যেদিন তুমি এসেছিলে ২ পর্ব -৩৯

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_৩৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
শালিকাদের টাকার আবদার মিটিয়ে আহনাফ যখন বরযাত্রী নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের ভেতর প্রবেশ করল, তখন তার বুকে ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ হচ্ছিল। নিজের প্রেয়সী, ভালোবাসার মানুষ, নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে বধূবেশে দেখবে ভাবতেই উত্তেজনায় তার হাত-পা কাঁপছিল। তবে ভেতরে এসে সে অর্ষাকে দেখতে পেল না। পার্লার থেকে বের হওয়ার সময় তো অর্ষা ফোন করে জানিয়েছিল, সে আসছে। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা। এছাড়া ওর বাকি বান্ধবীরা তো এখানেই উপস্থিত। আহনাফের অস্থির দৃষ্টি লক্ষ্য করে সকাল মুচকি হাসে। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,

“কাউকে খুঁজছেন ভাইয়া?”

প্রথমে ভীতিগ্রস্ত হলেও পরক্ষণে সকালকে দেখে ধাতস্থ হলো আহনাফ। তার এই শালিকাটি বাকিদের তুলনায় বেশ কোমল স্বভাবের। মশকরা খুব একটা করে না কিংবা এমতাবস্থায় আর যাই হোক, আহনাফকে নিয়ে অন্তত মজা উড়াবে না। সে ভীষণ সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল,

“তোমার আপু কোথায়?”

লামিয়া পাশ থেকে কথাটি শুনে ফেলে বলল,

“আছে, আছে। এত তাড়া কীসের? মাত্র তো এলেন। বসুন, বিশ্রাম করুন।”

আহনাফ সঙ্গে সঙ্গে চুপ মেরে গেল। হাসিব বলল,

“বউ না দেখে বিশ্রাম নেবে কীভাবে? আর শান্ত হয়ে বসবেই বা কীভাবে?”

“আপনি এত কথা বলছেন কেন? বউ তো আর আপনার না।”

“ভাবি তো আমার।”

“সেয়ানাগিরি আমাদের সাথে চলবে না। এমন নাচানো নাচাব যে…”

“যে কী?”

“সারা দিন-রাত শুধু ‘বেয়াইন বেয়াইন’ জপবেন।”

“তাই? বেশ তো! চলুন তাহলে শুরু করা যাক।”

“আমাদের এত তাড়া নেই। অপেক্ষা করুন।”

আহনাফ অপ্রসন্ন মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্ষাকে না দেখা অব্দি তার স্বস্তি নেই। মেয়েটাকে যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে কে জানে! সকাল কনুই দিয়ে গুঁতা দিল আহনাফকে। আহনাফ সকালের দিকে তাকাতেই সকাল চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বলল। ভাবলেশহীনভাবে সামনে তাকিয়ে আহনাফ থমকে যায়। স্থির হয়ে যায় তার দৃষ্টি। সময়ও বোধ হয় থমকে গেছে। টকটকে লাল লেহেঙ্গা পরে রুহুলের সাথে এগিয়ে আসছে অর্ষা। কী মিষ্টি লাগছে দেখতে! আর কিছুক্ষণ বাদেই মেয়েটা সম্পূর্ণ নিজের হয়ে যাবে। দুজনের মাঝখানে আর কোনো বাধা থাকবে না। দূরত্ব থাকবে না। হারানোর ভয় থাকবে না। খুশি ও আনন্দে কান্না গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। এমন হচ্ছে কেন তার? ঠোঁটে হাসি, অথচ চোখে অশ্রু। আনন্দের অশ্রু! অর্ষা এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। আহনাফের চোখে পানি দেখে তারও হাস্যোজ্জ্বল চোখে-মুখে অশ্রুর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আহনাফের পাগলামো দেখে সে জড়িয়ে ধরে। এবার বেশ শব্দ করেই কাঁদে আহনাফ। অর্ষা নিজেও হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে। সত্যিকারের ভালোবাসা বোধ হয় এমনই হয়। নিজের মানুষটাকে একান্তই নিজের করে পাওয়ার আনন্দটাও বোধ হয় ঠিক এমনই হয়। সত্য,পবিত্র, সাবলীল! কোথাও কোনো অভিনয়ের, মিথ্যের ছায়াটুকু নেই।

দৃশ্যটি বাকিদেরও আবেগপ্রবণ করে তোলে।

স্মৃতি বুকের ওপর দু’হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দু’চোখেও অশ্রুকণা। মেয়েরা আবেগপ্রবণ হয় এ কথা সত্য। কিন্তু সে মনে হয় একটু বেশিই আবেগপ্রবণ। দুঃখে যেমন ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে ফেলে, তেমনই কারও অতিরিক্ত সুখ, ভালোবাসা দেখলেও কেঁদে ফেলবে। সে আনমনেই অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

“আহা! দেখলেই নয়ন জুড়িয়ে যায়।”

আশিক খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বলল,

“নয়ন আর জুড়াল কোথায়? দু’নয়নে তো অশ্রুর বন্যা। জুড়ানোর জন্য কি আমি একটু বাতাস করব?”

স্মৃতি চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল। আশিক অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,

“আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? আচ্ছা,এসব থাক। হলুদে আপনি আসেননি কেন?”

“আমার না আসাতে কী হয়েছে?”

“অনেক কিছু হয়েছে। আমি আপনাকে মিস করেছি।”

“ফ্লার্টিং স্কিল দারুণ।” বলে স্মৃতি অর্ষার কাছে গেল। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

“অনেক অনেক শুভকামনা তোমার জন্য অর্ষা। এই সারপ্রাইজটা কিন্তু সত্যিই অনেক সুন্দর ছিল। আনএক্সপেক্টেডও বলতে পারো। আমি কিন্তু একদমই টের পাইনি।”

অর্ষা হাসল। বলল,

“হলুদে আসলে না কেন? খুব রাগ করেছি কিন্তু।”

“এজন্য আমি দুঃখিত! হঠাৎ করে বাবার শরীরটা খারাপ হয়ে গেল। ওমন অবস্থায় আসি কী করে বলো?”

“সেকি! অবস্থা কি বেশি সিরিয়াস?”

“না, না। এখন আলহামদুলিল্লাহ্‌ আগের চেয়ে সুস্থ আছে। কিন্তু বিয়েতে উপস্থিত থাকার মতো নয়। এজন্য মা-ও আসতে পারেনি।”

“ব্যাপার না। একদিন সময় করে আঙ্কেল-আন্টিকে নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবে।”

“ইন-শা-আল্লাহ্ আসব।”

ওদের কথার মাঝেই ফুলের বুকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় মিজান এবং জিসান। আহনাফকে কংগ্রেটস করে ফুলের বুকেটা জিসান অর্ষার হাতে দিল। কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাচ্ছিল্যর সুরে বলল,

“আমাকে গ্রহণ না করার কারণ বুঝি তাহলে এটাই ছিল?”

অর্ষা আশেপাশে একবার তাকিয়ে নিল। স্মিত হেসে বলল,

“কী করব বলুন স্যার? ভালোবাসি বলে কথা!”

জিসান হেসে ফেলল। হেসেই বলল,

“শুভকামনা রইল।”

“থ্যাঙ্কিউ।”

বিয়েতে সবার মাঝে শশীকে দেখে আর কেউ অবাক হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে অর্ষা ভীষণ অবাক হয়েছে। ভাবতেই পারেনি শশী ওদের বিয়েতে আসবে। তবে সত্যি বলতে তার উপস্থিতিতে অর্ষা ভীষণ খুশিও হয়েছে। মেয়েটা এত অমায়িক! ব্যবহারের প্রসংশা করলেও যেন কম হয়ে যাবে। মেয়েটা নিজেই তার তুলনা; ঠিক তার নামের মতোই। শশী এসেই সর্বপ্রথম অর্ষাকে জড়িয়ে ধরেছে, যেন কত বছরের চেনা দুজনে। অর্ষার এটা ভেবেই ভালো লাগছে যে, ওদের বিয়েতে কেউ কোনো মনোমালিন্য মনে পুষে রাখেনি।

হাসিব ওরা নাচবে বলে গান সিলেক্ট করেছে। তাও যেই সেই গান নয়, বিখ্যাতই বলা যায়। ‘আসসালামু আলাইকুম বেয়াইনসাব’ গান। গানের নাম শুনেই মেয়েরা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে। বিয়ে বাড়িতে নাচার জন্য এত সুন্দর সুন্দর নিউ ভার্সন গান থাকতে আদিকালের এই গানটাই কি চ্যুজ করতে হলো? বেয়াইনদের এমন মন্তব্য শুনে হাসিব জোর গলায় বলে,

“আদিকালের গান কোনটাকে বলছেন আপনারা বেয়াইনসাব? এটা হলো কালজয়ী গান। এই গানে না নাচলে বিয়ে বাড়ির আনন্দই তো বৃথা।”

রেশমি বেঁকে বসে বলল,

“আমরা এই গানে নাচব না।”

“কেন নাচবেন না? চিকন-চাকন কোমর কি শুধু হিন্দি গানের তালেই দোলে? বাংলা গানে নাচতে পারেন না?”

এই অপমান বেয়াইন জাতির সহ্য হলো না। তারা যে হিন্দি গানের সাথে বাংলা গানেও নাচতে পারে এটা প্রমাণ করার জন্যই অনিচ্ছা এবং জেদের রেশ ধরে এই গানেই নাচে। পুরো বিয়ের আয়োজন যেমন জাঁকজমকভাবে শুরু হয়েছিল। শেষটাও ঠিক সেভাবেই হলো। কবুল বলার মুহূর্তটাই যেন অর্ষা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছে। যেমন ভয় করেছে, তেমনই মনের ভেতর আনন্দও হয়েছে। এখন থেকে আহনাফ নামক মানুষটা শুধু তার ভালোবাসার মানুষই নয়; তার অর্ধাঙ্গ, তার স্বামী।

বিদায়ের বিষাদ মুহূর্তটুকুতে অর্ষা সম্পূর্ণ ভেঙেচূড়ে গিয়েছে। প্রিয়জন ছেড়ে যাওয়ার কষ্টের পরিমাণ কতটা তিক্ত ও প্রবল হয় এটা কেবলমাত্র ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোই উপলব্ধি করতে পারবে। এই সময়টিতেও আহনাফ দু’হাতে আগলিয়েছে তার প্রেয়সীকে। অর্ষার সাথে বন্ধু-বান্ধব, সকালও যাচ্ছে। অন্য গাড়িতে আহিলের বসার জায়গা হয়েছে সকালের পাশে। সকাল সেই বিদায়ের সময় থেকেই ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে যাচ্ছে। প্রথমে আহিল চুপচাপ সহ্য করলেও এখন কান্নাটা কানে খুব লাগছিল। সে ধমক দিতে গিয়েও শান্তকণ্ঠে বলল,

“আপনি কাঁদছেন কেন? অর্ষার সাথেই তো যাচ্ছেন।”

সকাল প্রত্যুত্তর করল না। সে নাক টেনে টেনে কাঁদছে। আহিল সান্ত্বনা দিতে গিয়েও চুপসে গেল। কাঁদছে, কাঁদুক। যেচে পড়ে কারও কান্না থামানোর দায় নেই তার। মাঝরাস্তায় গিয়ে গাড়ি পড়ল জ্যামেতে। সবাই ভীষণ বিরক্ত এতে। কতক্ষণ জ্যামের মধ্যে আটকে থাকতে হবে কে জানে! সকাল জ্যামে বসে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। মাথা রেখেছে আহিলের কাঁধের ওপর। আহিলের মনে হচ্ছিল,মেয়েটা বোধ হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও কাঁদছে। এর কারণ পাঞ্জাবির কাঁধের অংশ ভেজা ভেজা লাগছে।
.
.
বউ নিয়ে আহনাফরা যখন বাড়িতে ফিরে তখন রাত প্রায় একটা বাজে। কত মানুষ মুখিয়ে আছে নতুন বউ দেখার জন্য। আহনাফ রেণুকে বলে দিল,

”অর্ষা ত্রিশ মিনিটের বেশি ড্রয়িংরুমে থাকবে না। যার যার দেখার দরকার এখনই দেখে নিতে বলবে।”

ত্রিশ মিনিটও থাকতে হলো না। জহির চৌধুরীর দশ মিনিটের মাথায়ই অর্ষাকে রেস্ট করার জন্য রুমে পাঠিয়ে দিলেন। আমেনা বেগম এর মাঝেই কয়েকবার এসে চুমু খেয়ে গেছেন। আদর করে গেছেন। তার ভাবসাবে বোঝা গেছে, তিনি অর্ষাকে ভীষণ পছন্দ করেছেন।

অর্ষা রুমে এসে সর্বপ্রথম লেহেঙ্গা খুলে ফ্রেশ হয়ে অন্য একটা সুতি শাড়ি পরেছে। মেকাপ তোলার পর মনে হয়েছে এতক্ষণে হালকা লাগছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় বসতেই দেখতে পায় দরজায় দাঁড়িয়ে আদিব আহনাফের কানে কানে কিছু বলছে। কথা বলা শেষ হলে আহনাফ দরজা লাগিয়ে দিল। অর্ষা তার লাগেজ থেকে তোয়ালে বের করে মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল,

“আদিব ভাইয়া আপনাকে কানে কানে কী বলে গেল?”

আহনাফ সে কথার কোনো জবাব দিল না। পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে ঝুঁকে খাটের নিচে, আলমারির চিপায়, আলমারি খুলেও চেক করল। পর্দা সরিয়েও কিছু দেখল। অর্ষা ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“কী খুঁজছেন আপনি?”

“দেখছি তোমার ব’জ্জা’ত বান্ধবীরা আবার ঘাপটি মেরে কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা।”

অর্ষা তেলে-বেগুনে জ্ব’লে উঠে বলল,

“আমার বান্ধবীদের তো খেয়ে-দেয়ে আর কাজ নেই, আপনার বাসরঘরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে যাবে।”

“তোমার বান্ধবীরা বলেই এই সন্দেহ করেছি। ওরা যা সাংঘাতিক, এরকম কিছু করা অসম্ভব না ওদের পক্ষে।”

“সবসময় উলটা-পালটা সন্দেহ করবেন না ওদের নিয়ে।”

“যাহ্ বাব্বাহ্! এত রেগে যাচ্ছ কেন তুমি? এখন থেকে তুমি আমার বউ। আমি তোমার স্বামী। আমার দিকটাও একটু ভাবো।”

“এত ভাবাভাবির তো কিছু নাই। আপনি আপনার জায়গায়। ওরা ওদের জায়গায়। ওদের নিয়ে কিছু বললে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

“হয়েছে বিবি! থামেন। আজকের রাতে অন্তত ঝগড়া করিয়েন না।”

“আমি কি ঝগড়া করার জন্য ম-রে যাচ্ছি নাকি?”

“তুমি যে এত ঝগড়ুটে এটা কিন্তু আমি আগে টের পাইনি। নাকি বিয়ের পর তোমার সাহস আর পাওয়ার দুটোই বেড়ে গেছে?”

“আমি বরাবরই সাহসী। পাওয়ার বিয়ের পরই পেয়েছি বলতে পারেন। এখন বলুন, আদিব ভাইয়া আপনাকে কী বলেছে?”

আহনাফ কাবার্ড থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল,

“আগে ফ্রেশ হয়ে আসি।”

অর্ষা বিছানায় চুপ করে বসে রইল। অদূরে দৃষ্টি পড়ায় শান্ত হয়ে বসে থাকা ক্যাথিওনকে দেখতে পেল। সে টেবিলের ওপর বসে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। অর্ষা এগিয়ে গেল কিছুটা। কোমরে হাত গুঁজে বলল,

“কিরে ঝগড়ুটে বিড়াল, তোর চোখে ঘুম নেই?”

ক্যাথিওন বলল,

“ম্যাঁও!”

“শিখেছিস তো ঐ একটাই শব্দ। কিছু বললেই ম্যাঁও, ম্যাঁও!”

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনে অর্ষা পিছু ফিরে তাকাল। আহনাফ বিছানা থেকে অর্ষার তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছছে। অর্ষা বলল,

“আপনার বিড়াল কি ঘুমায় না?”

“অবশ্যই ঘুমায়।”

“তাহলে এখনও জেগে আছে কেন?”

“তোমাকে দেখার জন্য। সবাই নতুন বউ দেখবে। আর ও দেখবে না তা কি হয় নাকি?”

“ন্যাকা!”

“আদিব ভাই কী বলেছে শুনতে চাও?”

“হু।”

“বলেছে, বাসর রাতেই যেন বিড়ালটাকে মে’রে ফেলি।”

অর্ষা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। তার চক্ষু যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল,

“আপনি কী বললেন?”

“বললাম, ঠিক আছে। বাসর রাতেই বিড়াল মা-রা-র কাজ সমাপ্ত করব।”

অর্ষা তৎক্ষণাৎ দরজা খুলল। ভয়কে জয় করে ক্যাথিকে দু’হাতে নিয়ে দরজার বাইরে রেখে দরজা লাগিয়ে দিল। নিজে ঢাল হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“আপনি যে এমন নি’ষ্ঠু’র তা তো আমি জানতাম না! কী করে একটা নির্দোষ বিড়ালকে মা-রা-র জন্য রাজি হয়ে গেলেন আপনি?”

ঘটনার আকস্মিকতায় আহনাফ নিজেও হতভম্ব। পরক্ষণেই আবার দম ফাটিয়ে হেসে বলে,

“হায় আল্লাহ্! তুমি কি ভেবেছ ক্যাথিকে মা-রা-র কথা বলেছি আমরা?”

অর্ষা বুঝতে না পেরে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আহনাফ হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল। অর্ষার কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে বলল,

“বাসর রাতে বিড়াল মা-রা-র শ্লোক শোনোনি আগে?”

অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এ শ্লোক শুনেছে মানে, অনেকবার শুনেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই সে কথাটা ভুলে গেল কী করে? ছি! কী রকম বোকার মতো একটা কাজ করে ফেলল। তার-ই বা কী দোষ? চোখের সামনে বিড়াল ছিল বিধায় সে ভেবে বসেছে ওকে-ই মা-রা-র কথা বলেছে। তারমধ্যে এমনিতেই তো বিয়ের নানানরকম ঝামেলা! এতসব কিছুর মাঝে মাথা সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে গেছিল।

আহনাফ হেসে বলে,

“ওমা! বউ দেখি আমার লজ্জা পেয়েছে।”

এ কথায় অর্ষা আরও লজ্জা পেল। আহনাফ হাত বাড়িয়ে লাইট নিভিয়ে নীল রঙা ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিল। অর্ষাকে পাঁজাকোলা করে ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসিয়ে বলল,

“গল্প করবে নাকি বিড়াল মা-র-ব?”

লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছে অর্ষা। কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে গেছে। গলা দিয়ে একদমই কথা বের হতে চাইছে না। তবুও সে লজ্জায় ধরে আসা গলায় বলল,

“একদম অ’স’ভ্য, অ’স’ভ্য কথা বলবেন না।”

“তাহলে কী বলব? ভালো কথা বলব? দিনেরবেলায় ভালো কথা বলব। অ’স’ভ্য ধরণের কথা তো রাতেই বলতে হয়।”

“আমার ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমাব।” বলেই অর্ষা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

আহনাফ অর্ষার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে বুকে নিয়ে এলো। অর্ষা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে আরও শক্ত করে ধরা পড়ল। সটান কোলে বসিয়ে নিয়েছে অর্ষাকে। মেকি রাগ দেখিয়ে আহনাফ বলল,

“কোলে তো আছোই। বেশি ধস্তাধস্তি করলে এখন এক আ’ছা’ড়ে নিচে ফেলে দেবো।”

অর্ষা অবিশ্বাস্যের সুরে বলল,

“পারবেন আপনি?”

“পারব না জেনেই তো তোমার সাহস বেড়ে গেছে। আ-ছা-ড় দিতে না পারি অন্যকিছু তো ঠিকই পারব।”

“অন্যকিছু কী? মা-র-বে-ন আপনি আমাকে?”

“হ্যাঁ, মা-র-ব।”

“সত্যিই? কষ্ট হবে না আপনার?”

“কষ্ট হবে কেন? মা-ই-র হয় দু’রকম।আমি কোন মা-ই-র দেবো সেটা তো বলিনি। আমি দেবো হচ্ছে, আদরের মা-ই-র।”

“চুপ করেন। আর নামান আমাকে কোল থেকে।”

“নামাব কেন? মাথায় উঠে তো ঠিকই বসে থেকে রাজত্ব ফলাবে। এখন কোলে বসতে আপত্তি কোথায়?”

“আপনি কি ভালো কথা সব ভুলে গেছেন?”

“হ্যাঁ। বউয়ের কাছে এত ভালো হয়ে লাভ কী? বউয়ের কাছে যত নির্লজ্জ হতে পারব ততই লাভ।”

“কী লাভ?”

“যত নির্লজ্জ, ততই আদর।”

“অ’স’ভ্য!”

“নতুন কিছু ট্রাই করো।”

“পারব না। আমার কিন্তু সত্যিই অনেক ঘুম পেয়েছে।”

“এত ঘুম ঘুম করছ কেন? ঘুমকে আমার সতীন বানাবে নাকি?”

“ঘুম পেলে ঘুমাব না?”

“হ্যাঁ, ঘুমাবে। চারটার পর তোমাকে ঘুমাতে দেওয়া হবে। এখন আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করব।”

“কী প্রশ্ন?”

“ধরো, আমার সম্পূর্ণ শরীর তোমাকে দেওয়া হলো। আদর করার জন্য তুমি কোন জায়গাটা বেছে নেবে?”

অর্ষা কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল,

“কপাল!”

“হোয়াট! আমি তোমার স্বামী হই অর্ষা! আর সেখানে তুমি কিনা…”

একটু থেমে ফের বলল,

“তোমার মধ্যে দেখি রোমান্টিকের ‘র’-ও নাই। ঘুমাও তুমি যাও।”

অর্ষাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল আহনাফ। কী হলো, কেন রাগ করল অর্ষা কিছুই বুঝতে পারল না। আহনাফ একপাশ ফিরে শুয়েছে। অর্ষা অন্যপাশ ফিরে শুলো। গুণে গুণে হয়তো ষাট সেকেন্ডও পার হলো না, এর মাঝেই আহনাফ অর্ষাকে টেনে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,

“এত নি’ষ্ঠু’র তুমি! মায়া হয় না আমার জন্য?”

“আমি কী করলাম?”

“ঘুমাচ্ছ কেন?”

“কী বোকা বোকা প্রশ্ন করছেন!”

“কারণ আমি সহজ করে বলতে পারছি না। লজ্জার একটু ছিটেফোঁটা তো আমার মধ্যেও আছে নাকি! তুমি বোঝো না আমি কী বলতে চাই?”

অর্ষা চুপ করে রইল। আহনাফ ব্যাকুল হয়ে শুধাল,

“কী হলো? বলো। বোঝো না তুমি?”

অর্ষা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,

“না।”

আহনাফ কয়েক পল থমকে থেকে থেমে থেমে বলল,

“তুমি…তুমি কি…তুমি কি আজকের রাতের জন্য প্রস্তুত অর্ষা?”

অর্ষা হ্যাঁ, না কিছুই বলতে পারছে না। লজ্জায় আরও একবার ভেঙে চূরমার হয়ে যাচ্ছে সে।

“তোমার নীরবতাকে আমি সম্মতির লক্ষণ ধরে নেব নাকি নিষেধ ধরে নেব প্রজাপতি?”

অর্ষা নিশ্চুপ।

আহনাফ গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“তুমি প্রস্তুত না থাকলে আমি একদম জোর করব না প্রজাপতি। আর যদি তুমি আমার ভালোবাসায় সায় দাও তাহলে এইযে আমি চোখ বন্ধ করলাম, আলতো করে একটা চুমু দাও আমায়। যদি সায় না দাও, তাহলে নিজেকে ছাড়িয়ে শুয়ে পড়ো। কথা দিচ্ছি, একটুও জোর খাটাব না।”

চোখ বন্ধ করে রাখা আহনাফের মুখপানে তাকিয়ে আছে অর্ষা। ঠোঁটের কোণে তার হাসির রেখা। সে মাথাটা কিঞ্চিৎ তুলে আহনাফের দু’গালে হাত রাখল। আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়াল আহনাফের শুষ্ক ঠোঁটে। এক পশলা আনন্দের বৃষ্টি যেন পড়তে শুরু করেছে আহনাফের মনজুড়ে। সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে চোখ মেলে তাকাল। গাঢ় চুম্বন এঁকে দিল অর্ষার কপালের মধ্যিখানে। আবেশে এবার চোখ বন্ধ করে ফেলল অর্ষা। আহনাফ একের পর এক চুমু দিচ্ছে চোখে, গালে, ঠোঁটে, গলায়, ঘাড়ে, বুকে…! আহনাফের প্রতিটা স্পর্শে শিউড়ে উঠছে অর্ষা। তবে তার মাঝে বাঁধা দেওয়ার কোনো প্রবণতা নেই।

চলবে…
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here