যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব ৩২+৩৩

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

৩২.
ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করছে সিদ্রা, এখানে আসার পর থেকে ঘটে যাওয়া একেকটা ঘটনা একের পর এক ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এখনো ওর বিশ্বাস হচ্ছেনা, এতোদিনের সকল কষ্টের অবসান হয়েছে, ও এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। রাত পার হলেই ফিরে যাবে আম্মু আব্বুর কাছে, যাদেরকে আরেকবার দেখতে পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলো ও। আল্লাহ্‌ চাইলে কি না করতে পারেন, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে সব কেমন বদলে গেলো। তবে মুক্তির আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছেনা সিদ্রা, বুবুর জীবনে যা ঘটেছে সেটা মনে পড়ে অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠছে বারবার।

চলে যাওয়ার আগে পাহাড়ের উপরে ঝর্ণাপাড়ে শেষবারের মত খালার সাথে বেড়াতে এসেছে ও। এই ঝর্ণাপাড়ে কাটানো একেকটা মুহূর্ত, খালার থেকে সাঁতার শেখা, ভোরবেলা সূর্যোদয় দেখা কিছুই ভুলতে পারবেনা ও। বুঝতে পারছে, কি প্রচণ্ড মিস করবে এই ঝর্ণাটাকে। কাপড়চোপড়ও নিয়ে এসেছে, খালার শেখানো সাঁতার কতটা মনে আছে পরীক্ষা করতে চায়। অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কেটে উপরে উঠলো দুজনে। কাপড় বদলে ঘাসের উপরে যোহরের নামাজ আদায় করে নিলো। এরপর পরিপূর্ণ পর্দা করে আস্তে আস্তে ফারহানের কবরের কাছে এসে দাঁড়ালো সিদ্রা।

কবরের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল নয়নে বলল, “আমি জানিনা ভাই, কতটা ভয়াবহ আযাব তুমি ভোগ করছো। আমার দোয়াতে তোমার কতটুকু কষ্ট লাঘব হবে, আমি তাও জানিনা। কিন্তু আমি প্রতিটা মোনাজাতে আল্লাহর কাছে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবো। চিন্তা করোনা তুমি, মুনিরাও দোয়া করবে তোমার জন্য, আর ইন শা আল্লাহ্‌ তোমার ভাইও। এতজনের দোয়ায় ইন শা আল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ তোমার আযাব কমিয়ে দিবেন, চাই কি মাফও করে দিতে পারেন। আমি আর কোনদিন হয়ত এখানে ফিরবোনা, কিন্তু যেখানেই থাকিনা কেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার জন্য দোয়া করবো, আমার বোনের পক্ষ থেকে কথা দিলাম”

এরপর বসে পড়লো ও কবরের কাছে, দুহাত তুলল আল্লাহ্‌র দরবারে। প্রায় একঘণ্টা ধরে কেঁদেকেঁদে ফারহানের জন্য মোনাজাত করলো ও। পাশে খালাও হাত তুলে মোনাজাতে শামিল হল ওর সাথে।

বনের মাঝ দিয়ে ফিরতি পথে হাঁটছে সিদ্রা আর খালা। খালার মুখটা আষাঢ়ে মেঘের মত থমথমে, যেন এক্ষুনি বর্ষণ শুরু হবে। কালকে যখন রাইয়্যান এসে খালাকে সব কথা খুলে বলল, সিদ্রা নির্দোষ শুনে যারপরনাই খুশি হয়েছিল খালা। রাইয়্যানকে ইশারায় বলেছে, “আমি যে মানুষ চিনতে ভুল করিনা, প্রমাণ হল তো?” ঠিক তারপরেই যখন জানতে পারলো, সিদ্রা চলে যাবে এখান থেকে, সেই যে কান্না শুরু করলো, আর থামছেইনা। খালা ওকে ভালবাসে জানতো সিদ্রা, সেটা যে এতো বেশি, ভাবেনি ও! কাল রাতে কয়বার যে বলেছে, ওই লোককে যেন ও বিয়ে করে নেয়, সিদ্রা না বোঝার ভান করে এড়িয়ে গেছে।

এতদিন তাও একটা পরিস্থিতিতে পড়ে ছিলো, এখন এ কথার কোন মানে হয়না। যদিও আন্দাজ করতে পারছে, বাড়িতে ফেরার পর বুবুর মতই ভয়ানক পরিবেশের মোকাবেলা করতে হবে ওকে, কলংক লাগাতে এক মুহূর্ত দেরী করবেনা কেউ, কিন্তু সেই কলংকের ভয়ে তো ও বিয়ে করতে পারেনা! আচ্ছা, সেই বখাটে ছেলেটার মতো উনিও যদি আমাকে ভালোবাসতেন, তাহলেও কি আমি বুবুর মতো না করতাম! না না, ছি ছি, নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমি কি ভাবছি এসব! আল্লাহ্‌ যা লিখে রেখেছেন, তাই হয়েছে এতদিন আর ভবিষ্যতেও হবে, আমি কেন এতো চিন্তা করছি!

***
ড্রাইভ করতে করতে একটু পরপর সিদ্রার দিকে তাকাচ্ছে রাইয়্যান, কিন্তু সিদ্রার সেদিকে খেয়াল নেই, ও তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে।

শেষ একটা রিকোয়েস্ট করেছিল রাইয়্যান, যেভাবে এনেছিল সেভাবে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে চায়, ওকে ড্রাইভ করে ঢাকা নিয়ে যেতে চায়। যদিও বাসায় ফেরার জন্য তর সইছেনা, কিন্তু লোকটার লাস্ট রিকোয়েস্ট বলে রাজি হয়েছে সিদ্রা।

জানেনা কেন, বাসায় ফেরার এক্সাইটমেন্টের পাশাপাশি একটা চিনিচিনে কষ্ট হচ্ছে ওর। ও তো মুক্তি পেতেই চেয়েছিল, তাহলে আসার সময় এতো কাঁদল কেন? যদিও বুবু অসুস্থ বলে সত্যিটা জানানো হয়নি, হানিমুনে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে এসেছে ওরা, লোকটা পরে সবটা জানাবে বলেছে। মাত্র তিনমাসে এতোটা মায়া পড়ে যাবে মানুষগুলোর উপরে, কল্পনাও করেনি ও। এমনকি এই লোকটার জন্যেও কষ্ট হচ্ছে, কেন হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছেনা। তাকাল ও রাইয়্যানের দিকে,
“আচ্ছা, আমাকে যেদিন নিয়ে এসেছিলেন, আমি তো অজ্ঞান ছিলাম, কোথায় রেখেছিলেন আমাকে?”

“ইয়ে মানে, ওইসব জেনে কি হবে বল!” ইতস্তত করছে রাইয়্যান।

“এতো ইতস্তত করছেন তার মানে খুব খারাপভাবে এনেছিলেন, বনেটের ভেতরে করে?” ভ্রু নাচিয়ে বলল সিদ্রা।

“আরে না না, তাহলে তো চেক করলে ইজিলি ধরা খেয়ে যেতাম! পেছনের সিটের নিচে রেখে উপরে শিট দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম!” অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো রাইয়্যান, ভাবতে এখন কত খারাপ লাগছে ব্যাপারটা।

উত্তরে আর কিছু বললনা সিদ্রা, মুখ ফেরাল রাস্তার দিকে। কিছুক্ষণ পর একটা মসজিদ চোখে পড়তেই আবার ঘুরলো রাইয়্যানের দিকে,
“আমি অনেকদিন থেকে একটা কথা ভাবছিলাম, কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস পাইনি, আর তো কোনদিন সুযোগ হবেনা, এখন করতে পারি?”

“নিশ্চয়ই!”

“আপনি নামাজ পড়েননা কেন? আমি জানি আমি অনধিকারচর্চা করছি, কিন্তু এটা আমার একটা কৌতূহল বলতে পারেন” অনেক হেজিটেশান নিয়ে জিজ্ঞেস করলো সিদ্রা।

“উম্ম, আমি ঠিক জানিনা”

“মানে?” হতভম্ব দেখাল সিদ্রাকে।

“মানে, সত্যি বলতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার তাগিদ কেউ কখনো দেয়নি আর আব্বু আম্মুকেও কখনো বাসায় নামাজ পড়তে দেখিনি। আব্বু মাঝেমাঝে জুমার নামাজ পড়তো আর দুই ঈদের নামাজে যেতো, আমিও সেটাই করি”

“কিন্তু, নামাজ বেহেশতের চাবি! দুনিয়াতে যাই করেননা কেন, নামাজ না পড়লে বেহেশতে ঢুকতে পারবেননা আপনি”

“আমি যতদূর জানি, আত্মহত্যা করলে মানুষ দোজখে যায়! আমার ভাই যদি বেহেশতে যেতে না পারে, আমি সেখানে গিয়ে কি করবো?”

“নাউজুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ!! আল্লাহ্‌ আপনাকে ক্ষমা করুন, সহী বুঝ দান করুন” বিড়বিড় করে বলল সিদ্রা, “সেজন্যই তো আপনার আরো বেশি নামাজ পড়া উচিত”

“ঠিক বুঝলামনা”

“দেখেন, কেউ আত্মহত্যা করলে সরাসরি দোজখে যাবে, এটা বলা আছে, কিন্তু তাকে যে আল্লাহ্‌ কোনদিন ক্ষমা করবেননা, এমনটা তো বলা নেই তাইনা? এখন আপনার কি উচিত না, আপনার ভাইয়ের গোনাহ মাফের জন্য, তার আজাব কমিয়ে দেয়ার জন্য, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা? আপনি ওর একমাত্র ভাই, আপনার দোয়া এখন ওর সবথেকে বেশি প্রয়োজন। আপনি ও বেঁচে থাকতে ওর জন্য কি কি করতে পারেননি সেটা ভেবে আফসোস করছেন, কিন্তু ওই কবরের ভেতরে কতইনা আজাব ভোগ করছে ছেলেটা, আপনার দোয়া হয়তো একটু হলেও লাঘব করবে ওর কষ্ট। কিন্তু আপনি সেটা না করে নিজেও জাহান্নামে যেতে চাইছেন! কেমন ভাই আপনি!?”

সিদ্রার কথায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো রাইয়্যানের। “আমি নামাজ পড়ে দোয়া করলে ওর কষ্ট কমবে?”

“কমবে ইন শা আল্লাহ্‌। মানছি ফারহান অনেক বড় গুনাহ করেছে, কিন্তু কাফের তো আর হয়ে যায়নি। ওর মধ্যেও তো ইলমে দ্বীনের ঘাটতি ছিল, ওতো বুঝেনি, যে কষ্ট থেকে ও বাঁচতে চাইছে, তার থেকে কত কতগুণ বেশি কষ্ট অপেক্ষা করছে ওর জন্য। আত্মহত্যার পরিণাম কতটা ভয়াবহ ওর হয়ত আন্দাজই ছিলনা। আত্মহত্যা অনেক বড় পাপ, আর সেই পাপের সাজা ওকে ভোগ করতে হচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ্‌ তো অসীম দয়ালু, পরম করুণাময়। আল্লাহ্‌ চাইলে কি সেই শাস্তি মওকুফ করে দিতে পারেননা, নিশ্চয় পারেন। আপনি যে ওর জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘর সাজিয়ে কেক সাজিয়ে বসে ছিলেন, তাতে কি ওর কোন ফায়দা হবে? হবেনা। বরং আপনি যদি ওর নামে রোজা রাখেন, দানসদকা করেন, আরো যে ভাল ভাল কাজ আছে সেগুলো করেন, আর তার বিনিময়ে আল্লাহ্‌ ওর কবরের আযাব কমিয়ে দেন, তাহলেই তো ওর আসল ফায়দা হবে, তাইনা?”

মনের ভেতর যেন দপ করে আলো জ্বলে উঠলো রাইয়্যানের। একটু আগেও ওর মনে হচ্ছিল, ফারহান চলে গেছে আর এখন সিদ্রাও চলে যাচ্ছে, জীবনের আর কোন মানে নেই, কিন্তু এখন যেন বেঁচে থাকার নতুন উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছে ও।

“আর ওই যে পরশুদিন আপনি বললেন, আপনার অবসরের কোন প্রয়োজন নেই, সেটা সম্পূর্ণ ভুল। এতো কাজ করে কি করবেন আপনি? আরো বড় বিজনেসম্যান হবেন, আরো বেশি সম্পত্তির মালিক হবেন, এইতো! কিন্তু দুনিয়ার জীবন কয়দিনের? মৃত্যুর পর এসব কি কাজে আসবে আপনার? এসব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তো ফারহানও ছিলো, ও কি কিছু সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পেরেছে? কয়েক টুকরো সাদা কাপড় ছাড়া কিছুই কি গেছে ওর সঙ্গে? তেমনি আপনার সাথেও যাবেনা। তাই, শুধু দুনিয়ার জন্য না, দয়া করে আখিরাতের জন্যেও কিছু উপার্জন করার চেষ্টা করুন। প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছিলেন না, ধরে নিন না, নতুন করে জীবনটাকে সাজানোই হবে আপনার প্রায়শ্চিত্ত!”

অবাক হয়ে সিদ্রার কথাগুলো যেন গিলছিল রাইয়্যান। কিভাবে পারে ও, এতো সুন্দর করে বোঝাতে! সিদ্রা নিজেও জানতে পারলোনা, ওর সামান্য ক’টা কথায় মৃতপ্রায় একটা গাছে নতুন করে প্রাণসঞ্চার হলো।

“ঠিক বলেছো তুমি, জীবনটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে। আমি চেষ্টা করবো, সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো”

“ইন শা আল্লাহ্‌!” খুশি হয়ে বলল সিদ্রা।

কিন্তু সেই কাজটা কতইনা সহজ হতো, যদি তুমি পাশে থাকতে! কিন্তু আমি যা করেছি তোমার সাথে, তারপর আর সেটা চাওয়ার মতো মুখ নেই আমার। বুকে পাথর চেপে তাই তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি নিজের থেকে অনেক দূরে, মনে মনে বলল রাইয়্যান।

আস্তে আস্তে ফুরিয়ে এলো পথ, ঢাকায় ঢুকার পর থেকেই বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছে রাইয়্যানের। আর কিছুক্ষণ পরেই আলাদা হতে হবে ওদের, চিরজীবনের জন্য, ভাবলেই ভেতর থেকে কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসছে রাইয়্যানের, কিভাবে যে আটকে রাখছে, একমাত্র ওই জানে। একদম বাড়ির সামনে গাড়ি নিলোনা সিদ্রা। একেতো এতদিন পর ফিরেছে, তার উপর দামী গাড়ি থেকে নামতে দেখলে মানুষের কথা বানাতে সময় লাগবেনা। তাই গলির মুখেই ওকে নামিয়ে দিতে বলল সিদ্রা। গাড়ি থামাতেই দরজায় হাত দিলো সিদ্রা।

“একটু দাঁড়াও সিদ্রা!” তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো রাইয়্যান।

“কিছু বলবেন?” বলল সিদ্রা।

“হুম! এই নাও, সেদিন গাছে ওঠার সময় তোমার বোরকার বোতামটা খুলে পড়ে গিয়েছিল, আমি রেখে দিয়েছিলাম, লাগিয়ে নিও”

“জাযাকাল্লাহ!” বোতামটা হাতে নিলো সিদ্রা।

“বোতাম লাগালে বোরকা তো আগের মতো হয়ে যাবে, কিন্তু তোমার জীবন তো আগের মতো হবেনা! আমি জানি তোমার কতবড় সর্বনাশ আমি করেছি। একটা মেয়ে তিনমাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর বাড়ি ফিরছে, তাকে কি পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে, বুবুর জীবন থেকে আমি খুব ভাল করে জানি সেটা। তোমার আব্বু আম্মু হয়তো তোমাকে বিশ্বাস করবে, কিন্তু অন্যরা তোমার জীবনটা নরক করে দিবে। তুমি এখানে টিকতে পারবেনা। তাই, তুমি যদি রাজি থাকো, এতোদিন ধরে আমরা যে নাটকটা করছিলাম, আমি সেটাকে সত্যি করে দিবো। তুমি সবার সাথে দেখা করে সসম্মানে ফিরে যেতে পারো আমার সাথে, তোমার নিজের বাড়িতে”

“না” মুহূর্ত মাত্র অপেক্ষা না করে শক্ত কণ্ঠে উত্তর দিল সিদ্রা, “শুধুমাত্র মানুষের কথার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে আমি আপনাকে বিয়ে করে নিতে পারবো না। আমাকে একটা ছেলে তুলে নিয়ে গেছিলো আর তিনমাস পর ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, সর্বনাশ হয়েছে আমার, এটাই বলবে তো মানুষ! নিজের গায়ে লাগা এতটুকু কলঙ্ক আমি মেনে নিতে পারবো। কিন্তু বাবা মায়ের মুখে চুনকালি মাখিয়ে আমি একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করে ফেলেছি, এটা প্রচার হলে কি হবে জানেন? আমার সাথে সাথে আমার বাবা মায়ের শিক্ষা, আমার মাদ্রাসার শিক্ষা, কুরআনের শিক্ষা, এসবের প্রতি আঙুল তুলবে সবাই। যেমনটা আপনি নিজেই একসময় তুলেছিলেন। নিজে মানুষের কটুক্তি থেকে বাঁচতে এতোগুলো সম্মানিত জিনিসকে আমি অসম্মানিত করতে পারবোনা। তার জন্য আমাকে যত কষ্টই সহ্য করতে হোক না কেন। আর আপনি কেন শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছেন? এগুলো আমার ভাগ্যে লেখা ছিল, আপনি প্লিজ নিজেকে দোষ দিবেননা। আমি আপনাকে আপনার সকল অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিচ্ছি”

গাড়ির দরজা খুলল সিদ্রা, নেমে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো আবার, “ও, একটা কথা স্বীকার করা হয়নি, নিজেই শর্ত দিয়েছিলাম অথচ লজ্জাবশত নিজেই নিজের কথা রাখিনি। আপনার কফি মেকারের কফি আমার বানানো কফির থেকে বেশি টেস্টি, অনেস্টলি বলছি”

“উঁহু! তোমারটাই বেশি টেস্টি, নাহলে আমাকে আর কখনো কফি মেকারের কফি খেতে দেখেছো?”

“আপনার কাছে হয়ত হয়ে থাকবে, আমি আমারটা বললাম। অনেস্টলি বললেন বলে জাযাকাল্লাহ। এবার তাহলে যাই, ভাল থাকবেন, আল্লাহ্‌ হাফেজ” দরজাটা ধাক্কা দিয়ে আটকে দিলো সিদ্রা।
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

৩৩.
“থ্যাংকইউ” গাড়ি থেকে নেমে বলল রাইয়্যান, “থ্যাংকইউ সো মাচ! এই তিনমাসে আমার জন্য, খালার জন্য, আমাদের সবার জন্য তুমি যা যা করেছো, তার জন্য একবারও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। আজকে সবার পক্ষ থেকে বলছি, থ্যাংকইউ মিস সিদ্রাতুল মুনতাহা, থ্যাংকস ফর এভরিথিং” অনেক কষ্টে মুখে হাসি এনে বলল রাইয়্যান।

“তাহলে তো থ্যাংকস আপনারও প্রাপ্য! এই তিনমাসে অনেক কিছু শিখেছি আমি, অনেক কিছু রিয়েলাইজ করেছি, আমার জীবনে এ দুর্ঘটনাটা না ঘটলে হয়ত সারাজীবনেও সেগুলো অনুভব করতে পারতামনা, তাই আপনাকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন”

বিদায় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সিদ্রা।দ্রুতপায়ে হাঁটা দিলো চিরপরিচিত রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে। কয়েক পা এগিয়ে শেষবারের মতো পেছনে ঘুরতেই দাঁড়িয়ে গেলো সিদ্রা। খানিক দূরে রাইয়্যান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হয় ভাবতে পারেনি সিদ্রা পেছনে তাকাবে। চকিতে আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসলো সিদ্রা। ওর কপাল ভালো, এই ভরদুপুরের কড়া রোদে কেউই রাস্তায় নেই।

“আপনি পিছুপিছু আসছেন কেন?” অবাক হয়ে বলল সিদ্রা।

“তুমি সেফলি বাসায় পৌঁছেছো সেটা নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম” আমতাআমতা করে বলল রাইয়্যান, যদিও কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, সিদ্রা বাসায় গিয়ে কি পরিস্থিতিতে পড়বে আর কিভাবে সবটা সামলাবে, সেটা নিয়ে টেনশন হচ্ছে ওর।

“আমি ঠিক পৌঁছে যাবো, আপনি চলে যান প্লিজ” এদিকওদিক তাকাচ্ছে সিদ্রা।

“কিন্তু তুমি আমাকে তোমার সাথে কেন যেতে দিচ্ছোনা একটু বলবা প্লিজ? আমি তোমার আব্বু আম্মুকে খুলে বলবো সবটা। এতে উনাদের বিশ্বাস করতে সহজ হবে ব্যাপারটা” অস্থির কণ্ঠে বলল রাইয়্যান।

“না, আপনি গেলে আরো জটিল হবে সবকিছু। আর আমার আব্বু আম্মু বিশ্বাস করলে আমার কথাতেই বিশ্বাস করবে, আপনার সুপারিশের প্রয়োজন হবেনা। আর যদি তাঁরা আমার কথায় বিশ্বাস না করে আপনার স্বীকারোক্তি শুনে আমাকে বিশ্বাস করেন, তাহলে সেটা হবে মেয়ে হিসেবে আমার চরম ব্যর্থতা!”

“ঠিক আছে। তাহলে অন্তত আমাকে উনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে দাও। আমি উনাদের কম কষ্ট তো দিইনি”

“তার কোন দরকার নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দোষটা তো আমার বোনেরই। নিজের বোনের পাপের সাজা যেমন আমি পেয়েছি, তেমনি তারা তাদের মেয়ের, আপনি তো উসিলামাত্র। আর তাছাড়া আপনাকে তো বললামই, আপনার সাথে আমাকে দেখলে মানুষ যা নয় তাও রটিয়ে ফেলবে। এলাকায় সবাই আমাদের খুব ভাল করে চিনে। প্লিজ আমাকে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেননা। আল্লাহ্‌ আছেন তো আমার জন্য” আসলে সিদ্রা খুব ভালো করে জানে, ওর আব্বু সব জানার পর এই লোককে সামনে পেলে হয় মেরে আধমরা করে দিবে আর নাহয় পুলিশে দিবে । সেই রিস্কটা ও নিতেই চাচ্ছেনা।

কিন্তু সেটা তো আর বুঝলোনা রাইয়্যান, উলটা কষ্ট পেলো। তুমি আমাকে এতোটা ঘৃণা করো যে তোমার বাসা পর্যন্ত যাওয়ার, তোমার বাবা মার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু দিলেনা!

“বেশ, তুমি যা চাও তাই হোক। আমি আর আগাবোনা, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকছি, তুমি গেইটের ভেতরে ঢুকে গেলেই আমি চলে যাবো, কথা দিলাম। প্লিজ সিদ্রা, এটুকু মেনে নাও”

“আচ্ছা ঠিক আছে” নিরুপায় হয়ে মেনে নিলো সিদ্রা, আবারো সালাম দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা শুরু করলো ও। দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নেমে এলো অশ্রুধারা। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন আমার? উনি আমাকে তো প্রস্তাব দিলেন, আমিই তো ফিরিয়ে দিলাম! তাহলে কেন কাঁদছি আমি? কারণ উনি আমাকে চাননা, শুধুই উনার ভুল সংশোধন করতে চান, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। এক ভুল শোধরাতে গিয়ে আমি উনাকে আরেকটা ভুল করতে দিতে পারিনা। শুধুমাত্র আমাকে সুখী জীবন দেয়ার জন্য উনি নিজের জীবন স্যাক্রিফাইস করবেন, আমি সেটা কেন মেনে নিব? ভুলে যাও সিদ্রা, সব ভুলে যাও। ওই লোকের সাথে আর কোনদিন দেখা হবেনা তোমার, তোমাদের পথ কখনোই এক ছিলোনা আর হবেওনা, সব ভুলে যাওয়াই উত্তম তোমার জন্য। নেকাবের নিচে হাত ঢুকিয়ে চোখ দুটো মুছে নিলো সিদ্রা।

গেইটে ঢুকার আগে শেষবারের মত ঘুরে এক পলক দেখে নিলো রাইয়্যানকে, তারপর শরীর আর মনের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ঢুকে গেলো ভেতরে।

***
কলিংবেল বেজে উঠতেই বিরক্ত হল মুনিরা, এখন আবার কে এলো? মাত্রই ঘুমিয়েছে জাহানারা বেগম। আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছে উনাকে। সেদিন পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গিয়ে রক্তারক্তি অবস্থা হয়েছিল, সাতটা সেলাই লেগেছে! শারীরিক, মানসিক সব ধরণের অসুস্থতা বিবেচনা করে এতদিন হাসপাতালেই ভর্তি রেখেছিল ওরা। এখন একটু সুস্থ হওয়ায় রিলিজ তো দিয়েছে, কিন্তু কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে।

আইহোলে চোখ রাখতেই যেন শক খেল মুনিরা, সিদ্রার মতো লাগছেনা? ভুল দেখছিনা তো! দরজা খুলতেই খুশিতে পাগল হয়ে গেলো ও।

“সিদ্রা……….” চিৎকার করে সিদ্রাকে জড়িয়ে ধরল মুনিরা। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো দুইবোন, এতোদিনের নিরব কান্না যেন ভাষা পেয়েছে আজ।

চিৎকার শুনে নিজাম সাহেব(আব্বু) দৌড়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। চোখেমুখে প্রথমে অবিশ্বাস, তারপর বিস্ময় আর সবশেষে আনন্দের রেখা ফুটে উঠলো তার। সেখানেই শুকরিয়া আদায় করতে সেজদায় পড়ে গেলেন তিনি, এতোদিনের দোয়া যে আল্লাহ্‌ কবুল করেছেন! সেজদা থেকে উঠে তিনিও কাছে এসে জড়িয়ে ধরলেন দুইবোনকে। তিনজনের আনন্দাশ্রু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো।

“আমি জানতাম, আল্লাহ্‌ আমার মুনতাহা মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন, কিছু হবেনা ওর, আমি ঠিক জানতাম” বললেন নিজাম সাহেব।

আহ! কতদিন পর আব্বুর মুখে ডাকটা শুনলাম!! আব্বু ছাড়া আর কেউ ওকে মুনতাহা বলে ডাকেনা। আববুকে আবার দেখতে পাচ্ছে, জড়িয়ে ধরতে পাচ্ছে, আব্বু আদর করছে, সব যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে সিদ্রার। মনে মনে দোয়া করছে, এটা যেন ওর সুখস্বপ্ন না হয়, চোখ খুললেই যেন সবটা হারিয়ে না যায়।

কান্নাকাটির মধ্যেই ওরা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, কোথায় গিয়েছিল, কি হয়েছিল ওর, একটা খবর কেন দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সিদ্রা কান্নার দমকে কথাই বলতে পারছেনা। হঠাৎ খেয়াল হতেই জিজ্ঞেস করলো, “আম্মু কোথায়?”

মুনিরা ওকে ঘরে নিয়ে গেলে বিছানায় মাথায় ব্যান্ডেজ সহ জাহানারা বেগমকে দেখে জোরে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল সিদ্রা, ওর মুখ চেপে ধরে আবার বসার ঘরে নিয়ে এলো মুনিরা। “কি হয়েছে আম্মুর?” হাতটা সরিয়ে বলল সিদ্রা।

“ঘুমাচ্ছে, ঘুমের ওষুধ খেয়েছে তো” বলল মুনিরা।

“ঘুমের ওষুধ কেন?” উদ্বগের সুর সিদ্রার কণ্ঠে।

“তোর চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল তোদের আম্মু, সারাদিন এইখানে বসে থাকতো। কলিংবেল বাজলেই মনে করতো তুই ফিরে এসেছিস, পাগলের মত ছুটে যেতো দরজায়। আর যখন দেখত তুই না অন্য কেউ, তখন শকটা নিতে পারতোনা, অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। এই কয়েকদিন আগে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেয়ে মাথা ফেটে গেছিল, আজকেই নিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে” উত্তর দিলো আব্বু।

আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সিদ্রা, সান্ত্বনা দিলো মুনিরা, “চিন্তা করিসনা। তুই এসে গেছিস না, তোকে দেখলেই ইন শা আল্লাহ্‌ আম্মু একদম ঠিক হয়ে যাবে”

“ইন শা আল্লাহ্‌” বলল সিদ্রা।

মুনিরা এবার সিদ্রার দিকে ভাল করে খেয়াল করলো। চোখেমুখের লাবণ্য তেমন কমেনি, দুঃখকষ্টের কোন ছাপ নেই, স্বাস্থ্যও খারাপ হয়েছে বলে মনে হচ্ছেনা, বোরকাটাও নতুন। কেন মনে হচ্ছে, সুখেই ছিল ও! তাহলে কি ওই গোয়েন্দাটা সত্যি কথা বলছিল?

জেরার ভঙ্গিতে বলল মুনিরা, “কোথায় ছিলি তুই? তোর চেহারা সুরত, পোষাকের অবস্থা দেখে এটা অন্তত মনে হচ্ছেনা যে তুই কোন বিপদে পড়েছিলি। আর কোন এক্সিডেন্ট হলেও তো আমাদের জানাতে পারতি! তুই কি সত্যি সত্যি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিস?” কথাটা নিজে বিশ্বাস না করলেও কেন যেন বেরিয়ে গেলো মুখ দিয়ে।

এতোদিনের জমে থাকা রাগ আর অভিমানে যেন দপ করে আগুন ধরে গেলো। তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় মারল সিদ্রা মুনিরার গালে, এতোই জোরে যে ফর্সা গালে সাথে সাথে আঙুলের দাগ বসে গেলো।

“আমি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছি! বলতে পারলি তুই এটা!! তুই নিজে যা করেছিস, তারপরে আমাকে এই নোংরা কথাটা জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করলোনা তোর? বিবেকে বাঁধলোনা একটু?”

সিদ্রার এমন রূপ কোনদিন দেখেনি মুনিরা, ওর আব্বুও না। হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। কিন্তু থাপ্পড়টা হজম করতে পারলোনা মুনিরা, বলল, “আমি আবার কি করলাম!”

“কি করেছিস? কার জন্য এই তিনমাস বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে আমাকে? কার জন্য আমার সারাজীবন নষ্ট হতে বসেছিল? এতো বড় বড় কথা যে বলছিস, তুই আসলে কতবড় পাপ করেছিস জানলে থাকবে তো গলার জোর? মুখ দিয়ে কথা বের হবে তো?” হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল মুনিরা, যেন বুঝতে পারছেনা কি বলছে সিদ্রা।

“মুনতাহা মা, পরিষ্কার করে বলতো, কি হয়েছিলো তোর?”

“আব্বু, আমাকে একটা লোক কিডন্যাপ করেছিল”

“কি!” চমকে উঠেছে দুজন শ্রোতাই।

“হ্যাঁ আব্বু, কিন্তু ভয় পেয়োনা, কোন অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য না, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।”

“প্রতিশোধ! কিসের প্রতিশোধ?”

“ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ, আব্বু। উনার ভাই কয়েক মাস আগে আত্মহত্যা করেছে, তার জন্য আমাকে দায়ী মনে করে ভুল করে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সারাজীবনের জন্য বন্দী করে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আসলে এর জন্য কে দায়ী জানো? এই যে আমার বোন, জোর গলায় কথা বলছে। কিরে, ফারহানের সাথে প্রেম করার সময় বুঝতে পারিসনি ছেলেটা তোকে ভালবেসে জীবন দিয়ে দিতে পারে?” শেষের বাক্যটা মুনিরার দিকে তাকিয়ে বলল সিদ্রা।

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো মুনিরার, “কি বলছিস তুই? ফারহান! ফারহান আত্মহত্যা করেছে? কেন?”

“বুঝতে পারছিসনা কেন? তোর ভালবাসা ভালবাসা খেলাটা বড্ড সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিল রে ছেলেটা, তোকে এতই ভালবেসে ফেলেছিল যে তুই ওকে এতোদিন ধরে ভালবাসার নাম করে বোকা বানিয়েছিস, এই আঘাতটা ও সহ্য করতে পারেনি। একসাথে কতগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ইহকাল পরকাল সব নষ্ট করে ফেলেছে ছেলেটা। কি মনে হয় তোর? এর জন্য তুই কতটা দায়ী?” সিদ্রা নিজেও বুঝতে পারেনি এতোটা ক্ষোভ ওর মনে জমে ছিল, আজ যেন সব বেরিয়ে আসছে এক লহমায়।

পা দুটো যেন অবশ হয়ে গেলো মুনিরার, কাঁপতে কাঁপতে সোফার সাইড ধরে বসে পড়লো, চোখ থেকে উপচে পড়লো পানি, হু হু করে কাঁদতে লাগলো ও।

“ও….ও….ও এতো ভালবাসত আমাকে! আমার জন্য……. আ…..আমার জন্য…… নিজের জীবনটা শেষ করে দিলো?”

এদিকে নিজাম সাহেব তো কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা, হতভম্ব হয়ে একবার সিদ্রার দিকে আর একবার মুনিরার দিকে তাকাচ্ছে।

“কি বলছিস তোরা? একটু পরিষ্কার করে বলবি? এসব প্রেম ভালবাসা! এসবের মানে কি?”

“আমি বুঝিয়ে বলছি আব্বু, প্লিজ তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। তোমার বিপি হাই হয়ে যাবে নাহলে” হাতধরে আব্বুকে সোফায় বসাল সিদ্রা, তারপর বলতে শুরু করলো ও,“মুনিরা মিথ্যে নাম দিয়ে একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছিল। আশেপাশের সবাইকে দেখে ওরও হয়ত ইচ্ছে হয়েছিল ফেসবুকে ছেলে বন্ধু বানানোর। তখন সম্ভবত ফারহানের সাথে ওর পরিচয় হয়। কিন্তু প্রতিদিন চ্যাট করতে করতে ছেলেটা দুর্বল হয়ে যায় ওর প্রতি। ও মুনিরাকে নিজের মনের কথা জানায় আর মুনিরাও মনে হয় মজা করতে রাজি হয়ে যায় ওর প্রস্তাবে? কিরে তাইতো? ঠিক বলছি আমি?” শেষের কথাদুটো মুনিরার দিকে তাকিয়ে বলল সিদ্রা।

কিন্তু মুনিরার সিদ্রার দিকে কোন খেয়াল নেই, অপ্রকৃতিস্থের মত বিড়বিড় করছে, “ও….আমাকে এতো ভালবাসত! ও….. আমাকে এতো ভালবাসত!!”

অলরেডি মাথা ঘুরছে নিজাম সাহেবের, উনার মেয়ে এসব করেছে, বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। কিন্তু সিদ্রা তো মিথ্যে বলার মেয়ে না, আর মুনিরার আচরণই বলে দিচ্ছে কথাগুলো কতটা সত্যি।

“তুই বলে যা” নিজেকে শক্ত করে বললেন নিজাম সাহেব, আরো খারাপ কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত করছেন নিজেকে।

“কিন্তু এক পর্যায়ে মুনিরা বুঝতে পারে, ছেলেটা বেশি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে, তখন ও সত্যিটা বলে দিয়ে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তারপর কি হয়েছে সেটা তো আগেই বললাম”

“ঠিক আছে, সব বুঝলাম। কিন্তু নিয়ে গেলে তো ওকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তোকে কেন?”

“সেকথার উত্তরও তোমার মেয়ে দিতে পারবে, ও কেন নিজের নাম না বলে আমার নাম করে এসব করেছে”

“হোয়াট? ওর এতো অধঃপতন হয়েছে যে পাপ করেছে তো করেছে আবার নিজের বোনের নাম দিয়ে! ছি!! এমন মেয়েকে আমি জন্ম দিয়েছি, এতো শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে বড় করেছি, আমি তো ভাবতে পারছিনা” রাগে দুঃখে রীতিমতো কাঁপছে ওর বাবা।

“শান্ত হও আব্বু! প্লিজ শান্ত হও তুমি” হাত ধরে সোফায় বসাল ও আব্বুকে, “ আমি তো ফিরে এসেছি বলো, সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায়। আল্লাহ্‌ আমাকে হেফাজত করেছেন আব্বু, কোন ক্ষতি হয়নি আমার” মেঝেতে বসে আব্বুর কোলে মাথা রাখল সিদ্রা।

“আমি শান্ত হতে পারছিনা। মুনিরার বিচার আমি পরে করছি। তুই আগে আমাকে ওই লোকের নাম বল। আমি……আমি কেস করবো ওর নামে। দুনিয়াতে আইন আদালত কিছু নাই? আর কেউ প্রেম করেনা? ওর ভাই নিজে কিছু করেনি? কোন সাহসে ও আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেলো”

এবার যেন মাথায় বাজ পড়লো সিদ্রার। নাম! তাইতো, উনার নাম কি? এতোগুলো দিন যার কাছে থেকে আসলাম, তার নামটা পর্যন্ত জানিনা আমি!

(চলবে)
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here