যেদিন তুমি এসেছিলে ২ পর্ব -০৩

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_২
#পর্ব_৩
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
‘আপনি উনাকে বলেছেন আমি আপনার হাজবেন্ড?’

আহনাফের মুখে প্রশ্নটি শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা। মুন ফোন করে চটজলদি নিচে আসতে বলায়, অর্ষাও তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু এমন প্রশ্ন যে তাকে শুনতে হবে সেটি সে কস্মিনকালেও কল্পনায় আনেনি। সে এবার মুনের দিকে তাকাল। মেয়েটা এমন মিথ্যে কথা কী করে বলতে পারল?

‘কী হলো? বলুন।’ গম্ভীর কণ্ঠটি এবার গমগম করে উঠল।

সম্বিৎ ফিরে পেল অর্ষা।অবিশ্বাস্যকণ্ঠে বলল,’কক্ষণো না!’

মুন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। ঘোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,

‘তখন না তুই বললি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস? তুই তো নিজেই আমাকে এই বাড়ির ঠিকানা টেক্সট করেছিস।’

জহির চৌধুরী, আহনাফ এবং দারোয়ান উত্তরের প্রতিক্ষায় এবার অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অর্ষা পারে না শুধু মাটিতে গর্ত করে ভেতরে লুকিয়ে পড়তে। যতটা লজ্জা পাচ্ছে ততটা রাগও হচ্ছে মুনের ওপর। এতটা নির্বোধ এই মেয়ে!

সে কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘শ্বশুরবাড়ির কথা তোকে মজা করে বলেছি আমি!’

‘তাহলে তুই এই বাসায় কেন?’

‘এখানে আমি প্রাইভেট পড়াই তাই।’

মুন এবার নিজের ভুলটি বুঝতে পেরে জিভ কাটল। আহনাফ এবং জহির চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘স্যরি, আমারই বোঝার ভুল ছিল।’

আহনাফের রিয়াকশনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সে গম্ভীর হয়েই তাকিয়ে রয়েছে। জহির চৌধুরী মৃদু হাসলেন। বললেন,

‘সমস্যা নেই। ভেতরে যাও।’

অর্ষা মুনকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পথে ইচ্ছেমতো চাপা রাগ ঝাড়ল কিছুটা। মান-সম্মানের আর কিচ্ছু বাকি রাখল না।

ওরা চলে যাওয়ার পর দারোয়ান হেসে বলে,’তাও ভালো স্যার। আমি আরও মনে মনে ভাবতেছিলাম আহনাফ বাবাজীর বউ আসলো কোত্থেকে! বিয়ের আগেই বেনামি বউ বাসায় উঠে গেছে হাহা।’

দারোয়ানের কথায় জহির চৌধুরী হাসলেও আহনাফ হাসেনি একবিন্দুও। অর্ষাকে নিয়ে মনে মনে তার অন্যরকম চিন্তা-ভাবনা ঘুরছে। আসলেই মুন মেয়েটার বোঝার ভুল ছিল নাকি অর্ষারই কোনো প্ল্যান ছিল সেটা সে ভেবে পাচ্ছে না। ভার্সিটির প্রথমদিন রাশেদকে হেনস্তা করার পর থেকেই অর্ষার প্রতি তার মনোভাবটা অন্যরকম। অথচ আদতে এই ছেলে জানেই না, সেদিন কে রাশেদকে নিয়ে মজা লুটেছিল! কিছুটা বোঝার ভুল সম্পূর্ণ মনোভাবকেই বদলে দিয়েছে।

আহনাফ যেমন ভাবলেশহীনভাবে এসেছিলে সেরকমই ভাবলেশহীনভাবে বাড়ির ভেতর চলে গেল। সিঁড়ি বেয়ে সোজা চলে গেছে দুই তলায়। বাম পাশের করিডোর পেরোলেই মাঝখানের রুমটিতে থাকে আমেনা বেগম। মানিসকভাবে সে অসুস্থ। অন্যদের ভাষায় পাগল! আহনাফের যখন ১৭ বছর বয়স তখন থেকেই তার মায়ের এই সমস্যা। সমস্যাটির উৎস অবশ্য এক্সিডেন্টের মাধ্যমে। অনেক ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছে; তবে অবস্থার কোনো রকম পরিবর্তন হয়নি। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকবার বলেছে কোনো পাগলাগারদে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে আহনাফের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। পুরো পৃথিবী একদিকে আর অন্যদিকে তার মা। সে অসুস্থ হোক, পাগল হোক, যা খুশি হোক; নিজের কাছেই রাখবে।

আহনাফ দরজায় নক করে বলল,’আসব?’

ভেতর থেকে উত্তর আসে,’কে? আহনাফ? আয় বাবা।’

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে আহনাফ। আমেনা বেগমের মুখে অমায়িক হাসি। কে বলবে এই মানুষটি মানসিকভাবে অসুস্থ? হুট করে কেউ কথা বললে বুঝতেও পারবে না সহজে।

আমেনা বেগম বিছানায় দু’পা মেলে বসে আছেন। হাতে বই। গল্প কিংবা উপন্যাস নয়; কার্টুনের বই। মানসিক সমস্যাটা দেখা দেওয়ার পর থেকেই তার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তার আচরণ স্বাভাবিক মানুষের মতো তো নয়ই; বরং শিশুসুলভ। কার্টুন তার ভীষণ প্রিয় এখন।

আহনাফ বিছানায় বসে মায়ের কোলে মাথা রাখল। আমেনা বেগম আহ্লাদী হয়ে বললেন,

‘আমায় একটা গোপাল ভাঁড়ের কার্টুন এনে দিস তো বাবা। ডোরেমন আর ভালো লাগে না।’

আহনাফ কিছু বলল না। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে হাতটি নিজের বুকের ওপর রাখল।
.
.
বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মুন। ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা। সকাল এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় মুনের দিকে। মুন পানিটুকু পান করে ঢোক গিলে বলে,

‘কখন থেকে দেখছি ঐভাবে তাকিয়ে আছিস। এমন করছিস কেন?’

‘তোর নির্বুদ্ধিতা নিয়ে কী বলব বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ রে, তোর মাথায় কি একটুও কমনসেন্স নেই। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা বুঝিস না তুই?’

‘কী আশ্চর্য! এতদিন পর দেখা হয়েছে। তাই আমি ভাবলাম, তুই তো আর এখন মিথ্যা কথা বলবি না। আবার বাড়ির ঠিকানাও দেখি অন্যটা। তাই তো ধরে নিয়েছিলাম, তোর বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘উদ্ধার করেছিস আমায়! ঐ মানুষটাকে আমি মুখ দেখাব কীভাবে?’

‘আহ্! ঢং। এমন ভাব করছিস, মনে হচ্ছে তুই ঐ বাচ্চাকে না বরং বাচ্চার মামাকেই প্রাইভেট পড়াতে যাস।’

‘তুই বুঝবি না। ঐ লোক যে কী রকম ধরণের মানুষ তুই জানিস না।’

‘আমার এত জেনে কাজ নেই বাপু। অন্য ছেলেপেলে নিয়ে এত গবেষণা করেই বা আমার লাভ কী? আমার তো একটা নির্দিষ্ট মানুষ আছেই। আর হ্যাঁ, তোর বকাঝকা এখন বন্ধ কর। আমি তোর বাড়ির মেহমান এখন।’

‘হু, ঝামেলায় ফেলানো মেহমান।’

সকাল এবার অর্ষাকে থামিয়ে বলল,’হয়েছে তো আপু। এবার থামো। বেচারিকে একটু নিঃশ্বাস তো নিতে দাও।’

মুন বলল,’হ্যাঁ, একটু বুঝাও ও-কে। রাগ, জেদ আগের থেকে আরও বেড়ে গেছে।’

অর্ষা আর কিছু না বলে রান্নাঘরে গেল কিছু খাবার আনতে। যাওয়ার আগে রুহুলের ঘরে একবার উঁকি দিয়েছে। রুম ফাঁকা।

একটা ট্রে-তে চা, বিস্কিট আর মিষ্টি সাজাচ্ছিলেন সেলিনা বেগম। অর্ষা জিজ্ঞেস করল,

‘ভাইয়া কোথায়?’

‘বাইরে গেছে। কত করে বললাম এই অবস্থায় বাইরে যাস না। শুনলই না।’

‘কখন গেছে?’

‘তুই যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই।’

অর্ষা এই ব্যাপারে আর কোনো কথা না বলে ট্রে নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। চা, বিস্কুট খেতে খেতে জানা গেল মুন বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। ওর বয়ফ্রেন্ড ঢাকাতেই থাকে। কাল-পরশু বিয়ে করবে ওরা।

‘পালিয়ে আসাটা কি ঠিক হলো আপু?’ জানতে চাইল সকাল।

মুন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,’এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না বোন। বাড়িতে আব্বু-আম্মু অন্য এক ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বয়ফ্রেন্ডের কথা বাড়িতে জানিয়েছিলাম। মা রাজি হলেও, বাবা রাজি হয়নি।’

সকাল ঠোঁট উলটে বলল,’প্রেম ঘটিত ব্যাপার বুঝি এরকমই হয়।’

অর্ষা ধমক দিয়ে বলল,’তোকে আর প্রেম নিয়ে গবেষণা করতে হবে না। যা পড়তে বোস।’

ধমক খেয়ে সকাল পড়তে বসে। অর্ষা ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসেছে। কয়েকটা মেইল এসে জমা হয়েছে। তার মধ্যে আজকের মেইলটা নতুন। পাঁচটার দিকে এসেছে। মুন পাশে বসে বলল,

‘রাগ করে থাকবি এখনও?’

মেইল চেক করতে করতে অর্ষা বলল,’দুই বছর কোনো যোগাযোগ রাখিসনি।’

‘এজন্য স্যরি তো!’

‘তোর এখন সাহায্য দরকার। থাকার মতো বিশ্বস্ত একটা জায়গা দরকার। তাই মানবিকতার খাতিরে সাহায্য করছি। এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করিস না।’

‘তুই এত নিষ্ঠুর কেন রে অর্ষা?’

‘আমি এরকমই। আরও দুই বছর যাক। তখন কথা বলব।’

‘আমি আর আমার বয়ফ্রেন্ড আদিব প্ল্যান করেছি যে, আমরা বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বাবু নিব। তারপর বাড়ি ফিরে যাব। নাতি-নাতনির মুখ দেখলে বাবা-মা নিশ্চয়ই আর রাগ করে থাকতে পারবে না। এখন তো দেখছি, বান্ধবীর রাগ ভাঙানোর জন্য হলেও বাচ্চা তাড়াতাড়ি নিতে হবেই।’

অর্ষার প্রচণ্ড হাসি পেলেও এই মুহূর্তে হাসিটা আটকে রাখল সে। মেইল চেক করা শেষ। কাল সকালে হাসপাতালে যাবে ইন্টার্ভিউ দেওয়ার জন্য। সিভি পাঠিয়ে রেখেছিল। ওরা ই-মেইল করে ডেকেছে ইন্টার্ভিউ এর জন্য।

সকালের পড়া শেষ হলে রাতের খাবার খেয়ে তিনজনে একসাথে অনেকক্ষণ গল্প করে। সকালের ক্লাস আছে তাই ঘুমিয়ে পড়েছে এখন। মুনও জার্নি করে আসায় ক্লান্ত। দুজনই বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। অর্ষার নিজেরও আগামীকাল তাড়া আছে তবুও ভাইয়ের চিন্তায় ঘুম আসছে না। অনেক রাত অব্দি জেগে থাকার পরও রুহুল বাড়িতে ফেরে না। বাবা কয়েকবার ফোন করেছিল। রিসিভ করেনি। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে অর্ষা ঘুমিয়ে পড়েছে টের-ই পায়নি!
.
.
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি বাইরে। ভোরের দিকে ঝুমবৃষ্টি এলেও এখন বৃষ্টির তোড়জোড় কমে এসেছে। ছাতা নেবে নাকি নেবে না দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অর্ষা। ওমর রহমান ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়ের দ্বিধান্বিত মুখটি দেখে জিজ্ঞেস করেন,

‘কী হয়েছে মা?’

বাবার মুখে ‘মা’ ডাকটি শুনলেই মনের ভেতর শান্তি পায় অর্ষা। তার মনটা ভালো হয়ে গেল। সে হাসিমুখে বলল,

‘কিছু না বাবা।’

‘তোর মা বলল আজ নাকি তোর ইন্টার্ভিউ আছে?’

‘হ্যাঁ। জেনারেল হাসপাতালে রিসিপশনিষ্ট পদের জন্য সিভি পাঠিয়েছিলাম।’

‘যাক, যাক খুব ভালো। তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেরি করিস না।’

‘আসলে বাবা, আমি ভাবছিলাম ছাতা নেব নাকি নেব না।’

‘নিয়ে যা। রাস্তায় যদি আবার বৃষ্টি জোরে আসে তখন তো ভিজে যাবি।’

‘ঠিক আছে।’

অর্ষা রুমে গিয়ে ফাইল আর ছাতা নিয়ে বের হয়। বাবা-মায়ের থেকে দো’আ নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে চলে যায়। বৃষ্টির সময় প্রতিবার যা হয়, আজও তাই হলো। রিকশা পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। বাজার পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হবে। তারপর বাস ধরতে হবে। কাদা-পানির মধ্যে খুব সাবধানে পা ফেলছে সে। তার পরনে হলুদ রঙের একটা থ্রি-পিস। হলুদ কামিজে আবার হালকা গোলাপী রঙের হাতে আর্ট করা ছোটো ছোটো ফুল। এগুলো সকালের কাজ। দারুণ আঁকাআঁকি করে মেয়েটা। কখনও মায়ের শাড়িতে আঁকবে তো কখনও অর্ষার জামা কিংবা ওড়নাতে। সকাল সময় নিয়ে খুব যত্ন করে জামাটির ডিজাইন করেছে। তাই অর্ষারও খুব প্রিয় এই থ্রি-পিসটা। ওড়নার দু’ধারেও গোলাপী ফুল আঁকা।

ঠিক সময়ে বাস পাওয়াতে মনে মনে আল্লাহকে একটা ধন্যবাদ দিল সে। বাস থেকে নামল পরের স্টপেজে। এখান থেকে আবার রিকশা নিতে হবে। এই রাস্তায় বাস চলাচল করে না। সিএনজি, বাইক, প্রাইভেট কার, রিকশা এসব চলে। অর্ষার জন্য রিকশাই ভরসা। আরেকটু সামনে এগিয়ে রাস্তা পার হয়ে রিকশা নেওয়ার জন্য অর্ষা হাঁটতে থাকে। কিছুটা সামনেই অনেক মানুষের ভিড় দেখে সে এগিয়ে যায়। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় একটি ছেলে রাস্তায় পড়ে আছে। এখনও অচেতন হয়নি। কিছু লোক প্রাইভেট কারের ড্রাইভারকে ধরে বেধড়ক পে’টা’চ্ছে এক সাইডে। অর্ষা ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়। কয়েকজন লোক ছেলেটিকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য কোলে তুলে নিয়েছে। অন্য একটা ছেলে সিএনজি নিয়ে এসেছে। ছেলেটির মুখ দেখে অর্ষা আঁৎকে ওঠে। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে মৃদু চিৎকার করে বলে,

‘আহিল!’

সে এগিয়ে যায় র’ক্তা’ক্ত আহিলের কাছে। উৎকণ্ঠিত হয়ে ডাকে,

‘আহিল, আহিল!’

উপস্থিত একজন অর্ষাকে জিজ্ঞেস করে,’আপনি উনাকে চিনেন ম্যাম?’

অর্ষা তড়িৎ গতিতে মাথা ঝাঁকাল।

লোকটি বলল,’তাহলে আমাদের সাথে আসুন।’

অর্ষা সিএনজিতে উঠে বসল। আহিলকে বসানো হলো ওর পাশে এক হাতে আহিলকে আগলে ধরল অর্ষা। নিজের ওপর কোনো ভারসাম্য নেই আহিলের। এখন সে অচেতন। সম্পূর্ণ ভার অর্ষাকে সামলাতে হচ্ছে। সিএনজি ডেকে আনা ছেলেটি বোধ হয় অর্ষার মুখাবয়ব বুঝতে পেরেই সামনে থেকে পেছনে এসে বসল। এবার সে আহিলকে আগলে ধরল। অর্ষা অবশ্য আহিলের হাত ছাড়েনি। আহিলের একটা র’ক্ত মাখানো হাত অর্ষার কোলের ওপর পড়ে আছে। এই মুহূর্তে অর্ষা ভুলেই গেছে তার যে ইন্টার্ভিউ রয়েছে একটু সময় বাদেই। আতঙ্কে চোখ-মুখের বর্ণই বদলে গেছে তার।

নিকটস্থ একটা হাসপাতালের সামনে সিএনজি থামে। কয়েকজন ধরাধরি করে আহিলকে সিএনজি থেকে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়। অর্ষাও পিছু পিছু দৌঁড়ে যায়। তার হলুদ রঙের থ্রি-পিস, হিজাবে এখন র’ক্তে’র ছোপছোপ দাগ। ভেতরে ঢুকে সকল ফর্মালিটি সে-ই পূরণ করে। একবার রিসিপশনে ছুটছে তো, আরেকবার ফার্মেসীতে। হাসপাতালে আসার পর থেকে সে দৌঁড়াদৌঁড়ির ওপরই রয়েছে। দৃশ্যটা দূর থেকেই দেখছিল আহনাফ। সে আমেনা বেগমকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছিল। অর্ষার আপ্রাণ ছুটাছুটি তার দৃষ্টি এড়ায় না।

অর্ষা এখন রিসিপশনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইরে তখন ঝুমবৃষ্টি। ঠাণ্ডা আবহাওয়া। তবুও মেয়েটার কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। ফোনের রিংটোনে দৃষ্টি সরায় আহনাফ। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটি বের করে। কথা শেষ হলে সে একজন পরিচিত নার্সকে ডেকে বলে,

‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এক্ষুণী চলে আসব। মাকে একটু দেখে রাখবেন।’

বয়স্ক নার্সটি বলল,’আচ্ছা বাবা।’

হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পূর্বে আর একবার অর্ষার দিকে দৃষ্টিপাত করল আহনাফ। অর্ষা অবশ্য তাকে দেখেনি। রিসিপশনের কাজ শেষ হলে সে আহিলের কেবিনের সামনে গিয়ে বসে। প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এইটুকু সময়েই। বাম হাতের ঘড়িতে একবার সময় দেখল সে। ঠিক তখন একজন সুন্দরী মাঝ বয়সী মহিলা এসে শিশুকণ্ঠে শুধাল,

‘আমি কি এখানে বসতে পারি, মা?’

অর্ষা মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে বলল,

‘অবশ্যই।’

তিনি বসলেন এবং নিজে থেকেই কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন,

‘আমার ছেলে বাইরে গেছে। ও আসলেই আমি চলে যাব।’

মহিলাটির সরলতায় অর্ষা মৃদু হাসল। বলল,

‘কোনো সমস্যা নেই।’

এবার সে অর্ষাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করল,

‘তোমার কী হয়েছে? গায়ে র’ক্ত কেন? তুমিও কি ডাক্তার দেখাতে এসেছ?’

এতক্ষণে নিজের দিকে ভালোমতো নজর বুলাল অর্ষা। সত্যিই তার থ্রি-পিসে শুকনো র’ক্ত। হাতেও আছে। তখনই তার মনে হলো ইন্টার্ভিউ এর কথা। ঘড়িতে সময় দেখল সে। না, এখন আর গিয়েও লাভ নেই। সে হতাশ ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। পাশ ফিরে মহিলাটিকে উত্তর দিতে গিয়ে দেখে সে চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছে। অষার প্রচণ্ড মায়া হলো। সে আলতো করে তার মাথাটি নিজের কাঁধের ওপর রাখল। ঘুমের জন্য মহিলাটি নিজের ভর নিজেই ধরে রাখতে পারছিল না। অর্ষা নিজেও বিষয়টি লক্ষ্য করে।

আহনাফ কাজ শেষ করে ফিরে এসেছে। রিসিপশন পার হয়ে ডানদিকে যাওয়ার সময় তার চোখ পড়ে বামপাশের করিডোরে। হলুদ ড্রেস পরা এক মেয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। তার এক হাত চেয়ারের ওপর। মাথা কাৎ করে রাখায়, আঙুলগুলো কপালের ওপর রাখতে পেরেছে। র’ক্ত মাখা হাতের আঙুলগুলো কপালে ম্যাসাজের মতো বিচরণ করছে। তিনটা চেয়ার দখল করে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তার মা আমেনা বেগম। মাথা রাখা অর্ষার কোলে। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা মায়ের মুখ থেকে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল হলুদ ড্রেস পরা সেই ক্লান্ত মেয়েটির দিকে। এবং বলাই বাহুল্য, অনেক অনেকক্ষণ সেই দৃষ্টি আটকে ছিল মেয়েটির মলিন মুখের ওপর।

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here