যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব -৪৪+৪৫ ও শেষ

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৪

ঈশানী মোহকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলো। কেটে গিয়েছে কত গুলো বছর। কীভাবে বদলে গেছে জীবন! সেসব ভেবে ঈশানীর কান্নার বেগ বাড়ল। মোহ তখন হতবিহ্বল হয়ে শুধু মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। তার বিস্ময় কাটতে চাইছে না। এতদিন পর নিজের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী যাকে জীবিত দেখার কথাই নয় তাকে সরাসরি দেখতে পারছে সে। অনুভব করতে পারছে তার স্পর্শ। মোহের মনে তখন রাজ্যের কৌতূহল। সে ঈশানীকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রেখে অবাক হয়ে শুধাল,
“এতগুলো বছর কেটে গেছে ঈশানী! তুই জীবিত আছিস? কখনো ভাবিনি। তুই যোগাযোগ করলি না কেন কারোর সাথে? না আমার সাথে, না তোর মামা-মামীর সাথে। কেন এমনটা করলি?”

ঈশানী কাঁদতে কাঁদতে মাথা নুইয়ে বলল,
“তোকে কী করে বোঝাব? কোন মুখে বলব? সবই আমার বাধ্যবাধকতা ছিল। আমাকে মিথ্যে বলা হয়েছিল। এতদিন মিথ্যার রাজ্যে বসবাস করে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু মেনে নিয়েছিলাম।”

মোহ ভ্রু কুঁচকায়। টলমল চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,
“তোর কথার অর্থ বুঝিনি।”

ঈশানী চোখ বুঁজে নিজের সকল লজ্জা এড়িয়ে বলল,
“আমার ভালোবাসা আমাকে প;তিতা বানিয়ে ছেড়েছে। পুরো আড়াই লাখ টাকাই নিষি’দ্ধপ/ল্লীতে ব্রিকি করা হয়েছে আমায়। এই পাঁচটা বছরে কতগুলো পুরুষ আমাকে ছুঁয়েছে তার হিসাব আমার কাছে নেই। আমি অপবিত্র। আমার স্থান ডাস্টবিনে। কিন্তু আমি পালিয়েছি। শুধু একটাই উদ্দেশ্যে পালিয়েছি সেটা হচ্ছে আরিদ্রকে খু/ন করতে চাই আমি। আজ নতুন সব মেয়েদের অন্য জায়গায় পাঠানো হচ্ছিল তার মাঝে আমি ঢুকে পড়েছিলাম। তারা জানতে পেরে গেছিল। ততক্ষণে আমি পল্লীর বাহিরে। সবটা দিয়ে ছুট লাগিয়ে আসতে তোর সাথে দেখা হবে ভাবিনি৷”

“ওই জা/নোয়ার তোকে ওই জায়গায় বিক্রি করে দিলো আর তুই মেনে নিলি? একবার তো খবর দিতে পারতিস। কিছু না কিছু করতাম। আমি তোর খোঁজ করেছি কত জানিস?”

ঈশানী নিজের বুকের একপাশে হাত রেখে শুষ্ক এবং কাঁপা ঠোঁটজোড়া দিয়ে বলল,
‘আমার সন্তানের জন্য আমি চুপ করে ছিলাম বিশ্বাস কর। আরিদ্রকে আমি দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বাস করি এই ভেবে আমার বাচ্চা তারও বাচ্চা। সে বলেছে আমি নিজের করুণ সেই দশা মেনে নিলে সে আমাদের বাচ্চাকে সুন্দর করে বড়ো করে তুলবে। কিন্তু কয়দিন আগে জানলাম আমার বাবু নেই তার কাছে। সেদিন সে হসপিটালে খোঁজ নিতে যায়নি। বাবুর বেঁচে আছে নাকি নেই সেটার খোঁজও সে রাখেনি। আমার বাবু আর বেঁচে নেই। ও মে/রে ফেলেছে।”

ঈশানীর বুক কাঁপল নিজের সন্তান নিয়ে এ কথা বলতে। ফের শব্দ করে কাঁদল সে। মোহ একবার ইথানের গোল চেহারার দিকে চাইল। ইথানের চোখেমুখে বিস্ময়। হয়ত ঈশানীকে চেনার চেষ্টা করছে। তার বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে একনজরে ঈশানীকে দেখে যাচ্ছে সে৷ মোহ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে ঈশানীর দুটো হাত চেপে ধরল শক্ত করে। ঈশানী তার চোখের দিকে চাইল কান্না থামিয়ে। মোহ থেমে থেমে বলল,
“তোর বাবু আছে। ভালো আছে, সুস্থ্য আছে।”

ঈশানীর অশ্রু ভরা নয়ন দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল যেন। থরথর করে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। ঘনঘন শ্বাস ফেলে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“তুই জানিস তার খবর?”

উত্তরে মোহ মুখে কিছুই বলল না। শুধু নিজের দুচোখের ইশারা দ্বারা ইথানের দিকে তাকাল। এতকিছুর মাঝে ঈশানী খেয়াল করেনি তার সংলগ্নে থাকা ইথানকে। ঈশানী নির্বিকার হয়ে অপলকে দেখল ইথানকে। ঘন চোখের পাপড়ি দ্বারা আবৃত তার ছোটো ছোটো দুচোখ, জোড়া ভ্রু, নাক এবং মুখের ধরণ যেন একেবারেই আরিদ্রের মতো। রাস্তার মাঝে ধপ করে বসে পড়ল ঈশানী। নেত্রযুগল থেকে বেয়ে বেয়ে পানি পড়ে বোরখা ভিজে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ ঈশানী দুহাতে ছোট্ট ইথানের গালে হাত রাখল। হাতটাও তার ভীষণ কাঁপছে। ইথান কৌতূহলী নয়নে চেয়ে রইল। মুহূর্তেই অসংখ্য চুম্বন একে দিলো ইথানের মুখে। এ এক মিশ্র অনুভূতি যা ঈশানী কথায় প্রকাশ করতে পারল না। জাপ্টে ধরে রইল ইথানকে। ইথান তখন থতমত খেয়েছে। তার কাছে ঈশানী অপরিচিত একজন। অসহায় পানে সে চাইল মোহের দিকে। কিছু সময়ের মাঝেই ছটফটিয়ে ঈশানীর থেকে ছাড়া পেয়ে ছুট লাগাল মোহের দিকে। মোহকে জড়িয়ে ধরে রইল সে। মিনমিন করে বলে উঠল,
“ওটা কে মাম্মা? আমাকে এভাবে চুমু খেল কেন?”

মোহ একটু ইথানের দিকে ঝুঁকে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“মনে আছে? একদিন ওর সাথে আমার ছবি দেখেছিলে?”

ইথান মাথা নাড়ায়। এরপরই বলে,
“এটা সেই আন্টি?”

আন্টি সম্বোধন শুনে বিষণ্নতা আরো বাড়ে ঈশানীর। পরক্ষণেই ভাবে এটা স্বাভাবিক। ইথান তো কখনোই তাকে দেখেনি। তবে মোহ তাকে সন্তানের স্নেহে বড়ো করেছে তাও একা। এটা ভেবে স্বস্তি লাগছে ঈশানীর। মনে উদয় হয়েছে পরম শান্তির। মোহ ইথানকে ভালো করে ধরে বলল,
“না বাবু। ও তোমার আন্টি নয়। তোমার মা হয়।”

বিচলিত কণ্ঠ মোহের। জানে না সে ইথানের প্রতিক্রিয়া কী হবে। সে আদেও সত্যিটা ইথানকে বলে ঠিক করল কিনা! তৎক্ষনাৎ ইথান মোহকে অবাক পানে জিজ্ঞেস করল,
“মা কয়টা হয়? তুমি তো আমার মা।”

ঈশানী ঢক গিলে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আসলে বাবু, আমি তোমার মায়ের বান্ধবী যে তাই তোমার মা বলতে চেয়েছে আমিও তোমার মায়ের মতোই।”

ইথান সরল মনে ঈশানীর কথা বিশ্বাস করে। মোহকে জড়িয়ে বলে,
“হুঁ, আমার মা তো একটাই।”

মোহ বুঝতে পারে ইথানের সামনে আর কোনো কথা বলা চলবে না। তাই সে ইথানকে বলে,
“যাও তো বাবু। স্কুলে ওদের সাথে আবার খেলা করো। আরো কিছুক্ষণ এখানে থাকব আমরা।”

ইথান কোনোকিছু না ভেবেই দৌড়ে গেল অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করতে। ঈশানী তখন বলল,
“ও তোকে মা ভাবে। আমাকে ও কোনোদিন দেখেই নি। তুই ওকে বড়ো করেছিস। তাই তোকে মা ভাববে স্বাভাবিক। এখন ওর এই ছোট্ট মনে এসব ঝামেলা ঢুকিয়ে দিস না। ও তোকে অনেক ভালোবাসে। ও আমাকে মা ডাকবেই বা কেন বল? আমি মা হিসেবে কী করেছি ওর জন্য? এক সময় তো এবোরশন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই বুঝিয়ে দিলি ও নিষ্পাপ। আমার পাপে ও কেন ভুগবে। তাই ওকে জন্ম অবধি দিয়েছি। তারপর আর ওর জন্য কী করতে পেরেছি বল? কিছু না। ওর মা হিসেবে তুই ঠিক আছিস।”

“এসব কথা পরে হবে। তুই এখন আমার সাথে আমার বাড়ি চল। তোকে আর ওখানে ফিরতে হবে না। তুই নিজের জীবন নিজে গড়বি এখন থেকে।”

ঈশানী তড়িঘড়ি মোহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল,
‘”না,না। আমি যেতে পারব না এই মুখ নিয়ে আঙ্কেল, আন্টির সামনে। তুই মাফ কর আমায়।”

মোহের কণ্ঠ কড়া হলো। খানিকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“তো কোথায় থাকবি? তোর ওই মামা-মামীর কাছে? ওরা তো আর এই দেশেই থাকে না।”

“আমার কাছে টাকা আছে। কিছুদিনের জন্য কোনো হোস্টেল বা অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দে আমায় দয়া করে। তোর বাড়িতে যেতে বলিস না। এই মুখ আমি উনাদের দেখাতে পারব না। আমি তোর চোখেই চোখ রাখতে পারছি না। বিশ্বাস কর।”

মোহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বুঝল ঈশানীর মনের জটিলতা। সে ভালো করে দেখল ঈশানীর মুখটা। আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই তার মুখে। শুঁকিয়ে গিয়েছে। চোখ বসে গিয়েছে। তার এই করুণ অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে জানা আছে মোহের। খুব ভালো করে চেনা আছে।

ড্রয়িংরুমে বসে কোনোরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই ইচ্ছেমতো ফোনে গেম খেলছে সৌমিত্র। এমন সময় তৈরি হয়ে নিজ ঘর থেকে বাহিরে এলেন মিসেস যামিনী। ব্যস্ত কণ্ঠে সৌমিত্রকে বললেন,
“রিহান কোথায় রে? রেডি হয়েছে? বের হতে হবে আবার। সাথে না হয় তুইও চল।”

সৌমিত্র গেম খেলতে খেলতে সহজ কণ্ঠে বলল,
“রিহান ভাই তো বাড়িতেই নেই মনে হয়। আমার ঘরে তো দেখলাম না তাকে।”

মিসেস যামিনী চমকালেন। বললেন,
“কী বলিস? ও কোথায় যাবে এসময়? ও জানে তো এসময় আমরা পাত্রীর বাড়িতে যাব।”

“ভাই কোথায় গেছে সেটা তো বলতে পারব না। কিন্তু বাড়িতে নেই এটা জানি।”

মিসেস যামিনী ভীষণ চিন্তিত হলেন। তারপর সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন,
“আমি উপরে গিয়ে দেখে আসি।”

সৌমিত্রের গেম খেলা বন্ধ হয়ে গেল। ফোন রেখে উদ্বেগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
“আরে উপরে নেই। ওখানেই তো আমি ছিলাম। আমার ঘরেও নেই। তাই তো দরজা লক করা। তুমি হাঁটুর ব্যথা নিয়ে কষ্ট করে উপরে না গিয়ে যাও ফোন দিয়ে রিহান ভাইকে কল করো।”

মিসেস যামিনী সৌমিত্রের কথায় আশ্বস্ত হলেন যেন। বিড়বিড় করতে করতে নিজের ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলেন।
“ছেলেটা এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে কোথায় যাবে?”

সৌমিত্র তা শুনতে পেয়ে বলল,
“আমার তো মনে হয় ভাইয়ের একদমই পছন্দ হয়নি পাত্রী। তোমার তো তাড়া বেশি। বিয়েটা দিতেই হবে। তাই ভাইয়ের পছন্দ অপছন্দ দেখছ না। আমিও পাত্রীকে ছবিতে দেখলাম। আমারও কিন্তু ভালো লাগেনি। রিহান ভাইয়ের সঙ্গে মানাবেই না।”

বেশ ডাহা মিথ্যা কথাগুলো বেশ আরামে বলে চুপ করে রইল সৌমিত্র। মিসেস যামিনী এবার বেশি চিন্তিত হলেন। দ্রুত ঘরের দিকে এগোলেন। ফের ফোনের গেমে মগ্ন হলো সৌমিত্র। মিনিট দুয়েক পরেই কে যেন বারংবার তার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকতে থাকল। সৌমিত্র বিরক্তি বোধ করে বলল,
“কী সমস্যা? যা বলার আছে পরে বলো। এখন ব্যস্ত আছি।”

“আমাকে ওয়াশরুমে লক করে দিয়ে গেম নিয়ে প্রচুর ব্যস্ততা দেখাচ্ছিস তুই?”

রিহানের কণ্ঠে ভড়কে গিয়ে নিজের ফোনটি ফেলে দিলো সৌমিত্র। ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের বুকের অংশ ফাঁক করে ফুঁ দিয়ে বলল,
“এভাবে কেউ চমকে দেয় ভাই? আমি ভাবলাম ওয়াশরুমে ওখানেই তোমার ইন্না-লিল্লাহ হয়ে গিয়েছে আর তোমার অতৃপ্ত আত্মা আমার উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছে।”

রিহান তখন বেশ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রয়েছে। তা বুঝে থমথমে হয় সৌমিত্রের মুখ। আমতা আমতা করে শুধাল,
“কীভাবে বের হলে?”

“ঘর মুছতে এসেছিল একজন। ও খুলে দিয়েছে। তুই আমায় বলেছিলি দরজা নাকি লক নেই। কিন্তু দরজা তো লক করাই ছিল। তার মানে সেটা তুই করেছিলি। কেন?”

সৌমিত্র শুকনো ঢক গিলে এগিয়ে আসে। বেশ জড়োসড়ো হয়ে রিহানের হাতটা চেপে ধরে। রিহান তখন রিহান বিস্ময়ের শেষ সীমানায়।
“রিহান ভাই, তুমি আর যাই করো এই বিয়েতে রাজি হবে না প্লিজ। এর জন্য আমাকে তোমার হাত-পা যাই ধরতে হোক সব ধরব। তুমি তবুও রাজি হবে না।”

“কেন রে? কী হয়েছে? ব্যাপার কী বল তো? ওই মেয়েকে তুই চিনিস? ওর সাথে কোনো চক্কর আছে নাকি?”

সৌমিত্র বেশি আবেগপ্রবণ হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“শুধু চক্কর না। টক্কর, বক্কর সব আছে। তুমি এই বিয়েতে নাকচ করো জলদি!”

রিহান চোখজোড়া সরু করে তাকাল। সৌমিত্রের চোখেমুখে তখনও রাজ্যের আতঙ্ক। গাম্ভীর্য ধারণ করে বলল,
“আগেই সন্দেহ করেছিলাম। কত দিন এগুলা করিস? তোর না আগে বেশ কয়েকটাই গার্লফ্রেন্ড ছিল। এখন ওই মেয়েকে ধরেছিস?”

সৌমিত্র লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে বলল,
“নাউজুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ! আমি খাঁটি প্রেমিক। কোনো খাদ নেই ভালোবাসায়। ওরা শুধু আমার বান্ধবী ছিল। আর কিছু না।”

“বাট তুই তো এখনো ভার্সিটি শেষ করে উঠতে পারছিস না। ওদিকে মেয়ের অনার্স করা শেষ! ও তোর সিনিয়র হচ্ছে।”

“আরে রাখো তো তুমি সিনিয়র জুনিয়র! প্রিয়াঙ্কা-নিক এদের দেখো না? আমি তো বলব তুমিও সিনিয়র খুঁজে নাও।”

রিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশা নিয়ে বলল,
আপাতত মাকে বোঝানোর চেষ্টা করি! কী করে বিয়ের সম্বন্ধ কাটিয়ে ওঠা যায় তাই ভাবি। তারপর সিনিয়র নাকি জুনিয়র খুঁজব দেখা যাবে।”

সৌমিত্র খুশিতে গদগদ করে রিহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আজ নিজ হাতে খিচুড়ি রান্না করেছে মোহ। কিছুক্ষণ আগেই রৌদ্রময় দিনটি কালো মেঘ মেঘলা করে তুলেছিল। বৃষ্টিও হয়েছে ফের। নিজের বান্ধবীর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন খুশি করে দিয়েছে তাকে। অতঃপর তার খুব করে মন চাইল স্বচ্ছকে তার হাতের রান্না খাওয়াতে। লোকটা নিজের সকল বিলাসিতা ছেড়ে পড়ে আছে বাহিরে। তার জন্য মায়া হয় মোহের। তাই নিজের ইচ্ছে না দমিয়ে সৌমিত্রের থেকে স্বচ্ছ যেখানে থাকে সেখানকার ঠিকানা নিলো সে। বেরিয়ে পড়ল সে। ক্লাবে পৌঁছানোর পর দরজায় টোকা দিতেই তার মনে হলো দরজা একটু খোলা। মোহ একহাতে দরজা ঠেলতেই দুপাশে খুলে গেল দরজা। মোহ হতবাক হলো। দরজা খোলা কেন? একটু ইতস্ততবোধ করেই ভেতরে প্রবেশ করল সে। বাহিরের ঘর পেরিয়ে ভেতরের ঘরের কাছাকাছি যেতেই তার নজরে পড়ল ভেতরে এক সোফায় মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে থাকা স্বচ্ছের উপর। ভ্রু কুঁচকে বিনা শব্দে এগিয়ে গেল সে। তার সংলগ্নে এগিয়ে গিয়ে নিচু সুরে ডাকল,
“শুনছেন!”

অতিরিক্ত জ্বরের ঘোরে নিজের চোখ দুটো যেন জোর করেই মেলল স্বচ্ছ। আচানক মোহকে দেখে চমকালেও প্রকাশ করল না সে। গম্ভীর মুখে ধীরে ধীরে উঠে বসে মাথা নিচু করে নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে রইল। মোহ খেয়াল করল, স্বচ্ছের গায়ে ভেজা টিশার্ট। সে হকচকিয়ে উঠল।
“এ কী! আপনার না জ্বর? আপনি ভেজা টিশার্ট গায়ে দিয়ে শুয়ে রয়েছেন?”

স্বচ্ছ তেমন কোনো আগ্রহ দেখাল না যেন। ছোট্ট করে জবাব দিল,
“হুঁ। তো?”

“আপনার কি সত্যিই বুদ্ধিভ্রম হয়েছে? ভেজা জামাকাপড় পরে কেউ শুয়ে থাকে? এটা কেমন অভ্যেস।”

“স্বচ্ছের একান্ত অভ্যেস এটা।”

মোহ কিছু না ভেবেই স্বচ্ছের গালের কাছে হাত রাখল। অতঃপর চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“জ্বরে ম/রতে চান?”

“আমার মনে হয় আগুনে পু;ড়ে ম/রার চেয়ে জ্বরে ম;রাটা অনেক ভালো। কষ্ট অন্তত কম হবে।”

স্বচ্ছের কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না মোহ। চোখমুখ কুঁচকে বলল,
“জ্বরে আপনার মাথাও গেছে। দেখি এখনি টিশার্ট খুলে ফেলুন।”

স্বচ্ছ স্পষ্ট জবাব করল,
“না।”

“জেদ করছেন কেন?”

“আমার জেদ সহ্য করছ কেন তুমি?”

মোহ হতাশ হয় স্বচ্ছের ত্যাঁড়া উত্তরে। কড়া সুরে বলে ওঠে,
“টিশার্ট খুলবেন কি না?”

স্বচ্ছ জবাব দেয়না এবার। মোহের মুখের দিকে একবার দেখলও না সে। মোহ ক্ষিপ্ত হচ্ছে এবার। আবারও বলল,
“এমন জেদ করলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

তবুও স্বচ্ছ নীরব। এবার মোহের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। কিছুটা দূরে থাকা লম্বা টেবিলে ছু/রির দেখা পেল সে। বিলম্ব না করে দ্রুত ছু/রি হাতে নিয়ে এলো স্বচ্ছের কাছে। এবার স্বচ্ছ খানিকটা থতমত খেল বটে। ছু/রিটা স্বচ্ছের বুকের কাছে ধরলে স্বচ্ছ ভড়কে যায়।
“একি! এবার সত্যিই মে/রে দেবে নাকি?”

চলবে…#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৫ (১ম খণ্ডের সমাপ্তি)

(বি.দ্র. পড়ার অনুরোধ রইল)

গলা শুকিয়ে আসে স্বচ্ছের। মোহ মেয়েটা বেশ সাংঘাতিক সেটার প্রমাণ সে প্রথম থেকে পেয়ে আসছে। তবে পরক্ষণেই তার মনে হলো অন্যকিছু। মোহ আস্তে করে টিশার্টের শুরু অর্থাৎ কলার থেকে টেনে ধরে ছু/রি দিয়ে আস্তে করে কেটে দেয়। এরপর পুরোপুরি দুই খণ্ড করে ফেলে টিশার্টটি। স্বচ্ছ চমকে তাকায় মোহের পানে। মোহ এবার নিজের গায়ের শক্তি দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেয় টিশার্ট। খালি ভেজা গায়ে বসে থাকা স্বচ্ছ তখন হতভম্ব এবং মোহের চোখে তখনও বিরক্তি। সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“জানি এই সময়ে আপনার টিশার্ট ছিঁড়ে ঠিক করিনি। কিন্তু আপনি অন্য কোনো রাস্তা বাকিও রাখেন নি। আশা করি এবার জেদ না ধরে, আমার পদক্ষেপের অপেক্ষা না করে নিজের ভেজা গা মুছে ফেলবেন।”

“এবার যদি গা না মুছি তাহলে তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? নিজে মুছে দেবে? তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারো।”

মোহ এবার ক্রুদ্ধ নয়নে তাকায়। স্বচ্ছ এবার বিনা শব্দে উঠে গিয়ে নিজের টাওয়াল দিয়ে গা মুছতে থাকে। মোহ তখন নির্বিঘ্নে খাবার বের করছে আর বলছে,
“খাবার এনেছি আপনার জন্য। খেয়ে নিন।”

“তুমি কী করে বুঝলে যে আমি খাইনি?”

“মানুষের চোখমুখের গঠন একেক সময় একেক ভাষা প্রকাশ করে। আপনার শুকনো মুখ অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে। জ্বরের গায়ে ভেজা জামায় শুয়ে ছিলেন। এসব কিছুর মানে কী বোঝাবেন?”

“বোঝালেই বুঝবে?”

স্বচ্ছের উদ্ভট প্রশ্নে কপালে ভাঁজ পড়ে মোহের। উল্টো জিজ্ঞেস করে,
“কেন বুঝব না?”

“বুঝবে না। বোঝাতে চেয়ে হতাশ হয়েছি বারবার।”

মোহ ঢক গিলে বলল,
“হয়ত হতাশ হওয়ার দিন খুব শীঘ্রই মিটে যেতে চলেছে।”

স্বচ্ছ নিজের গা মোছা থামিয়ে দিলো। গোল গোল নেত্রপল্লবের সহিত দেখল মোহকে।
“কেমন আশা দেখাচ্ছো এটা?”

মোহ আর উত্তর দিলো না। স্বচ্ছ এবার নিজের মনের বাঁধা মানতে না পেরে হুট করে প্রশ্ন করে বসল,
“শৌভিক কে হয় তোমার? ইথানের কে হয়?”

আচানক মোহের ফোনে আসা শৌভিকের গুরুত্বপূর্ণ মেসেজে ব্যস্ত হয়ে পড়া মোহের কানে ঠিকঠাক গেলই না স্বচ্ছের প্রশ্নটি। স্বচ্ছের দিকে চকিতে তাকায় সে। অতঃপর বলে ওঠে,
“কী বললেন?”

পুনরায় প্রশ্নটা বলার ইচ্ছে জাগল না স্বচ্ছের। তীব্র ক্রোধে যেন শরীরের প্রতিটা রগ অবধি কম্পন সৃষ্টি করছে। তবে সে প্রকাশ করতে পারছে না। দম আঁটকে নিজেকে দমিয়ে কোনোমতে সে বলল,
“কিছু না।”

মোহ নীরব হলো। স্বচ্ছের রাগটা সবেমাত্র মোমবাতির ন্যায় নিভু নিভু হয়েছিল তা আবারও জ্বলে উঠল যেন। দ্রুত বাহিরের ঘর থেকে নিজের পোশাক সম্পূর্ণ পাল্টে এলো মোহের নিকট। আবারও উদ্ভ্রান্তের ন্যায় প্রশ্ন করল,
“কেন এসেছ?”

“কেন এসেছি মানে? ভাগ্যিস এসেছি। নাহলে তো ভেজা জামাকাপড়ে শুয়ে থেকে আধম/রা হয়ে যেতেন।”

“আমাকে দেখে কি তোমার মনে একটুও ভয় জাগে না?”

মোহের দৃষ্টি সূক্ষ্ম হলো। তীব্র মনোরোগ দিয়ে একবার দেখল স্বচ্ছের এক সমুদ্রের স্পষ্ট দুটো চোখকে। যা আকারে ছোটো হয়ে এসেছে জ্বরে। বেশ যত্নের অভাবে বেড়ে গিয়েছে তার গালের দাড়ি। ধূসর আবরণে ঢাকা ঠোঁটে নেই কোনো হাসি বা সুখের আবেশ। এরপর মোহ অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিলো। বলল,
“দেখলাম বেশ মনোযোগ দিয়ে। ভয় লাগল না মোটেও। কিন্তু দেখতে পেলাম শৌখিনতায় গড়ে ওঠা মানুষটি কীভাবে সবকিছু ছেড়ে পাগলামি করে যাচ্ছে। তার চোখে নিজেকে ছোটো লাগছে ভীষণ। আমি মনেপ্রাণে চাই সে পাগলামি না করুক।”

“তোমার এই কথা সে রাখতে পারবে না মিস. মোহ। তার পাগলামির মাত্রা আরো বাড়বে। কারণ তাকে সামলানোর তুমি নেই।”

মোহ এবার প্রতিত্তোর না করে খাবার স্বচ্ছের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খিচুড়ি নিজ হাতে রান্না করেছিলাম। খেয়ে অবশ্যই বলবেন কেমন হয়েছে। আজ আসি। আকাশের মেঘ কাটে নি। যখন তখন বৃষ্টি চলে আসবে।”

“এসেছ যখন থেকে যেতে তো পারো কিছুক্ষণ।”

মোহ শান্ত নয়নে দেখল স্বচ্ছকে। স্বচ্ছের চোখ দুটোতে পরিষ্কার আবেদন। মোহ বলে,
“আপনি চান আমি থাকি?”

স্বচ্ছ আর জবাব দিলো না। নির্লিপ্ত মনে খাওয়া শুরু করল গম্ভীর হয়ে। মোহ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আপনার কথা রাখব আজ। বলা তো যায় না কালকের পর আর কোনোদিন আমায় এভাবে আটকাবেন কিনা!”

স্বচ্ছের খাওয়া বন্ধ হলো। দমবন্ধকর সুরে বলল,
“মানে?”

“পরিস্থিতি পাল্টায় কারণে অকারণে। তাই বললাম।”

মোহের কথাই ধোঁয়াশা, রহস্য। স্বচ্ছের মনে তখনও বিশাল কৌতূহল। কিন্তু সে পাল্টা জানতে চাইল না। সে একবারের বেশি প্রশ্ন করে না। নিজের অহমিকা কাটিয়ে উঠতে সে এখনো পারে না। ফলস্বরূপ দুজনেই নীরব রয়।

আবহাওয়া অফিস থেকে খবর প্রচার হচ্ছে টানা তিনদিন বৃষ্টি হওয়ার। শুধু বৃষ্টি নয় শিলাবৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা ব্যাপক। সবে বন্ধুদের সাথে জম্পেশ আড্ডা দিয়ে পার্ক দিয়ে বেরিয়ে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পায়তারা করছিল সৌমিত্র। বৃষ্টি তৎক্ষনাৎ ঝমঝমিয়ে নামে। হুটোপুটি লেগে সকল লোকজনের ছোটাছুটি শুরু হয় বৃষ্টির পানি থেকে রেহাই পেতে। সৌমিত্রও দ্রুত হাঁটা ধরে। পার্কের পার্কিং প্লেসে গাড়ি। সেখানে অবধি পৌঁছাতে হবে। ফুলের বাগানের মাঝের কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তার নজর হঠাৎ তার পড়ে মাঝে থাকা ছোটো পুকুরের পাশে উল্টোদিকের বেঞ্চে বসে থাকা একটি মেয়ের দিকে। তীব্র বর্ষণেও যেন একদম পাথরের মতো সোজা হয়ে বসে রয়েছে মেয়েটি। বৃষ্টি যে পড়ছে তাতে যেন তার কোনো হেলদোলই নেই। সৌমিত্র শুধু তার মাথার চুলটাই দেখতে পাচ্ছে। যা ভিজে গিয়ে নেতিয়ে পিঠের সাথে লেগে গিয়েছে একদম। মেয়েটি এভাবে বসে রয়েছে কেন? সৌমিত্রের অবাধ্য কৌতূহলের বাঁধ ভাঙে। নিজের তাড়া ভুলে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বেঞ্চের পাশেই। ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে মেয়েটির মুখ দেখতেই গিয়েই চমকে উঠল সে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“এ তো মিস. সিনিয়র গোলাপি!”

সৌমিত্র বেশ ভাবুক হয়ে পড়ল তানিয়ার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না মেয়েটার। সৌমিত্র বিড়বিড়িয়ে আপনমনে বলল,
“মেয়েটা কি বিয়েশাদির টেনশনে ডিপ্রেশনে চলে গেল? কিন্তু রিহান ভাইকে তো আমি আঁটকে দিয়েছিলাম। তাহলে আবার কী হলো?”

আগপাছ না ভেবেই তানিয়ার থেকে দূরত্ব রেখেই ফট করে বসে পড়ল সৌমিত্র। তানিয়ার যেন সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। চোখের পানিগুলো তার বৃষ্টির পানির সাথে মিলিয়ে মুছে দিয়ে যাচ্ছে। পলকহীন দৃষ্টি তার পুকুরের দিকে স্থির। হঠাৎ কর্ণকুহরে বেজে ওঠে এক মোটা কণ্ঠস্বর।
“পুকুরে কয়টা বৃষ্টির পানি পড়ছে তা গুনছেন নাকি?”

তানিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। সৌমিত্রকে দেখে অবাকই হয় সে। ভাঙা গলায় শুধায়,
“আপনি এখানে?”

“এখানে আসা বারণ বুঝি? নাকি দুঃখবিলাসে ডিস্টার্ব করে ফেললাম?”

“তেমন কিছু না।”

“তা দুঃখবিলাস তো করছেন। কিন্তু এটা কি সুখের দুঃখবিলাস নাকি দুঃখের দুঃখবিলাস জানা যাবে?”

তানিয়া ফের তাকায়। সৌমিত্রের অবান্তর কথাবার্তা তাকে কখনো বিরক্ত করে কখনো বা হাসায় বা কখনো অবাক হয়। তানিয়ার উত্তর না পেয়ে সৌমিত্র আবারও বলে,
“আপনার বিয়ে আমি আঁটকে দিয়েছি। আমার এক ভাইয়ের সাথেই বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। সেটা আমি দায়িত্ব নিয়ে ভেঙে দিয়েছি। তাই দুঃখবিলাসের দরকার নেই। এখন আপনার বয়ফ্রেন্ডকে বলুন তো দ্রুত চাকরি টাকরি খুঁজে বিয়ে সেরে ফেলতে। বারবার আমি বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব নিতে পারব না বলে দিলাম।”

তানিয়ার মুখে তবুও উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। তখনও সে বিষণ্ণ। একটু সময় নিয়ে ফট করে তানিয়া বলে ফেলল,
“আপনাকে বিয়ে ভাঙতে হবে না। যার জন্য বিয়ে ভাঙবেন সে আমার জীবন থেকে চলে গেছে বিদায় নিয়ে।”

সৌমিত্র চরম বিস্মিত হলো। ধা;ক্কা খেল যেন। তৎক্ষনাৎ জানতে চাইল,
“কেন? কী হয়েছে?”

তানিয়ার এবার মাথা নত করে কেঁদে ফেলল। ক্রন্দন কণ্ঠে বলল,
“বিগত কয়দিন ধরেই সমস্যা চলছিল। সে আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছিল যেন। আমি খুব চেষ্টা করছিলাম স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। আজ দেখা করি তার সাথে জোর করে এখানে। ও আসতে চাইছিল না। তবুও আসে আর আমি রাগারাগি করে জিজ্ঞেস করি কেন এমন করছে। সে আমায় জানায়, তার খুব ভালো একটা চাকরি হয়েছে। এখন তার পরিবারের লোকজন তার জন্য পাত্রী খুঁজছে। সে নাকি আমার সম্পর্কে বলেছিল তার মাকে। তার মা নাকি সরাসরি না বলে দিয়েছে। কারণ একটাই, আমার বয়স নাকি বেশি। তার মায়ের চাই কমবয়সী আঠারো-উনিশ বছরের সুন্দরী একটা মেয়ে। সেই তুলনায় আমার বয়স নাকি অনেক বেশি হয়ে গেছে। তাই ওর পরিবার আমায় মানবে না। আর সবচেয়ে বড়ো কষ্টের কথা কী জানেন? সে এক বলাতেই তার পরিবারের কথা মেনে নিয়েছে। অন্য একটা সুন্দর, কমবয়সী মেয়ের সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তাই আমি যেন তাকে আর বিরক্ত না করি সেটা সে পরিস্কার করে জানিয়ে চলে গিয়েছে। আমাদের এত বছরের সম্পর্ক এইটুকু সময়ের মধ্যে কত সহজে সমাপ্তি ঘটিয়ে সে চলে গেছে।”

সৌমিত্র স্তব্ধ হলো। কিছু বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেল না সে। কাউকে ভালোবাসলে বুঝি এত সহজে তাকে ছেড়ে দেওয়া যায়? সৌমিত্রের স্বচ্ছের কথা মনে পড়ে। তার ভাই কত সুন্দর করে তার প্রেয়সীর জন্য নিজের সব ত্যাগ করে যাচ্ছে। প্রেম আর ভালোবাসার পার্থক্য বুঝি এখানেই। তানিয়া এবার তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আমার বয়স কার জন্য বেশি হয়েছে বলুন তো? তার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই তো। এইচএসসির পর থেকে আমার বিয়ের কত প্রস্তাব এসেছে তার ধারণার বাহিরে। আমি সবাইকে মানা করেছি শুধু তার জন্য। মায়ের সাথে অশান্তি করেছি, পরিবারের সাথে লড়াই করেছি। লাভ কী হলো? সে আমাকে সবার কাছে ছোটো করে চলে গেল। আমার পাওনা এই ছিল?”

সৌমিত্র এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কে বলেছে আপনার বয়স বেশি? মোটেও না। আমি আর আপনি প্রায় একই বয়সের। তবুও সবাই আমাকে ছোটো বলেই গণ্য করে। আমি নাকি এখনো বড়ো হইনি। মেয়েরা এখন ত্রিশ বছর বয়সেও বিয়ে করেছে। আমি আপনাকে একদিন বলেছিলাম মনে আছে? প্রেমিকরা প্রেম করতেই ওস্তাদ। সংসার তাদের দ্বারা হয়না।”

তানিয়ার মনে পড়ে সৌমিত্রের কথা। কে জানত সৌমিত্র সেদিন বাস্তব এক কথা বলে ফেলেছিল! তানিয়ার চোখ ফেটে কান্না আসে। সৌমিত্রকে বলে,
“আপনি আমার সঙ্গে বসে আছেন কেন বৃষ্টিতে? ঠাণ্ডা লাগবে। চলে যান।”

“না, না। সদ্য প্রেম ভেঙে যাওয়া মানুষজনের পাশে থাকতে হয়। কখন কী করে বসে ঠিক নেই।”

” কতক্ষণ পাহারা দেবেন শুনি? সারাজীবন তো আর পাহারা দিতে পারবেন না আমায়।”

সৌমিত্র এবার না চাইতেও বলে ফেলল,
“হুকুম আর ভাগ্যে থাকলে সেটাও হয়ে যাবে।”

তানিয়ার কান্না একেবারে থেমে গেল। গোল গোল চোখে তাকায় সৌমিত্রের দিকে। ভিজে চুপসে যাওয়া সৌমিত্র নিজেই লজ্জা পেল এবার। মুখ ফসকে বলেছে কথাটা। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“থামলেন কেন? কাঁদতে থাকুন।”

“এভাবে তাকিয়ে থাকলে কাঁদব কী করে?”

“আমি তো এভাবেই তাকিয়ে থাকব।”

তানিয়া আর কাঁদল না। কাঁদতে পারল না। কারণটা সৌমিত্র।

অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার পরেও যখন বৃষ্টি থামছিল না তখন যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল মোহ। বৃষ্টিতে ভিজেই যাবে সে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইথান নিশ্চয় তাকে খুঁজবে। স্বচ্ছও উঠে দাঁড়াল সাথে। বলল,
“চলো এগিয়ে দিয়ে আসি।”

মোহ চক্ষু ছানাবড়া হলো। দ্রুত স্বচ্ছের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
“পাগল আপনি? বৃষ্টিতে এত জ্বর নিয়ে বাহিরে যাবেন? এখানে থাকুন। আমি যেতে পারব।”

“তোমার সঙ্গে আরো একবার বৃষ্টিতে ভেজার ভীষণ ইচ্ছে আমার। এই জন্য যদি আমি আধম/রা হয়ে যাই তবুও আমি এই ইচ্ছে পূরণ করব।”

বাঁধা মানল না স্বচ্ছ। বেরিয়ে এলো মোহের সাথে। ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠছে দুজনের শরীর। দুজনে এসে দাঁড়াল এক দোকানের নিচে ছাউনিতে। কোনো গাড়ির অপেক্ষা করতে থাকল। আধভেজা স্বচ্ছ হঠাৎ বলল,
“তোমার আর আমার প্রথম সাক্ষাতেও বৃষ্টি আমাদের সঙ্গে ছিল।”

মোহ হাত দিয়ে পড়ন্ত বৃষ্টিগুলো উপভোগ করতে করতে বলল,
“হুঁ, মনে আছে। সেদিনই নিজের ত্যাড়ামির সর্বোচ্চ দেখিয়েছিলেন আপনি। কাঁদা পানিতে আমার শরীর মাখিয়ে দিয়েছিলেন।”

“কে জানত সেই কাজের পরিণাম এত ভয়ঙ্কর হবে? কে জানত আমি সেই বিশেষ বৃষ্টিতে ভিজে ভয়ানকভাবে ডুবে যাব কারো আসক্তিতে? কেউ জানত না।”

মোহ মৃদু হাসে আর বলে,
“হয়ত সেটা সাধারণ বর্ষণ ছিলই না। সেই বৃষ্টিতে প্রেমের ছোঁয়া ছিল।”

স্বচ্ছ আচানক আবদার করে,
“আমি তোমার হাতে হাত রেখে বৃষ্টি উপভোগ করতে পারি?”

মোহের হাসিতে পরিবর্তন হাসে। লাজুকতায় মেতে ওঠে মুখ।
“কিছু কিছু কাজে অনুমতি নিতে নেই। আন্দাজ করার আগে সেরে ফেলতে হয়।”

স্বচ্ছ কথা ব্যতীত মোহের হাতের নিচে হাত রাখল। দুজনের হাতে পড়ছে বর্ষণের বিন্দু। কমছে অনুরাগ, বাড়ছে প্রণয়।

(১ম খণ্ডের সমাপ্তি)

]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here