#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৩০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অফিস থেকে দু’দিন ছুটি নিয়েছে অর্ষা। আহনাফের বলা আইডিয়া সে বাবা এবং ভাইকে বলার পর তারা বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যায়। যদিও অর্ষা জানায়নি আইডিয়াটা তার নিজের নয়; বরং ধার করা। পারতপক্ষে আহনাফের ব্যাপারে বাড়িতে এখনও কেউ কিছুই জানে না। অর্ষা কাকে ভালোবাসে এই ব্যাপারেও কেউ কিছু জানতে চায়নি এখনও। তবে বোধ করি, সকাল কিছু কিছু বিষয় জানে। বিশেষ করে সেদিন রেস্টুরেন্টে সবাই এক হওয়ার পর থেকে।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাজারের মাঝখানে একটা দোকান নিয়েছে। মুদি দোকানের জন্য প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যাদি কিনেছে। অর্ষা, ওমর রহমান, সকাল আর রুহুল মিলে দোকান গোছাচ্ছিল। রুহুলের একার পক্ষে তো আর সম্ভব নয়। সন্ধ্যায় মিলাদ পড়িয়ে তারপর দোকানের বেচা-কেনা শুরু করবে। সকাল সকাল কাজ শুরু করেছিল বলে দুপুর দুইটার মধ্যে দোকানের সব কাজ শেষ হয়ে যায়। সকাল দম নিয়ে বসল চেয়ারে। হেলান দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, তোমার দোকান থেকে কি আমাকেও টাকা দিয়ে কিনে মজা খেতে হবে?”
রুহুল ভারী অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,
“অ্যা? বলিস কী? তুই আমার বোন। আমার কলিজা। এই দোকানের ছোটো মালকিন তুই। তোর থেকে আমি টাকা নেব? ছি, ছি! গ’র্দা’ন না যাবে আমার?”
সকাল খিলখিল করে হেসে ওঠে। অর্ষা কোমর থেকে ওড়না খুলে গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে বলল,
“আব্বা তুমি সকালকে নিয়ে বাসায় যাও। আমি আর ভাইয়া একটু পর আসছি।”
সকাল গো ধরে বলল,
“কেন? তোমরা কোথায় যাবে?”
“ম’র’তে যাব। যাবি?”
“হ্যাঁ।”
অর্ষা রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। সকাল উঠে গিয়ে রুহুলের হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে বলল,
“ও ভাইয়া আমিও যাব। আপুকে বলো আমায় নিতে।”
রুহুল হেসে বলল,
“আমিই তো জানিনা ও কোথায় যাবে।”
“ঠিকই তো। কোথায় যাবি রে মা?” জিজ্ঞেস করলেন ওমর রহমান।
অর্ষা বলল,
“সেলুনে যাব।”
রুহুল বিস্ময় নিয়ে বলল,
“তুই সেলুনে গিয়ে চুল কা’ট’বি কেন? পার্লারে যা। টাকা লাগলে বল। আমার কাছে দোকানের জিনিসপত্র কিনেও কিছু ক্যাশ টাকা আছে।”
অর্ষা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“বুদ্ধি একদম হাঁটুতে চলে আসছে নাকি তোমার? আমি কেন সেলুনে চুল কা’ট’তে যাব?”
“তবে?”
“তবে কী আবার? তুমি চুল কা’ট’বে। দাড়ি কামাবে। নিজের অবস্থা দেখেছ? মনে হচ্ছে পার্বতীর শোকে দেবদাস হয়ে গেছ।”
ওমর রহমান হেসে ফেললেন। সকালের জেদের জন্য তাকেও সেলুনে যেতে হলো। অর্ষা ওমর রহমানকে বললেন,
“তুমিও বসে পড়ো বাবা। চুল কে’টে আরেকটু ছোটো করে নাও।”
সকাল বলল,
“আমিও বসে পড়ব নাকি আপা?”
“কেন? তুই চুল কা’ট’বি? তাহলে আয় আমি তো টাক বানিয়ে দেই।”
সকাল মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“হুহ!”
বাড়িতে ফিরে রুহুল এবং ওমর রহমান একসাথে বাইরের কলপাড়ে গোসল করতে গেল। সকাল রুমে গেল তাদের জন্য কাপড় আনতে। অর্ষা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে সেলিনা বেগম হরেক রকমের পিঠাপুলি বানাচ্ছেন।
অর্ষা জিজ্ঞেস করল,
“এত রকমের পিঠা কেন বানাচ্ছ?”
“প্রথমবার হবু জামাই আমাদের বাড়িতে খাবে। একটু পিঠাপুলি না খাওয়ালে হয়?”
“হবু জামাই মানে? কার কথা বলছ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
“কার কথা মানে? আহনাফের কথা বলছি। কেন তুই কি ওকে দাওয়াত করিসনি?”
অর্ষা ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
“তুমি তার কথা জানলে কী করে?”
“আমি বলেছি।”
অর্ষা পেছনে তাকিয়ে দেখল মুন। ওর হাতে আটার গুড়ি। অর্ষাকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে বলল,
“তুই যেই লজ্জাবতী! মুখ ফুটে তো আর সত্যি কথা বলবি না। তাই আমিই বলে দিয়েছি।”
অর্ষা সেলিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনি মুচকি মুচকি হাসছেন। অর্ষার মনে হলো লজ্জায় সে মাটিতে মিশে যায়। সেখানে আর বসে থাকতে পারছে না। ওদিকে ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকলেও তো চলবে না। মাকে সাহায্য করতে হবে কাজে। সন্ধ্যায় মিলাদ পড়ানোর পর কাছের কয়েকজন মানুষ রাতের খাবার এই বাড়িতেই খাবে। কাছের মানুষ বলতে আহনাফ, হাসিব, রাফি, গ্যাঞ্জাম পার্টি, স্মৃতি, মুন, আদিব আর এলাকার কিছু মুরুব্বি।
মেয়ে লজ্জা পেয়েছে বুঝতে পেরে সেলিনা বেগম আর এই বিষয়ে কিছু বললেন না। শুধু জিজ্ঞেস করলেন,
“আহনাফকে কি একাই আসতে বলেছিস?”
“না। সাথে তার বন্ধু আর ভাগিনা আসবে।”
“সেকি! ওর বাবা-মাকে বলিসনি?”
অর্ষা লজ্জা পেয়ে বলল,
“উনারা কি আসবেন…”
“আসা না আসা পরের ব্যাপার। কিন্তু তোর তো বলা উচিত ছিল। যা ফোন দিয়ে এক্ষুণী বলে দে।”
অগত্যা অর্ষা উঠে রুমে গেল। আহনাফের নাম্বারে ডায়াল করল। প্রথমবার রিং হওয়ার পরই ওপাশ থেকে কল কেটে দিয়ে ব্যাক করল আহনাফ।
“বলো বাটারফ্লাই।”
অর্ষা মুচকি হাসল। জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় আপনি?”
“অফিসে আছি। কিছু বলবে?”
“আমাদের বাসায় কখন আসবেন?”
“কেন আমায় ছাড়া বুঝি থাকতে পারছ না?”
“হুশ! বলেন।”
“সন্ধ্যার আগেই চলে আসব।”
“আঙ্কেল-আন্টি আর রেণু আপাকেও কিন্তু নিয়ে আসবেন সাথে করে।”
“তোমার শ্বশুর তো বিজনেস ডিলের জন্য সিলেট গিয়েছে। তবে তোমার শাশুড়ি আর রেণুকে আনতে পারি সাথে। চলবে?”
অর্ষা হেসে বলল,
“দৌঁড়াবে। হাসিব ভাইয়া আর রাফিকে আবার রেখে আসিয়েন না।”
“ওরা দুধভাত। না বললেও চলে আসবে। রেখে আসতে হবে না।”
অর্ষা হেসে ফেলল।
“আচ্ছা এখন রাখছি। পরে কথা হবে।”
“ঠিক আছে।”
অর্ষা ফোন রেখে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। সে, মুন, সকাল আর সেলিনা বেগম মিলে রান্নাবান্নাসহ সমস্ত কাজ একসাথে শেষ করে নিল। সন্ধ্যায় গ্যাঞ্জাম পার্টি, আহনাফ, হাসিব, রাফি, আমেনা বেগম রেণু, আদিব, স্মৃতি সবাই চলে এসেছে। আহনাফ এবং হাসিবকে এখানে দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছে স্মৃতি। সে বারবার অর্ষাকে খোঁচাচ্ছে কাহিনি কী জানার জন্য। অর্ষা মেহমানদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত ছিল। স্মৃতির সাথে মন খুলে কথা বলার মতো সময় আপাতত হাতে নেই। সে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“পরে বলব সব। একটু ধৈর্য ধরো।”।
অগত্যা স্মৃতিকেও ধৈর্য ধরতে হলো। লামিয়া, রেশমি, জুঁইয়ের সঙ্গে তার খাতির হয়ে গেছে। ওরা এত মিশুক যে খুব অল্প সময়েই স্মৃতি মিশে যেতে পেরেছে। এত মানুষ দেখে ভেবেছিল, সে সবার মাঝে একা একা বোর হবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। মুনও অর্ষার সঙ্গে ব্যস্ত থাকায় এখনও ওদের কাছে আড্ডা দেওয়ার জন্য আসতে পারেনি।
ছেলেরা ওমর রহমান এবং রুহুলের সঙ্গে দোকানে মিলাদের জন্য চলে যায়। মিলাদ শেষ করে তারা-সহ বাকি মেহমানরাও চলে আসে। আশিক খেয়াল করে যে, আহনাফ অর্ষাকে চোখে হারাচ্ছে। যখনই ওকে দেখছে নিষ্পলক শুধু তাকিয়েই থাকছে। কে দেখছে বা কেউ কিছু ভাবছে কিনা তাতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। খেতে বসার পূর্বে আহনাফের কাছে গিয়ে খুব বিনয়ী হয়ে বলল,
“ভাইয়া একটু কথা বলা যাবে?”
আহনাফ অর্ষার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“শিওর।”
“একটু এদিকে আসেন।”
ওরা কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল।আশিক চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“দেখেন দুলাভাই, আজ এখানে আমরা দাওয়াত খেতে এসেছি। আমাদের সাথে আপনিও শুধু দাওয়াত খাবেন। অন্য কিছু খাবেন না। দয়া করে আমার সামনে তো নয়-ই। ইট’স মাই হাম্বল রিকোয়েস্ট। আজ যদি আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি, তাহলে মুন, লামিয়া শুধু কৃ’মি নিয়েই নয়; আমার পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি, হাগু-মুতু নিয়েও পর্যন্ত কথা শোনাবে। ওদের তো আপনি ভালো করেই চেনেন। দয়া করে আমাকে আর আমার হাগু-মুতুকে ওদের দিয়ে হ্যারাস করাবেন না প্লিজ!”
আহনাফ কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে অস্বস্তিতে কপাল চুলকাচ্ছে।
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৩১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
আহনাফ নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আমি তো শুনেছি, তোমার নাকি অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে। তাহলে চুমু নিয়ে তুমি এত সিরিয়াস কেন? কখনও কাউকে চুমু খাওনি?”
আশিক মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ছি, ছি! আমি কি ওদের সত্যিকার ভালোবাসি নাকি? আমি তো টাইমপাস করি।”
“তার মানে কাউকে চুমু খাওনি?”
“উঁহু!”
“তুমি যে টাইমপাস করো, বলতে গেলে মন নিয়ে খেলো। এসব কি ঠিক?”
“আমি যাদের সাথে টাইমপাস করি ওরাও আমার মতো টাইমপাসই করে। আমি ছাড়াও ওদের কত বয়ফ্রেন্ড আছে।”
“তুমি জেনেও রিলেশন করো?”
“হ্যাঁ, করি। কারণ সত্যিকারের ভালো তো আর বাসি না। যেদিন আপনার মতো ভালোবাসার কাউকে পেয়ে যাব তাকেই সত্যিকার ভালোবাসব।”
আহনাফ বিব্রত হয়ে বলল,
“আমার মতো মানে?”
“আই মিন, আপনি যেরকম অর্ষাকে পেয়ে সত্যিকারের ভালোবাসেন।”
“ওহ। তাই বলো!” হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল আহনাফ।
আশিক বলল,
“কেন আপনি কী ভেবেছিলেন?”
“তোমরা একেকজন যা সাংঘাতিক। কথা বলতেও ভয় লাগে। তোমাদের চিন্তা-ভাবনাও আলাদা লেভেলের। তাই তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
আশিক হেসে বলে,
“দুলাভাই! আপনিও না! খুব দুষ্টু।”
আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলে প্রথমে। পরে হেসে ফেলে। মুন তখন সেখানে উপস্থিত হয়ে আশিকের উদ্দেশ্যে বলে,
“কিরে উজবুক দুলাভাইয়ের সাথে কী করিস?”
গ্যাঞ্জাম পার্টির সাথে মুনের সখ্যতা এতটাই বেড়ে গেছে যে, এখন সবার সাথেই তার তুই-তোকারির সম্পর্ক। আহনাফ মুনকে দেখে আরও অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বেফাঁসে এই মেয়ে না জানি আবার কোন উলটা-পালটা কথা বলে ফেলে। ব্রেক তো একটার মুখেও নাই। বিশেষ করে লামিয়া মেয়েটা আর মুন! এই দুজনের মুখ নির্ঘাত লাইসেন্স করা।
আশিক বলল,
“প্রেম করি। তোর কি সমস্যা?”
মুন চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“প্রেম করিস মানে? ছেলে হয়ে ছেলের সাথে আবার প্রেম করে কেমনে! তোর চরিত্রে সমস্যা আছে নাকি?”
অবস্থা বেগতিক। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়াবে তা বেশ ভালোই আন্দাজ করতে পারছে আহনাফ। তাই এসব কথোপকথন এখানেই স্থগিত রাখার জন্য দুজনকে থামিয়ে গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বলল,
“বাড়িতে অনেক মানুষজন এসেছে। তোমরা এখানে কোনো ঝগড়া কোরো না তো!”
আহনাফের গম্ভীরতায় দুজনই দমে গেল।
.
“আপনার চোখে কী হয়েছে?”
সকালের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল আহিল। বিব্রত ভঙ্গিতে বলল,
“কই? কিছু না তো!”
“কিছু না হলে আপনার চোখ সেই কখন থেকে আমার দিকেই কেন স্থির হয়ে আছে?”
“তাই নাকি?”
“জি তাই। কী এত দেখছিলেন? আমাকে কি পাগলের মতো লাগছে দেখতে? নাকি ভূতের মতো?”
“এই না, না!”
“তাহলে? শাড়ি পরা ঠিক নেই? কিছু দেখা যাচ্ছে? পেট, বুক…”
আহিল দম আটকে বলল,
“আপনি থামুন প্লিজ!”
সকাল ভ্রুকুটি করে বলল,
“থামব কেন? এতক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে কী দেখছিলেন আমার জানার দরকার নেই?”
“আপনি একটা সাংঘাতিক মেয়ে। বাইরে থেকে সহজ-সরল, শান্ত মনে হলেও আপনি মোটেও সেরকম নন।”
“জানি। সে তো আপনাকেও বাইরে থেকে সহজ-সরল, শান্তশিষ্ট লাগে। কিন্তু আপনিও তো তা নন। ভেতরে ভেতরে সেয়ানা। বলেন দেখি এখন, কী দেখছিলেন?”
“আপনি একটা চূড়ান্ত ফাজিল!”
“যাহ বাব্বাহ্! আপনি তাকিয়ে থাকলে দোষ নেই। আর ওমন করে কী দেখেছিলেন আমি জানতে চাইলেই দোষ?”
আহিল চোখ-মুখ শক্ত করে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি শুধুই আপনাকে দেখছিলাম। অন্য কিছু না।”
“আমাকে আপনি কখনও দেখেননি?”
“শাড়ি পরা দেখিনি।”
“আমাকে শাড়িতে ভালো লাগছে?”
আহিল এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু তাকিয়ে রইল। তার দু’চোখ ভর্তি যেই মুগ্ধতা; সেই মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ মুখে করার প্রয়োজন নেই। সকাল কয়েক সেকেণ্ড চোখে চোখ রেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। তার চোখে এত মায়া, মুগ্ধতা কেন? বেশিক্ষণ সামনে আর দাঁড়িয়েও থাকতে পারল না সকাল। একটু আগেও তার মাঝে যেই তেজ, কনফিডেন্স ছিল সব এখন কর্পূরের ন্যায় উবে গেছে। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে সে। হাসি হাসি মুখটা হয়ে গেছে পাংশুটে। তাকে ফ্যাকাশে দেখতে লাগছে। নার্ভাস হয়ে দৌঁড়ে আহিলের সামনে থেকে চলে যায় সকাল। আহিল সেদিকে মুচকি মুচকি হাসছে।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই এখন বসে কথাবার্তা বলছে। আশিক সবার মাঝখান থেকে অর্ষাকে টেনে দূরে নিয়ে গেল।
“সমস্যা কী?” বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
“সমস্যা অনেক। হলুদ থ্রি-পিস পরা মেয়েটা কে?”
অর্ষা একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে নিল। বলল,
“স্মৃতি। কেন?”
“তোর কী হয়?”
“কলিগ। আমরা একই অফিসে কাজ করি। তোর মতলব কী আশিক?”
“মতলব ভালোই। মেয়েটা সুন্দর আছে।”
“ব্রেকাপ হয়েছে?”
“কী?”
“জিজ্ঞেস করলাম রিসেন্ট কি কারও সাথে তোর ব্রেকাপ হয়েছে?”
“আরে তা নয়।”
“তবে? নতুন গার্লফ্রেন্ড লাগবে আরও?”
আশিক ইনিয়ে-বিনিয়ে বলল,
“না মানে, গার্লফ্রেন্ড তো যা আছে তাতে চলে যাবে। এবার একটা বউ দরকার বুঝলি।”
“ঝেড়ে কাশ।”
আশিক সত্যিই খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বলল,
“স্মৃতিকে আমার ভালো লেগেছে। একটা ব্যবস্থা করে দে না দোস্ত।”
সঙ্গে সঙ্গে চপেটাঘাত করল অর্ষা। আশিক গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। পরক্ষণেই মুখটা কাঁদোকাঁদো করে বলল,
“তুই আমাকে মারলি কেন?”
“এই চ’ড়টা স্মৃতিই তোকে দিত প্রপোজ করার পর। ওর কাছে চ’ড় খেলে তো আর তোর সম্মান থাকবে না। তাই আমিই দিলাম।”
“কী আশ্চর্য! মনের কথা বললেও চ’ড় খেতে হবে?”
“হ্যাঁ, হবে। কারণ স্মৃতি আমাদের থেকে দু’বছরের বড়ো।”
“আজব! তাতে কী? বয়স ডাজেন্ট ম্যাটার ব্রো। লাভ ইজ রিয়েল।”
“তুই কি আর একটা চ’ড় খাবি আশিক?”
আশিক সঙ্গে সঙ্গে দু’গালে হাত রেখে বলল,
“স্যরি। কী হলো? স্যরি বললাম তো। ওভাবে তাও তাকিয়ে আছিস কেন? আচ্ছা বেশ চল। তোকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছি সেখানেই দিয়ে আসি।”
পূণরায় সে অর্ষার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আহনাফের হাতে অর্ষার হাত দিয়ে বলল,
“আপনার বউকে সামলান দুলাভাই। পুরুষ মানুষ দেখলেই ওর চ’ড়, থা-প্প-ড় দিতে মনে চায়। ওকে জিজ্ঞেস করবেন, ওর ঘরে কি ভাই, বাবা, স্বামী নেই?”
ওর কথা শুনে স্মৃতি শব্দ করে হেসে ওঠে। আশিক স্মৃতির দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওমন করে হাসবেন না মিস স্মৃতি! তাহলে আমি নিজেই স্মৃতিশক্তি হারিয়ে পাগল হয়ে যাব।”
স্মৃতির হাসি বন্ধ হয়ে যায়। সে অস্বস্তি ফিল করছে। অর্ষা আশিককে কিছু বলতেই যাবে এর পূর্বে আহনাফ ওকে নিয়ে রুমে চলে যায়। হুট করেই জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“সবাই তোমার থেকে সময় পায়। শুধু আমার বেলাতেই যত ব্যস্ততা?”
“আশ্চর্য! আপনি আমাকে রুমে নিয়ে এলেন কেন? ওরা কী ভাববে?”
“কেউ কিছুই ভাববে না। বুদ্ধি তো ওরাই দিয়েছে।”
“ভাইয়া দেখলে একদম মে’রে ফেলবে।”
আহনাফ সুর করে বলল,
“তোমার জন্য ম’র’তে পারি,
ও সুন্দরী তুমি গলার মালা।”
অর্ষা হেসে ওঠে। আহনাফ একের পর এক চুমু খেতেই থাকে হাসিরত অর্ষার গালে।
“ও দুলাভাই, এটা তো একটা কোকাকোলার এড। বহু আগের। কিন্তু ঐ জায়গায় তো নায়ক কোকাকোলা নিয়া আসে। আপনি দেখি চুমু নিয়ে আসছেন। থামেন একটু। রেস্ট নিয়ে নিন। বান্ধবী আমার তো কাহিল হয়ে যাচ্ছে।”
আহনাফ-অর্ষা দুজনেই পাশে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে গিয়ে দু’দিকে ছিটকে যায়।
মুন তখন বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিল। তার এই এক স্বভাব। খাওয়ার পর একটু শুয়ে না নিলে শরীর ম্যাজম্যাজ করে। হুট করেই তখন রুমে আহনাফ আর প্রবেশ করেছে। সে কিছু বলার পূর্বেই আহনাফের কথা শুরু হয়। তাই ডিস্টার্ব না করে চুপ করে থাকে মুন।
এখন সে কাৎ হয়ে শুয়ে হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে রেখেছে। লজ্জায় অর্ষার সত্যি সত্যিই ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। এই মানুষটা তাকে আর কত লজ্জায় ফেলবে? সে আমতা আমতা করে মুনকে বলল,
“তুই এই রুমে!”
“আসছিলাম তো একটু রেস্ট নিতে। কিন্তু সাথে বিনা পয়সা ও বিনা টিকিটে শর্ট রোমান্টিক মুভিও দেখে নিলাম। আমার বেশ ভালো লেগেছে। লিপকিস হলে আরও ভালো লাগত। আসলে কী বলতো, বিয়ের পর লিপকিস ছাড়া সব কিস এখন পানিভাত মনে হয়। দুলাভাইয়ের উচিত আরও একটু রোমান্টিক হওয়া। দুলাভাই, আপনি কি টাইটানিক মুভিটা দেখেছেন? ঐযে জাহাজে জ্যাক আর রোজ যে চুমু খায় সিনটা দেখেছেন না? যা রোমান্টিক দৃশ্য!”
অর্ষা এগিয়ে এসে মুনের মুখ চেপে ধরে বলল,
“আল্লাহর দোহাই লাগে! তোর পায়ে পড়ি, মুখটা বন্ধ কর বোন প্লিজ!”
“আরে, আরে! নাক আটকে রাখছিলি কেন? মে’রে ফেলবি নাকি? তোরা সিনেমা দেখিয়েছিস আমি দেখেছি। এখানে আমার কী দোষ?” অর্ষার হাত সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল মুন।
অর্ষা রাগান্বিত দৃষ্টিতে বারবার আহনাফের দিকে তাকাচ্ছে। পারছে না শুধু ভস্ম করে দিতে। বেচারা আহনাফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। মুন খাট থেকে নিচে নামল। দাঁত বের করে হেসে বলল,
“ভয় পাইয়েন না দুলাভাই। আমি কাউকে কিছু বলব না। চলে যাচ্ছি এখন। চাইলে আবার কন্টিনিউ করতে পারেন।”
অর্ষাও উঠে গেল। দু’হাত দিয়ে আহনাফের গলা টি’পে ধরতে গিয়েও দাঁত-মুখ খিঁচে হাত সরিয়ে নিল। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে তারপর সেও রুম থেকে চলে গেল। আহনাফ মাথা চুলকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“শা-লা-র কপাল! যখনই চুমু খাব তখনই কি ওদের চোখে পড়া লাগে? এত মানুষ থাকতে ওরাই কেন? মান-সম্মানের ফালুদা করে ছাড়ল একেকজন। আহনাফ, বি কেয়ারফুল। এক ভুল আর করিস না। এখন থেকে বিয়ের আগে নো কিস, নো রিস্ক। হুহ!”
চলবে…
[