যে গল্পের নাম ছিলো না পর্ব ১৫+১৬

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

১৫.
পরদিন দুপুরে আবার কলিংবেল বাজলো দরজায়। আগেরবারের মতই ছুটে গেল সিদ্রা, তবে নিশ্চিন্তে, ওকে আটকাবার কেউ নেই এখন, লোকটা চলে গেছে। কিন্তু, ছিটকিনিটা লাগানো নেই কেন? হ্যান্ডেল ধরে মোচড় দিতেই উত্তর পেয়ে গেল সিদ্রা, দরজা খুললনা। তার মানে চাবি দিয়ে লক করা হয়েছে আর শুধু চাবি দিয়েই খোলা যাবে এ দরজা। দরজায় এবার জোরে জোরে ধাক্কা পড়ল। আইহোলে চোখ রাখতেই আত্মা শুকিয়ে গেল ওর, লোকটা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। কাঁপা পায়ে পেছনে হটল ও, কপালে আজ দুঃখ আছে, বুঝে গেছে। দরজা খুলল খালা।

সিদ্রা কি করবে ঠিক করে বুঝে উঠার আগেই ওর সামনে যমদূতের মত হাজির হয়ে গেল লোকটা, দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। লোকটা এক পা আগায় আর ও এক পা পেছায়, এমন করতে করতে দেয়ালে গিয়ে ঠেকল সিদ্রা। লোকটা তার দুই হাত ওর দুই পাশে রেখে ঝুঁকল ওর দিকে, হাত দিয়ে যেন লক করে দিল ওকে।

“তোকে আমি কালকে নিষেধ করেছিলাম?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল লোকটা। ভয়ে ঢোক গিলল সিদ্রা।

“উত্তর দিচ্ছিসনা কেন? করেছিলাম?” এতো জোরে চিৎকার করল লোকটা, কেঁপে উঠলো সিদ্রা। কোনরকমে মাথা ওপর নিচ করলো ও।

“তাহলে শুনলিনা কেন আমার কথা?” একই স্বরে বলল লোকটা। সিদ্রা আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললো, দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে লাগলো লোকটার পরবর্তী অত্যাচারের জন্য। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে কোন আঘাত আসলোনা। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখল হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়েছে লোকটা, একটু স্বস্তি পেল ও।

“তোকে জঙ্গল থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি বলে কি তুই সাপের পাঁচ পা দেখেছিস?” হালকা পায়চারি করে বলল কথাটা, “ভুলেও ভাবিসনা, এতে তোর পালানোর পথ সুগম হয়েছে”

আবার কাছে এগিয়ে এল লোকটা, “তুই তোর বোনকে অনেক ভালবাসিস তাইনা? কি যেন নাম মেয়েটার। হ্যাঁ, সিরাজাম মুনিরা। কি, ঠিক বলেছি তো?” কালকের মত বাঁকা হাসি লোকটার ঠোঁটে।

সিদ্রা বুঝতে পারছেনা লোকটার কথা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে, কালকের আতঙ্ক আবার ফিরে এল, ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল ওর।

“এটা নিশ্চয় এতদিনে বুঝেছিস, আমি চাইলে কি কি করতে পারি। এখন, তুই যদি আমার কথা না শুনে কোন উল্টাপাল্টা কাজ করিস, তার খেসারত কিন্তু তোর বোনকে দিতে হবে! তখন কিন্তু আমাকে দায়ী করিসনা”

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল সিদ্রার, “এসব কি বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে আপনার? এতদিন ধরে আমাকে তো কষ্ট দিচ্ছেন, তাতেও আপনার শান্তি হচ্ছেনা? এখন এর মধ্যে আবার আমার বোনকে ঢুকাচ্ছেন!” রাগ আর আতঙ্ক স্পষ্ট ফুটে উঠলো ওর গলার স্বরে।

“আমি ঢুকালাম কখন! তোর হাতেই তো ছেড়ে দিলাম। তুই তোর বোনকে ঢুকাবি কি না, সেটা তো তোর মর্জির ওপর!! শুধু শুধু আমাকে দুষছিস কেন? তুই আমার কথামত চললেই তো তোর বোন এসবের মধ্যে ঢুকবেনা, সিম্পল!”

“আপনি…..আপনি আসলেই একটা অমানুষ!” রাগে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল সিদ্রার, “আমার আপনার জন্য একটু মায়া হয়েছিল, আপনার ভাইয়ের কথা শোনার পর। কিন্তু আজ আপনি প্রমাণ করে দিলেন, এসব আপনি কষ্ট থেকে করছেননা, মজা পাচ্ছেন আপনি এসব করে। মানুষের জীবন আর ইমোশন নিয়ে খেলে আপনি মজা পান। আপনি খারাপ! খুব খারাপ!” কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল সিদ্রা।

***
আজ এক সপ্তাহ হল সিদ্রার বাংলোতে আসা। সেদিনের পর সিদ্রা হয়ে গেছে আরো মনমরা, যদিও এখানে এসে বন্দীজীবন কিছুটা আরামদায়ক(!) হয়েছে ওর। দামী ফার্নিচারে মোড়া ঘর (যদিও সেগুলো ওর কোন কাজেই লাগেনা), বিশাল গদির বিছানা, ঘরের ভেতর আধুনিক বাথরুম, পেছনে বিশাল বারান্দা দিয়ে অসাধারণ চা বাগানের দৃশ্য। কোথাও ঘুরতে গিয়ে এমন একটা রুম পেলে হয়তো খুশিতে লাফাতো ও। কিন্তু বন্দীজীবনে হাজার আরামের ব্যবস্থা থাকলেও কি তাতে কোন সুখ থাকে!

কাজও অনেক কমে গেছে এখন, অন্তত বালতি বালতি পানি তো আর বইতে হয়না। তবে ঝর্ণাটা অনেক মিস করে ও। মাটির চুলাতে রান্নার কষ্টও নেই। বাড়তি কাজ এখন ঘর ঝাড়ু দেয়া আর মোছা। এতবড় ডুপ্লেক্স বাংলো, ওর জান বের হয়ে যায় মুছতে গিয়ে। তাও কপাল ভাল, অনেকগুলো ঘরই বন্ধ, সেগুলো ওকে মুছতে হয়না।

লোকটার ব্ল্যাকমেইলে সব আশা ভরসা হারিয়ে গেছে সিদ্রার। কোনকিছুর বিনিময়েই ও মুনিরার কোন ক্ষতি হতে দিতে পারবেনা। আমার সাথে তো যা হবার হয়েছেই, এখন মুনিরারও কিছু হলে আব্বু-আম্মু শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য আমার খোঁজ না পেয়েই যে কি অবস্থা, সেটাই তো জানিনা, ভেবেছে ও। সেজন্য পালানোর চিন্তা পুরোপুরি ত্যাগ করেছে সিদ্রা। শুধু একটা আশার আলো ধিকিধিকি জ্বলছে ওর মনে, “সত্য”। আসল সত্যিটা জানতে হবে, যার কারণে ও ঢুকে গেছে এই চক্রব্যূহে। শুধুমাত্র তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। ও নিশ্চিত, লোকটার ঘরেই পাওয়া যাবে সব প্রশ্নের উত্তর, কারণ ওই ঘরে ঢুকা ওর একদম নিষেধ।

প্রতি মোনাজাতে এখন শুধু একটাই প্রার্থনা করে ও, আল্লাহ্‌ আমাকে সত্যের সন্ধান দাও। অবশেষে আল্লাহ্‌ ওর দোয়া কবুল করলেন।

***
মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘর থেকে বের হতে যাবে, লোকটার গলার আওয়াজ পেল, কার সাথে যেন কথা বলছে। উঁকি মারল সিদ্রা, দেখল লোকটা চাবি দিয়ে নিজের ঘরের দরজা লক করছে। পরনে নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি, এই প্রথম লোকটাকে পাঞ্জাবি পরতে দেখল ও। বেশ ভাল দেখাচ্ছে তো, মনে মনে বলল সিদ্রা। বাম কানে ফোন ধরা লোকটার, কাকে যেন বলছে, “এইতো রেডি হয়ে গেছি, দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব, চিন্তা করিসনা”।

কথা বলতে বলতেই চাবিটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকাল লোকটা। কিন্তু বিস্ময়ে হা হয়ে দেখল সিদ্রা, চাবিটা পকেটে না ঢুকে নিচে পড়ে গেছে। ডোরম্যাটের উপর পড়েছে বলে শব্দও হয়নি। লোকটাও খেয়াল না করে গটগট করে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। লোকটা চোখের আড়াল হতেই ল্যান্ডিংএ ছুটে এল সিদ্রা। নিচে তাকিয়ে অপেক্ষা করল বাইরের গেইট বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা পর্যন্ত।

উত্তেজ্জনায় হাত কাঁপছিল সিদ্রার, দরজা খুলতে প্রয়োজনের থেকে বেশি সময় নিয়ে ফেলল। ঘরে ঢুকেই লাগিয়ে দিল দরজাটা, বাইরে থেকে যেন কেউ বুঝতে না পারে। আন্দাজে হাতড়ে লাইট জ্বালাল সিদ্রা আর হা হয়ে গেল একদম। ও যেই ঘরে থাকছে, তার থেকে দ্বিগুণ বড় ঘরটা আর আরো অসাধারণ আর দামী সব ফার্নিচারে মোড়া। টিভিতে যেমন বড়লোকদের বেডরুমগুলো দেখা যায়, ঠিক তেমন।

বিশাল একটা বিছানা, সাইড টেবিল, এক দেয়ালের প্রায় পুরোটা জুড়ে আলমারি, ডানসাইডে জানালার পাশে একটা কাউচ, তার পাশেই সোফাসেট সাজানো, বামদিকে ড্রেসার, স্টাডি টেবিল, কি নেই ঘরে। আর সবকিছু একদম ছবির মত পরিপাটি করে সাজানো, যেন ধরলেই নষ্ট হয়ে যাবে। বিছানার মাথার কাছের দেয়ালে একটা বিশাল ছবি, হাসিমুখে তাকিয়ে আছে দুইটা ছেলে, একজন তো এই লোকটা, আরেকজন নিশ্চয় উনার ভাই। কি সুন্দর মিল দুই ভাইয়ের চেহারায়। ভাবতেই কষ্ট লাগছে ছেলেটা আর এ পৃথিবীতে নেই, আর তার জন্যই আমি আজ এখানে!

এসব করতেই সিদ্রা নষ্ট করে ফেলল মূল্যবান কিছু মুহূর্ত। দেখা শেষ হতেই ভাবতে লাগলো, কোথা থেকে খোঁজা শুরু করবে। বিশাল স্টাডি টেবিলটাই বেস্ট চয়েস, এগোল সিদ্রা। টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনটা দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত অবস্থা হল ওর। কিন্তু রিসিভারটা তুলতেই লোকটার হুমকির কথা মনে পড়ে গেলো, কোনকিছু করলে তার দাম মুনিরাকে চুকাতে হবে। কিন্তু ফোন করলে লোকটা তো আর জানতে পারবেনা। নাহ! পারবে, কল হিস্ট্রি চেক করলেই বুঝে যাবে। ফোন করবে নাকি না, এ চিন্তাতেও চলে গেল আরো কিছু সময়। শেষ পর্যন্ত বুকে পাথর চেপে রিসিভারটা রেখে দিলো ও।

জোর করে মনযোগ আনলো যেজন্য ঘরে ঢুকেছে তার প্রতি। কাগজপত্র আর ফাইল দিয়ে ভরা পুরো টেবিল। এত গোছানো মানুষের টেবিল এত অগোছালো কেন বুঝে আসলনা ওর। সবার উপরে লাল কালিতে লেখা “PROJECT X” নামক ফাইলটা ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ফাইলটা খুলতেই দুচোখ বিস্ফোরিত হল সিদ্রার। এগুলো কি দেখছি আমি! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা ও। সারা শরীর অবশ হয়ে গেল ওর, পড়ে গেল ফাইলটা হাত থেকে।

পাগলের মত পড়ে যাওয়া ছবিগুলো দেখতে লাগলো সিদ্রা। এটা কিভাবে সম্ভব! ছবির ভেতর থেকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ও। হ্যাঁ, অন্য কেউ হয়তো সেটাই ভাববে, কিন্তু সিদ্রা নিজে খুব ভাল করেই জানে, এগুলো ওর ছবি না, এগুলো ওর জমজ বোন মুনিরার ছবি!

এখানকার কতগুলো ছবি ও নিজেই তুলে দিয়েছে মুনিরার জোরাজুরিতে। এইতো সেদিন বলেছিল, আয় আমরা দুজনে শাড়ি পরি। তারপর ছবি তোলার জন্য কত রিকোয়েস্ট! তবে কি এই ছেলেকে দেয়ার জন্যই ছবিগুলো তুলেছিলি তুই!!
তুই মুনিরা, তুই! তুই দায়ী এই ছেলেটার এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য!! ফারহানের ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো সিদ্রার। তোর এত অধঃপতন হয়েছে, আমি তোর বোন হয়ে বুঝতেও পারিনি, চোখ মুছল সিদ্রা। দেখি, আর কি কি আছে এখানে, ছবিগুলো সরাতেই পেয়ে গেল কনভারসেশন এর প্রিন্টগুলো। সবার উপরে যেটা ছিল, পড়তে শুরু করল সিদ্রা।

:ফ্রেন্ড কে নাম বলবানা, এটা কেমন কথা

:নাম দিয়ে কি হবে, ফ্রেন্ড হয়েছি এটাই কি বড় না?

:ও আচ্ছা বিলিভ করতে পারছোনা!
যদি বিলিভই না করো, তাইলে কিসের ফ্রেন্ডশিপ!
ঠিক আছে, যাও
এমন ফ্রেন্ড লাগবেনা আমার
আর জ্বালাবোনা তোমাকে
ভাল থেকো 🙂

:এই পাগল, রাগ করছো কেন?
এই
মেসেজ সিন করে উত্তর দিচ্ছোনা কেন?
😡
আচ্ছা বাবা বলছি, আর রাগ করতে হবেনা
আমার নাম সিদ্রাতুল মুনতাহা
এবার হ্যাপি?

নিচে আরো কিছু মেসেজ ছিল, কিন্তু দেখতে পেলনা সিদ্রা। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেছে সবকিছু। গোটা দুনিয়া যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। এসব কি দেখছে ও? ওকে এই চক্রব্যূহে ঢুকিয়েছে ওরই বোন, বিশ্বাস করতে যে বুক ফেটে যাচ্ছে। আর কি দেখবে? কি আছে দেখার? সব প্রশ্নের এমন জবাব পেয়েছে, যা না পেলেই ভাল ছিল। এমন জবাব তো আমি চাইনি আল্লাহ্‌! কান্না উথলে আসল ওর।

তবু চোখ মুছে পরের পেজে গেল সিদ্রা। আগের কথার সাথে ধারাবাহিকতা নেই। এখানে ও কোথায় পড়ে এর জবাবে মুনিরা বলেছে সিদ্রার মাদ্রাসার নাম। তার পরের পেজে মুনিরার মোবাইল নাম্বার আছে। মনে পড়ল সিদ্রার, প্রায় দুমাস আগে মুনিরা ওর এই নাম্বারটা অনেক ছেলেরা ডিস্টার্ব করে বলে বন্ধ করে দিয়েছে। ইম্পরট্যান্ট ইনফরমেশন ওয়ালা পাতাগুলো উপরে রেখেছে লোকটা, বুঝলো ও। পাতা উল্টাল আবার। এবার ছিল শেষ মেসেজের পাতাটা। লোকটার কথায় কথায় কিউরিসিটি মেটানোর উল্লেখ করার কারণ এবার বুঝতে পারল সিদ্রা।

এত মোটা একটা ফাইল, কতদিন ধরে করেছিস এসব তুই মুনিরা! এটা পুরোটা পড়া সম্ভব না এখন, আর নিয়ে গেলে আবার রাখতে আসার সুযোগ পাওয়া যাবেনা হয়তো, ধরা পড়ে যাবে ও। যা জানার, তাতো জেনেই গেলাম, আর পড়ে কি হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইলটা গুছিয়ে আবার আগের মত করে রেখে দিল সিদ্রা। চাবিটা ডোরম্যাটের ওপর রেখে কোনমতে পা টেনে টেনে ফিরে গেল নিজের ঘরে। বিছানার সামনে গিয়ে শরীরটা ছেড়ে দিল।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিগত কয়েক মাসের টুকরো টুকরো স্মৃতি! মুনিরার সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা, মাঝে মাঝে ও আসলেই ফোনের কথা থমকে যাওয়া, দুই মাস আগে ওর একটু অস্বাভাবিক আচরণ, মন খারাপ করে থাকা, সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে এখন। সবগুলো মেসেজ পড়তে পারলে আরো ভালভাবে বুঝতে পারতো, মুনিরার দোষ আসলে কতখানি ছিল। কিন্তু, পাপ তো করলি করলি, মিথ্যে নাম যখন বললিই, তখন আর কোন নাম পেলিনা! আমার নাম দিয়ে কেন আমার জীবনটাকে নষ্ট করলি তুই!! অথচ আমি তোকে বাঁচানোর জন্য পালানোর চিন্তা বাদ দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছি। আর সামলাতে পারলোনা সিদ্রা, এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কষ্টের যেন বাঁধ ভেঙে গেল, জোরে জোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল ও।
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা

– Farhina Jannat

১৬.
শৈশবের এক বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছে রাইয়্যান। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে পকেটে গাড়ির চাবি ঢুকাতে গিয়ে খেয়াল করল ঘরের চাবিটা নেই। কি হল? স্পষ্ট মনে আছে, চাবি ঢুকালাম পকেটে, কোথায় পড়লো? গাড়ির ভেতরে আতিপাতি করে খুঁজল, নেই। বাইচান্স যদি বাসার ভেতরে পড়ে থাকে আর মেয়েটা পেয়ে যায়, তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। ঘরে টেলিফোন আছে, কম্পিউটারে ইন্টারনেট কানেকশন আছে, যদি কোথাও খবর পাঠিয়ে দেয়!

তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে বাংলোয় ফিরল রাইয়্যান। দুই তিন সিঁড়ি একসাথে বেয়ে উপরে উঠতেই দেখল সিদ্রা ঢুকছে নিজের ঘরে, গতিটা কেমন যেন মন্থর। নিজের ঘরের সামনে এসে হাঁফ ছাড়ল, যাক! ভাগ্যিস মেয়েটা খেয়াল করেনি। তাও একবার চেক করে দেখি সব ঠিক আছে কিনা, ভাবল রাইয়্যান। ঘরে ঢুকার একটু পরেই সিদ্রার কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে ঘর থেকে বের হল ও।

দরজাটা ভেজানো ছিল, কারণ রাইয়্যান ভেতর থেকে দরজা লাগানোর সিস্টেমই নষ্ট করে দিয়েছে, এখন শুধু বাইরে থেকে লাগানো যায়। ফারহানের কান্ড দেখে শিক্ষা হয়েছে ওর, ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আবার এই মেয়েও একই কাজ করবে, তার রিস্কই রাখেনি। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, সিদ্রা বালিশ আকড়ে ধরে কান্না করছে। এতদিনে ওকে অনেকবার কাঁদতে দেখেছে রাইয়্যান। কিন্তু আজকের কান্নাটা যেন একদম আলাদা। মেয়েটার কান্নাতে এত বিষাদ আগে তো ছিলনা, মনে হচ্ছে যেন ওর সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কি হল ওর, আমি তো কিছু করিনি, ভাবল রাইয়্যান।

ভাবতে ভাবতেই ঢুকে গেল ঘরে, “এই, এমন পাগলের মত কাঁদছিস কেন? হঠাৎ করে কি হল তোর?” উদ্বেগের সাথেই জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান।

“কেন? আমাকে আটকে রেখেছেন বলে কি আমি নিজের ইচ্ছামতো কাঁদতেও পারবোনা? সেজন্যেও আপনার অনুমতি নিতে হবে?” সিদ্রার অশ্রুভেজা চেহারা দেখে আর এমন জবাব শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল রাইয়্যান।

“না মানে, আমি সেটা বলিনি…………” থেমে গেল রাইয়্যান। আশ্চর্য তো, আমি এত কনসার্ন হচ্ছি কেন? আমি তো চেয়েইছিলাম ও কষ্ট পাক, কিন্তু এভাবে ওকে কাঁদতে দেখে আমার এত খারাপ লাগছে কেন!

ওর মনের কথা যেন পড়ে ফেলল সিদ্রা। বলল,
“আপনি তো আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে চেয়েছিলেন, দেখুন, দুচোখ ভরে দেখুন। নিজের কান্নায় নিজের না হোক, অন্য কারো কষ্টই নাহয় কমুক” দুহাতে মুখ ঢেকে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সিদ্রা।

এসময় খালা কোথা থেকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল সিদ্রাকে, সিদ্রা অন্যদিনের মত ধরলনা উনাকে, শুধু ওর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। ইশারায় জানতে চাইল রাইয়্যান, খালা কিছু জানে কিনা। মাথা নাড়ল খালা, আরো চিন্তায় পড়ে গেল ও। এসময় ওর বন্ধু আবার ফোন করতেই মনে পড়ল বিয়ের কথা, সিদ্রার চিন্তা মাথায় নিয়েই এগোল ও সিঁড়ির দিকে।

***
সিদ্রার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাইয়্যান। এইমাত্র ফিরেছে ও, বুঝতে পারছেনা, ভেতরে ঢুকবে কিনা। নিজের ব্যবহারে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে রাইয়্যান, আগে তো কখনো ওর ঘরে ঢুকতে হেজিটেট করিনি, তাহলে আজকে কেন!

অনুষ্ঠানে একটুও মনোনিবেশ করতে পারছিলোনা রাইয়্যান। বারে বারে সিদ্রার কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে। শেষমেশ আগেভাগে খেয়ে নিয়ে বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফেরার রাস্তা ধরেছে।

সাবধানতার সাথে নিঃশব্দে দরজাটা ঠেলল রাইয়্যান। অন্ধকারে বুঝার চেষ্টা করল, সিদ্রা কোথায় কি করছে। বুঝতে না পেরে আলো জ্বালল, অবাক হয়ে গেল ও। ঘরে ফ্যান চলছেনা, এসি চলছেনা, আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। এত শীত তো এখনো পড়েনি, জ্বর আসল নাকি? দেখবো হাত দিয়ে? না থাক! যেই মেয়ে, ঘুম ভেঙে গেলে পরে আমাকেই চরিত্রহীন বানিয়ে দিবে! ওর ঘুমন্ত চেহারাটা কখনো দেখতে পেলামনা, কিভাবে যে এই গরমেও সবসময় মাথা মুখ সব ঢেকে ঘুমিয়ে থাকে, আল্লাহ্‌ মালুম!! হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালাগুলো আর বারান্দার দরজাটা খুলে দিল। আলো নিভিয়ে বেরিয়ে এল আগের মতই নিঃশব্দে।

কম্বলে মোড়া শরীরটা উঠে বসল বিছানায়। সিদ্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে, এতক্ষণ কাঠ হয়ে পড়ে থেকে ঘামছিল কম্বলের ভেতরে। অবাক হয়ে খেয়াল করল, ঘরটা এরই মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

***
সকালবেলা সিদ্রাকে নাস্তার টেবিলে দেখতে পেলনা রাইয়্যান। খালাকে দিয়ে ডেকে আনাল ওকে, দেখল চোখদুটো ফোলাফোলা, মুখটা এখনো থমথমে হয়ে আছে। চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে নাস্তা করতে বসতে বলল ওর সাথে।

“আমি রোজা রেখেছি” না বসে উত্তর দিল সিদ্রা।

“কি? রোজা? আজ তো শনিবার”

“তাতে কি হয়েছে? শনিবারে কি রোজা রাখা নিষেধ?”

“তুই তো সোমবার আর বৃহস্পতিবার রোজা রাখিস, খালার কাছে শুনেছি। তাহলে আজকে কেন হঠাৎ?”

“এটা আইয়্যামে বিজের রোজা”

“কিসের রোজা?”

“আইয়্যামে বিজের”

“মানে কি এর?”

“শুভ্র দিবসগুলী”

“তো এর সাথে রোজা রাখার কি সম্পর্ক!?”

উফ! রোজা রেখেছি তো রেখেছি, তা নিয়ে এত কথার কি আছে। মন মেজাজ ভাল নেই আর এই লোকটা শুধু শুধু প্যাঁচাল পাড়ছে!! মনে মনে বলল সিদ্রা। পরক্ষণেই ভাবলো, থাক দ্বীনের একটা বিষয় হলেও তো জানানো হচ্ছে। বলল,
“আরবি মাসের ১৩, ১৪ আর ১৫ এই তিনদিন চাঁদের আলো সবথেকে বেশি থাকে, তাই এই তিনদিনকে আইয়্যামে বিজ বলে। রাসূল (স) এই তিনদিন রোজা রাখতেন, এটাকেই আইয়্যামে বিজের রোজা বলে। তিনি জীবনে কখনো এই রোজা বাদ দেননি। বছরভর প্রতি মাসে এই তিনদিন রোজা করলে সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়”

“তার মানে পরপর তিনদিন রোজা রাখবি তুই?”

ঘাড় নেড়ে সায় দিল সিদ্রা।

“নিজের শরীরের দশা দেখেছিস? শুকিয়ে তো এমন অবস্থা হয়েছে জোরে বাতাস লাগলে পড়ে যাবি, এসব রোজা টোজা করতে হবেনা, খেতে বস”

“আপনার কথায় নাকি? যা কিছু বলছেন মেনে নিচ্ছি বলে মনে করবেননা আমার নামাজ রোজার উপরেও আপনি খবরদারি করবেন। ভুলেও সে চেষ্টা করবেননা! আমার নামাজ রোজায় বিন্দুমাত্র ব্যাঘাতও আমি মেনে নিবোনা” শক্ত কণ্ঠে বলল সিদ্রা। সিদ্রা যখন এভাবে কোন কথা বলে, রাইয়্যান তখন কোন উত্তর খুঁজে পায়না, আজও সেটাই হল। কিছুক্ষণ পরে আবার জিজ্ঞেস করল,
“সেহরিতে কি খেয়েছিস?”

“কি আবার খাবো? পানি খেয়েছি”

“কি? পানি খেয়ে রোজা রাখে মানুষ? তুই কি মরে গিয়ে আমাকে খুনি বানাতে চাচ্ছিস?”

“আস্তাগফিরুল্লাহ! মরতে যাবো কেন?”

“এভাবে না খেয়ে খেয়ে শরীর দুর্বল হবে, নানান অসুখ করবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যাবে, তারপর বড় কোন অসুখ হবে আর বড় অসুখ করলে তো মরেই যাবি, নাকি?” লোকটার বিশ্লেষণ শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো সিদ্রা।

“কপালে মরণ থাকলে মরবো, এত চিন্তার কি আছে” কিছুক্ষণ পর বলল ও। এমনিতেও বেঁচে থেকে আর কি হবে, এ জীবনের সবকিছুই তো শেষ হয়ে গেছে আমার, এখন শুধু আখিরাত নিয়েই ভাবনা, মনে মনে বলল ও।

“তোর না থাকলেও আমার আছে, নিজের গায়ে খুনির তকমা লাগানোর শখ লাগেনি আমার। খালা, ও যে ঠিকঠাক সেহরি খায়না, তুমি সেটা দেখোনা?”

খালা জানাল অন্যদিনগুলোতে উনি খাবার রাখেন, কিন্তু সিদ্রা আজকে রোজা রাখবে সেটা ও আগে বলেনি, সেজন্য এমনটা হয়েছে।

“এরপর যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়” দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বলল রাইয়্যান।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো খালা।

এহ! খুনির তকমা লাগানোর শখ লাগেনি! কিডন্যাপার হয়ে বসে আছে, সেটা কিছু না, যতসব হাস্যকর কথাবার্তা!! রাইয়্যান খাওয়া শেষ করে উঠে গেলে বিড়বিড় করে বলল সিদ্রা।

***
দিন কেটে যাচ্ছে নিজস্ব গতিতে। সিদ্রা পুরো রোবট হয়ে গেছে, ওর ওপর দেয়া কাজগুলো নিঃশব্দে করে যায় প্রতিদিন। প্রথম প্রথম মুনিরার ওপর খুব রাগ হয়েছিল ওর, কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেকে বুঝিয়েছে। মুনিরা তো আর জানতোনা, ছেলেটা এমন একটা কাজ করবে। ও নিশ্চয় ছেলেটার পাগলামি আঁচ করতে পেরেছিল, সেজন্যই সরে গেছে, ওর লাস্ট মেসেজটা দেখে এমনটাই মনে হয়েছে ওর। আর বাকি রইল ওর নাম বলা, সেটা কেন করেছে যদিও জানেনা ও। কিন্তু মুনিরা যদি জানতো ও এমন বিপদে পড়বে, তাহলে যে ওর নামটা বলতোনা, এটুকু বিশ্বাস বোনকে করে সিদ্রা। পুরোটাই তাই নিজের ভাগ্য আর আল্লাহর পরীক্ষা বলে মেনে নিয়েছে।

আর মুনিরা যদি নিজের নাম বলতো, তাহলে আজ আমার যায়গায় ও এখানে এই অবস্থায় থাকতো! না না, আল্লাহ্‌ আমাকে ওর থেকে অনেক বেশি সহ্যশক্তি দিয়েছেন। ও এসব কিছুতেই সহ্য করতে পারতোনা, আর তার উপরে নিজের অপরাধবোধে দুমড়ে চুমড়ে অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতো। তার থেকে এই অনেক ভাল হয়েছে, আল্লাহ্‌ যা করেন সব ভালোর জন্য করেন।

কাজ শেষ করে বাকি সময়টা রাইয়্যান এখানে না থাকলে বাগানে বা নিচে ড্রয়িংরুমে কাটায় সিদ্রা আর রাইয়্যান থাকলে নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে। রাইয়্যান নিজে থেকে না ডাকলে ওর চেহারা দেখা তো দূরের কথা, ওর অস্তিত্বের জানানটাও পায়না। খালার কাছে শুনেছে, খাওয়া দাওয়া এত কমিয়ে দিয়েছে, খালা জোর করলেও খেতে চায়না। এজন্য ও এখানে থাকলে প্রতিবেলায় নিজের সাথে বসিয়ে জোর করে ইচ্ছেমত খাওয়ায় ওকে, মাঝেমাঝে কান্নাও করে দেয় সিদ্রা, গুরুত্ব দেয়না রাইয়্যান।

সেদিন সকালবেলা নাস্তার পরে রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে সিদ্রা। আগেরদিন রাতে ফিরেছে রাইয়্যান। লোকটা এখানেও সবসময় থাকেনা, টি এস্টেট ছাড়াও মনে হয় আরো বিজনেস আছে উনার। থাকলেও বা, আমার কি? আনমনে এসব ভাবছিল সিদ্রা।

এদিকে টি এস্টেটের ম্যানেজার বাসায় এসেছে রাইয়্যানের কাছে কি একটা জরুরি কাগজে সাইন করাতে। সিদ্রাকে এখানে নিয়ে আসার পর থেকে সব কাজ টি এস্টেটের অফিসেই করে রাইয়্যান, বাসায় কাউকে আসার স্কোপই দেয়না। কিন্তু আজকে ম্যানেজার নিজে থেকে চলে আসায় কিছু বলতে পারেনি। রাইয়্যান ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিল, ওর ধারণা খালা আছে রান্নাঘরে, উনি সিদ্রাকে এখানে আসতে দিবেননা, কিন্তু আসলে খালা রান্নাঘরে ছিলইনা।

ম্যানেজার যখন আসে, রাইয়্যান দরজার বাইরেই ছিল, ওর সাথেই বাসায় ঢুকেছে। কলিংবেলও বাজেনি, সিদ্রা জানেওনা কেউ এসেছে। ও নিশ্চিন্তে চা নিয়ে যাচ্ছে রাইয়্যানকে দিতে, ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখল সোফায় অন্য লোক বসে আছে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসল ও।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সিদ্রা। দোয়া করছে প্রাণপণে, ওই নতুন লোকটা যেন ওকে দেখে না ফেলে। তাহলে ইনি যে ওকে কি করবেন, আর মুনিরার কি করবেন, সেটা ভেবেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে ওর। কান পেতে দুজনের কথা শুনছিল সিদ্রা, যখন শুনল লোকটা বলছে, “আচ্ছা স্যার, আমি তাহলে আসি” হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সিদ্রা।

কিন্তু একটু পরেই আবার ওই নতুন লোকের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। শুনতে পেল সিদ্রা, ম্যানেজার বলছে, “স্যার উনি কে ছিলেন?” হাত পা কাঁপতে শুরু করল সিদ্রার।

(চলবে)
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here