”
“হলে হবে, তুমি বল”
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যে ভাইটুর আপন বোন না, এটা তো জানিস?” বই বন্ধ করে বলল বুবু।
“কি? আপন বোন না মানে?” টাশকি খেল সিদ্রা।
“এটাও বলেনি, অবশ্য বলবে কেন, ওরা তো আমাকে আপন ছাড়া পর ভাবেইনি কোনদিন” খুশির অশ্রু চিকচিক করে উঠলো বুবুর চোখের কোণে, “মানে তুই গল্প থেকেই বুঝে যাবি, শোন তাহলে” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গল্প শুরু করল বুবু।
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
২৭.
বুবুর গল্পঃ
আমি তখন ইন্টার্নি করছি ডিএমসিতে। মাত্র আর এক মাস পরেই পরিপূর্ণ ডাক্তার হয়ে বের হব। মেডিকেলে পড়ার শুরুর দিক থেকেই একটা ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো। যাওয়া আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রেম নিবেদন করা এসব যা করে আরকি বখাটে ছেলেরা। আমি কোনদিন পাত্তা দিইনি কিন্তু এ ছেলে হাল ছাড়েনি, এতদিন ধরে লেগেই ছিল। আমরা তখন পুরান ঢাকার এক ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। আমরা বলতে আমি, আব্বা-আম্মা আর ভাইয়া-ভাবী। আব্বা রিটায়ার্ড করেছে, ভাইয়ার টাকায় পুরো সংসার চলে। সবাই তাকিয়ে আছে আমি কবে ডাক্তার হয়ে ভাইয়ার বোঝা হালকা করব। কিন্তু আল্লাহ বোধহয় সেটা চাননি, তাঁর ইচ্ছে অন্যরকম ছিল।
এমনিতে তো বাসা কাছে হওয়ায় যাওয়া আসা করেই পড়াশোনা শেষ করেছি। কিন্তু গলিঘুপচির মধ্যে বাসা বলে ইন্টার্র্নি করার সময় বেশি রাত হয়ে গেলে কখনো ফিরতামনা আমি, হোস্টেলে থেকে যেতাম। কিন্তু সেদিন আম্মু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যায়, ভাইয়া আমাকে ফোন করে ওষুধ নিয়ে আসতে বলে আম্মুর জন্য। আমিও নিজের চিন্তা না করে রাত একটার সময় বের হয়ে যাই হাসপাতাল থেকে। রাস্তায় আমার পথ আটকায় ওই ছেলেটা, বরাবরের মত প্রেম নিবেদন করে, আমাকে নাকি বিয়ে করতে চায়।
এমনিতে আম্মুর জন্য টেনশনে মাথার ঠিক নেই, তার মধ্যে এই উটকো ঝামেলা, মাথা ঠিক রাখতে পারিনা আমি। ছেলেটাকে অনেক আজেবাজে কথা বলে অপমান করি। ছেলেটাও রেগে গিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যায় কোন এক গুদামঘরে। সেখানে তিন দিন আটকে রেখেছিল আমাকে। না না, তুই যেটা ভাবছিস তেমন কিছু না, ওর একটাই কথা ছিল, আমাকে বিয়ে কর। কিন্তু আমি ছিলাম প্রচণ্ড জেদি, একবার কোন কিছুতে না করলে কারো সাধ্য ছিলনা আমাকে হ্যাঁ বলাবে। জানিস, একটা কাজীকেও ধরে এনেছিল ও। কিন্তু আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েও আমার মুখ দিয়ে কবুল বলাতে পারেনি। আমার মাথায় ঘুরছিল শুধু, মরে যাবো কিন্তু ওকে বিয়ে করবোনা। কিন্তু আজ মনে হয় বিয়ে করলেই বেঁচে যেতাম! বুবুর চোখ দিয়ে টপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
শেষমেশ ও হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় আর আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসে। তারপর আমি ওকে আর কোনদিন ওই তল্লাটে দেখিনি।
আমাকে ফিরিয়ে তো দিয়ে গেল, কিন্তু জীবনটা আমার নরক হয়ে গেল। এক বখাটে ছেলে তুলে নিয়ে গিয়ে তিনদিন ধরে আমাকে আটকে রেখেছিল, ব্যবহার করে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, এমন কথা পাড়াময় চাউড় হয়ে গেল। পাড়ায় মুখ দেখানোর উপায় থাকলোনা আমার গোটা পরিবারের। বাড়িতে চরম অশান্তি শুরু হল। ভাইয়া তো মুখের ওপর বলে দিল, এমন অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভাল। হোস্টেলে চলে গেলাম বাধ্য হয়ে, কিন্তু সেখানেও স্বস্তি ছিলনা। আমাকে দেখলেই কানাঘুষা শুরু হয়ে যেতো, নিজের রুমমেট আর ক্লাসমেটেরা পর্যন্ত এমন ব্যবহার করতে লাগল যেন আমি অচ্ছুত হয়ে গেছি।
মেন্টাল প্রেসারে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, ফিরে এলাম বাসায়। তাতে বাসায় টেকা আরো দুঃসহ হয়ে উঠলো। ভাবী রাতদিন আমাকে আর আব্বা আম্মাকে কথা শোনাতে লাগলো। মা আমার দিকে মাঝেমাঝে এমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকাত, মনে হত ধরণী, তুমি দ্বিধা হও। একদিন ভাইয়া ভাবি মিলে চরম সিনক্রিয়েট করল বাসায়। আমি ঠিক করলাম মরবো, মরে গিয়ে সবাইকে শান্তি দিয়ে যাবো। কিন্তু মরার আগে একটা ইচ্ছা পূরণ করার সাধ জাগল আমার। কলেজের স্টাডি ট্যুরে কক্সবাজার নিয়ে গেছিল আমাদের ক্লাসকে, চাঁদার টাকা যোগাড় হয়নি বলে আমি যেতে পারিনি। সেই থেকে মনে সমুদ্র দেখার সাধটা থেকে গেছিল। আমি আমার ইন্টার্নির স্যালারি তুললাম। তারপর এক কাপড়ে বাসে চড়ে রওনা দিলাম কক্সবাজার।
সারাদিন সমুদ সৈকতে কাটিয়ে বিকেলবেলা নেমে গেলাম পানিতে। উদ্দেশ্য, সাগরের বুকেই এ জীবন বিসর্জন দিব। কিন্তু আল্লাহ্ ফেরেশতারূপে পাঠালেন বাবাকে মানে ভাইটুর বাবাকে। আমি প্রায় হাবুডুবু খেতে শুরু করেছি এমন অবস্থায় উনি আমাকে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। বাবা ভেবেছিল আমি ডুবে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পরে যখন জানল যে আমি মরতে যাচ্ছিলাম, বাবা আর মা মিলে যা একটা বকা দিয়েছিলোনা, আমি আজও ভুলতে পারিনা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ, বাবা অন্যের মেয়েকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিল, অথচ আজ তাঁর নিজের ছোট ছেলেই সেই কাজ করেছে।
তারপর? জানতে চাইল সিদ্রা।
তারপর আর কি, বাবা মা আমাকে বুঝাল, তোমাকে আর ফিরতে হবেনা, আমাদের সাথে চলো, নতুন জীবন শুরু করবে। ওঁদের তো কোন মেয়ে ছিলোনা, আমাকে মেয়ে করে নিল আর ওরা দুই ভাই তো এত বড় বুবু পেয়ে মহাখুশি। আমিও নরক থেকে বেরিয়ে এমন একটা বেহেস্তের মত জায়গায় আসতে পেরে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করলাম। আমি তো সাথে করে কিছু নিয়ে আসিনি, বাবা নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমার সমস্ত সার্টিফিকেট আর মার্কশিট তুলে আনার ব্যবস্থা করে। অনেক বলেছিল বিসিএস দিয়ে কোন একটা হাসপাতালে জয়েন করতে। কিন্তু যারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে, আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাইলাম। তাই তাদের এ প্রিয় মানুষগুলোর চিকিৎসা করার দায়িত্ব নিয়ে নিলাম সারাজীবনের জন্য। বিসিএস দিয়েছি, অন্যান্য ডাক্তারি ডিগ্রীও নিইয়েছে বাবা আমাকে দিয়ে, কিন্তু হাসপাতালে যোগদান করাতে পারেনি।
ওঁদের মৃত্যুর পরও সেই ঋণ শোধ করে যাচ্ছি, আল্লাহ চাহেতো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে যাবো। ব্যাস, এই ছিল আমার গল্প।
***
সিদ্রা সেই কখন থেকে চোখের পানি ফেলছে, এবার বুবুকে জড়িয়ে ধরে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। বুবু তো অবাক, “আরে পাগলী কাঁদছিস কেন?”
বুবু তো আর জানেনা, সিদ্রা বুবুর সাথে সাথে নিজের কথা ভেবে কাঁদছে। বুবুর কাহিনী থেকে ও বুঝে গেছে, যদি, জাস্ট যদি কোনদিন ও মুক্তিও পায়, ওর জীবন কখনওই আর আগের মত হবেনা। বুবুর মতই ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করবে ওর জন্য।
বুবুর বাসা থেকে চলে আসার সময় আরেকটা কথা মনে হল সিদ্রার, “কিন্তু বুবু, তুমি কখনো বিয়ে করনি কেন?”
“বিশ্বাস কর বা না কর, যার জন্য আমার জীবনের এই দুর্গতি, তারই জন্য”
“কি? ওই বখাটে ছেলের জন্য? কি বলছ কি তুমি?”
“হুম, ওর চাওয়ার মধ্যে কোন লালসা ছিলোনা রে, শুধুই ভালবাসা ছিল, শুধু ওর পন্থাটা ভুল ছিল। নাহলে ওই তিনটা দিন ও আমাকে বিয়ে করার জন্য জোর না করে নিজের লালসা ঠিকই মিটিয়ে নিতে পারতো, কি পারতো না বল?”
“হুম, সেটা ঠিকই বলেছো, কিন্তু তবুও”
“তবে সেটাই একমাত্র কারণ না, আমি আসলে এই বেহেস্তের মত জায়গা আর আমার ভাইদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি”
***
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে রাইয়্যান, ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল ও, আজ সোমবার। সবে জ্বর থেকে উঠেছে তবুও সিদ্রার রোজা রাখার ব্যত্যয় ঘটবেনা জানে ও। ফোন করে সেক্রেটারিকে বলল, “নেক্সট ফ্লাইটে ব্যাক করতে চাই আমি, ব্যবস্থা করো”
মাগরিবের আজানের মাত্র পনেরো মিনিট আগে বাসায় ঢুকল রাইয়্যান। সময় নেই দেখে বড় একটা ফাস্টফুড শপে ঢুকে যা চোখে পড়েছে তুলে নিয়ে চলে এসেছে। খালার হাতে খাবারের ব্যাগগুলো ধরিয়ে জলদি টেবিলে সাজিয়ে সিদ্রাকে ডাকতে বলল।
সিদ্রা ড্রয়িংরুমেই বসে ছিল, ওকে ডাকতে বলছে শুনে বেরিয়ে এলো। খালা ওর সামনে দিয়ে মুখে একটা হাসি নিয়ে চলে গেলো। সিদ্রা কনফিউজড হয়ে তাকাল রাইয়্যানের দিকে। রাইয়্যানের মুখটা সিদ্রাকে দেখে হাসিহাসি হয়ে গিয়েছিল, সিদ্রা তাকাতেই স্বাভাবিক করে ফেললো।
“ডাইনিং এ চল” গম্ভীর মুখে বলল রাইয়্যান।
কোন কথা না বলে হুকুম তামিল করলো সিদ্রা। ডাইনিং এ ঢুকে টেবিলের দিকে তাকিয়ে ওর চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। অনেকগুলো বার্গার, স্যান্ডউইচ, বিশাল একটা পিজ্জা, কয়েক রকমের পেস্ট্রি কেক আর আরো কিছু নাম না জানা ফাস্টফুড আইটেম, পাশে একটা কোল্ড কফির প্লাস্টিক কাপও দেখা যাচ্ছে।
“এসব কি?” মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল সিদ্রার।
“তোর ইফতার আর আমাদের নাস্তা” হাসিমুখে বলল রাইয়্যান। এখন তুই বলতে অনেক খারাপ লাগছে ওর, কিন্তু হঠাৎ করে তুমি বললে সিদ্রা কি না কি মনে করবে তাই আর চেঞ্জ করলোনা।
“আপনি কি কোন জিনিস কম কিনতে পারেননা? এতকিছু দিয়ে মানুষ ইফতার করে?”
“কেন? সারাদিন খাসনি, ক্ষুধা লেগেছে তো, আর একা কেন খাবি, আমরাও তো খাবো। শুনেছি, রোজাদারকে বসিয়ে ইফতার করালে অনেক নেকী হয়”
আরো কিছু বলতে মুখ হা করেছিলো সিদ্রা কিন্তু আজান দিয়ে দিল। রাইয়্যান তখন ওর হা করা মুখে কি একটা ঢুকিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সিদ্রা নড়তেও ভুলে গেলো। কি করছে লোকটা এগুলা? উনার মাথাটাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?
কোনমতে মুখটা বন্ধ করলো সিদ্রা। চকলেট কেকের মত টেস্ট, কিন্তু ঠিক কেক না, তবে স্বাদটা ভালই।
“নে, এবার বসে ধীরেসুস্থে ইফতার কমপ্লিট কর” বলে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো রাইয়্যান।
“কিন্তু আমি তো রোজাই রাখিনি আজকে!!” মুখেরটুকু গিলে উত্তর দিল সিদ্রা।
আয়েশ করে বার্গারে কামড় বসাতে যাচ্ছিল রাইয়্যান, হাতটা মাঝমথেই থেমে গেলো। হায়রে, একদিনে আর কতগুলা টাশকি খেতে হবে আমাকে! জীবনে একদিন মেয়েটার জন্য ইফতারি নিয়ে আসলাম, আর ও রোজাই রাখেনি!! একেই বলে কপাল!!! কোনমতে নিজেকে সামলে নিলো ও।
“রোজা নাইবা রাখলি, নাস্তা করতে তো আর অসুবিধা নেই, বসে পড়”
বসলো সিদ্রা, “আসলে আমি তো রোজা রাখতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু খালা কিছুতেই রাখতে দিলোনা” মিনমিন করে বলল সিদ্রা। বুঝতে পারছে, লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে কামড় বসাল।
***
পরদিন সন্ধ্যার পর আদেশজারি করলো রাইয়্যান, রেডি হতে হবে, ওরা নাকি বাইরে ডিনার করতে যাবে। সিদ্রাও শর্ত দিল, যদি বুবু আর খালা যায়, তাহলেই শুধু ও যাবে, নাহলে না। বেচারা রাইয়্যান, আগে ওকে হুমকি ধামকি দিয়ে কত কিছু করিয়েছে, কিন্তু এখন যেন আর কিছুতেই পারছেনা, বাধ্য হয়ে রাজি হল।
“ঠিক আছে, আমরা রেডি হয়ে বুবুর বাসায় গিয়ে বুবুকে নিয়ে তারপর যাবো”
কিন্তু বুবুর বাসায় গিয়ে দেখসা গেলো বুবুর মাথা ধরেছে, বাইরে যেতে পারবেনা, ওদের দুজনকে যেতে বলল। কিছুতেই রাজি হলনা সিদ্রা, শেষমেশ চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে হোম ডেলিভারি আনার সিদ্ধান্ত হল।
দেড় ঘণ্টা পর ডেলিভারি দিয়ে গেলে সবাই মিলে খেতে বসলো ওরা। যথারীতি গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে খাওয়া দাওয়া চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন বুবু শুনল যে সিদ্রা এখনো রাইয়্যানকে আপনি করে বলছে।
“তুই এই মুহূর্ত থেকে ওকে তুমি করে বলবি, নাহলে তোর সাথে কোন কথা নাই আমার” মুখ ঘুরিয়ে বলল বুবু।
“ছাড়োনা বুবু, আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, কিছুই মনে হয়না আমার। ডাক দিয়ে কি এসে যায় বলো, ভালবাসাটাই তো আসল” সিদ্রা হা করে তাকিয়ে রইল রাইয়্যানের দিকে। ঠিক শুনছি আমি, উনু বুবুকে সাপোর্ট না করে আমাকে সাপোর্ট করছেন!
“উঁহু, তুই মাঝখানে ঢুকবিনা, এটা আমার আর ওর মধ্যের ব্যাপার, আমি দেখতে চাই আমার কথার কোন গুরুত্ব ওর কাছে আছে কি নেই!”
বুবুর সিরিয়াস কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল সিদ্রা, বুবু সত্যি সত্যি রাগ করে ফেললে তো মুশকিল হয়ে যাবে, তার থেকে সামান্য একটা তুমিই তো, কি আর হবে!
“আচ্ছা আচ্ছা, রাগ করোনা বুবু প্লিজ, বলো, কি বলতে হবে?”
“কি বলতে হবে মানে? যা খুশি বল, যেমন ধর, আমি তোমাকে ভালবাসি” চোখ টিপল বুবু।
নিজের অজান্তেই গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে গেল সিদ্রার, কেন যে এত লজ্জা পেল নিজেও বুঝতে পারলোনা, মাথা নিচু করল ও। হাসল বুবু,
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, লজ্জা পেতে হবেনা, ওইসব পার্সোনাল সময়েই বলিস, এখন অন্যকিছু বল”
কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল সিদ্রা, “আচ্ছা, বলছি” এখনো মুখ নিচু করে আছে, যেন সাহস সঞ্চয় করছে। পিনপতন নিরবতা ঘরের মধ্যে, সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে কি বলবে ও। অবশেষে মুখ তুলল ও, রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলো পৃথিবীর সবথেকে সহজ তিনটা শব্দ।
“তুমি কেমন আছো?”
(চলবে)
(চলবে)