#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_১৭
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
অর্ষা রাগে, জিদ্দে পারছে না শুধু ফাইলগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করতে। যদিও অবলা, অসহায় ফাইলগুলোর কোনও দোষ নেই এখানে। সে শব্দ করে ফাইলগুলো ডেস্কের ওপর রাখল। আহনাফের পরিবর্তন তার কাছে ভালো লাগছে না। সে যখন যা ইচ্ছে তাই করবে নাকি? সেদিন ঐ কথাগুলো বলার আগে এসব মাথায় ছিল না? সে শুধু অপমান-ই করেনি; ইগো হার্টও করেছে, যেটা অর্ষা কোনও দিন ভুলতে পারবে না। রাগ সামলে সে ফাইলগুলো নিয়ে জিসানের কেবিনে গেল। জিসান অর্ষাকে দেখেই মুচকি হাসে। বিব্রত হলো অর্ষা। হওয়ারই কথা। যাকে রাগ ছাড়া কখনও দেখেনি তাকে যখন হুটহাট কারণ ছাড়াই হাসতে দেখে তখন বিব্রত না হয়ে আর উপায় কী।
জিসান হেসে বলল,
“বসো।”
ফাইলগুলো দিলেই অর্ষার কাজ শেষ। বসার কোনও প্রয়োজন নেই। তবুও জিসান কেন তাকে বসতে বলছে সেটা বুঝতে পারছে না। ওদিকে তার আরও কাজ আছে। কিন্তু সামনে বসে থাকা মানুষটি তো আর আহনাফ নয় যে মুখের ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং দু’চারটা কথা শুনিয়ে দেবে।
অর্ষাকে বিব্রতমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিসান বলল,
“কী হলো? বসো।”
অর্ষা প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসার চেষ্টা করে বসল। জিসান ফাইলগুলো দেখছে। দুটো ফাইল দেখেই বন্ধ করে সরিয়ে রাখল। জিজ্ঞেস করল,
“সকালে খেয়েছ?”
অর্ষার ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। এই লোকের হলোটা কী হঠাৎ? এত ভালো-মন্দ, খোঁজ-খবর কেন নিচ্ছে? ভেতরের চাপা উত্তেজনা ভেতরেই চাপা রেখে অর্ষা বলল,
“জি।”
“কাজ কেমন চলছে?”
“জি, ভালো।”
“কোনও সমস্যা হচ্ছে না তো?”
“না, স্যার।”
“কোনও সমস্যা হলে আমায় জানাবে। ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। আমাকে বন্ধুর মতো ভাববে।”
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“জি, জি স্যার।”
জিসান হাসি হাসি মুখ করে অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিল অর্ষা। এখানে আর সঙের মতো বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল,
“স্যার, আমার যদি এখানে কোনও কাজ না থাকে তাহলে আমি যাই? আমার কয়েকটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ যাও।”
অর্ষা বাইরে এসে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। সব মুসিবত কি একসাথে তার ঘাড়ে এসে চেপে বসতে চাইছে নাকি আল্লাহ্ মালুম! এমন হলে সে চাকরীটা কন্টিনিউ করবে কীভাবে?
নিজের জায়গায় গিয়ে সে আহিলের সিভিটা নিল। এরপর গেল মিজানের কেবিনে। অর্ষাকে দেখে মিজান বলল,
“কী ব্যাপার অর্ষা? কিছু বলবে?”
“জি স্যার। আপনি ফ্রি আছেন?”
“হ্যাঁ। বসো।”
অর্ষা বসল। বলল,
“স্যার একটা উপকার করতে হবে।”
“কী উপকার বলো? সম্ভব হলে অবশ্যই করব।”
“আমার একটা ফ্রেন্ডের চাকরীর ভীষণ দরকার। একটা ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ!”
মিজান কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল,
“এখন তো কোনও লোক নিয়োগ দিচ্ছে না ময়না। আচ্ছা তাও একটা সিভি দিও তুমি। আমি আহনাফ স্যারের সাথে কথা বলে জানাব।”
অর্ষা সিভিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নিয়ে এসেছি। প্লিজ ট্রাই করবেন যেন চাকরীটা ও পেয়ে যায়। রিকোয়েস্ট প্লিজ!”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অবশ্যই চেষ্টা করব।”
“থ্যাঙ্কিউ স্যার। আসছি।”
মিজান মাথা নাড়াল।
.
.
সকাল বাবা-মায়ের সামনে বসে আছে। কলেজ থেকে আসার পর দেখল তারা দুজনই ভীষণ কান্নাকাটি করছে। কেন কাঁদছে এই প্রশ্ন হাজার বার করেও কোনও উত্তর পেল না। একবার ভাবল অর্ষাকে ফোন করে জানাবে কিনা। পরে আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলল। এমনিতেই তার বোনটা অনেক কষ্ট করে। সারাদিন কাজ করে এসে আবার টিউশনি করায়। এর মাঝে এক্সট্রা টেনশন জুড়ে দেওয়ার কোনও মানেই হয় না।
সকাল যে কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল নিজেও জানে না। গম্ভীরসুরে মাকে জিজ্ঞেস করল,
“দুপুরে খেয়েছিলে?”
সেলিনা বেগম শাড়ির আঁচলে নাকের পানি, চোখের পানি মুছে বললেন,
“তোর বাবা খায়নি। আমি খাই কী করে?”
সকাল উঠে গেল। ভাত, তরকারি সব বেড়ে কড়া কণ্ঠে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার খুব খিদে পেয়েছে। তোমরা যদি এখন আমার সাথে খেতে না বসো তাহলে কিন্তু আমিও খাব না বলে দিচ্ছি।”
সেলিনা বেগম স্বামীকে বুঝিয়ে, সুঝিয়ে খেতে বসালেন। খেতে বসলেও খাবার তার গলা দিয়ে নামছিল না। কতগুলো দিন পার হয়ে গেল অথচ এখনও রুহুলের কোনও খবর পায়নি তারা। দুশ্চিন্তায় দিনদিন আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তিনি। বাবা-মায়ের খাওয়া শেষ হলে সে বড়ো মানুষের মতো করে বলল,
“তোমরা এখন শুয়ে থাকো। একটু রেস্ট করো। কান্নাকাটি তো কম করলে না।”
ক্লান্তি বোধ করায় ওমর রহমান এবং সেলিনা বেগম সকালের কথামতন শুয়ে রইলেন। ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে সকাল এঁটো থালাবাসনগুলো ধুয়ে ফেলল। চুলায় ভাত বসিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিতে গেল। সারাদিন ডিউটি করে এসে অর্ষার যদি ভাতের খিদে পায় তখন? তাই সে এক ঘণ্টায় যা পারে রান্না করে রাফিকে পড়াতে যাবে। উঠান ঝাড়ু দেওয়ার সময় সদর দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকায়। আহিল এসেছে। তার পরনে কালো রঙের প্যান্ট-শার্ট। এক মুহূর্তের জন্য থমকাল সকাল। তার এই এক সমস্যা। কালো ড্রেস পরা কোনও ছেলেকে দেখলেই যেন হৃদস্পন্দন থেমে যায় তার। অসভ্য মনটাকে এজন্য সে কত যে গালমন্দ করে তার হিসাব নেই।
নিজেকে চট করেই সামলে নিল সকাল। ঝাড়ু হাতে নিয়েই জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যাপার?”
আহিল শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“অর্ষা আসেনি?”
“উঁহু। একটুপরেই এসে পড়বে। আপনি বসেন।”
“না, বসব না।” বলে আহিল তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে। সে কাগজটি সকালের দিকে এগিয়ে দিতেই চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে সকাল। বিস্মিতস্বরে বলে ওঠে,
“আল্লাহ্! মাত্র ক’দিন দেখা হয়েছে আমাদের? কথা হয়েছে ক’দিন? এর মধ্যেই আপনি আমাকে লাভ লেটার দিচ্ছেন? আমি আপনাকে কত শান্তশিষ্ট ভেবেছিলাম! আপনি তো দেখছি ভেজা বেড়াল নন একদম। ভেতরে ভেতরে সেয়ানা। আপু জানে এসব? নাকি আপুর অগোচরে আমাকে পটানোর চেষ্টা করছেন?”
সকালের কথা শুনে আহিল ভিরমি খেয়ে তাকিয়ে থাকে। সকাল তখনও ফোস ফোস করে যাচ্ছিল। আহিল অবাক হয়ে বলল,
“এসব কী বলছেন আপনি? আপনাকে আমি লাভ লেটার দিতে যাব কেন?”
সকাল ভ্রুকুটি করে বলল,
“লাভ লেটার নয়?”
“না।”
“তবে কী ওটা?”
“নোট। এই সপ্তাহের পড়াগুলো সব নোট করে অর্ষার জন্য এনেছি।”
সকাল বিমর্ষস্বরে বলল,
“ওহহ! আমি আরও ভাবলাম লাভ লেটার। আচ্ছা যাই হোক, এটা আপনার আমাকে আগে বলা উচিত ছিল।”
“আপনি বলার সুযোগটা দিলেন কোথায়? নিজে নিজেই তো এতগুলে কথা শুনিয়ে গেলেন।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপুকে দিয়ে দেবো।” বলে আহিলের হাত থেকে ছোঁ মেরে কাগজটি নিল।
আহিল বলল,
“যাই আমি।”
“চলে যাচ্ছেন যে? আপুর সঙ্গে দেখা করবেন না?”
“না। কাজ আছে একটু।”
“ঠিক আছে। আর শুনেন, আপনাকে যে আমি কথা শুনিয়েছি এসব আবার আপুকে বলতে যেয়েন না যেন।”
আহিল পিছু ফিরে বলল,
“কেন?”
“কেন মানে? আপু শুনলে বকবে না আমায়?”
“বকা খাওয়াই তো উচিত আপনার। তাহলে হিসাব করে কথা বলা শিখবেন।”
“আর এমন হবে না। তিন সত্যি।”
“আচ্ছা বলব না।” বলে আহিল হাঁটা ধরে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সকালের বোকা বোকা কথাগুলো মনে করে আনমনে হাসে।
______
স্মৃতি আর অর্ষা কথা বলতে বলতে অফিস থেকে বের হচ্ছিল। জিসানের পরিবর্তনের কথা শুনে স্মৃতি বলে,
“আমি ৯৯% গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ঐ ব্যাটা নির্ঘাত তোমার প্রেমে পড়েছে।”
“তাহলে এটা আমার জন্য সত্যিই দুঃখজনক একটা কথা। কিন্তু আমি চাই না এমনটা হোক।”
স্মৃতি ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“কেন? সমস্যা কী? স্যার তো এখন আর আগের মতো রাগী নেই।”
“এখানে কাজ করতে এসেছি স্মৃতি। মনোযোগ অন্যদিকে নিতে চাই না।”
“তুমি অদ্ভুত একটা মেয়ে। এরকম সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চায় নাকি? আমি বলি শোনো, স্যার দেখতে সুন্দর আছে। স্যালারিও ভালো। যদি প্রপোজ করে তাহলে সরাসরি বিয়ের কথা বলে দেবে। যদি রাজি হয় তাহলে বিয়ে করে ফেলবে।”
অর্ষা হাসল। স্মৃতি গাল ফুলিয়ে বলে,
“হাসো কেন?”
“তোমার কথা শুনে।”
“খারাপ কিছু বলেছি?”
“একদম না। তবে আমার মনে হয় না জিসান স্যার আমায় পছন্দ করে। মানে তুমি যেভাবে বলছ আরকি! হতে পারে সে আমার সাথে খারাপ আচরণ করায় তার গিল্টি ফিল হয়েছে তাই সে এখন ভালো আচরণ করছে।”
“তোমার তাই মনে হয়?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে চলো বাজি ধরি?”
“কীসের বাজি?”
“তোমার ধারণা সত্যি হয় নাকি আমার ধারণা সত্যি হয় সেটা দেখব।”
অর্ষা হেসে বলল,
“না, বাবা দরকার নেই। এসব বাদ দাও। আমরা কাজ করতে এসেছি, শান্তিমতো কাজ করতে পারলেই হলো।”
“তুমি না কেমন জানি! তোমার জায়গায় আমি হলেই তো এই সুযোগ হাতছাড়া করতাম না।”
“তাহলে তুমিই তাকে প্রস্তাব দিচ্ছ না কেন?”
“ধুর যা! পরে দেখা যাবে আমাকে দু’হাতে তুলে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবে।”
স্মৃতির কথা শুনে অর্ষা শব্দ করে হাসল।
“আচ্ছা অর্ষা তুমি কাউকে ভালোবাসোনি কখনও?”
হঠাৎ স্মৃতির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে অর্ষার হাসি থেমে যায়। মুখে একরাশ মলিনতা। ভালোবাসা! বেসেছিল নাকি বাসে? অতীত নাকি তা বর্তমানেও স্থির রয়েছে? না, বর্তমানে ভালোবাসা বলতে তার জীবনে কিছু নেই।
অর্ষা উত্তর দেওয়ার আগেই স্মৃতি ও-কে কনুই দ্বারা গুঁতা দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ঐ দেখো, গেটের বাইরে জিসান স্যার দাঁড়িয়ে আছে।”
অর্ষা সামনে তাকাল। স্মৃতির মতো করেই বিড়বিড় করে বলল,
“তাতে কী?”
“মনে হচ্ছে তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে।”
“হুশ!”
গেটের বাইরে যাওয়ার পর সত্যি সত্যিই অর্ষার মনে হতে লাগল জিসান তার জন্যই অপেক্ষারত ছিল। সে সুন্দর করে হেসে জিজ্ঞেস করল,
“বাড়ি যাচ্ছ?”
অর্ষা মনে মনে বলে,
“আহাম্মক! অফিস ছুটির পর বাড়িতে যাব না তো কি অফিসেই বসে থাকব?”
কিন্তু মুখে বলল,
“জি, স্যার।”
“চলো একসাথে যাই।”
অর্ষা ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
“কিন্তু স্যার আমাকে তো স্মৃতির সাথে একটু পার্লারে যেতে হবে এখন।”
স্মৃতি চোখ বড়ো করে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। জিসান একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলো। পরক্ষণে সপ্রতিভ হয়ে বলল,
“আচ্ছা সমস্যা নেই। সাবধানে যেও।”
“জি স্যার। আপনিও সাবধানে যাবেন।”
জিসান তার বাইকে করে চলে গেল। স্মৃতি কোমরে দু’হাত রেখে বলল,
“মিথ্যা বললা কেন?”
“তো কী করব? তার সাথে বাইকে করে যাব? মাথা খারাপ নাকি! একে যতটা পারা যায় এড়িয়ে চলতে হবে।”
স্মৃতি ফোনে সময় দেখে বলল,
“মন যাতে সায় দেয় তা-ই করো। কিন্তু এখন বাসায় যেতে হবে।”
দুজনের বাড়ি দু’দিকে হওয়ায় একসাথে যাওয়া সম্ভব না। তাই দুজন দু’দিকে হাঁটা ধরে। অর্ষা বাসায় যাওয়ার আগে বাজারে যায়। কিছু তরিতরকারি কিনতে হবে। বাসায় বাজার নেই কোনও। ডাল আর আলু ভর্তা দিয়েই সকালে খেয়ে এসেছিল। সারাদিন ওরা হয়তো ডাল, আলু ভর্তাই খেয়েছে। সে বাজার ঘুরে ঘুরে তরকারি দেখছে। দামাদামি করছে। দামাদামিতে সে এখনও পটু হতে পারেনি। তবে হয়ে যাবে বলেই ধারণা।
“লাউ শাক নাও। আমার খুব পছন্দের।”
অর্ষা চমকে পেছনে তাকাল। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে আহনাফ দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্ষা চোখ পাকিয়ে বলল,
“আপনি এখানে কেন?”
আহনাফ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বলল,
“কোথাও তো এমন কোনও সাইনবোর্ড দেখছি না যেখানে লেখা আছে,’এই বাজারে আহনাফ মিজবাহ চৌধুরীর আসা নিষেধ।’ তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?”
“মশকরা করেন আপনি আমার সাথে?”
“মশকরা করতে যাব কেন? তোমার সাথে কি আমার মশকরা করার সম্পর্ক? তোমার সাথে আমার পেয়ার, মহব্বতের সম্পর্ক।”
অর্ষা রাগ করে ঐ দোকান থেকে অন্য দোকানে চলে যায়। পিছু পিছু আহনাফও যায়। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় অর্ষার। সে চিৎকার করে রাগ ঝাড়তে গিয়েও থেমে যায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“কেন ফলো করছেন আমায়?”
আহনাফ ভ্রুকুটি করে বলে,
“তোমাকে আমি ফলো করতে যাব কেন হ্যাঁ? আমিও বাজার করতে এসেছি।” এই বলেই সে দোকানদারকে বলল,
“এই মামা এক কেজি লেবু দেন।”
দোকানদার মাথা চুলকে বলে,
“মামা লেবু তো কেজি দরে বেচি না। হালি বেচি।”
অর্ষার সেই মুহূর্তে হাসি পেয়ে গেলেও সে হাসল না। অনেক কষ্টে চেপে গেল। আহনাফ বলল,
“ঠিক আছে তাহলে পাঁচ হালি লেবু দেন।”
“আর কী দিমু মামা?”
আহনাফ তখন অর্ষার উদ্দেশ্যে বলল,
“একটু সাহায্য করো এটলিস্ট। আর কী কী নেওয়া যায়?”
“আপনি কী কী বাজার নেবেন তা আমি জানি নাকি?”
অর্ষার কথার মাঝেই সেখানে হুড়মুড় করে মুন এসে উপস্থিত হয়। তার পিছু পিছু আদিব দু’হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসছে। মুন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে একবার অর্ষার দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার আহনাফের দিকে চাকাচ্ছে। এরপরই সে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে,
“দোস্ত তোরাও কি না জানিয়ে বিয়েশাদী করে ফেলেছিস আমাদের মতো? না, না আমাদের মতো বলছি কেন। আমি তো তোকে জানিয়েছি। আমার বিয়েতে সাক্ষীও তোকে রেখেছি। সবচেয়ে বড়ো মিষ্টিটা তোকে খাইয়েছি। হ্যাঁ, তোর মিষ্টি থেকে একটুখানি আমিও খেয়েছিলাম অস্বীকার করব না। তুই একবার সাধলি বলেই তো রাজি হয়েছিলাম খেতে। বুঝতে পারছি আরও দু’বার সাধার পর রাজি হওয়া উচিত ছিল। সে যাই হোক, ঐ রাগে তুই আমাকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেললি দুলাভাইকে?”
আহনাফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। তবে মুনকে সে চিনতে পেরেছে। অর্ষা আশেপাশে একবার তাকাল। তারপর কপাল চাপড়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছিস নাকি?”
মুন প্রতিবাদ জানাল। বলল,
“পাগল হব কেন? নিজ চক্ষেই তো দেখতে পাচ্ছি সব। এই মামা-ও সাক্ষী।” দোকানদারকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল মুন।
অর্ষা মুনকে নিয়ে দোকানের সামনে থেকে সরে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। আদিবও গেল সেখানে। আহনাফ যাওয়ার সময় দোকানদার ডেকে বলল,
“মামা লেবু নিবেন না?”
আহনাফ টাকা দিয়ে লেবু নিয়ে অর্ষার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মুন সতর্ক দৃষ্টিতে একবার আহনাফের দিকে তাকিয়ে লেবুর দিকে তাকাল। বলল,
“লেবুগুলো তো সুন্দর আছে দুলাভাই। আমি একটা নিই?”
আহনাফ বোকার মতো হেসে বলল,
“ইয়ে! সবগুলোই নাও তুমি।”
মুন লেবুগুলো নিয়ে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ দুলাভাই।”
অর্ষা প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে বলল,
“বারবার দুলাভাই দুলাভাই করছিস কেন? তোর কোন বোনের স্বামী সে?”
“কেন তোর?”
“আজেবাজে কথা বলবি না। আপনি ওকে সহ্য করেন কীভাবে ভাইয়া?”
শেষের কথাটা আদিবকে উদ্দেশ্য করে বলল অর্ষা। আদিব একটা প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,
“দুঃখের কথা আর বলব কী বোন! শোনার মতো কেউ নেই।”
মুন চোখ পাকিয়ে একবার আদিবের দিকে তাকাল। অর্ষাকে বলল,
“তোরা বিয়ে করেছিস কবে?”
“আমরা বিয়ে করিনি মুন।”
“মিথ্যা বলবি না। একসাথে বাজার করতে এসেছিস। সংসার না করলে বাজার কেন হুম?”
“আমি আমার বাসার জন্য বাজার করতে এসেছি। আর সে তার বাসার জন্য। এখানে এসে দেখা হয়েছে। বুঝেছিস এবার?”
“ওহ তাই বল! আমি ভাবলাম আমায় না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেছিস।”
“ভুল ভেবেছিস। আর কখনও এমনটা ভাবিস না। এটা কোনোদিন সম্ভব না।”
আহনাফ মাঝখানে ফোঁড়ন কেটে বলল,
“তুমি মনে হয় ভবিষ্যৎবাণী করতে জানো। কী হবে না হবে সব জানো?”
“সব জানিনা। তবে এটা জানি, মুন যেটা ভেবেছে সেটা কখনও হবে না।”
মুন বলল,
“কেন? হোক না। উনাকে তো দুলাভাই হিসেবে অনেক পছন্দ হয়েছে। আপনার নাম কী?”
আহনাফ বলল,”শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার নাম দুলাভাই।”
মুন হেসে আদিবকে বলল,
“দুলাভাই একদম তোমার মতো দুষ্টু।”
আদিব ঝেড়ে কাঁশল। মুন তখন বায়না ধরে বলল,
“অনেকদিন হয়েছে তুই আমার বাসায় যাস না। আজ চল যাই প্লিজ! আমি তোর কোনও বারণ শুনব না।”
“আজ না। অন্য একদিন।”
“না, না। আজ মানে আজই।”
অগত্যা অর্ষাকে মুনের জেদের কাছে পরাস্ত হতে হয়। আহনাফ চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় তখন। মুন বলে,
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন দুলাভাই? আপনিও চলেন।”
অর্ষা রাগান্বিত স্বরে বলল,
“সে গেলে আমি যাব না।”
“তুই যাবি, তোর জামাইসহ যাবে। আদিব, তুমি দুলাভাইকে ধরে নিয়ে আসো। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।”
মুন শক্ত করে অর্ষার হাত চেপে ধরে হাঁটছে। আদিব অসহায়ের মতো মুখ করে আহনাফকে বলে,
“ভাই, আমার দু’হাতেই বাজারের ব্যাগ। আপনাকে ধরে নিয়ে যাই কীভাবে বলেন? আবার বউয়ের কথা না শুনলেও প্যানপ্যানানি, ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে হবে এক সপ্তাহ্। তাই আপনি যদি নিজেই আমার হাতটা ধরে সাথে যেতেন তাহলে খুবই উপকৃত হতাম।”
আহনাফ হেসে ফেলে আদিবের কথা শুনে। এক হাতে আদিবের হাত ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে রাশেদকে কল করে বলে দেয়, সে যেন গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যায়। তারপর ফোন আবার পকেটে রেখে আদিবের হাত থেকে একটা বাজারের ব্যাগ নেয়। আদিব দিতে চায় না। আহনাফ তবুও জোর করে নিল।
ওরা বাজার থেকে বের হতে হতেই মুন একটা সিএনজি ডেকে ভাড়া করে নিয়েছে। আহনাফ আর আদিব আসার পর আদিবকে বলল,
“তুমি সামনে ড্রাইভারের পাশে বসো। দুলাভাই আপনি পেছনে ঐপাশে বসেন যান। আমি এইপাশে আছি। দেখি ও কী করে আজ আমার বাসায় না যায়।”
মুনের এমন চঞ্চলতায় আর অর্ষার ভারী বর্ষণধারার মতোন মুখাবয়ব দেখে মুখ টিপে হাসে আহনাফ। মুন আর আহনাফের মাঝখানে বসেছে অর্ষা। সে চোখ-মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। মুন নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন সে বড়োসড়ো একটা যু’দ্ধ জয় করেছে মাত্রই। আহনাফ অর্ষার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছে। বাতাসের দাপটে হিজাব সরে ছোটো চুলগুলো বেরিয়ে এসেছে অর্ষার। সেগুলো উড়ছে তাদের ইচ্ছেমতোন। আহনাফ সুযোগ বুঝে মুখটা একটু কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমার রাগবতী বাটারফ্লাই, আপনাকে আমি ভালোবাসি।”
চলবে…