রংধনুর রঙ কালো পর্ব ১০

#রংধনুর_রঙ_কালো
১০.

অরিন অন্বয়ের সাথে তার এপার্টমেন্টে চলে এসেছে। অরিন নিজেই আসতে চেয়েছিল। অন্বয়ের ক্ষমতা ছিল না তাকে নিষেধ করার। তাছাড়া অরিনকে আশ্রয় দেওয়া তার কাছে মহানন্দের ব্যাপার। সোফায় বসে মাথার ব্যন্ডেজ একহাতে খোলার চেষ্টা করছিল অন্বয়। অরিন এগিয়ে এসে বললো,” আমি হেল্প করি?”
অন্বয়ের অনুমতির অপেক্ষা না করেই অরিন ব্যন্ডেজ খুলে দিতে চাইল। অন্বয় সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,” ইটস ওকে। আমি পারবো।”
তার উচ্চারিত এই দু’টি বাক্যে গাঢ় অভিমানের স্পর্শ ছিল। যা অরিন একটু হলেও টের পেয়েছে। অন্বয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যন্ডেজ খোলার চেষ্টা করলো। অরিন হঠাৎ বললো,
” একটা প্রশ্ন করি অন্বয়সাহেব?”
” করুন।”
” ইলহান যখন আপনাকে আক্রমণ করেছিল তখন আপনি আত্মরক্ষা করলেন না কেনো?”
” আত্মরক্ষা কিভাবে করতাম?”
” কিভাবে করতেন মানে? চাইলেই কি আপনি তাকে পাল্টা আঘাত করতে পারতেন না?কিন্তু আপনি নির্বিকার ছিলেন। আমি খেয়াল করেছি।”
অন্বয় ফিক করে মৃদু হাসি দিল।
” আপনি হয়তো ভুলে গেছেন মিসেস অরিন। আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, কখনও আপনার স্বামীর গায়ে হাত তুলবো না।”
অরিন হতচকিত হয়ে বললো,” আপনি কি পাগল? এজন্য সে আপনাকে মেরে ফেললেও আপনি চুপ করে থাকবেন নাকি? কিচ্ছু বলবেন না তাকে?”
অন্বয় আয়না দিয়ে অরিনের চেহারার দিকে চেয়ে স্থির দৃষ্টিতে বললো,” জ্বী না।”
অরিন ঠিক অন্বয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,” আপনি অদ্ভুত। ”
তারপর দুইহাত ঘষতে ঘষতে একা একা বিরবির করে বললো,” সব দোষ আমার। তখন ওইভাবে আপনার হাত ধরাই উচিৎ হয়নি। যদি হাত না ধরতাম তাহলে এইসব কিছুই হতো না। আপনাকেও রাস্তার মাঝে মার খেতে হতো না। আই এম রিয়েলি ভেরি স্যরি অন্বয়সাহেব।”
অন্বয় সামান্য হাসলো। মনে মনে বললো, ” শুধুমাত্র আপনি হাত ধরেছিলেন বলেই আমি ইলহান মাহদীকে হাজতে নিতে পেরেছি। নাহলে সেটাও করতাম না। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ভরসা করতে শুরু করেছেন। তাই আমি যেটাই করবো আপনি আমাকে সাপোর্ট করবেন। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম অরিন। তখন আমি বুঝতেই পারিনি শুধু ইলহান মাহদীকে জ্বালানোর জন্য আপনি আমার হাত ধরেছিলেন। ভরসা করে ধরেননি। এটা কখন বুঝলাম জানেন? যখন নিজের স্বামীকে হাজত থেকে বের করার জন্য আপনি আমার পায়ে পড়ে গেলেন।”
মুখে অন্বয় ভিন্ন কথা বললো,” রাস্তার মাঝে মার খেয়ে কিন্তু আমার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।”
অন্বয় ঠোঁট টিপে হাসার চেষ্টা করলো। অরিন অনুতপ্ত কণ্ঠে বললো,” ইলহানকে হাজত থেকে বের করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করতাম না। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম বিশ্বাস করুন! ইলহান যদি বাসায় বলে দিতো, আমি তাকে অবজ্ঞা করে আপনার সাথে মেলামেশা করছি এমনকি তাকে হাজতে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি তাহলে অনেক বড় সমস্যা হতো। তাছাড়া মা-বাবা মানে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের ছেলের ব্যাপারে খুব বেশি সেন্সিটিভ। তারা যদি জানতে পারতেন ইলহান আমার জন্য জেলে গেছে তাহলে আমাকেই ভুল বুঝতেন। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারতো। এসব ভেবেই আমি..”
” বুঝতে পেরেছি। এখন এসব কথা থাক। আপনি সারাদিন কিছু খাননি। আপাতত ডিনারের ব্যবস্থা করি?”
অরিন মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল। অন্বয় মনে মনে ভাবলো,” আপনি কাউকে ভয় পাননি মিসেস অরিন। যদি সত্যিই পরিবারের ভয় আপনার থাকতো তাহলে ইলহান মাহদীকে অবজ্ঞা করে আমার সাথে সকাল-সকাল দেখা করতে আসতেন না আপনি। তার সামনে আমার হাত ধরার সাহস করতেন না। আপনি আসলে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন। হয়তো ইলহান মাহদীকে আপনার অবচেতন মন এখনও ভালোবাসে। হয়তো আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। এজন্যই এতোসব যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন। আসলে আমরা যেটা করতে চাই সেই বিশেষ কাজটির পক্ষে অযথাই যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। ঠুনকো যুক্তিগুলোকেও আমাদের কাছে অনেক শক্ত মনে হয়। নিজের স্বামীকে ওই অবস্থায় দেখে মেনে নিতে পারেননি আপনি। এজন্যই এতোটা উতলা হয়েছেন। এখনও নিজের ভালোবাসার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আপনার হয়নি। আপনি কি জানেন মিসেস অরিন? আপনার সমস্ত কঠোরতা, গর্জন উপরে উপরে। কিন্তু ভেতর থেকে আপনার অন্তর এখনও ভেজা মেঘের মতো নরম।”
” অন্বয় সাহেব।”
অরিনের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল অন্বয়।
” জ্বী মিসেস অরিন?”
” একটা সাহায্য করতে পারবেন আমাকে?”
” কি ধরণের সাহায্য? আমাকে মাটিতে শুতে হবে?”
” আরে নাহ।”
হেসে ফেললো অরিন।
” আমি আসলে চাইছি আপনি আপনার ড্রাইভার ‘বাবা’ ভাইকে পাঠিয়ে আমার জিনিসগুলো ইলহানের এপার্টমেন্ট থেকে নিয়ে আসবেন।”
অন্বয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,” কেনো? ওইখানে আর ফিরে যাবেন না আপনি?”
” না।”
অরিনের গলায় কাঠিন্যতা। অন্বয় জানতে চাইলো,” কেনো?”
” আমি তার সাথে আর থাকতে চাই না। সবকিছু বাদ। অন্তত আমাকে অপদস্ত করা আর আপনার গায়ে হাত তোলার জন্য ওকে আমি ক্ষমা করতে পারবো না।”
” আপনাকে অপদস্থ করেছে মানে? তিনি কিভাবে আপনাকে অপদস্ত করেছেন? আমাকে খুলে বলুন অরিন!”
অরিন চোখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গতরাতের কাহিনীগুলো অন্বয়ের সাথে শেয়ার করলো। অন্বয় কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই বললো,” এজন্য দুঃখ পাবেন না মিসেস অরিন। যারা আপনাকে ভুল বুঝেছে তারা একসময় ঠিক আফসোস করবে। কিন্তু আপনি হাল ছাড়বেন না। ইলহান মাহদীর ভালোমানুষির মুখোশ আপনিই তার পরিবারের সামনে টেনে খুলবেন।”
” না। আমি এসব কিছুই চাই না। সে যা করছে তার শাস্তি আমি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম। একদিন সে ঠিকই তার পাপের শাস্তি পাবে। আমি ওর মতো কীটকে মেরে হাত কলঙ্কিত করতে চাই না। আমি শুধু ওর থেকে সেপারেশন চাই। একজন চরিত্রহীনের সাথে থাকার কোনো মানেই হয় না।”
” তাহলে আপনি এখন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”
” আমি কিছুদিন অস্ট্রেলিয়াতেই থাকবো। কিন্তু যতদিন থাকবো, ইলহানের থেকে দূরে থাকবো। অন্যকোথাও নিজের মতো করে। আমার কার্ডে যে পরিমাণ টাকা আছে তাতে কমপক্ষে একবছর অস্ট্রেলিয়াতে আরামে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাছাড়া আমিও দেখতে চাই সে আর কি কি করতে পারে। আরও কতটা খারাপ হতে পারে।”
অন্বয় মনে মনে হাসলো এবং বললো,” আপনি নিজেও জানেন না অরিন। যতই মুখে মুখে এসব কথা বলেন না কেনো আপনার অবচেতন মন এখনও ইলহান মাহদীর সান্নিধ্য কামনা করে। আপনি মনে-প্রাণে ঠিকই চাইছেন যেনো আপনার স্বামী শুধরে যায়। সবকিছু ছেড়ে আপনার কাছে ফিরে আসে। এই অসম্ভব ইচ্ছে আপনার তখনি ভেঙে যাবে যখন আপনি নিজের চোখে ইলহান মাহদীর নিকৃষ্ট রূপ দেখবেন। আমি চাই সেইদিন খুব জলদি আসুক।”
অন্বয়ের ড্রাইভার বাবা’কে পাঠানো হলো অরিনের জিনিসপত্র ইলহানের এপার্টমেন্ট থেকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বাবা ফোন করে জানালো,
” স্যার, উনি কিছুই দিতে চাইছেন না। শুধু বলছেন যার জিনিস তাকে এসে নিয়ে যেতে হবে। অন্যকারো হাতে তিনি মাল দিবেন না।”
অরিন এই কথা শুনে সাথে সাথে অন্বয়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল।
” হ্যালো বাবা ভাই, আপনি তাকে বলুন আমার জিনিস আমি চাইছি। তাকে দিতেই হবে। দিবে না কি আবার? জোর করে নিয়ে আসুন।”
ইলহান শব্দ করে বললো,” অপরিচিত কারো কাছে আমি জিনিস দিবো না। যদি নিজে এসে নিতে পারো তাহলে নিয়ে যাও। নয়তো আমি সব পুড়িয়ে ফেলবো।”
” কি?”
হুমকি শুনে হতভম্ব হলো অরিন। ইলহান এইসব কি শুরু করেছে? অরিন ফোন রাখতে রাখতে বললো,” অন্বয়সাহেব আপনি অপেক্ষা করুন। আমার জিনিস আমি নিজেই নিয়ে আসবো।”
” আমি কি আপনার সাথে আসবো?”
” দরকার নেই। আপনি গেলে ঝামেলা বাড়বে। তার চেয়ে ভালো রেস্ট করুন।”
” আমার রেস্ট করা নিয়ে আপনি চিন্তা করেছেন দেখে ভালো লাগলো।”
অরিন অন্বয়ের শেষ কথাটুকু শুনতে পেয়েছে কি-না বোঝা গেল না। সে হাতব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়েছে। অনেক ব্যস্ত সে। অন্বয়ের কথা শোনার সময় কই?
অরিন এপার্টমেন্টে ঢুকে লিফটে চড়ে অষ্টমতলায় এসে দেখলো তাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। অরিন খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই খট করে দরজাটা আটকে দেওয়া হলো। অরিন ঝট করে পেছনে তাকিয়েই ইলহানকে দেখতে পেয়ে বললো,
” আমার স্যুটকেস কোথায় রেখেছো? দিয়ে দাও চলে যাই।”
” দিচ্ছি। আগে ভেতরে চলো।”
” ভেতরে কেনো?”
ইলহান পেছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে অরিনকে ভেতরে নিয়ে গেলো। এরপরের ঘটনা অরিনের কিচ্ছু মনে নেই। শুধু জ্ঞান ফেরার পর অরিন উপলব্ধি করলো তার হাতের সাথে ইলহানের হাত হ্যান্ডকাপ দিয়ে আটকানো।

চলবে

-Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here