#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_২
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
লোকে লোকারণ্য ব্যস্ত রাস্তাটুকু পার হওয়ার সময় নীল রঙের জর্জেট ওড়নার এক কোণা গাড়ির দরজার সাথে আটকে গেছে। অর্ষা হাঁটতে গিয়ে গলায় টান লাগায় বিষয়টা লক্ষ্য করে। তড়িঘড়ি করে সে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। ড্রাইভিং সিটের কাচে শাহাদাৎ আঙুল দ্বারা ঠকঠক শব্দ করে। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই জানালার কাচ নেমে আসে। মাথার তালুতে চুল প্রায় নেই অবস্থা এমন একজন ভদ্রলোক ভ্রুঁ কুঁচকে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। একহারা গায়ের রঙ লোকটির। মুখের তুলনায় হাত ফরসা। লোকটি ভ্রুঁ কুঁচকেই জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’
কথা বলার সময় তার ভ্রুঁ তো মসৃণ হলোই না। এখন কপালও কুঁচকে রয়েছে। অর্ষা তার স্বভাবসুলভ মৃদুস্বরে বলল,
‘আমার ওড়নাটা গাড়িতে আটকে গেছে।’
লোকটির ভাবান্তর হলো না। সে আরও বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কী আশ্চর্য! আপনার ওড়না ভেতরে এলো কী করে?’
‘আমি ঠিক জানিনা। সম্ভবত আপনি গাড়ির ভেতরে যাওয়ার সময় আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই অসাবধানতায় গাড়িতে ওড়না আটকে গেছে। আপনি লকটা খুলুন।’
ড্রাইভার বিরক্তিরস্বরে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল পেছন থেকে তখন গুরুগম্ভীর একটি পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসে। ভরার কণ্ঠে পেছন থেকে বলে,
‘অযথা তর্ক কেন করছ রাশেদ? গাড়ির লক খোলো।’
রাশেদ নামক লোকটির চেহারার রঙ-ই পালটে গেছে এখন। সে তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল,
‘জি, স্যার। এখন-ই লক খুলে দিচ্ছি।’
রাশেদ দরজার লক খোলার পর অর্ষার ওড়নারও মুক্তি হয়। সে আর কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে যায়। রাশেদের ভ্রুঁ আবার কুঁচকে যায়। সে নাক ফুলিয়ে বলে,
‘একটা থ্যাঙ্কিউ-ও দিলো না!’
‘গাড়ি স্টার্ট দাও।’
‘জি, স্যার।’
অর্ষা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওড়নাটি দেখছে। ছিঁড়েনি; তবে ওড়নার সুতায় টান লেগে কুঁচকে গেছে। সেটাই এখন সে টেনেটুনে ঠিক করার চেষ্টা করছিল। হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিয়ে দ্রুত পা চালালো সে। আজ তার ভার্সিটিতে নবীন বরণ অনুষ্ঠান রয়েছে। সে যখন ভার্সিটিতে পৌঁছাল তখন ১০:০৫ বাজে। অলরেডি অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। সে গিয়ে পেছনের একটা চেয়ারে বসল। ভার্সিটিটা বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে। সে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখছিল; তখন স্টেজের পাশে রাশেদ নামক সেই লোকটিকেও দেখতে পায়। তার দৃষ্টি কয়েক সেকেণ্ড তার দিকে আটকে ছিল। এবার সে স্টেজে বক্তৃতা দেওয়া লোকটির দিকে তাকাল। তিনি এই ভার্সিটির প্রফেসর জহির চৌধুরী। অর্ষা যখন মনোযোগসহকারে তার কথাগুলো শুনছিল তখন ঝড়ের বেগে এক মেয়ে তার পাশের চেয়ার টানে। হয়তো মেয়েটি বসতেই চেয়েছিল তবে দুর্ভাগ্যবশত মেয়েটি চেয়ারে না বসে, বসে পড়েছে অর্ষার কোলে। বিস্মায়ভূত হয়ে অর্ষা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি এসেছে হন্তদন্ত অবস্থায়। টের পায়নি প্রথমে। যখন বুঝতে পারল তখন আবার চেয়ার টেনে চেয়ারে বসে জিভ কেটে বলল,
‘স্যরি, স্যরি। আমি খেয়াল করিনি গো।’
অর্ষা মৃদু সহাস্যে বলল,’ইট’স ওকে।’
মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,’ইট’স ওকে? তার মানে কি আমি তোমার কোলে আবার বসতে পারি? না মানে, তুমি তো বললে ঠিক আছে হা হা হা।’
অর্ষা বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে যায়। হুট করে অপরিচিত কারও সাথে এমনভাবেও কথা বলা যায়? মেয়েটি এবার হাসতে হাসতে অর্ষার পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
‘হা হা! ভয়ে পেলে? আরে জোক্স করেছি।’
অর্ষার এবার কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো বৈকি! হাসবি তো হাস। কিন্তু হাসতে হাসতে মারতে হবে কেন? তবে অর্ষা মেয়েটির মতো হুট করেই তার চঞ্চলতা প্রকাশ করতে পারল না। সে একবার ভাবল এখান থেকে সরেই বসবে কিনা! পরক্ষণে মনে হলো, এতে মেয়েটি অপমানিতবোধ করতে পারে। সে জেনে-বুঝে কখনও কাউকে অল্প কষ্ট দিতেও নারাজ। তাই সে মেয়েটির ননস্টপ বকবকানি সহ্য করে পাশেই বসে রইল।
‘এই শোনো, মুখ ওমন গোমড়া করে রেখেছ কেন? আমার ওপর বুঝি রাগ হয়েছে?’ ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল মেয়েটি।
অর্ষা ভদ্রতা রক্ষা করতে মৃদু হাসল ফের। বলল,’না, না। রাগ কেন করব?’
‘রাগ করেও লাভ নেই। তাহলে আরও রাগিয়ে দেবো হা হা। এই তোমার নাম কী?’
‘অর্ষা।’
‘আমি লামিয়া।’
অর্ষার ডান পাশে তখন অন্য একটি ছেলে এসে বসেছে। অর্ষা একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। ছেলেটি হাসফাস করছে গরমে। ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা। ঘামে ডার্ক ব্লু কালার শার্ট অব্দি ভিজে গেছে। হাত দ্বারা মুখের ওপর হাওয়া করতে করতে বলল,
‘উফফ বাবা! এই অসহ্য গরমে
মন চায় জামা-কাপড় খুলি হাওয়ামে,
কিন্তু বিধিবাম! পারিনা শরমে।’
কবিতার রসে এমন উদ্ভট কথা শুনে অর্ষা আর লামিয়া হেসে ফেলে। সামনের চেয়ার থেকে অন্য একটি মেয়ের খিলখিল করা হাসির শব্দ আসে। মেয়েটি এবার পিছু ফিরে বলে,
‘আপনি তো অসাধারণ কবিতা বলেন।’
ছেলেটি খুশিতে গদগদকণ্ঠে বলল,’তাই না? কিন্তু বাড়িতে আমার মা একদম কবিতা সহ্য করতে পারে না। না, না এমন নয় যে কবিতা তার অপছন্দ। শুধু আমার কবিতা-ই তার পছন্দ না। আমি মায়ের সামনে কবিতা বললে মা কী করে জানেন?’
‘কী?’
‘ডালঘুটনি নিয়ে দৌঁড়ানি দেয়।’
এবার ঐ মেয়েটির সঙ্গে অর্ষা আর লামিয়াও শব্দ করে হেসে ওঠে। আশেপাশের সবাই ওদের লক্ষ্য করছে দেখে মুখটিপে হাসছে এখন।
‘আচ্ছা আপনার নাম কী?’ লামিয়ার প্রশ্ন।
ছেলেটি কৌতুক করে বলল,’আমার নামে অনেকগুলো গান রয়েছে। আচ্ছা সহজ করে বলি, আমার নামের বাংলা অর্থ প্রেমিক। এখন আপনারা বলেন দেখি কী হতে পারে?’
অর্ষা বলল,’আশিক?’
ছেলেটি উৎসাহিত হয়ে বলল,’রাইট, রাইট! ঠিক বলেছেন একদম।’
কথা বলতে বলতে সে অর্ষার হাত থেকে রুমালটি নিয়ে নেয়। অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আশিক এবার হাসতে হাসতে বলে,
‘হে হে! ইয়ে মানে টিস্যু নাই তো। আমি আপনাকে পরে একটা রুমাল কিনে দেবো। ২০ টাকা দিয়েন।’
অর্ষা হা হয়ে যায়। একই তো তার রুমাল নিয়ে গেছে। নতুন রুমাল কিনে দেবে বলল তাও আবার কিনা তার থেকেই টাকা নিয়ে! কী সব অদ্ভুত মানুষ এরা। কথা বলার এক পর্যায়ে জানা গেল সামনে বসে থাকা মেয়েটির নাম রেশমি। ওরা সবাই এক-ই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে।
আশিকের পাশে এখন অন্য একটি ছেলে এসে বসেছে। সে বেজায় বিরক্ত বোঝা যাচ্ছিল। পাশের অন্য একটি চেয়ার টেনে, চেয়ারের গায়ে হাত রাখতে যাবে তখন অন্য একটি মেয়ে নিচে পড়ে যায়। ছেলেটি এবার বলে ওঠে,
‘আরে পড়লেন কী করে?’
মেয়েটি দাঁত-মুখ খিঁচে বলে,’চেয়ার টান দিলেন কেন? আমি তো এই চেয়ারেই বসতে যাচ্ছিলাম।’
‘আমি কী করে জানব আপনি এই চেয়ারেই বসবেন? আমি কি মনের খবর পড়তে পারি নাকি?’
এক কথায়, দুই কথায় দুজনের বেশ ঝগড়া লেগে যায়। সেখানে উপস্থিত এক ছাত্রনেতা এগিয়ে এসে বলে,
‘কী ব্যাপার? এখানে এত গ্যাঞ্জাম কীসের?’
এবার তাদের সামনের সারি থেকে একজন ছেলে বলে ওঠে,
‘দেখুন না ভাই, এই সারিতে সেই কখন থেকে গ্যাঞ্জাম শুরু হয়েছে। এইযে আমার পাশে বসা মেয়েটিও এই গ্যাঞ্জামের অন্তর্ভূক্ত।’
রেশমি খ্যাঁক করে ওঠে। পালটা জবাবে বলে,’পরিচিত হয়েছি জাস্ট। আপনি এটাকে গ্যাঞ্জাম কেন বলছেন?’
ওদের একেকজনের একেক জবাবে ছাত্রনেতার ছেলেটির পাগল হওয়ার উপক্রম। স্টেজ থেকে তখন এক স্যার বলে,
‘কী হয়েছে? কী সমস্যা?’
ছাত্রনেতা সবগুলোকে ধমক দিয়ে বসিয়ে বলল,’কিছু না স্যার।’
এরপর সে যাওয়ার আগে বিড়বিড় করে বলে গেল,’এই ব্যাচে এবার আসছে কতগুলা গ্যাঞ্জাম পার্টি!’
সেই ঝগড়া করা ছেলে-মেয়ের পরিচয় জানা যায় অনুষ্ঠানের প্রায় শেষের দিকে। একজন দিদার ও অন্যজন জুঁই। এবং রেশমির পাশে বসে থাকা ছেলেটি; যে বিচার দিয়েছিল তার নাম আহিল। ইতিমধ্যে আশিকের সাথে তার একটা ভাবও জমে গেছে। বলা বাহুল্য আশিক গায়ে পড়ে ভাব জমিয়েছে।
অনুষ্ঠান শেষে খাবার নিয়ে কেউ কেউ বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল আবার কেউ কেউ ওখানেই বসে খাচ্ছিল।
রাশেদ মাঠের একপাশে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। লামিয়া তখন রেশমি আর অর্ষাকে ডেকে নিয়ে হাঁটতে থাকে। পেছন থেকে তখন দৌঁড়ে আসে জুঁই। সে রেশমিকে খাবারের প্যাকেট দিয়ে বলে,
‘এটা তোমার। চেয়ারের ওপর রেখে এসেছিলে।’
রেশমি হেসে বলে,’থ্যাঙ্কিউ।’
‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’
লামিয়া মুখটিপে হেসে বলে,’একটা মজা দেখাব। তুমিও আসো।’
রাশেদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়াল ওরা। অর্ষা, রেশমি, জুঁই ওরা কেউ বুঝতে পারছে না লামিয়া ঠিক কী করতে চাচ্ছে। লামিয়া একাই গেল রাশেদের কাছে। রাশেদ আগের মতোই ভ্রুঁ কুঁচকে আছে। তার ভ্রুঁ মনে হয় বেশিরভাগ সময় এমনই থাকে।
লামিয়া মুচকি হেসে বলে,’একটু কথা বলা যাবে?’
রাশেদ কাঠখোট্টাভাবে বলল,’কী কথা?’
‘আপনার মাথার টাক অনেক সুন্দর।’
রাশেদের হাত আপনা-আপনি তার মাথায় চলে গেল। বিস্মায়ভূত বলল,’কীহ! মজা করছেন?’
‘ছি না! মজা কেন করব?’
‘এই এই আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়েন? খুব সাহস না আপনার? আমার সাথে মশকরা! আপনি জানেন আমি কে?’
‘জি। আপনি টাকওয়ালা সুন্দর মানুষ।’
‘আপনি আবার মজা করছেন! এই ভার্সিটির প্রফেসর জহির চৌধুরীর ছেলে আহনাফ মিজবাহ চৌধুরী আমার স্যার হয়। আমার সাথে ফাইজলামি করতে আসলে তাকে বলে এই ভার্সিটি থেকে বের করে দেবো।’
‘আপনার টাক সত্যিই খুব সুন্দর। আমি মিথ্যে বলছি না।’
রেশমি আর জুঁই ওর কাণ্ড দেখে হাসলেও অর্ষার এসব ভালো লাগছিল না। সে এগিয়ে যায় ওদের কাছে।
রাশেদ লামিয়াকে বলে,’ঐতো আমার স্যার আসছে। আপনার বিচার করছি আমি।’
লামিয়া পেছনে তাকিয়ে আহনাফকে দেখতে পায়। অবাক হয়ে বলে,’উনি আপনার স্যার?’
‘হু!’
‘ধুর মিয়া! আগে বলবেন না? তাহলে কি আর আপনাকে লাইন মারি? আহা! কী সুন্দর হ্যান্ডসাম লুক।’
রাশেদ তাজ্জব বনে যায়। অর্ষা লামিয়ার হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে রাশেদকে বলে,
‘কিছু মনে করবেন না। ও আসলে ডেয়ার নিয়েছিল তো তাই আপনার সাথে দুষ্টুমি করেছে।’
লামিয়া যাওয়ার আগে বলে গেল,’এই টাকলা উনার নাম্বারটা ম্যানেজ করে দিয়েন প্লিজ! তাহলে আপনাকে দশ টাকা দেবো।’
রাশেদ দাঁতে দাঁত চেপে ওদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। আহনাফ তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে,
‘কী হয়েছে?’
‘স্যার দেখুন না! কীসব ফাজিল মেয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে! আমাকে ডাকে টাকলা। প্রথমে এসে আমার টাকের প্রশংসা করল। পরে আপনাকে দেখে নাকি ফিদা। আবার আমায় বলে আমি যেন আপনার নাম্বার ঐ মেয়েটিকে ম্যানেজ করে দেই। তাহলে আমায় নাকি দশ টাকা দেবে।’
আহনাফ মেয়েগুলোর দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি গেল অর্ষার দিকে। সে ধরেই নিল এসব কথা অর্ষা বলেছে। তবে সেখানে আর কথা বাড়াল না। গাড়িতে উঠে বলল,
‘গাড়ি স্টার্ট দাও।’
রাশেদ তার টাক মাথায় হাত বুলিয়ে আফসোস করে বলল,’শালার কপাল! এই টাকে একটু চুল গজালে কী এমন হয়ে যেত?’
_____
ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেছে অর্ষার। কাঠের মেইন দরজাটি খুলতে গেলে ক্যাঁচক্যাঁচ একটা শব্দ হয়। আজ বাড়ির ভেতর থেকে আসা শোরগোলের জন্য গেইটের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটা কানে বিঁধল না। বাড়ির ভেতর দরজার পাশেই লাগানো আছে একটা জামরুল গাছ। গাছের পাতা পড়ে উঠোন ভরে গেছে। ঝাড়ু দেওয়া হয়নি। সে হিজাবের পিন খুলতে খুলতে ভেতরে গেল। তাদের বাড়িতে আজকাল নিত্যনতুন ঝগড়া লেগেই থাকে। তার বড়ো ভাই রুহুল-আমিনের মাথায় ভূত উঠেছে সে বিদেশে যাবে। তার কোনো এক বন্ধু নাকি সৌদি আরবে চাকরি করে। মাস শেষে মোটা অংকের একটা বেতনও পায়। এসব গল্পগুজব শুনে রুহুলেরও ইচ্ছে হয়েছে সে বিদেশ যাবে চাকরির জন্য। এজন্য প্রয়োজন অনেক টাকা। পাসপোর্ট, ভিসা করাসহ বাদবাকি যা খরচ করা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী ক্যাশ টাকা তাদের কাছে নেই। এমনকি কোনো ব্যাংক একাউন্টও নেই। এরপর রুহুলের আরেক বন্ধু বুদ্ধি দিলো তার ভাগের সম্পত্তি যেন সে নিয়ে যায়। বিক্রি করে যা টাকা পাবে তা দিয়ে বিদেশ গিয়েও টাকা বাঁচবে। সেদিন থেকেই বাড়িতে ঝগড়া-ঝাটি নিয়মিত হওয়া শুরু করেছে। বাবা কিছুতেই তার বাবার ভিটেমাটি বিক্রি করতে রাজি নয়।
অর্ষা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। রুহুল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তার বাবাকে বলছে,’তুমি আমার ভাগের সম্পত্তি আমারে দিবা না?’
অর্ষার বাবা ওমর রহমানের বয়স হয়েছে। তিনি এখন চাকরি-বাকরি কিছুই করেন না। প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন। মাস চারেক হবে অবসর নিয়েছেন। পেনশনের টাকায় কোনো রকম সংসার চলে। এছাড়া দুই মেয়ে তাদের পড়াশোনার খরচ নিজেরাই চালায়। রুহুল কোনো চাকরি করে না। অন্যের আন্ডারে কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বসের বকাঝকা তার সহ্য হয় না। কিছুদিন ফলের ব্যবসা করে এখন লস খেয়ে বসে আছে।
‘আমি তো বললাম, আমি ম’রা’র পর তোরা তোদের ভাগ নিয়ে যা ইচ্ছে করিস। আমি বেঁচে থাকতে এসব হবে না।’ বললেন ওমর রহমান।
জিদ্দে রুমের ভেতর ভাঙচুর শুরু করে রুহুল। অর্ষা শক্ত কণ্ঠে বলে,
‘একটা জিনিসও তো কেনার মুরোদ হয় না। তাহলে এসব ভাঙছ কোন অধিকারে?’
রুহুল ক্ষিপ্রকণ্ঠে বলে,’একটা কথাও বলবি না তুই। একদম খু’ন করে ফেলব।’
‘তোমার এসব হুমকি-ধামকিতে ভয় পাই আমি? বাবা-মায়ের সাথে ঝামেলা বন্ধ করো বলে দিচ্ছি। সামান্য মানবতাও তো নাই তোমার মাঝে। পারো শুধু বাপের পয়সায় খেতে। আর বন্ধুদের উলটা-পালটা বুদ্ধি শুনতে।’
‘অর্ষা চুপ কর।’ মৃদু ধমক দিয়ে বললেন মা।
অর্ষা বলল,’কেন চুপ করব? কেমন ব্যবহার করে সবসময়। তোমাদের জন্যই তো সাহস পায়।’
রুহুল রাগ দমিয়ে রাখতে না পেরে অর্ষাকে থা’প্পড় দিতে গিয়েও হাত নামিয়ে নেয়। আজকাল অর্ষা আর তার ছোটো বোনটি নেই। তার মাঝে এখন ব্যাপক পরিবর্তন। আগের মতো আহ্লাদী নেই, চুপচাপ মাথা নত করে রাখে না। ভয় পায় না। বরঞ্চ এখন প্রতিটা কথার, কাজের প্রতিবাদ করে নির্ভয়ে। আগে রাগে এজন্য বার দুয়েক হাতও তুলেছিল; অর্ষা দমে যায়নি। বরং এমন কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছিল যেগুলো এখনও তার কর্ণকুহরে মাঝে মাঝেই আঘাত হানে। তারই জের ধরে আজও সে মারতে গিয়ে হাত নামিয়ে নিয়েছে। রাগে তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে।
অর্ষা চুপ করে থাকল না। সে রাগান্বিতস্বরে বলে,’কাপুরুষের মতো শুধু মারতেই পারবে। বোনের প্রতি তো কোনো দায়িত্ব পালন করার বেলায় তোমায় খুঁজে পাওয়া যায় না।’
রুহুল অর্ষাকে কিছুই বলল না। শুধু বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলে গেল,
‘থাইকো দুই মেয়ে নিয়া তোমরা। আমিই চলে যাব তোমাদের বাড়ি থেকে।’
রুহুল বেরিয়ে যাওয়ার পর ওমর রহমান অর্ষাকে বলেন,’জানিস-ই তো ও এমন! শুধু শুধু ও-কে রাগাস কেন বল তো?’
‘চোখ বেঁধে রাখলে এই প্রশ্নের উত্তর জীবনেও পাবে না।’ বলে অর্ষা চলে যায় নিজের রুমে। এত অন্যায়-অবিচার, খারাপ ব্যবহার করার পরও ছেলের প্রতি দরদ বাবা-মায়ের কখনো কমে না।
.
পরন্ত বিকেল। ডুবো ডুবো সূর্যের আলো চারদিকে। সকাল কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরে তখন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ড্রেস না পালটিয়েই অর্ষার পাশে শুয়ে পড়ে। গায়ের ওপর হাত রেখে বলে,
‘আপু ঘুমিয়েছিস?’
ঘুম জড়ানো গলায় অর্ষা বলল,’হু।’
‘ওঠ না একটু। কথা আছে।’
‘পরে।’
‘খুব জরুরী কথা।’
ঘুমের মধ্যে উঠে বসল অর্ষা। ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’বল।’
‘আপু আমার পড়ার অনেক চাপ এখন।’
‘তো?’
‘বাড়িতে গিয়ে প্রাইভেট পড়ানোর সময় নেই। সারাদিন ক্লাস করে কোথাও গিয়ে পড়াতেও ইচ্ছে করে না। বাকি যেগুলো টিউশনি করাই ওরা বাড়িতে এসে পড়ে যাবে। একটা বাচ্চাকে আমি বাসায় গিয়ে পড়াই। ওখানেই আমি তিন হাজার টাকা পাই। ঐ প্রাইভেটটা তুই নিয়ে নে।’
‘ধুর! আমি এখন চাকরির ব্যবস্থা করব। টিউশনি করিয়ে ভালোমতো সংসার চলে না।’
‘যে ক’দিন তোর চাকরি না হয় সে ক’দিন অন্তত পড়া।’
‘দেখি।’
‘দেখি না আপু। বাচ্চাটার পরীক্ষা চলছে স্কুলে। এদিকে আমারও এখন অনেক পড়া বাকি। ঐ বাসায় পড়াতে গেলে পড়াগুলো কমপ্লিট করতে পারব না।’
অর্ষা হাই তুলে বলল,’কী যে ঝামেলায় আমায় ফেলিস তুই! প্রাইভেট ক’টায়?’
‘পাঁচটা থেকে। সাড়ে চারটা বাজে। তুই উঠে ফ্রেশ হয়ে নে।’
ঘুম আর সম্পূর্ণ হলো না। ফ্রেশ হয়ে সকালের থেকে ঠিকানা নিয়ে অর্ষা বেরিয়ে পড়ে। এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো লাগত। ঘুম ঘুম ভাবটা এখনও কাটেনি। ঐ সময়ে বাড়িতে চা হয় না। তাই ইচ্ছে হলেও খেতে পারেনি। মা কিংবা সকালকে বললে অবশ্য বানিয়ে দিত। কিন্তু মায়ের ওপর এখন সে রেগে আছে। আর সকাল মাত্র এসেছে কলেজ থেকে। এমনিতেই তো ও ক্লান্ত। যা হোক, হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে পৌঁছে যায় সে।
দরজার সামনে বিশাল গোঁফওয়ালা এক দারোয়ান দাঁড়ানো। তার গোঁফটাই যে বিশাল তা নয়; শরীরটাও বিশাল। এমন দারোয়ানের ভয়ে তো চোর ডাকাত বাড়ির ত্রিসীমানায়ও পা রাখতে ভয় পাবে।
অর্ষাকে দেখে দারোয়ান একটু এগিয়ে এলো। কী রকম ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলল,’কাকে চাই?’
‘আমি রাফিকে প্রাইভেট পড়াতে এসেছি।’
দারোয়ান আগাগোড়া অর্ষাকে পরখ করে বলল,’রাফিকে তো অন্য এক মেয়ে প্রাইভেট পড়ায়। আপনি কে?’
‘জি আমি ওর বড়ো বোন। ওর পড়ার চাপ থাকায় আমি রাফিকে পড়াতে এসেছি।’
‘বাড়ির লোকদের পারমিশন আছে?’
অর্ষার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এমন কোন বাড়ি এটা যে এখন তার পারমিশন কার্ডও লাগবে! দারোয়ান বোধ হয় অর্ষার বিরক্তির কারণটি বুঝতে পারলেন। বললেন,
‘এখানেই দাঁড়ান। আমি ফোন করে আসছি।’
অর্ষা নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দারোয়ান মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরে এসে বলল,’ভেতরে যান।’
অর্ষা ভেতরে যেতে যেতে ভাবছে আবার নতুন কোনো জেরার মুখে না পড়তে হয়! দরজায় দু’বার কলিংবেল বাজানোর পর একজন সুদর্শন যুবক দরজা খুলে দিলো। অর্ষার কেন জানি মনে হচ্ছে, আগে কোথাও সে এই ছেলেকে দেখেছে। কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না।
অর্ষা ভেবেছিল এই লোকও অর্ষার পরিচয় জানতে চাইবে। তবে এমন কিছু হলো না। বরঞ্চ যাওয়ার জন্য সরে গিয়ে পথ করে দিলো। অর্ষা ভেতরে যাওয়ার পর ছেলেটি ড্রয়িংরুমে বসে থাকা এক মেয়েকে বলল,
‘রেণু আপা, রাফিকে বলো ওর নতুন টিচার এসেছে।’
রেণু অর্ষাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলে বামদিকে চলে গেল। অর্ষা বসে আছে চুপচাপ। তার থেকে একটুখানি দূরে সে বসে টিভিতে খেলা দেখছে। অর্ষার একটু ইতস্তত লাগছিল। সে দেয়ালে প্রফেসরের ছবি দেখতে পায়। সাথে এই ছেলেটি দাঁড়ানো। তখন তার মনে হলো ভার্সিটিতেই স্টেজে বসে থাকতে দেখেছিল। কী যেন নাম! হ্যাঁ, আহনাফ। তার ভাবনার মাঝে তখন রেণু এসে অর্ষাকে নিয়ে গেল।
রাফির গোলগাল চেহারায় গোল ফ্রেমের একটা চশমা। চোখগুলো বড়ো বড়ো কিন্তু বেশ মায়াবী। মুখটায় মায়া মিশে আছে। অর্ষা হাসল। রাফি অবশ্য একটুও হাসেনি। সে কেমন গম্ভীর গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অর্ষার দিকে।
রেণু চলে যাওয়ার আগে রাফিকে বলল,’এটা তোমার নতুন ম্যাডাম। একটুও দুষ্টুমি করবা না কিন্তু।’
অর্ষার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, এই ছেলে কি আদৌ দুষ্টুমি করতে পারে? মুখের দিকে তাকালেই তো মনে হয় সিরিয়াস টাইপ বাচ্চা। প্রশ্নটি আর করা হলো না। রেণু চলে গেছে।
রাফি এবার প্রথম মুখ খুলল,’তুমি কেন এসেছ? সকাল ম্যাম কোথায়?’
অর্ষা মুচকি হেসে বলল,’তোমার সকাল ম্যামের পড়ার অনেক চাপ। সে তো এখন আর আসতে পারবে না।’
‘আমি তোমার কাছে পড়ব না।’
কী মুসিবত! বাচ্চাকাচ্চা সামলানোর বিশেষ এক গুণ রয়েছে অর্ষার। কিন্তু এমন সিরিয়াস টাইপ বাচ্চাকে কী করে কব্জা করতে হয় অর্ষার জানা নেই। বাচ্চারা হবে দুষ্টু, দূরন্ত, চঞ্চল। সবসময় হাসবে। বাচ্চা কেন এমন গম্ভীর হয়ে থাকবে?
অর্ষা ঠোঁটে হাসি ধরেই রাখল। বলল,’আচ্ছা বেশিদিন পড়তে হবে না। তোমার পরীক্ষা শেষ হলে আমি আর আসব না। এই ক’দিন আমার কাছে পড়ো?’
রেণু ট্রে-তে চা, বিস্কিট এনে টেবিলের ওপর রাখল। যেভাবে নিঃশব্দে এসেছিল, সেভাবে নিঃশব্দেই চলে গেল। রাফি তখন বলল,
‘তাও পড়ব না।’
অর্ষা আর কথা না বাড়িয়ে চায়ে চুমুক দিলো। মাথা ধরে গেছে। সে বলল,
‘বই বের করে যা ইচ্ছে করো তুমি। একা একাই পড়ো।’
রাফি চুপ করে বসে রইল। তার দৃষ্টি স্থির। অর্ষা প্রায় বিরক্ত হয়েই বলল,
‘তুমি কি সত্যিই আমার কাছে পড়বে না? তাহলে আমি গিয়ে কথাটা তোমার গার্জিয়ানকে জানাচ্ছি।’
রাফি বাধা দিয়ে বলল,’না। আমি একাই একাই পড়ছি। তুমি কাউকে কিছু বোলো না।’
সত্যি সত্যিই রাফি একা একা পড়তে শুরু করেছে। অর্ষা বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। হাই তুলে টবিলের ওপর হাত রাখে। হাতের ওপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করতেই কেমন ঘুম ঘুম ধরে যায়। চায়ে কাজ হয়নি। কড়া চা হলে ঘুম আসতো না। মিষ্টি বেশি দিয়ে ফেলেছে। সে চা নিয়ে গবেষণা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। রাফি বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ষার দিকে। পড়াতে এসে ঘুমিয়ে পড়ে; এমন টিচার হয়তো ইতিপূর্বে সে কখনো দেখেনি। সে ডাকলও না। একটু একটু করে অর্ষার দিকে তাকাচ্ছিল আর খাতায় কবিতা লিখছিল।
আহনাফ টিভি দেখা শেষ করে নিজের রুমে যাওয়ার সময় রেণু রান্নাঘর থেকে এসে বলে,
‘ভাইজান আপনে একটু গিয়া দেইখা আসেন রাফি ঠিকমতো পড়তাছে নাকি। ওর মতিগতি তো আমি কিছু বুঝি না।’
আহনাফ কথাগুলো শুনে পড়ার রুমে যায়। পদশব্দ শুনতে পেয়ে ঘুম ঘুম ভাব উবে যায় অর্ষার। সে তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে একটা বই হাতে নেয়। মুখের সামনে বই ধরে গভীর মনোযোগ দিয়ে চোখ বুলানোর প্রচেষ্টা তার। অথচ চোখ ভর্তি ঘুম!
আহনাফ রুমে এসে একবার রাফির দিকে তাকাল আর একবার অর্ষার দিকে। ফিরে যাওয়ার পূর্বে অর্ষার উদ্দেশ্যে বলল,
‘বইটা উলটো ধরেছেন। সোজা করে ধরে পড়ুন।’
চলবে…