রংধনুর রঙ কালো পর্ব ২১

#রংধনুর_রঙ_কালো
২১.

সোফিয়াকে গাড়িতে তুলে দিয়ে অরিনের পেছনে ছুটে আসলো অন্বয়। সড়কের একপাশে সারিবদ্ধ ল্যাম্পোস্টের সোনালী আলোয় নিচের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে অরিন হেঁটে যাচ্ছে সোজা রাস্তায়। অন্বয় অরিনের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে জিজ্ঞেস করলো,” কোথায় যাচ্ছেন?”
অন্বয়ের উপস্থিতি পেয়ে অরিন একটু থামলো। মলিন হেসে বললো, ” কোথাও না। এমনি হাঁটছি।”
অন্বয় সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকালো।
” আপনার মনখারাপ? ”
অরিন মুখ থেকে মলিনতার ছাপ উধাও করার চেষ্টা চালিয়ে বললো,” না তো। মনখারাপ হবে কেনো?”
অন্বয় আরও সন্দেহ প্রকাশ করলো।
” সোফিয়ার সামনে যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন সেটা কি আপনার মন থেকে নেওয়া?”
অরিন চোখের কোণ চুলকে বললো,” অবশ্যই।”
” মিসেস অরিন, আপনি কি কাঁদছেন?”
অরিন চেহারায় কাঠিন্য ভাব টেনে আনলো।
” মোটেও না। কেনো কাঁদবো আমি? একজন প্রতারকের জন্য? কক্ষনো না। আমি এতোটাও দূর্বল না।”
অন্বয় পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছুটা রসিকতার স্বরেই বললো,” কিন্তু ইলহান মাহদী তো আপনাকে ভালোবাসে। আপনার জন্য মিস সোফিয়ার মতো ভুবনমোহিনীকেও পাত্তা দিচ্ছেন না। ”
অরিন বাঁকা হেসে উত্তর দিল,” এতেই কি প্রমাণিত হয় ভালোবাসা? ভালোবাসলে আমাকে এতো নিষ্ঠুরভাবে কষ্ট দিতে পারতো? আমার হৃদয়টাকে ক্ষত-বিক্ষত করে, আমারই চোখে চোখ রেখে দিনের পর দিন মিথ্যে বলতে পারতো? আমাকে এতো বাজেভাবে ধোঁকা দিতে পারতো? আমাকে ছেঁড়ে অন্য একটি মেয়ের সাথে টানা ছয়মাস..”
অরিন একটু দম নিয়ে আবার বললো,” যতই হোক, ভালোবাসার মানুষের কাছে কখনও মিথ্যে বলা যায় না। সবচেয়ে আপন মানুষটিই যদি আমাদের ঠকায় তাহলে ভরসা করবো কাকে বলতে পারেন? ইলহান যদি কখনও সত্যি আমাকে এক মুহুর্তের জন্য ভালোবাসতো তাহলে ঠিক ওই মুহুর্তেই এসে আমার কাছে ওর সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিতো। আর বিশ্বাস করুন, আমিও ওকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করতাম। কারণ আমি ওকে সবকিছু উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম। যাকে এতো ভালোবাসলাম তাকে সামান্য ক্ষমা করতে পারবো না? ওর আকুতি কি আমার সহ্য হতো? আমি কখনও ওকে অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে ও আমার মন থেকে সম্পূর্ণ উঠে গেছে। এখন আমার পক্ষে চাইলেও আর ওকে ক্ষমা করা সম্ভব না। আগের মতো ভালোবাসাও সম্ভব না। ধরা খাওয়ার পরেও বার-বার পিঠ বাঁচানোর জন্য ও মিথ্যে বলে গেছে। আমাকে পরিবারের সবার কাছে অপমানিত করেছে। আমি এখন চাইলেও কারো সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। আপনি আমাকে সাহায্য করতে এসেছিলেন। সেই আপনাকেও ও আহত করেছে৷ ওর সমস্ত আচরণ জঘন্য, ঘৃণ্য, পাগলের মতো! কুরুচিপূর্ণ মানুষ সে। ও আমাকে শুধুই অধিকার মনে করে নিজের কাছে বেঁধে রাখতে চায়। যেমন করে মানুষ পছন্দের পাখিটি খাচায় আটকে রাখতে চায়! আবার কেউ চায়, খাচায় বন্দ্বী প্রিয় পাখির সুখের জন্য তাকে খোলা আকাশে উন্মুক্ত করে দিতে। এই মুক্ত করে দেওয়ার নামই ভালোবাসা৷। জোর করে নিজের কাছে আটকে রাখতে চাওয়া কখনও ভালোবাসা হতে পারে না। এটা বর্বরতা। ভালোবাসার নামে এই নিষ্ঠুর বর্বরতার আমার কোনো প্রয়োজন নেই।”
অরিন এবার সত্যিই কাঁদছে। মুখে হাত দিয়ে, ফুপিয়ে উঠেছে। অন্বয় বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে অরিনের কাঁধে হাত রাখলো। অরিন কিছুই বললো না। অন্বয় ধীরে ধীরে কাঁধে হাত বুলিয়ে দিল। মনে মনে বললো,” ব্ল্যাক পার্ল, সুন্দরী ব্ল্যাক পার্ল। ঝর্ণার মতো স্বচ্ছ হাসির অধিকারী, প্লিজ ডন্ট ক্রাই। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি৷ সারাজীবন থাকতে চাই আর অনেক বেশি ভালোবাসতে চাই।”
রাতে ডিনারে যেতে দেরি হয়ে গেল অরিনের। অন্বয় আর অরিন প্রায় একসাথে রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার করে। মাঝেমধ্যে অরিন রুমে বসেই খাবার অর্ডার করে। আজকে তাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্বয় বাহিরে গিয়ে খেতে চাইলো। তাই অরিনকেও বাধ্য হয়ে আসতে হলো। ওরা মাত্র খাবার অর্ডার করে টেবিলে বসেছে। অরিনের মোবাইলটা তখনই বেজে উঠলো। অরিন ফোনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে অন্বয় কৌতুহলবশত প্রশ্ন করলো,” কার ফোন?”
অরিন কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,” মা।”
” আপনার মা?”
” জ্বী না৷ আমার শাশুড়ী মা। ম্যাসেঞ্জারে ফোন দিচ্ছেন। সেদিনের ঘটনার পর উনি আর কখনও আমাকে ফোন দেয়নি।”
” তাহলে হয়তো জরুরী বিষয়। ফোনটা ধরুন।”
অরিনের বুক কাঁপছে। সে মোবাইল রিসিভ করে কানে নিল। অপরাধী সে নয় তাও অপরাধে চিমসে যাওয়া কণ্ঠে বললো,” হ্যালো মা।”
” তোমরা দুটো মিলে কি শুরু করেছো আমাদের সাথে? বাসায় নেই কেনো তোমরা?”
অরিন হকচকিয়ে কয়েকবার পলক ফেলে বললো,” মানে?”
ওই পাশ থেকে প্রথমে চাপা হাসির আওয়াজ এলো। তারপর নুসাইবা বললেন,
” মানে আমরা তোমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি। জলদি বাসায় এসো।”
অরিন টেবিল ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ালো।
” মা এসব কি বলছেন? আপনি অস্ট্রেলিয়াতে?”
” শুধু আমি না, তোমার বাবাও এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে শুধু তোমাদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এসেছেন। আজ বারোটার পর তোমাদের ম্যারেজ এনিভার্সেরি না? আমরা কিন্তু ভুলিনি।”
নুসাইবা – শায়িখ সাহেব অদ্ভুত আনন্দের শব্দ তুলে হেসে উঠলেন। অরিনের মাথায় প্রচন্ড শব্দ হলো। বাজ পড়েছে যেনো।মা-বাবা তাদের এনিভার্সেরির জন্য সারপ্রাইজ দিতে এসেছেন? এদিকে যে তাদের ডিভোর্স হতে চলেছে সেটা কি তারা জানেন? অরিন বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে খুব সহজ ভাবে বললো,” মা আপনারা এই মুহুর্তে কোথায় আছেন?”
” কোথায় আবার থাকবো? আরে তোমাদের বাসার নিচে আছি! মেয়েটার কি আমাদের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? ”
ওই পাশ থেকে শায়িখ সাহেবের উপদেশ বাণী শোনা গেল।
” আহা, তুমি ভিডিওকল দাও না। দেখিয়ে দাও আমরা কোথায় আছি। তাহলেই বিশ্বাস হবে।”
অরিন কিছু বলার আগেই নুসাইবা ভিডিওকল দিয়ে ফেললেন। অরিন কল রিসিভ করতেই শাশুড়ীমায়ের হাসি মাখা মুখ দেখতে পেল। পেছনেই তার শ্বশুরমশাই চেয়ারে বসে আছে। দু’জনের চোখ থেকেই আনন্দ ঝরছে। নুসাইবা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললেন,” এইযে দেখো, উই আর ইন অস্ট্রেলিয়া। একদম তোমাদের এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
অরিনের মাথায় তখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। সে ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেই বুঝতে পারলো মা-বাবা সেই এপার্টমেন্টেই এসেছে যেখানে সে আর ইলহান দুইরাত থেকেছিল। এখানকার ঠিকানাই সে সবাইকে বলেছিল। তাই মা-বাবা না জেনে এখানেই চলে এসেছেন। অরিন বললো,
” বাবা আসসালামু আলাইকুম। মা, আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি এই এক্ষুণি আসছি।”
অরিন ফোন রেখে অন্বয়ের দিকে একরাশ অসহায়ত্ব নিয়ে তাকালো। অন্বয় বললো,” আপনার শ্বশুর-শাশুড়ির কথাবার্তা শুনে তো একটুও মনে হলো না যে তারা আপনার উপর রেগে আছে?”
” জানি না। এখন এসব ভাবার মতো অবস্থা নেই। পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবো সেটাই ভাবছি। বাবা এমনিতেও খুব অসুস্থ। হাসি-খুশি ভাব নিয়ে দু’জন সেই বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন আমাদের সারপ্রাইজ দিতে। এই অবস্থায় আমি কিভাবে তাদের আসল সত্যি জানাই? এসব শুনলে তো বাবা নিশ্চিত স্ট্রোক করবেন। হায় আল্লাহ!”
” আপনি এক কাজ করুন। ইলহান মাহদীকে খবর দিন। তারপর তিনি নিজেই তার মা-বাবাকে যা বলার বলবেন।”
” ইলহানকে তো খবর দিতেই হবে। কিন্তু সবার আগে আমি এখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে যাবো। যত দেরি করবো ততক্ষণ তাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমি আসছি অন্বয় সাহেব।”
” আমি কি আপনাকে অন্তত পৌঁছে দিতে পারি?”
অরিন চোখ বড় করে তাকাতেই অন্বয় বললো,” কারো সামনে যাবো না। দূরে থাকবো।”
অরিন স্পষ্টভাবে না বললো। অন্বয় অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললো,” ঠিকাছে। সাবধানে যাবেন।”
নুসাইবা আর শায়িখ সাহেব মাত্র গেস্টরুমে ঢুকেছেন ফ্রেশ হওয়ার জন্য। দু’জনই অরিনের মাথা পুরো খেয়ে ফেলেছেন। কত যে গল্প করছেন! কিভাবে এলেন, ফ্লাইটে কি হলো, কত মজার কাহিনী ঘটলো। এয়ার হোস্টেজ নাকি শায়িখ সাহেবের প্রেশারের ঔষধ দেখে ড্রাগ ভেবে সন্দেহ করেছিল৷ এই নিয়ে অনেকক্ষণ হাসাহাসি হলো। অরিন হেসেছে জোর করে। ভাগ্যিস এপার্টমেন্টে ঢুকতে কোনো অসুবিধা হয়নি। রিসেপশনিস্টকে বলার সাথে সাথেই চাবি দিয়ে দিল। ইলহান কি এখনও এপার্টমেন্ট ছাড়েনি? অরিন এইবার ইলহানকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফোন করলো। কিন্তু ইলহানকে অনলাইনে পাওয়া গেল না। অরিন ডিরেক্ট সিমে ফোন করে দেখলো মোবাইল বন্ধ। আশ্চর্য! ইলহানের বাড়ির সামনে টেলিফোন নাম্বার লেখা থাকে। মেইন গেইটে কেউ এলে সেই নাম্বারে ফোন করে বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি চাওয়া হয়। অরিন কয়েকবার নাম্বারটা দেখেছিল৷ স্মৃতিশক্তি তার আগে থেকেই প্রখর তাই মনে করতে অসুবিধা হলো না। অরিন ওই নাম্বারে ফোন দিয়ে দাঁড়োয়ানের থেকে জানতে পারলো ইলহান গতরাতের পর আর বাড়ি ফিরে যায়নি। অরিন বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” গতরাতে সে কোথায় গিয়েছিল?”
” স্যার আপনাকেই তো ফলো করতে আপনার গাড়ির পেছনে গেছিল ম্যাডাম। আমাকে রেগে বললেন গাড়ি বের করতে। আমি গাড়ি বের করলাম। স্যার তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠলেন। তিনি তখন অনেক আহত ছিলেন। শরীর থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল। আমি দেখতে চাইলাম, দেখতেও দিলেন না। আপনার পেছন পেছন চলে গেলেন।”
অরিনের হাত থেকে মোবাইলটা টপাস করে সোফায় পড়ে গেল। সে আর কিছু চিন্তাই করতে পারলো না। ইলহানকে ছুঁড়ি মারার ঘটনা সে বেমালুম ভুলে গেছিল। এইবার কি হবে? সে ইলহানকে কোথায় খুঁজবে? বাবা-মাকে কি জবাব দিবে? পাথর হয়ে চুপচাপ সোফায় বসে রইল অরিন। নুসাইবা অরিনের কাছে এসে বললেন,” তোমার শ্বশুর কফি খেতে চাইছে।”
অরিনের তখন মাথা কাজ করছিল না। কোনোকিছু বিবেচনা না করেই বললো,” রান্নাঘরে সব ব্যবস্থা আছে মা। সহজেই কফি বানিয়ে নিতে পারবেন।”
নুসাইবা এক মুহুর্তের জন্য একটু থমকালেন। তারপর পুনরায় মুখে হাসি এনে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। অরিনের যখন সম্বিৎ আসলো এবং সে বুঝতে পারলো এইমাত্র কি করেছে তখনি কপালে হাত ঠেকিয়ে নিজেকে ধিক্কার দিল। তারপর দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে বললো,” মা আপনি রেস্ট করুন। আমি আপনাদের দু’জনের জন্যই স্ন্যাকস, কফি বানিয়ে আনছি।”
নুসাইবা মুচকি হেসে অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” খুব দুশ্চিন্তায় আছো তাই না মা? ছেলেটা মনে হয় তোমাকে অনেক জ্বালাচ্ছে৷ আজকে আসুক বাসায়। আমি আর তোমার শ্বশুর মিলে এমন ঝাড়া দিবো জীবনে আর কখনও না বলে কোথায় যাবে না।”
অরিনের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে একটা কথাও বলতে পারলো না। নুসাইবা বললেন,” তুমি চুপ করে গিয়ে বসো। আমি কফি বানাচ্ছি। এতো সুন্দর রান্নাঘর দেখে তো আমার খালি রান্না করতেই ইচ্ছে করছে। তুমি বসো মা।”
অরিন বললো, ” না মা, আপনি গিয়ে বাবার কাছে বসুন।”
” আরে, তোমার শ্বশুর মশাই আমার হাতেই কফি খেতে চেয়েছেন। তুমি বানালে পারফেক্ট হবে না। তাই আমি যা বলছি তাই শোনো। নাহলে কিন্তু বকা দিবো।”
” মা আমি আপনার সাথেই দাঁড়িয়ে থাকি প্লিজ।”
নুসাইবা হেসে ফেললেন। আদুরে কণ্ঠে বললেন,” আচ্ছা।”
শায়িখ সাহেব নিজেও অবিরাম ইলহানকে ফোন করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে লাফরাঙ্গা, অসভ্য, বেয়ারা বলে ধমক দিচ্ছেন। অরিন তাদের বলেছে ইলহান রাগ করে বিকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিল। অরিন তাকে খুঁজতেই এই রাতের বেলা বের হয়েছিল। নুসাইবা আর শায়িখ বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। কারণ তারা জানেন, ইলহানের রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে৷ কিন্তু অরিনের দুশ্চিন্তা দেখে তারা ইলহানের উপর রেগে গেছেন৷ সারাক্ষণ কি তাদের ছেলেটা তাদের বউমাকে এভাবেই দুশ্চিন্তায় রাখে? নুসাইবা কফিতে সাবধানে চিনি ঢালতে ঢালতে বললেন,” তোমার মা-বাবাকে নিয়ে আসতে পারলাম না। এজন্য মনখারাপ করো না। আসলে ভিসা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল।”
অরিন অবাক হয়ে বললো,” মা-বাবারও আসার কথা ছিল নাকি?”
নুসাইবা জীভ কেটে বললেন,” যাহ, মুখ ফসকে বলে দিলাম। ইলহান বলতে নিষেধ করেছিল।”
” মানে? কি হয়েছে মা আমাকে বলুন প্লিজ।”
” আরে, তুমি এমন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করছো কেনো? সেন্সিটিভ কিছু না। আসলে ইলহান তোমাকে প্রথম এনিভার্সেরিতে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। ওর কথাতেই কিন্তু আমরা এখানে এসেছি। তোমার মা-বাবাকে আনার জন্য ও-ই তো কত ব্যবস্থা করলো। শেষমেষ হলো না। সমস্যা নেই, পরেরবার ঠিক আসবে।”
” মা, আপনি কি সত্যি বলছেন? কিন্তু আমার মা তো আমার উপর খুব রেগে আছে।”
নুসাইবা অরিনের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,” আরে বোকা মেয়ে, কেউ রেগে নেই৷ ওইটাও আমাদের সারপ্রাইজ প্ল্যান ছিল। পুরো প্ল্যান বদমাইশটার৷ মানে ইলহানের। প্রথমে তোমাকে ধমকাতে হবে তারপর চমকাতে হবে। বুঝেছো? সব ছিল আমাদের ছোট্ট অভিনয়। নাহলে তোমার উপর কেনো শুধু শুধু রেগে থাকবো আমরা?”
” এর মানে সেদিন ইলহান আমাকে আর অন্বয়সাহেবকে নিয়ে আপনাদের ওইসব মজা করে বলেছিল?”
” হ্যাঁ মা। সব মজা করে বলেছে। তোমার সামনে আমাদের ফোন দেওয়ার আগে আড়ালেও একবার ফোন দিয়েছিল। ও আমাদের যা বলতে বলেছে আমরাও মুখস্তভাবে তাই বলেছি।”
” তাহলে মা, শ্যানিনের সাথে অন্বয়সাহেবের বিয়েটা কিভাবে ভাঙলো?”
” সেটা তো ইলহান ভেঙেছে। ও এই বিয়েতে রাজি ছিল না।”
” কেনো রাজি ছিল না?”
” কি জানি বাবা? বোনের জন্য ওর ব্যারিস্টার ছেলে পছন্দ হয়নি। নিজেই নাকি পাত্র ঠিক করবে শ্যানিনের জন্য। এখন দেখা যাক কেমন পাত্র আনে। তুমি এসো মা, আমাদের সাথে কফি খাবে।”
এই কথা বলে নুসাইবা কফি নিয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গেলেন। অরিন কয়েক মুহুর্ত হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারপর আবার তার মোবাইল বাজলো। অপরিচিত নাম্বার।
” হ্যালো কে বলছেন?”
” আপনি কি ইলহান মাহদীর ওয়াইফ?”
অরিন সর্বোচ্চ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললো,
” জ্বী, জ্বী। কেনো?”
” মেলবোর্ন ইস্ট পুলিশ স্টেশন থেকে আমি একজন অন ডিউটি পুলিশ অফিসার বলছি। আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দেওয়ার ছিল।”
ওই পাশ থেকে কোনো জবাব না পেয়েও পুলিশ অফিসার থামলেন না। কথা বলা চালিয়ে গেলেন,” আমাদের কাছে গতকাল রাত তিনটায় ভয়াবহ স্ট্রিট এক্সিডেন্টের একটা রিপোর্ট এসেছে ম্যারুন্ডা হসপিটাল থেকে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো যাচ্ছে যে ইলহান মাহদীর মৃতদেহ সনাক্ত করার জন্য আপনার সাহায্য প্রয়োজন। আসলে গুরুতর এক্সিডেন্টের কারণে মৃতের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। জামা-কাপড় দেখে সনাক্ত করতে হবে। আমরা আপনার ঠিকানা সংগ্রহ করেছি। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন। আমরা এখন আপনার বাসার কাছে আছি।”
অরিন ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। ওই ঘর থেকে নুসাইবা ও শায়িখ সাহেবের হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অরিনের বুক ফেটে বেরিয়ে আসলো আত্মচিৎকার!

চলবে

– Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here