#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৩৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
শুনশান নিরবতা যেন ভর করেছে চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায়। চতুর্দিকে মেহমান, আত্মীয়স্বজনের এতটুকুও কমতি নেই; তবুও রয়েছে নিরবতার সঙ্গ। হুট করেই বর এবং হাসিব, আহিল ওরা উধাও। কোথায় গেছে না গেছে কাউকেই কিছু জানানো হয়নি। এদিকে হলুদের অনুষ্ঠানের শুরু হলে বলে। চারপাশে চাপা গুঞ্জন। ‘বর কি তবে আবার পালাল নাকি?’
এমন গুঞ্জনে জহির চৌধুরীর মেজাজ চড়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তার ছেলেকে নিয়ে এমন বিরূপ মন্তব্য সহ্য করা তার ধাতে অন্তত নেই। তথাপি প্রশ্ন তবুও রয়েই যায়, দুই ভাই আর বন্ধু মিলে গেল কোথায়? তিনি লাগাতার আহনাফের ফোনে কল করে যাচ্ছেন। রেসপন্স না পেয়ে আহিল এবং হাসিবকেও কল করলেন। তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। এবার দুশ্চিন্তায় তিনি রীতিমতো ঘামছেন। ছেলেগুলো গেল কোথায়?
.
.
মুনসহ বাকি মেয়েরা নিস্তব্ধ, নির্বাক চাউনিতে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছে। লামিয়া দু’গালে হাত রেখে বলে,
“হায়ে! তোকে কী সুন্দর লাগছে রে অর্ষা! আজ তো দুলাভাই একদম পাগল হয়েই যাবে।”
মুন বলল,
“উঁহু! আজ নয়। কাল। দুলাভাই আজ দেখবে কী করে?”
“কীভাবে আবার! ভিডিয়ো কলে। এত সুন্দর হলুদকন্যাকে যদি দুলাভাই আজ দেখতে না পারে তাহলে তার হলুদ সন্ধ্যাটাই বৃথা যাবে বুঝলে?” বলল রেশমি।
জুঁই ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল,
“ঠিক কথা। নে ভাইয়াকে একটা কল কর তাহলে।”
অর্ষা বাঁধা দিতে গিয়েও দিল না। উহ্য রইল, পারল না। সে আগের চেয়ে স্বাভাবিক হলেও পুরোদমে হতে পারেনি। ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। তার কণ্ঠস্বরের গতি শ্লথ হয়ে আসে। চিনচিনে ব্যথাটা বুকে এখনও হয়। তার দরুণ সে এবারও চুপ করে রইল। রেশমি বার দুয়েক চেষ্টা করেও আহনাফকে কলে পেল না। শেষে বিরক্ত হয়ে বলল,
“কিরে তোর জামাই কি হলুদের নিচে পড়ছে নাকি?”
অর্ষা ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
“কীসব কথা বলিস!”
“তাহলে আর কী বলব? এতগুলো কল দিলাম। একটাও ধরছে না।”
লামিয়া বলে,
“আহিল ওদের দিয়ে দেখ। দুলাভাই হয়তো ফোন সাথে রাখেনি।”
আহিলকে ফোন করার পূর্বেই সকাল রুমে এসে উপস্থিত হলো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপুকে স্টেজে নিয়ে যেতে বলেছে।”
পূণরায় আর কাউকেই ফোন করা হলো না। স্টেজে গিয়ে না হয় পরে ট্রাই করা যাবে ফের। সবাই এখন সাবধানে অর্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে। গায়ে হলুদের স্টেজ বাড়ির উঠানেই বানানো হয়েছে। ওদের পক্ষের মেহমানের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। তবুও বিশাল আকৃতির উঠান মানুষে মানুষে এখন গিজগিজ করছে। বাড়ির চতুর্দিকে ঝাড়বাতির ঝিকিমিকি আলো। স্টেজে ফুলের বাহার। অর্ষার রুম থেকে বেরোনোর প্রয়োজন হয়নি বলে সে এত সুন্দর করে সাজানো নিজের বাড়িটা লক্ষ্যই করেনি। তবে এতটুকু সে শুনেছিল, রুহুল নিজে লোক সাথে নিয়ে পুরো বাড়ি সাজিয়েছে। ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার জানান দিতে গিয়ে তার চোখ ছলকে পানি বের হতে চাইছে। পুরনো ক্ষত, বাজে অতীত এবং সেদিনের দুর্ঘটনা ছাপিয়ে গেছে এখন রুহুলের ভালোবাসা। সে সমস্ত খারাপ ঘটনা ভুলে গেছে এক সেকেন্ডেই। মনের ভেতর অনুভব করছে এবার অন্য ক্লেশের উপস্থিতি। আগামীকাল বিয়েটা হয়ে গেলেই সে হয়ে যাবে অন্য বাড়ির বউ। চিরপরিচিত তার এই বাড়িটাকে, বাড়ির মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে হবে। অর্ষা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। তার কাজল কালো সুন্দর আঁখিদ্বয় থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার কোমল, পেলব গাল পেয়ে। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। স্টেজে তার দুইপাশে বান্ধবীরা বসে আছে। অর্ষা একবার চোখ তুলে সামনে তাকাল। এত মানুষের উপস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তিবোধও করছে সে। ক্যামেরাম্যান এসে উপস্থিত হয় তখন। জানতে পারে এদেরকে রুহুলই এনেছে। তারা এখন অর্ষাকে দিয়ে নানানরকম পোজ দেওয়াচ্ছে আর ছবি তুলছে। এর মাঝেই সে বান্ধবীদের সঙ্গে উদ্ভট ছবির পোজ দিতে গিয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে শব্দ করে হেসেও ফেলে। ওমর রহমান,সেলিনা বেগম দূর থেকে দেখে চোখের পানি ফেলেন। আহা, সময়! রাত পোহালেই আগামীকাল মেয়েটা তাদের ছেড়ে যাবে। বুকে পাথর বাঁধতে চেয়েও তারা বারংবার দুর্বল হয়ে পড়ছেন। চোখের পানি যেন বাঁধ-ই মানতে চাইছে না কোনো। আচ্ছা মন এত দুর্বোধ্য বেহায়া এবং অবাধ্য কেন? কেন চাইলেও মন নামক বস্তুটাকে কোনোভাবেই মানানো যায় না!
মুন, লামিয়া, জুঁই, রেশমি আর সকাল একসাথে মিলে নাচবে। গায়ে হলুদের আগের দিন রাতেই রাত জেগে সবাই ড্যান্স প্র্যাকটিস করেছিল। “তেরে লিয়ে সাজনা ইয়ে চুড়ি কাঙ্গনা” গানেই ড্যান্স কভার করবে ওরা। মাঝখানে এজন্য সুন্দর করে সাজিয়েছে রুহুল। পাঁচজনের নাচ শেষ হলেই হাত-তালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বাড়ি। ওরা ক্লান্ত হয়ে অর্ষার পাশে এসে বসে। রুহুল পানির বোতল এনে দিল। রুদ্ধশ্বাসে সবাই পানি শেষ করে হাফ ছেড়ে বসতে না বসতেই হঠাৎ করে বাড়িতে শোরগোল শুরু হয়ে যায়। অর্ষাসহ বাকিরা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঘটনা কী! রুহুল নিজে বাইরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই আহনাফ, আহিল, আশিক, দিদার আর আদিবকে দেখতে পায় সবাই। আহনাফ হাসিহাসি মুখ করে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার এদিকের বাকিরাও জোরে চিৎকার করছে আর শিষ বাজাচ্ছে। অর্ষা তাকিয়ে রয়েছে ভূত দেখার মতো। এতটা সারপ্রাইজড হয়েছে যে, সেটা সে রিয়াকশন দিয়েও প্রকাশ করতে পারছে না। আনন্দে চোখের কোণে ফের জমা হয়,দু’ফোটা অশ্রু। সে পারিপ্বার্শিক দিক এবং সমস্তটা বেমালুম ভুলে গিয়ে বসা থেকে উঠে দৌঁড়ে গিয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। আহনাফ হেসে ফেলে। অর্ষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“আয় হায়! আমার প্রজাপতিটা কি আমায় এতটাই ভালোবাসে যে বাবা-মা, ভাই-বোন, ফ্রেন্ডস এমনকি এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও সমস্ত কিছুর পরোয়া না করেই আমায় জড়িয়ে ধরেছে?”
অর্ষা কিছুই বলল না প্রত্যুত্তরে। শুধু চুপচাপ পড়ে রইল আহনাফের বুকের মাঝখানে।
চলবে…#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৩৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
চারদিক থেকে ভেসে আসা করতালির শব্দে অর্ষার ঘোর ভাঙে। আবেগে, খুশিতে ও আনন্দে সে এতগুলো মানুষের সামনেই কী করে ফেলল ভাবতেই বারংবার লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে সে। আহনাফের বুক থেকে মাথাও তুলতে পারছে না। মনে হচ্ছে, মুখ লুকানোর চেয়ে এরচেয়ে ভালো কোনো স্থান এই মুহূর্তে আর কিছু হতেই পারে না। তবে সে বেশিক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে আহনাফের বুকে থাকতে পারল না। নতমুখে সরে এলো কিছুটা। আহনাফের চোখে-মুখে তখনও হাসি। তবে তারও এই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শালিকারা তাকে জেঁকে ধরেছে। একেকজন কোমরে হাত রেখে এমনভাবে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে একেকজন থানার ওসি! আহনাফ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলল। লামিয়া চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে বলল,
“ঢোক গিলে তো কোনো লাভ হবে না দুলাভাই। এইযে আপনি হুট করেই এসে অনুষ্ঠানে জুড়ে বসলেন। ফ্রি-তে হবু বউয়ের উষ্ণ স্পর্শ নিলেন। সব তো আর আমরা এমনি এমনিই বরদাশত করব না তাই না?”
রুহুল গলা খাঁকারি দিয়ে সেখান থেকে শটকে পড়ল। হাজার হোক, বড়ো ভাই বলে কথা! বাবা-মা’ও সেখানে না থেকে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওরা বাচ্চা মানুষ, এবার যা করে করুক গিয়ে।
লামিয়ার কথার মাঝে হাসিব ফোঁড়ন কেটে বলল,
“এমনি এমনি বরদাশত করবেন না বলতে কী বোঝাতে চাইছেন? আহনাফ আপনাদের প্রত্যেককে জড়িয়ে ধরবে এটা? কিন্তু মিস ঝগড়াপার্টি, এটা তো সম্ভব নয়। আহনাফের মনে-প্রাণে, দেহে শুধু একজনেরই বসবাস। আর সে হলো আমাদের ভাবি অর্ষা। আহনাফ তো অর্ষা ব্যতীত কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, আমি সিঙ্গেল আছি। কোনো গার্লফ্রেন্ড, ফিয়ন্সে, বউ কিচ্ছু নাই। সূতরাং আপনারা চাইলেই আপনাদের জড়িয়ে ধরার মহৎ কাজটা করতে পারি। আসুন কে আগে আসবেন। তার আগে লাইনে দাঁড়ান আগে সবাই।”
রেশমি বিকট শব্দে একটা ধমক দিল হাসিবকে। হাসিব ততক্ষণে শাহরুখ খানের স্টাইলে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিল। যেই না ধমক খেল, ওমনি মনে হলো তার শিরদাঁড়া বেয়ে ভূ’মি’ক’ম্প হয়ে গেল। সে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“বাচ্চা একটা ছেলেকে কেউ এভাবে ধমক দেয় নাকি?”
“ঠিক সময়ে বিয়ে হলে এখন তিন বাচ্চার বাপ থাকতেন আপনি ভাই!” বলল মুন।
আদিব তখন বলল,
“তুমি বাচ্চা মেয়ে এসবের মধ্যে কথা বলছ কেন?”
মুন এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমি বাচ্চা? হ্যাঁ, আমি বাচ্চা? বাচ্চা মেয়েকে তাহলে বিয়ে করেছ কেন? তোমাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত। দেবো নাকি থানায় কল?
দুলাভাই, আপনার চেনাজানা ভালো কোনো পুলিশ আছে? যে এই লোকটাকে থানায় নিয়ে ডা-ন্ডা-পে-টা করে বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করার শখ মেটাতে পারবে?”
আদিব অসহায়ভাবে তাকাল আহনাফের দিকে। আহনাফও অসহায় ভঙ্গিতে আদিবের কাঁধে হাত রাখল; যার অর্থ,’ভয় পেও না। চেনাজানা থাকলেও তোমায় আমি পুলিশে দেবো না।”
আশিক দু’হাত বগলদাবা করে গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বলল,
“ওগো বান্ধবী মুনমুন,
কানের কাছে কোরো না গুণগুণ,
কথার বাণে হয়ে যাব;
আমরা সবাই গণ-খু-ন।”
জুঁই বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
“এত সুন্দর হলুদের রাতেও তোর আজাইরা কবিতা শুনতে হচ্ছে।”
“ঝগড়া পরে হবে। আগে আমাদের পাওনা চাই।” বলল লামিয়া।
আহিল প্রশ্ন করল,
“কীসের পাওনা তোদের?”
“বুঝিস না? টাকা, টাকা! টাকা বখশিশ চাই আমরা।”
“মামার বাড়ির আবদার?”
সকাল ভেংচি কেটে বলল,
“জি না! দুলাভাইয়ের বাড়ির আবদার।”
দিদার আহনাফের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“কেন যে ভাই শুধু শুধু যেচে এখানে আসতে গেলেন! এখন গেলেন তো ফেঁসে। ভালো হয়েছে না?”
আহনাফ প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,
“তোমাদেরই তো বান্ধবী!”
সূক্ষ্ম খোঁচাটা স্পষ্ট টের পেয়েও চুপ করে গেল দিদার। অর্ষা ওদের পক্ষ নিয়ে রিনরিনে স্বরে বলল,
“বাদ দে না!”
“বাদ দেবো? কী বাদ দেবো? তুমি হলো গিয়ে বিয়ের কনে। তোমার মাতব্বরি চলবে বিয়ের পর স্বামীর ওপর। এই সকাল, যাও তো সোনা ওদেরকে স্টেজে বসিয়ে আসো।”
লামিয়ার কথামতো সকাল আহনাফ এবং অর্ষাকে স্টেজে নিয়ে গেল। বেচারা হাসিব সেই যে ধমক খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে; আর একটা টু’শব্দ-ও করেনি। লামিয়া কোমরে হাত গুঁজে বলল,
“এইযে বিড়াল কমিটির চেয়ারম্যান, এখন কেন চুপ করে আছেন? ওয়ালেট বের করুন। আর আমাদের পাওনাটা ভালোই ভালো মিটিয়ে দিন।”
আহিল বলল,
“অসম্ভব! কাল তো ঠিকই গেইট ধরে পকেট ফাঁকা করবি। আবার আজও টাকা নিবি? মগের মুল্লুক পেয়েছিস নাকি?”
আহিলের সঙ্গে বাকি ছেলেরাও তাল মেলাল।
“নে’ম’ক’হা’রা’মে’র দল! বরপক্ষ হয়েছিস বলে কি মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি? জলদি, জলদি টাকা বের কর বলছি।”
উপায়ন্তরহীন হয়ে ওদের ওয়ালেট হালকা করতেই হলো। টাকা হাতে পেয়ে জুঁই হেসে বলল,
“তো, তোরা এখন কী খাবি বল? শরবত নাকি মিষ্টি?”
আশিক বলে,
“কীসের শরবত, মিষ্টি? বি-ষ দে। খেয়ে ম-রে যাই। টাকা নিয়ে তো দিলি ফুতুর করে।”
“সরি রে! বি-ষ কোথায় পাওয়া যায় আমি জানিনা। তবে তুই চাইলে, তোর জন্য আমি খুঁজে অর্ডার করতে পারি।”
“মাফ চাই বইন! মিষ্টি, শরবত যা ইচ্ছে খাওয়া। আমার পেটে ইঁদুর হা-ডু-ডু খেলছে। কাবাডি কাবাডি বলার বদলে বলছে,’খাবার দে, খাবার দে।’ বুঝতেই পারছিস অবস্থা কী রকম সাংঘাতিক?” বলল দিদার।
লামিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“শা-লা পেটুক!”
হালকা খাওয়া-দাওয়া করেই ওরা সবাই চৌধুরী বাড়ির দিকে রওনা হলো। জহির চৌধুরী ফোন দিয়ে এরকম খামখেয়ালির জন্য সবার ওপর ভীষণ ক্ষেপে আছেন। হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। সেলিনা বেগম মেয়েদেরকে আগে আগে খাইয়ে দিয়ে কড়াস্বরে বললেন,
“সব্বাই কিন্তু এখন চুপটি করে ঘুমাবে। রাত জেগে হাহা, হিহি করা যাবে না একদম। সকালে কিন্তু তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। মনে থাকবে?”
মুন হাই তুলে বলল,
“মনে থাকবে আন্টি। আমরা লক্ষী মেয়ের মতো এখনই ঘুমিয়ে পড়ব।”
সেলিনা বেগম মুচকি হেসে ঘরের দরজা চাপিয়ে দিলেন। বান্ধবীরা সবাই ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমিয়েছে। খাটে ঘুমিয়েছে অর্ষার দুঃসম্পর্কের দুই নানি। বান্ধবীরা একেকজন জড়াজড়ি করে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাত দুটো নাগাদ আহনাফ বেশ কয়েকবার অর্ষাকে ফোন দেয়। তবে দুঃখের বিষয়, অর্ষার ফোন ছিল সাইলেন্ট মুডে।
.
সকালে প্রত্যেকের ঘুমও ভাঙল সেলিনা বেগমের ডাকে। সবাইকে টেনে ঘুম থেকে তুলতে হয়েছে তার। সকাল বাচ্চাদের মতো করে অর্ষার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। একপাশে মুন। সে ওর এক পা দিয়ে রেখেছে অর্ষার পায়ের ওপর। লামিয়াকে দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরেছে জুঁই এবং রেশমি। আদার মতো একজন আরেকজনের সাথে জোড়া লেগে আছে। মহারানিদের ঘুম ভাঙাতেও তাকে বেশ কসরত করতে হলো। কাঁথা টেনে নিয়ে ভাঁজ করতে করতে বললেন,
“দশ মিনিটের মধ্যে সবাই ফ্রেশ হয়ে নেবে। আমি নাস্তা এনে যেন দেখি তোমাদের ফ্রেশ হওয়া শেষ।”
এরপর তিনি নানিদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
“খালা, যাও তোমরাও মুখ ধোও। আমি খাবার আনছি। একটুপর কাজের চাপে সরতেও পারব না। তোমাদেরকে আগে খাইয়ে আমি কাজে হাত দেবো। নইলে এগুলো তো একেকটায় আনন্দে খাওয়া-দাওয়াই বাদ দিয়ে বসে থাকবে।”
শেষের কথাটি অর্ষাদের উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। ব্যস্তভাবে যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। সকালের নাস্তা একসাথে খেয়ে অর্ষা ফোন হাতে নিয়ে দেখল ১৯+ মিসডকল। সবগুলোই আহনাফের কল ছিল। সে পার্লারে যাওয়ার সময় কলব্যাক করল আহনাফকে। আহনাফ রেসপন্স করেনি। রুহুল ওদেরকে পার্লারে পৌঁছে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। সাজতে বসার ঠিক আগ মুহূর্তে আহনাফ অর্ষাকে কলব্যাক করে।
“হ্যালো।”
“জি, বলেন।”
“কোথায় তুমি?”
“পার্লারে এসেছি।”
“পরে ফোন করব?”
“সমস্যা নেই। আপনি বলেন। আর হ্যাঁ, সরি। কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফোনও সাইলেন্ট ছিল তাই রিসিভ করতে পারিনি।”
আহনাফ হেসে বলল,
“বুঝতে পেরেছিলাম প্রজাপতি। এমনিতে আমিও গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলার জন্য অবশ্য কল করিনি রাতে।”
“তাহলে?”
“এমনিই খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।”
“ওহ।”
“তবে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ফোন করেছি।”
“বলেন।”
“ভালোবাসি প্রজাপতি।”
অর্ষা আয়নায় তাকিয়ে ছিল। সলজ্জিতভাবে হাসল সে। পার্লারে কর্মরত মেয়েটি বলল,
“কথা শেষ হয়েছে ম্যাম? ব্রাইডাল সাজ তো। একটু বেশি সময়ই লাগবে কিন্তু।”
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আহনাফ কথাগুলো শুনেছে। সে বলল,
“এখন তাহলে রাখছি বাটারফ্লাই। তুমি সুন্দর করে সাজো। আমার পরীটাকে আজ সবচেয়ে সুন্দর দেখতে চাই।”
“শুনুন না!”
“বলো না!”
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে অর্ষা বলল,
“আপনার প্রজাপতিও আপনাকে ভালোবাসে।”
অপরপ্রান্ত থেকে আহনাফের হাসির শব্দ শুনতে পেল অর্ষা। লজ্জা পেয়ে তৎক্ষণাৎ ফোনের লাইন কেটে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ফা-জি-ল বান্ধবীগুলো সমস্বরে বলে উঠল,
“বাহ্, বাহ্,! বাহ্, বাহ্! কী প্রেম!”
অর্ষার লজ্জার পরিমাণ গেল আরও বেড়ে। পার্লারের মেয়েগুলোও এখন মুচকি মুচকি হাসছে। অর্ষার মনে হচ্ছে, এই বুঝি লজ্জায় সে শেষ হয়ে যাবে।
চলবে…
[