যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব ৭+৮

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

৭.
গাছের আড়াল হলেও চলে যায়নি লোকটা। তার ধারণা ছিল মেয়েটা পালাবে, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল সিদ্রা কি করে। তাড়াহুড়ো করে পাড়ে ওঠা আর বালতি নিয়ে ওর নাজেহাল অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসছিল।

তারপর যখন সিদ্রা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল, পিছু নিল ওর। আর যখন ও রাস্তা ছেড়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল, রাগতে শুরু করল লোকটা। আচ্ছা, তাহলে ঠিকই ভেবেছি! দেখছি, তুই পালিয়ে কতদূর যাস!

একটু পর যখন হাত থেকে বালতি পড়ে গেল আর এদিক ওদিক আঁকাবাঁকা করে পা ফেলতে লাগল, তখন বুঝল, মেয়েটা স্বাভাবিক নেই। দৌড়ে ওর কাছে যেতে না যেতেই আয়ায়াহ! করে একটা চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল মেয়েটা। লোকটা এসে দেখল একটা মোটা ডালে মাথা ঠুকে জ্ঞান হারিয়েছে সিদ্রা। আর পায়ে একটা শুকনা কাঁটাওয়ালা ডাল বিধে আছে। বুঝলো, কেন চিৎকার দিয়েছে সিদ্রা।

সিদ্রার গায়ে হাত দিতেই দেখল প্রচণ্ড তাপ বেরোচ্ছে গা দিয়ে। যা ভয় করেছিলাম, তাই! এতো ভারী জ্বালা হল! এজন্যই বলেছিলাম উঠে আসতে। আস্ত ত্যাঁদড় মেয়ে, সেই তো আমি দেখলামই ওর ভেজা জামাকাপড়। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানো।

প্রথমে টান দিয়ে কাঁটা ছুটাল লোকটা, রক্ত বের হল খানিকটা। তারপর বালতি থেকে হাতের চোলে পানি নিয়ে মুখে ছিটাল। ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়ে চোখ খুলল সিদ্রা। লোকটা ওর কথা বলার অপেক্ষা না করে আগের দিনের মত বাম কাঁধে সিদ্রাকে তুলে নিল। বুঝতে পারল, আগের দিনের থেকে কত হালকা হয়ে গেছে মেয়েটা। আজ আর বাধা দিলনা সিদ্রা, অবশ্য সেই হুঁশ থাকলে না দিবে।

ডান হাতে বালতিটা নিয়ে হাঁটা শুরু করল লোকটা। আরিব্বাস! গায়ের তাপে দেখি জামাকাপড় শুকিয়ে যাচ্ছে। একদিনেই মরে গেলে তো সব প্ল্যান মাটি হয়ে যাবে, জোরে পা চালাল লোকটা।

***
জ্বরের দুটো দিন স্বপ্নের মত কাটল সিদ্রার। কখনো খালার মুখ আবার কখনো ওই শয়তান লোকটার মুখ দেখতে পেল। আকুল হয়ে থাকল একটু মাকে দেখার জন্য।

জ্বরের ঘোরে সারাক্ষণ মা আর বোনকে নিয়ে প্রলাপ বকছে মেয়েটা। আর মাঝেমাঝে আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করছে। লোকটা আশা করছিল, জ্বরের ঘোরে কোন না কোন প্রেমিকের নাম নিশ্চয় মুখে আনবে মেয়েটা। কিন্তু ওর আশা ভঙ্গ করে কারো নামই মুখে আনেনি সিদ্রা। আস্তে আস্তে লোকটার বিশ্বাস দৃঢ় হল। এ মেয়ে আসলেই একটা খারাপ মেয়ে। মন থেকে কাউকেই ভালবাসেনি, সবার সাথে নাটক করেছে। কোন ভুল করিনি আমি, একদম ঠিক কাজ করেছি, ভাবল লোকটা।

***
তৃতীয় দিনে জ্বর পুরোপুরিভাবে ছাড়ল সিদ্রার। এ কয়দিন জ্বর না থাকলে ঘুমাতো, আর জ্বর থাকলে শুধু ভুল বকত। এ কয়দিনের কথা কিছুই মনে করতে পারছেনা ও। তবে মাঝেমাঝে খালা ওকে বাতাস করেছে, গা মুছিয়ে দিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে, এরকম মনে পড়ছে হালকা হালকা।

আজকে ঘুম ভেঙে দেখল খালা নিচে বিছানা করে শুয়ে আছে। ওর ওড়নার এক কোনা, খালার আচলের সাথে গিট্টু দেয়া। দেখে হাসল সিদ্রা, যাতে পালাতে না পারি তাই এ ব্যবস্থা নাকি। ওড়নাটা নতুন, খেয়াল করতেই গায়ের দিকে তাকাল, একই সেটের একটা জামা পায়জামা ওর গায়ে। খুবই নিম্নমানের কাপড়, তবু খুশি হল সিদ্রা। আর ওই ছেড়া শাড়ি কষ্ট করে পরতে হবেনা। অনেক পিপাসা লেগেছে ওর। বিছানা থেকে নামল পানি খাওয়ার জন্য। শাড়িতে টান পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল খালার।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মহিলা। হেসে দিল সিদ্রা।

“আপনি সবসময় ঘুম ভাঙলে এত চমকে উঠেন কেন?”

খালা কিছু বললনা, উঠে সিদ্রাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে নিজে পানি ঢেলে দিল ওকে। তারপর জ্বর আছে কিনা দেখল কপালে হাত দিয়ে। খালার মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠতেই সিদ্রা বুঝল যে ওর জ্বর নেই। ইশারা করে সিদ্রাকে এখানেই থাকতে বলল, আর আঁচলের গিটটা খুলে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। খালার কথা না শুনে সিদ্রাও উনার পেছন পেছন বের হয়ে এল।

বিকেলবেলার হালকা আলো ঢুকছে গাছের ফাঁক দিয়ে। মৃদুমন্দ বাতাসে মনটা ভাল হয়ে গেল সিদ্রার। ভাল করে একটু বাতাস খাওয়ার জন্য বারান্দা থেকে নিচে নামল সিদ্রা। ঘরে ফেরা পাখির জোর কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।

সিদ্রাকে বাইরে দেখে দৌড়ে আসল খালা, চোখে ভয়ের চিহ্ন। “আরে খালা, ভয় পায়েননা। পালাচ্ছিনা আমি” হেসে বলল সিদ্রা। “ঘরের ভেতরে দম বন্ধ লাগছিল, তাই একটু বাতাস খেতে আসলাম আর পালালেওবা, আমার যে গতি, আপনি তো আমাকে ধরেই ফেলবেন!”

খালার মুখ থেকে সন্দেহ দূর হলনা, কিন্তু আর জোর করলনা ওকে ঘরে যাওয়ার জন্য। বারান্দা থেকে চেয়ারটা নিচে এনে দিল বসার জন্য।

“থ্যাংকইউ” বলে চেয়ারে বসল সিদ্রা। একটু পর খালা এসে ওর হাতে একটা বাটি ধরিয়ে দিল। কিছু একটার স্যুপ হবে হয়তো, তরল জিনিসটা দেখতে তেমন সুস্বাদু লাগছেনা, কেমন যেন ঢ্যালঢেলে। ফু দিয়ে মুখে দিয়ে দেখল, স্বাদ তেমন খারাপ না। চুপচাপ খেয়ে নিল। বাটি নিয়ে গিয়ে গ্লাসে করে পানি আর ওষুধ এনে দিল খালা।

“বন্দী মানুষের জন্য এতকিছু নাইবা করলেন খালা, আমাকে তো আপনারা কষ্টই দিতে চান” গ্লাসটা নিতে নিতে বলল সিদ্রা। খালা কিছু বললনা, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ওর পাশে।

ওষুধ খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিল খালাকে। তারপর আরেকবার চেষ্টা করল,
“খালা, অন্তত আপনি আমাকে বলেন, আমার অপরাধটা কি? আমার কি এটুকু জানারও অধিকার নেই?” বরাবরের মত চুপ করে রইল খালা, শুধু আগের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টিটা নিক্ষেপ করলনা।

“আপনিও কি ওই লোকটার মত বিশ্বাস করেন, আমি একটা খারাপ মেয়ে? ওই লোকটা আমাকে যেসব অপবাদ দিচ্ছে, সেগুলা সত্যি বলে মনে করেন আপনি?

খালার মুখে একটা ইতস্তত ভাব ফুটে উঠল, যেন ডিসিশন নিতে পারছেনা। মুখে বেদনার হাসি ফুটে উঠল সিদ্রার।

“বুঝেছি খালা, আমিও বড্ড বোকা, আপনার মনিব আপনাকে যা বলবে, আপনি তো সেটাই বিশ্বাস করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক, আমাকে বিশ্বাস করার তো কোন কারণ নেই” গলাটা কেঁপে উঠল সিদ্রার। গাল বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

এসময় ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল, সূর্য ডুবে গেছে, বুঝল সিদ্রা। খালা ওকে ঘরে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিল। ঘরে যাওয়ার আগে অযু করতে বসল সিদ্রা। তখন মনে পড়ল ওইদিনের কথা, পানি নিয়ে ফেরার সময় পায়ে কাঁটা বিধল, তারপর কি হয়েছিল! জিজ্ঞেস করল সিদ্রা, “খালা, ওইদিন আপনি আমাকে নিতে গিয়েছিলেন, তারপর…… কিভাবে নিয়ে আসলেন আমাকে?”

না না করে উঠল খালা, তারপর ইশারায় ওকে বুঝিয়ে দিল, ওই লোকটা ওকে অজ্ঞান অবস্থায় বয়ে নিয়ে এসেছে।

“শয়তান লোক একটা, নিজেই আমাকে ওইরকম অবস্থায় ফেলবে, আবার নিজেই তুলে নিয়ে আসবে!” বিড়বিড় করে বলল সিদ্রা। তারপর খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু আপনি প্রতিদিন ঝর্ণা থেকে পানি নিয়ে আসেন?” মাথা ঝাঁকাল খালা।

অবাক হল সিদ্রা। “এতদূর থেকে পানি আনতে হয়! কতবার যাওয়া আসা করেন আপনি, এগুলো ভরতে?”

পুরো হাত উঠিয়ে দেখাল খালা। চোখ কপালে উঠল সিদ্রার, “পাঁচবার!”

“আর কালকে থেকে এই কাজটা তুই করবি” পেছন থেকে লোকটার গলা শুনতে পেল সিদ্রা।

তাড়াহুড়ো করে জামার হাতা দুটো নামিয়ে ফেলল সিদ্রা, ওড়নাটাও ঠিক করে নিল। “অবশ্য তুই যে আধা বালতি করে পানি আনিস, তোকে তো দশ-পনেরো বার যেতে হবে” হেসে উঠল লোকটা। এই হাসি শুনলে সিদ্রার গা পিত্তি একদম জ্বলে যায়।

“আমি যাবনা আনতে, কি করবেন আপনি?”

“এক্ষেত্রে আমাকে কিছুই করতে হবেনা, করবি তো তুই। গাছের পাতা আর ঢেলা দিয়ে বাথরুম করবি, আর খাবার পানি পাবিনা, সিম্পল!” বাঁকা স্বরে বলল লোকটা।

“আপনি একটা……….” রেগে আঙুল তুলে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সিদ্রা।

“কি, পাগল, সাইকো! ওয়ে………. বেটার দ্যান ইউ!! আর আমাকে পাগল, সাইকো যদি কেউ বানায় তো সেটা তুই!!! সো, জাস্ট শাট আপ।“

এরপর খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল থেকে সব কাজ ওকে দিয়ে করাবা, কিভাবে সেটা কালকে তোমাকে বলে দিয়েছি আমি। কিন্তু তুমি যদি ওর প্রতি মায়া দেখাও খালা, আমি কিন্তু টলেরেট করবনা। আই হোপ, তুমি ভুলে যাবানা, ও কার সাথে কি করেছে।“ মাথা ওপর নিচ করল খালা।

“কার সাথে কি করেছি আমি?” বলে উঠল সিদ্রা।

লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে “খালা, আসছি আমি” বলে আবার ঢুকে গেল বনের মাঝে।

“এই যে, কোথায় যাচ্ছেন, আমার কথার উত্তর দিয়ে যান” বলতে বলতে লোকটার পেছনে এগোল সিদ্রা। কিন্তু খালা ওর হাত ধরে আটকে ফেলল। হাত ইশারা করে না করল। তারপর ওকে ধরে টেনে এনে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। দৌড়ে গেল সিদ্রা জানালার কাছে। “খালা, আপনি বলেন, কার সাথে কি করেছি আমি? খালা, ও খালা” কোন উত্তর দিলনা খালা, সামনেও আসলনা।

এবার জানালার দিকে খেয়াল করল সিদ্রা। দুটো কাঠের টুকরো আড়াআড়ি করে লাগিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানেও একই অবস্থা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা, আমি কি পালিয়ে না গিয়ে খুব বেশি ভুল করেছি!
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

৮.
আজ অন্যদিনের মত খালাকে ডাকাডাকি করতে হলনা সিদ্রাকে। ওর আবার জ্বর আসতে পারে ভেবে খালা ওর ঘরেই নিচে বিছানা করে ঘুমিয়েছে। কিন্তু ঘুম ভেঙে পায়ে শিকল আবিষ্কার করল সিদ্রা, যার আরেক প্রান্ত ওর বিছানার সাথে আটকানো। রাগ হতে গিয়েও কি মনে করে আর রাগ করলোনা সিদ্রা, হয়তো এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে ও। খালাকে ডাকল,

“খালা, ও খালা, শিকল খুলে দেন, নামাজ পড়ব”

যথারীতি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল খালা। হকচকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে উঠে বাইরে গেল।

“আরে খালা, আমাকে না খুলে কই যাচ্ছেন আপনি?” বলে উঠল সিদ্রা। হাতে চাবি নিয়ে ফিরে আসল খালা। ও, আমি যেন হাতের নাগালে চাবি না পাই, তাই বাইরে রেখেছে, কত্ত সাবধানতা, মনে মনে বলল সিদ্রা।

কিন্তু সমস্যা এটা না, সমস্যা হল, বাথরুম করে এসে দেখল, ড্রামে পানি নাই। ঘরের জগেও যেটুকু পানি আছে, তাতে অজু হবেনা। এখন কি করবে, এ পরিস্থিতিতে তায়াম্মুম হবে কি হবেনা ভাবছিল সিদ্রা।

সমস্যার সমাধান দিল খালা। বালতি আর একটা টর্চলাইট নিয়ে এসে ইশারা করল পানি আনতে যাওয়ার জন্য। “কিন্তু খালা, এই অন্ধকারে……কিভাবে?” প্রশ্ন করল সিদ্রা। খালা ইশারা করল, কোন ব্যাপারই না এটা উনার জন্য। হতভম্ব হয়ে খালার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল সিদ্রা।

যখন ওরা ঝর্ণার কাছে পৌঁছল, তখন আকাশ সবে ফর্সা হয়ে এসেছে। সিদ্রা তো পুরা অবাক, খালা কিভাবে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা চিনল!

ঝর্ণার পানিতে নেমে অজু করল সিদ্রা। তাহাজ্জুদ তো গেছেই, এখন আর ফিরে গিয়ে ফজরও পড়ার সময় থাকবেনা, ঘাসের উপরেই পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ও। সবথেকে বেশি অবাক হল সালাম ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে। খালাও ওর পেছনে বসে আছে নামাযের আসনে, শাড়ির আঁচল মাথায় পেঁচিয়ে। সিদ্রা তাকাতেই খালা যেন একটু লজ্জা পেল। খুশিতে সিদ্রা দৌড়ে এসে খালাকে জড়িয়ে ধরল।

খালা ওকে ইশারায় বলল, উনি নামাজ পড়তে জানেননা, কিন্তু সিদ্রাকে নামাজ পড়তে দেখে উনারও ইচ্ছে হয়েছে নামাজ শেখার। সিদ্রা একটু ভাবনায় পড়ে গেল। বোবারা তো কথা বলতে পারেনা, সুরাও শিখতে পারবেনা, কোন দোয়াও না। তাহলে বোবাদের নামাজ পড়ার হুকুম কি, জানিনাতো আমি।

ওকে চিন্তা করতে দেখে খালা ইশারায় বালতিতে পানি ভরার কথা মনে করিয়ে দিল। সিদ্রা অনুরোধ করল, “খালা, আমি একটু এখানে থাকি, প্লিজ! কতদিন সূর্যোদয় দেখিনা!! আমি তো বেশি তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারিনা, আপনি বরং এই ফাঁকে এক বালতি পানি রেখে আসেন”

সন্দেহ ফুটে উঠল খালার চোখেমুখে, মাথা নাড়ল সজোরে।

হেসে দিল সিদ্রা, “আপনি ভাবছেন পালাব আমি? পালানোর শক্তি আছে নাকি শরীরে? এটুক এসেই তো হাঁপিয়ে গেছি। আপনি নিশ্চিন্তে পানি রেখে আসেন” সিদ্রার যুক্তি দেখানোতে খালার সন্দেহ আরো বাড়ল, কিছুতেই রাজি হলনা যেতে। একটু মন খারাপ হল সিদ্রার, খালা ওকে এতোটুকুও বিশ্বাস করতে পারেছেনা!

একটু পরেই আকাশ পুরোপুরি সাদা হয়ে গেল। পাহাড়ের পাশে ছোট একটা টিলা আছে, ওইদিন পানিতে থাকার সময় খেয়াল করেছিল। দৌড়ে গিয়ে ওইটার উপর উঠল সিদ্রা, ভালভাবে দেখার জন্য। ঠিক এই সময়েই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে সূর্য উঁকি দিল। শিশির ভেজা ঘাস আর ফুলগুলোর ওপর সূর্যকিরণ পড়ে ঝলমল করতে লাগল, যেন সদ্যস্নান করেছে ওরা। ঝর্ণার আর জলাশয়ের পানিও ঝিকমিক করছে আলো পড়ে।

কি অপরূপ সৃষ্টি আল্লাহ তোমার! নিজের অজান্তেই গুনগুন করে তেলাওয়াত করে উঠল সিদ্রা, “ফাবি আয়্যি আলায়ি রব্বিকুমা তুকাজ্জিবান” (তোমরা আল্লাহ্‌র কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?)

খেয়াল হতেই মনে হল, পুরো সূরাই তেলাওয়াত করে ফেলি। প্রথমে অনুচ্চ কন্ঠে শুরু করে আস্তে আস্তে আওয়াজ বাড়াতে লাগাল সিদ্রা। মধুর কন্ঠে সূরা রহমান তেলাওয়াত করতে থাকল। ওর সুমধুর তেলাওয়াত পাহাড়ের গায়ে লেগে পুরো বনে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সিদ্রা বিমুগ্ধ নয়নে কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে ওর জীবনের সবথেকে সুন্দর সূর্যোদয় উপভোগ করল।

তেলাওয়াত শেষ করে টিলার চারপাশ ভাল করে দেখার জন্য পেছন দিকে তাকাল সিদ্রা। সেখানে আরেকটা ছোট টিলা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সাইজটা একটু অদ্ভুত। কেমন লম্বাটে, আর উপরের মাটিগুলো কেমন ঝুরা ঝুরা, নতুন করে দেয়া হয়েছে মনে হচ্ছে কেন, ভাবল সিদ্রা। ভাল করে তাকাতেই বুঝে ফেলল ওটা কি! উত্তর দক্ষিণে লম্বা, তার মানে ওটা একটা কবর!!

উপরের মাটি আর ঘাসের সাইজ দেখে বোঝা যাচ্ছে কবরটা একদম নতুন। চারপাশে লাগানো ফুলগাছগুলোও বেশি বড় হয়নি, তার মানে কবরটা খুব বেশি হলে একমাসের পুরনো হবে। মাথায় ভয়ঙ্কর একটা চিন্তা আসল সিদ্রার। কবরটা আমারই মত একটা মেয়ের!

ওই মেয়েটাকে মেরে ফেলে লোকটা আমাকে ধরে এনেছে। আমি ঠিকই ধরেছিলাম। এই লোকটা মানসিক রোগী, ঠাণ্ডা মাথার খুনি! আমার নাম আর পরিচয় ছাড়া যা যা বলেছে, সব তো মিথ্যা, এসব তার মনগড়া। সে নিশ্চয় এভাবেই মেয়েদের ধরে এনে অত্যাচার করে খুন করে। আমাকেও একইভাবে মেরে ফেলে এমনি করে কবর দিয়ে দিবে! সিদ্রার এ চিন্তার পেছনে রিসেন্টলি পড়া সাইকো থ্রিলারগুলোর অবদান কম ছিলনা!

ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল সিদ্রার। না না করে মাথা নাড়তে নাড়তে পিছু হটতে লাগল, খেয়ালও করলোনা যে কিনারে চলে এসেছে। যা হবার তাই হল, ব্যালেন্স হারিয়ে উলটে পড়ে গেল সিদ্রা। ভয়ে চিৎকার দিল সিদ্রা, কিন্তু মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ একটা শক্ত হাতে ধরে ফেলল ওকে।

***
খালা আর সিদ্রা পানি আনতে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর চালাঘরে এসে পৌঁছল লোকটা। দুইজনের কাউকেই কোথাও দেখতে না পেয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে ভাবছিল কোথায় যেতে পারে ওরা। পানির ড্রামের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ঢাকনা খোলা, কাছে গিয়ে দেখল, খালি। পানি আনার বালতিটা কোথাও চোখে পড়ছেনা। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাল, দুজন মিলে পানি আনতে গেছে। বুঝতে পেরেই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল লোকটা।

প্রায় ঝর্ণার কাছাকাছি এসে গেছে, এমন সময় কানে আসল সিদ্রার সুমধুর তেলাওয়াত। আপনা থেকেই কান খাড়া হয়ে গেল লোকটার। আস্তে আস্তে যত এগোচ্ছে, তেলাওয়াত তত স্পষ্ট হচ্ছে। এত সুন্দর কন্ঠ, আর এত সুন্দর তেলাওয়াত, মুগ্ধ আবেশে সামনে এগিয়ে গেল লোকটা। গাছের আড়াল থেকেই দেখা যাচ্ছে সিদ্রাকে। দাঁড়িয়ে গেল লোকটা, ওর সামনে গিয়ে ওকে থামিয়ে দিতে চাচ্ছেনা।

টিলার উপর দাঁড়িয়ে প্রসন্ন মুখে কুরআন তেলাওয়াত করছে মেয়েটা। সূর্যের মিষ্টি কিরণ ওর ফর্সা মুখে পড়ে যেন ওকে আরো সুন্দরী করে দিয়েছে আর নতুন কিনে দেয়া হলদে রঙের জামা ওড়নায় ওকে যেন ঠিক একটা সদ্যফোটা ফুলের মত লাগছে। সিদ্রার অপরূপ সৌন্দর্য আর সুললিত কন্ঠের তেলাওয়াতের আবেশে যেন হারিয়ে গেল লোকটা। ভুলে গেল সবকিছ, সব রাগ, সব প্রতিশোধের কথা, সিদ্রা আর ওর তেলাওয়াত ছাড়া আর কোন কিছুই খেয়াল রইলোনা তার।

তেলাওয়াত থেমে যেতেই চমক ভাঙ্গল লোকটার। কিন্তু আবেশ এখনো কাটেনি, নড়েনি নিজের জায়গা থেকে। হঠাৎ খেয়াল করল, পিছাচ্ছে সিদ্রা। আরে, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে তো, নিজের অজান্তেই ছুটল ওকে ধরতে। কোনমতে শেষ মুহূর্তে দুহাত দিয়ে ধরে পতনের হাত থেকে বাঁচাল ওকে।

ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল সিদ্রা। চোখ খুলতেই ওই লোককে দেখে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল ও। লোকটাও ওর হঠাৎ চিৎকারে চমকে গিয়ে ফেলে দিল ওকে। মাটিতে পড়েই ভয়ার্ত চোখ নিয়ে পিছু হটল সিদ্রা। লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল সিদ্রা লোকটাকে, তারপর উল্টো ঘুরে দৌড় দিল বনের মধ্যে।

“আরে আরে, কি করছিস!” বলতে বলতে লোকটাও উঠে ছুটল সিদ্রার পেছন পেছন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পরপর এতগুলো ঘটনায় খালা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সম্বিত ফিরে পেয়ে উনিও লোকটার পিছু নিল।

জ্বরের জন্য তো এমনিই দুর্বল হয়ে আছে শরীর, বেশি দূর যেতে পারলনা সিদ্রা। একটু পরেই লোকটা ধরে ফেলল ওকে।

“এই, কি হল তোর হঠাৎ? এমন পাগলের মত ছুটছিস কেন?” ধরেই জিজ্ঞেস করল লোকটা।

কোন কথা না বলে লোকটার হাত ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল সিদ্রা, যেন ওর ওপর কিছু একটা ভর করেছে। লোকটা ওকে ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিল।

“ওই! কি হয়েছে তোর! এমন করছিস কেন? জ্বীনে ধরেছে নাকি?” থামল সিদ্রা, একটু যেন শান্ত হল।

“জ্বীনে তো আপনাকে ধরেছে। আপনি একটা মাথা খারাপ লোক, আপনি…..আপনি একটা খুনি!”

“কি! পাগল-সাইকো তো আগে থেকেই বলছিলি, এখন আবার খুনি কোথা থেকে আসল? দুইদিনের জ্বরে কি মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে তোর?” এখনো লোকটা ওর কথায় মজা নিচ্ছিল।

“খুনি নন আপনি? আমার মতই একটা মেয়েকে খুন করে আপনি ওইখানে কবর দিয়ে রাখেননি?” আঙুল তুলে দেখাল সিদ্রা।

এতক্ষণে বুঝল লোকটা কাহিনী কি, চোঁ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল তার। ঠাস করে একটা চড় মেরে সিদ্রাকে মাটিতে ফেলে দিল লোকটা।

“আমি খুনি? আমি?” উঠিয়ে আরেকটা চড় মারল। তারপর দুহাত দিয়ে ওকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “আরে খুনি তো তুই! তোর জন্য আমার ভাইটা আজ ওখানে শুয়ে আছে! শুধু তোর দুদিনের কিউরিসিটি মেটানোর মাশুল দিচ্ছে আমার ভাই ওখানে শুয়ে, আর তুই আমাকে খুনি বলছিস, আমাকে!” কিউরিসিটি শব্দটা কেমন মুখ বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গ করে উচ্চারণ করল লোকটা।

লোকটার কথায় হতভম্ব হয়ে গেল সিদ্রা, পরক্ষণেই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত হা হা করে হেসে উঠল, “এতদিন ছিল, আমি খারাপ মেয়ে, ছেলেদের সাথে প্রেম করে বেড়াই, আমার হাজারটা প্রেমিক, আর এবার আমি উনার ভাইকে খুন করে ফেলেছি” হা হা হা “আরে খুন করা তো দূরের কথা, আপনার ভাইকে আমি চিনিনা, জানিনা, দেখিনি পর্যন্ত!” হাসি থামিয়ে চিৎকার করে বলল সিদ্রা।

রাগে যেন উন্মাদ হয়ে গেল লোকটা, দুহাত দিয়ে সিদ্রাকে গাছের সাথে ঠেঁসে ধরল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনিসনা জানিসনা, এমনি এমনি দিনের পর দিন প্রেম করেছিস ওর সাথে!?”

ব্যাথায় কাতরে উঠল সিদ্রা।

“আমি কারো সাথে প্রেম করিনি, কতবার বলব আপনাকে?”

“আবার মিথ্যা কথা!” এই বলে লোকটা আবার মারতে যাচ্ছিল সিদ্রাকে, খালা এসে লোকটার হাত ধরে ফেলল।

লোকটা বিস্মিত হয়ে খালার দিকে তাকাল, “তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন? তুমিও কি এই মেয়ের দলে চলে গেলা নাকি!”

সজোরে হাত আর মাথা নাড়াল খালা। ইশারায় বলল, জ্বরের মানুষ, আর মার খেলে মরে যাবে।

হুঁশ ফিরল যেন লোকটার, ছেড়ে দিল ওকে। ধপ করে পড়ে গেল সিদ্রা, আগুন চোখে তাকাল লোকটার দিকে।

“ঠিকই বলেছো খালা, কিন্তু এই মিথ্যাবাদীকে শিগগীর আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও, নাইলে কি করতে কি করে ফেলব আমি জানিনা!” বলল লোকটা।

খালা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে সিদ্রাকে উঠাল। সিদ্রা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু খালা ওর মুখ চেপে ধরে কিছু না বলতে ইশারা করল। তারপর ওকে ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে লাগল ঘরের দিকে।

ওরা চলে যেতেই লোকটা ছুটে গেল কবরটার কাছে, হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিছুক্ষণ কান্নার পর একটু শান্ত হয়ে বলতে লাগল,
“ভাইরে, তুই দেখছিস তো, আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি। তোকে যে কষ্ট দিয়েছে, আমি কিভাবে তাকে শাস্তি দিচ্ছি। তুই শান্তি পাচ্ছিস তো ভাই! তুই কোন চিন্তা করিসনা, আমি ওই সিদ্রাতুল মুনতাহা কে এত সহজে ছাড়বোনা। ওকে আমি এভাবেই শাস্তি দিব, আজীবন শাস্তি ভোগ করবে ও আমার হাতে!” শেষের কথাগুলো যেন চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল লোকটা।

“কিন্তু তুই এমন একটা মেয়ের জন্য এরকম কাজ করলি, যে এখন তোকে চিনতেই অস্বীকার করছে! একবারও আমার কথা ভাবলিনা! ভাবলিনা, তুই চলে গেলে আমার কি হবে! আমাকে একা করে দিয়ে কেন চলে গেলি!” আবার চোখে পানি এসে গেল লোকটার।

“শুধু তুই যদি আমাকে একবার বলতি, আমি তোকে বুঝিয়ে দিতাম, এসব দুইটাকার মেয়ে তোর যোগ্য না। তুই আমাকে একবার কেন বললিনা ভাই।” হাতের মুষ্টি দিয়ে মাটিতে আঘাত করছিল লোকটা, “যে ভাই তুই চাইলে তোর জন্য সারা দুনিয়া হাজির করে দিতে পারে, সেই ভাইয়ের কাছে তোর মনের কথা কেন একবার মুখ ফুটে বললিনা ভাই, কেন…….?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here