#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_২৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
আহনাফ, হাসিব এবং জহির চৌধুরী একসাথে খেতে বসেছেন। রেণু খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। জহির চৌধুরী রেণুকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমেনা আর রাফি খেয়েছে?”
রেণু মাথা ঝাঁকাল। তিনি ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি খেয়েছ?”
“হ খালু। রাফিরে খাওয়ানোর সময় খাইয়া নিছি।”
“ভালো করেছ।”
হাসিব কখন থেকে আহনাফকে খোঁচাচ্ছে। তিনি বিষয়টা খেয়াল করেও এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু বারবার একই ঘটনা ঘটায় তিনি বললেন,
“তোমরা কি কিছু বলতে চাও?”
হাসিব যেন সুযোগ পেয়ে গেল। খাবার গিলে মুখটা হাসি হাসি করে বলল,
“জি আঙ্কেল। আহনাফ বলবে।”
আহনাফ খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে হাসিবের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। দুজনের খোঁচাখোঁচির কারণ হচ্ছে বিয়ের প্রসঙ্গ। কথা ছিল হাসিব নিজেই বলবে। অথচ এখন ফাঁসিয়ে দিল আহনাফকে। বাপের কাছে তাই বলে কি নিজের বিয়ের কথা যেচে নিজেই বলা যায়? কী লজ্জা!
“ওর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? কী বলবে বলো।” বললেন জহির চৌধুরী।
আহনাফ হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কিছু না আব্বু।”
হাসিব মৃদু ধমকের সুরে বলল,
“মিথ্যা বলিস কেন? তুই না বিয়ে করবি? বল আঙ্কেলকে।”
আহনাফের বাবার দিকে তাকাতে লজ্জা করছে। তাই সে মাথা নত করে রেখেছে। ছেলেকে লজ্জা পেতে দেখে মুচকি হাসলেন জহির চৌধুরী। বললেন,
“শুনেছিলাম, শশীকে নাকি বিয়ে করবে না। তাহলে এখন আবার বিয়ের কথা ভাবছ। মেয়ে ঠিক করা আছে বুঝি?”
হাসিব বলল,
“হ্যাঁ, আঙ্কেল। মেয়ে তো ঠিক করাই। এখন শুধু আপনি হ্যাঁ বলা বাকি। তাহলেই আমরা মেয়েকে উঠিয়ে আনতে পারি।”
তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন,
“তাই বুঝি? তুমি চেনো মেয়েকে?”
“চিনি মানে! কী যে বলেন না আপনি আঙ্কেল। ওর প্রেম-কাহিনিও জানি।”
আহনাফ এবার চোখ পাকিয়ে তাকায়। বলতে বলতে হড়বড় করে মুখে যা আসছে সেসবও বলে যাচ্ছে হাসিব। জহির চৌধুরীও কম যান না। তিনিও ছেলের প্রেমের কাহিনি শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। শেষে আর না পেরে আহনাফ বলে উঠল,
“হাসিব থামবি তুই? আর আব্বু! তুমিও কী শুরু করলে।”
তিনি বললেন,
“কেন থামবে কেন? তুই প্রেম করছিস এটাই তো আশ্চর্যজনক ঘটনা। শোনার জন্য কৌতুহল তো হবেই।”
হাসিব কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,
“কিন্তু আঙ্কেল, প্রেম তো এক তরফা।”
“এক তরফা মানে?”
“মানে মেয়ে তো ওর সাথে প্রেম করে না।”
“বলো কী! মেয়ে কি তাহলে অন্য কারও সাথে প্রেম করে?”
“না, না! ভুল ভাবছেন। মেয়ে খুবই ভালো। আসলে আঙ্কেল আহনাফের কিছু ভুলের জন্যই মেয়ে রাগ করে আছে।”
“রাগ করুক। তাতে কোনো আপত্তি নেই। রাগ করা মেয়েদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু কথা হচ্ছে, মেয়ে আমার ছেলেটাকে ভালোবাসে তো?”
“১০০% ভালোবাসে আঙ্কেল।”
“মাশ-আল্লাহ্, মাশ-আল্লাহ্। তো এবার মেয়ের সম্পর্কে কিছু বলো। নাম কী ওর?”
“ওর নাম অর্ষা। অনার্সে পড়ে। আর পাশাপাশি আহনাফের অফিসেই জব করে।”
রেণু এতক্ষণ চুপচাপ তিনজনের কথোপকথন শুনছিল। এবার সেও উৎসাহিত হয়ে বলে উঠল,
“অর্ষা মানে! মানে সকালের বড়ো বোন?”
“রাইট, রাইট। ঐ অর্ষাই।” বলল হাসিব।
জহির চৌধুরী বললেন,
“ওকে তো আমিও চিনি। রাফিকে কয়েকদিন পড়াতে এসেছিল। তাই না রেণু?”
রেণু বলল,
“জি খালু।”
“ভারী মিষ্টি মেয়েটা। কী শান্তশিষ্ট! দু’বোন-ই বেশ মিষ্টি।”
“জি খালু। আমারও ওদের দুইজনরে অনেক ভালো লাগে। মনও খুব ভালা।”
“তাহলে আহনাফ, কবে প্রস্তাব নিয়ে যাব বলো?”
“আর কিছু জানতে চাইলে না আব্বু? ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড…”
তিনি মুচকি হেসে বললেন,
“আমি ছেলের জন্য বউ আনব আর বাড়ির জন্য মেয়ে। কোনো সম্পত্তি তো আনব না। তাহলে ওর বাবার কী আছে না আছে তা দিয়ে আমার কী? আমার ছেলে খুশি মানেই আমি খুশি।”
আহনাফ সন্তুষ্টির হাসি হাসল।
.
.
সকাল অপরাধীর মতো মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ষা অফিস থেকে ফিরে এসেই ওর পেছনে পড়েছে। সে বলল,
“কয়েকদিন ধরেই দেখি, তুই টিফিনে বেশি করে খাবার নিয়ে যাস। আবার মা বলল, কলেজ থেকে এসেও নাকি তোকে দেখেছে লুকিয়ে বাটিতে খাবার নিতে। আজ তো আমি নিজেই দেখলাম। কোথায় যাচ্ছিলি খাবার নিয়ে?”
সকাল নিশ্চুপ।
“সকাল চুপ করে থাকবি না। উত্তর দে।”
সকাল কিছু বলতেই যাবে অর্ষা তখন বলে,
“বানিয়ে বানিয়ে কোনো মিথ্যা বলবি না। খাবার নিয়ে নিশ্চয়ই রাফিকে পড়াতে যাস না?”
“হ্যাঁ, আপু। ওকেই তো দিতাম খাবার।”
“ও তোর বাসার ভাত, আলু ভর্তা, মাছের ঝোল এসব খাওয়ার জন্য বসে থাকে না সকাল। ও এরচেয়েও ভালো ভালো খাবার খায় প্রতিদিন। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার আগে জলদি সত্যিটা বল। নয়তো এক থা’প্প’ড়ে তোর সব কয়টা দাঁত আমি ফেলে দেবো।’
অর্ষার গলার আওয়াজ শুনে সেলিনা বেগম ঘরে এলেন। সকাল কাঁদছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে? কাঁদছে কেন ও?”
অর্ষা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
“সকাল!”
সকাল এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ভাইয়াকে দিতাম খাবার!”
অর্ষা এবং সেলিনা বেগম দুজনই বিস্ময় নিয়ে তাকাল। সেলিনা বেগম বললেন,
“রুহুলকে দিতি? ও কোথায়?”
“ভাইয়ার সাথে কলেজে যাওয়ার সময় একদিন দেখা হয়েছিল। মুখ শুকিয়ে গেছে। খায় না ঠিকমতো। কাজ তো করে না। তোফায়েল ভাইয়ার সাথেও নাকি সম্পর্ক নাই। ভাইয়া খুব কেঁদেছে মা। আপুর সাথে তোফায়েল ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করে নিজেও খুব আফসোস করেছে। তোমার আর আব্বার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করত এজন্য খুব আফসোস করে। আমি বলেছিলাম, বাসায় আসতে। কিন্তু ভাইয়া বলে তার নাকি তোমাদের সামনে আসার মুখ নাই। খুব কেঁদেছে মা ভাইয়া। আমার খুব কষ্ট হয় ভাইয়ার জন্য। তোমাদের বললে যদি তোমরা রাগ করো। তাই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়ার জন্য খাবার নিয়ে যেতাম।”
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল সকাল। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই সেলিনা বেগমের চোখ থেকে পানি পড়ছে। তিনি শাড়ির আঁচলে বারবার চোখ মুছেও চোখের জল আটকাতে পারছেন না। অর্ষার বুকের ভেতরটায় হুহু করে ওঠে। তার ভাই না খেয়ে থাকে! করুক না ভুল, আপন ভাই তো! কষ্ট হয় এসব জানলে। চোখের কোণে আসা পানিটুকু মুছে অর্ষা বলল,
“ভাইয়া কোথায় থাকে তুই জানিস?”
“বাজারের শেষ মাথায় ক্যারাম বোর্ডের দোকান আছে না? ঐখানেই থাকে।”
অর্ষা ওমর রহমানের ঘরে গিয়ে সকালের বলা কথাগুলোই সংক্ষেপে তাকে বলল।
“আব্বা, ভাইয়াকে যদি বাসায় নিয়ে আসি তাহলে কি তুমি রাগ করবে?”
ওমর রহমান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“না, মা। বরং খুশি হব। ভুল তো মানুষই করে। চল আমিও সাথে যাই।”
তিনি একা না। সঙ্গে সেলিনা বেগম এবং সকালও গেল। রুহুল তখন বেঞ্চের ওপর গুটিসুটি হয়ে বসেছিল। সবাইকে একসাথে এখানে দেখে সে হতভম্ব হয়ে যায়। অর্ষা বলল,
“বাড়ি চলো ভাইয়া।”
রুহুল সকালের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। সকাল তখন বলল,
“আমি সব বলে দিছি ভাইয়া। তুমি আমাদের সাথে বাড়িতে চলো।”
রুহুল দোকানে সবার সামনেই ওমর রহমান আর সেলিনা বেগমের পা ধরে কেঁদে ফেলে। ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
“আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও আব্বা। আমি ভুল করছি মা। আমারে তোমরা মাফ কইরা দাও।”
ওমর রহমান রুহুলকে ধরে উঠিয়ে বললেন,
“ক্ষমা না করলে কি তোকে নিতে আসতাম বোকা ছেলে? চল, চল বাড়ি চল।”
রুহুল চোখের পানি মুছে সকাল আর অর্ষাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে দুজনের মাথায় চুমু খেল। আবেগে অর্ষার চোখে পানি চলে আসে। সকাল তো কেঁদেই ফেলে আনন্দে। অর্ষা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তোমরা সবাই বাড়িতে যাও। আমি রাফিকে পড়িয়ে আসি। প্রায় রাত হয়ে গেছে। সকালের যেতে হবে না আজ।”
“আজ না পড়ালে হয় না?” বললেন সেলিনা বেগম।
“না, মা। ওর পরীক্ষা আছে। তোমরা যাও। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।”
রুহুল একটা রিকশা ঠিক করে দিয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু।”
অর্ষা হাসল। আজ না পড়ালেও হতো। মাকে সে মিথ্যে বলেছে। হাসিব কল করে বলেছিল, আজ যেন সকালের বদলে সে যায় বাসায়। গুরুত্বপূর্ণ কথা নাকি আছে।
.
অর্ষা বাসায় গিয়ে দেখে আহনাফ, হাসিব আর রাফি ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। রেণু দরজা খুলেই তাকে দেখে কেমন যেন রহস্যজনক হাসি দিল। খুব অমায়িকভাবেই জিজ্ঞেস করল,
“ভালো আছেন ম্যাডাম?”
অর্ষা কিছুটা হতভম্ব হলেও জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়াল। ড্রয়িংরুমে যাওয়া মাত্রই তাকে দেখে রাফি দৌঁড়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোমাকে অনেক মিস করেছি।”
অর্ষা হেসে বলল,
“আমিও তো তোমাকে মিস করেছি।”
“হাসিব মামা বলেছিল আজ তুমি আসবে। তাই তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ এনেছি।”
“তাই? দেখি?”
রাফি অর্ষাকে অন্য সোফায় জোরপূর্বক বসিয়ে বলল,
“তুমি বসো এখানে। আমি এক্ষুণী নিয়ে আসছি।”
আমেনা বেগমও তখন ড্রয়িংরুমে এলেন। অর্ষার পাশে বসে বললেন,
“ভালো আছো?”
অর্ষার মনে হলো কী স্বাভাবিক তিনি! কত স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছে। সে তার হাত ধরে বলল,
“ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ। তুমি সেই মিষ্টি মেয়েটার বোন না?”
অর্ষা বুঝল তিনি সকালের কথা বলছেন। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ।”
“জানতাম। আহনাফের বাবা বলল আজ তোমার কথা। তুমিও খুব মিষ্টি।”
অর্ষা অবাক হয়ে একবার তার দিকে এবং আরেকবার হাসিব, আহনাফের দিকে তাকাল। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই রাফি দৌঁড়ে এলো। তার হাত পেছনে। সে বলল,
“চোখ বন্ধ করো।”
আমেনা বেগমও বললেন,
“দাদুভাই বলেছে চোখ বন্ধ করতে। চোখ বন্ধ করো মিষ্টি মেয়ে।”
অর্ষা হেসে চোখ বন্ধ করল। রাফি তার ছোট্ট ছোট্ট দু’হাত ভর্তি কাঠগোলাপ ফুল অর্ষার সামনে এনে বলল,
“এবার চোখ খোলো।”
অর্ষা চোখ খুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“কাঠগোলাপ!”
“তোমার পছন্দ না?”
“খুব!”
“আমার স্কুলের সামনে দুইটা কাঠগোলাপ গাছ আছে। তোমার জন্য এনে ফ্রিজে রেখেছিলাম, যাতে শুকিয়ে না যায়।”
অর্ষা রাফির গাল টেনে বলল,
“কী বুদ্ধি গো তোমার!”
“হুম! মামার মতো।”
অর্ষা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল আহনাফ হাসছে। আমেনা বেগম একটা ফুল নিয়ে অর্ষার কানের পিঠে গুঁজে দিলেন। অর্ষাও একটা ফুল নিয়ে তার খোঁপায় গুঁজে দিয়ে বলল,
“আপনাকে সুন্দর লাগছে।”
“সত্যিই?”
“হ্যাঁ?”
তিনি আহনাফ, হাসিবকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমায় সুন্দর লাগছে?”
ওরাও বলল,
“অনেক সুন্দর লাগছে।”
তিনি খুশি হয়ে অর্ষার চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেল। অর্ষা রাফিকে নিয়ে রাফির রুমে চলে যায়। ওকে পড়িয়ে তারপর হাসিবের সঙ্গে কথা বলবে। কিছুক্ষণ বাদে আহনাফ এসে বলল,
“রাফি, তোমাকে রেণু ডাকছে।”
রাফি দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। আহনাফ তখন এগিয়ে গেল অর্ষার কাছে। নিচু হয়ে ঝুঁকে অর্ষার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি কাঠগোলাপের মায়ায় জড়ালে, আমি চোখ ফেরাতে পারি না।”
এরপর সে ঠোঁট দিয়েই অর্ষার কান থেকে ফুলটা নিয়ে দুষ্টু হাসি দিল।
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_২৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
রাফি মুখ কালো করে ফিরে এলো। অর্ষা তখনও স্তব্ধ হয়ে আছে।
“মামাটা আজকাল মিথ্যা বলাও শিখে গেছে।” বিড়বিড় করে বলল রাফি।
অর্ষা ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
“মা বকেছে।”
“কেন?”
“মা তো আমায় ডাকেনি। মামা মিথ্যে বলেছে। আমি গিয়ে মায়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন ডেকেছ?’ তখন মায়ের হাত থেকে জগ নিচে পড়ে গেছে। এখানে আমার দোষটা কোথায় বলো? দিল বকা!”
“হুম! ভীষণ অন্যায় গেছে। আসলে দোষ তোমার আম্মুরও কিন্তু নয়।”
“তাহলে কার?”
“তোমার মামার। মিথ্যে তো তোমার মামাই বলেছে তাই না?”
“তা ঠিক। কিন্তু মামা যখন মিথ্যে বলেছে তখন অবশ্যই এর পেছনে কোনো কারণ আছে।”
অর্ষা বিড়বিড় করে বলে,
“একদম মামার অ’ন্ধ ভক্ত!”
এই টপিকে আর কথা লাভ নেই বলে অর্ষা রাফিকে পড়ানো শুরু করে। আজ বেশিক্ষণ পড়ায়নি। হাসিবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাছাড়া সে টায়ার্ডও। ত্রিশ মিনিটের মতো পড়িয়ে রাফিকে বলল,
“তোমার হাসিব মামাকে ডেকে আনো তো।”
“আচ্ছা।” বলে রাফি হাসিবকে ডাকতে চলে গেল।
হাসিব আসার সময় একাই এলো। রাফি কিংবা আহনাফ কেউ সাথে নেই। অর্ষা ভেবেছিল আহনাফও বুঝি আসবে।
হাসিব রাফির খাটে বসে বলল,
“কেমন আছেন?”
“ভালো আছি। আপনি?”
“খুবই ভালো। বলতে পারেন আজ আমি দারুণ খুশি।”
“তাই? কারণ কী?”
“কারণটা হচ্ছে গিয়ে আপনার এবং আহনাফের বিয়ে।”
অর্ষা হতভম্ব হয়ে যায়।
“আমাদের বিয়ে মানে?”
“দেখেন ভাবি, ঝগড়া, মান-অভিমান, রাগ অনেক হয়েছে। যদি কিছু বাকি থাকে তাহলে সেগুলো বিয়ের পর বুঝে নিয়েন। আগে বিয়েটা হোক। এখন বলেন, কবে যাব আমরা?”
“কবে যাব মানে? কোথায় যাবেন?”
“কেন আপনার বাসায়। প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে না? এমনি এমনি তো আর আপনাকে নিয়ে আসা যাবে না।”
“সব আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।”
“তাহলে আরেকটু সোজা হয়ে মাথা উচুঁ করে বসুন। আশা করি, তাহলে কথা সরাসরি মস্তিষ্কেই পৌঁছাবে।”
“আমি মজা করছি না।”
“আমিও মজা করছি না। এই বাড়ির সবাই রাজি। বিশ্বাস না হলে আমি আঙ্কেলকে ডাকি। আপনি তার সাথেই কথা বলুন।”
হাসিব উঠে দাঁড়িয়েছে জহির চৌধুরীকে ডাকার জন্য। অর্ষা তড়িৎগতিতে পথরোধ করে বলল,
“না, না। তাকে ডাকতে হবে না। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করেছি।”
“ঠিকাছে। তাহলে বসলাম। এবার বলুন, কবে যাব আমরা?”
অর্ষা কিছু কথা আগে মনে মনে গুছিয়ে নিল। পরক্ষণে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি এখনই বিয়ে করতে পারব না।”
হাসিব অবাক হয়ে বলল,
“কেন? এখনও কি রাগ করে আছেন?”
“না। তেমন কিছু নয়। আসলে আমার পরিবারের অবস্থা তো মোটামুটি জানেন সব-ই। ভাইয়াকে আজ বাসায় নিয়ে এসেছি। ও কতটা শুধরিয়েছে বা ভবিষ্যতে কী করবে তা এখনও শিওর হয়ে বলতে পারছি না। এমন অবস্থায় তো আমি বিয়েও করতে পারছি না।”
“আপনি এত ভাবছেন কেন? আহনাফ আপনাদের হেল্প করবে।”
“না ভাইয়া। বিয়ের পর উনার আমাকে সাহায্য করা আর আমার পরিবারকে সাহায্য করা বিষয়টা এক রকম নয়।”
হাসিব জানে, অর্ষার আত্মসম্মান ঠিক কতটা বেশি। এরপরও যদি সে এই বিষয়ে জোড়াজুড়ি করে তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। এরচেয়ে বরং না হয় মেয়েটাকে সব গুছিয়ে নেওয়ার জন্য একটু সময় দেওয়া যাক।
হাসিব হেসে বলল,
“ঠিক আছে। আপনি যা ভালো বোঝেন। কিন্তু রিকোয়েস্ট থাকবে, বেশি সময় নেবেন না প্লিজ! আর পারলে আমি চলে যাওয়ার আগেই বিয়েটা করবেন। বন্ধুর বিয়েতে থাকতে না পারলে খুব আফসোস লাগবে।”
প্রত্যুত্তরে অর্ষাও মুচকি হাসল।
হাসিবের সঙ্গে কথা শেষ করে বেরিয়ে দেখল আহনাফ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এতক্ষণ সে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ষাকে দেখেই দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“উঠুন ম্যাম।”
অর্ষা মুচকি হাসল তবে প্রত্যাখান করল না। আহনাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মৌনতা কাটিয়ে অর্ষা বলল,
“হাসিব ভাইয়ার সাথে কথা…”
পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আহনাফ বলল,
“জানি সব। শুনেছি আমি।”
অর্ষা চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলে,
“আপনি আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনেছেন?”
আহনাফ হেসে ফেলে। অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,
“না। আমি কলে ছিলাম।”
“ওহ। এভাবে লুকোচুরি করে শোনার কী ছিল?”
“কারণ আমি সামনে থাকলে তুমি এত সহজে কথাগুলো বলতে পারতে না।”
“আপনার রাগ লাগছে না?”
“রাগ লাগবে কেন?”
“এইযে আমি রাজি হলাম না বলে।”
“তুমি তো রাজিই। শুধু এখন বিয়ে করবে না এই যা তফাৎ!”
“তবুও রাগ হচ্ছে না?”
“উঁহু! একটুও না। যাকে ভালোবাসি তার প্রতিটা সিদ্ধান্তকেই আমি ভালোবাসি। এইযে তুমি নিজের চেয়েও পরিবারের জন্য এত ভাবো, এজন্যই তোমাকে আমার আরও বেশি ভালো লাগে। স্বার্থের এই যুগে ক’জন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে পরিবারের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে? বাবা-মা কষ্ট করে লালন-পালন করে বড়ো করে, পড়াশোনা শেখায়। এরপর ছেলে-মেয়েরা কী করে? বিয়ে করে যে যার মতো সেটেলড্ হয়ে যায়। তাদের হাড়ি-পাতিলের ভাত বেশি হলে তার জায়গা হয় ডাস্টবিনে। কিন্তু বাবা-মায়ের জন্য এক বেলার খাবার তাদের হাড়িতে চড়ে না। তখন বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে নয়তো ভিক্ষা করে মানুষের দারে দারে ঘুরে অনাহারে জীবন কাটায়। খুব কষ্ট লাগে অর্ষা জানো? আমার যদি ক্ষমতা থাকত এরকম সব বাবা-মায়ের দেখভাল করার দায়িত্ব আমি নিতাম। কিন্তু আল্লাহ্ আমায় যতটুকুই দিয়েছে ততটুকু দিয়েও আমি আমার সাধ্যমতো এমন অনেক বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি বলছি না সব সন্তান স্বার্থপর। এখনও অনেক সন্তান আছে যারা পরিবারের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দিতে পারে। ঠিক তোমার মতো। তাদের প্রতি সম্মানে মাথা নুইয়ে আসে আমার। সেখানে আমি এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসি যার কাছে তার পরিবারের প্রায়োরিটি সবার প্রথমে। তাহলে তুমিই বলো তাকে ভালো না বেসে, তার সিদ্ধান্তকে সম্মান না করে আমি কীভাবে থাকি?”
অর্ষা কথা বলতে পারছে না। চুপ করে শুধু শুনে যাচ্ছে। আহনাফ অর্ষার হাতের ওপর নিজের এক হাত রেখে বলল,
“তুমি আমার সাহায্য না নাও। আইডিয়া তো নিতে পারো। আমার মনে হয় না, ভাইয়া আর ভুল কিছু করবে। ভাইয়া যেহেতু পরের অধীনে কাজকর্ম করতে পারে না তখন ভাইয়াকে একটা দোকান দিয়ে দিতে পারো। কাপড়ের দোকান অথবা মুদি দোকান। যেটা ভাইয়ার পছন্দ হয় আরকি। আঙ্কেল আর ভাইয়া মিলে দোকান করল। কষ্টের তো কাজ নয়। এতে বাবা-ছেলের সম্পর্কটাও আগের মতো ভালো হয়ে যাবে। ভাইয়ারও বেকারত্ব ঘুচবে। এর কিছুদিন পর ভালো একটা মেয়ে দেখে ভাইয়ার বিয়ে করিয়ে দাও। একবার সংসারি হয়ে গেলে আর বিপথে যাবে না ইন-শা-আল্লাহ্। এরপর না হয়, এই অধমের প্রতি তোমার করুণা হলে বিয়ে কোরো।”
শেষের কথাটা শুনে অর্ষা হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
“আপনার আইডিয়া আমার পছন্দ হয়েছে। ভাইয়া আর আব্বার সাথে বাড়িতে গিয়ে এই ব্যাপারে কথা বলব। আর হ্যাঁ, সবটা গুছিয়ে নিতে পারলে আপনার প্রতি করুণাটাও দ্রুত হয়ে যাবে আশা করি।”
“তার মানে আমাদের বিয়েটাও তাড়াতাড়ি হবে আশা করতে পারি?”
অর্ষা হেসে কপালের ওপর পড়ে থাকা ছোটো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে বলল,
“হুম, পারেন।”
আহনাফ নিজের বুকের বা-পাশে হাত রেখে বলে,
“হায়ে! ওভাবে কানের পিঠে চুল গুঁজবে না বাটারফ্লাই। অন্তত বিয়ের আগে আমার সামনে নয়। একদম নয়! আমি কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারি না বলে দিচ্ছি।”
অর্ষা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
হ্যাপি নিউ ইয়ার পাঠকমহল। নতুন বছরের অনেক শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা রইল। আমার জন্য দোয়া করবেন।]