রংধনুর রঙ কালো পর্ব ৬

#রংধনুর_রঙ_কালো
৬.

গাড়িতে বসেই ইলহান ফোন হাতে নিয়ে সোফিয়াকে ম্যাসেজ করলো,” হেয়ার ইজ দ্যা ইন্ড অফ আওয়ার স্টোরি। আই নেভার ওয়ান্না সি ইউ’র ফেইস এগেইন। শেইম অন ইউ। এন্ড গুড বাই।” ফোনটা রেখেই গাড়ির স্টেয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরলো ইলহান। তার শরীর তীব্র রাগের স্রোত প্রবাহিতে হচ্ছে। অরিন কপালে হাত রেখে চোখ-মুখ কুচকে রেখেছে। মাঝে মাঝে ‘ উহু’ এর মতো শব্দ করছে ব্যথায়। কপাল বেয়ে এখনও রক্ত পড়ছে অনর্গল। ইলহান অসহায় দৃষ্টিতে অরিনের দিকে চেয়ে বিরবির করে বললো,
” আই এম স্যরি।”
এরপর সে পকেট থেকে রুমাল বের করে অরিনের কপালে চেপে দিতে চাইল। অরিন ধাক্কা মেরে তার হাত সরালো। ইলহান আর বাড়াবাড়ি করলো না। গাড়ি চালিয়ে এপার্টমেন্টের দিকে গেল। গাড়ি থেকে নামার সময় ইলহান অরিনকে ধরতে চাইলো। কিন্তু অরিন নিজেকে স্পর্শ করতে দিল না। ইলহান চোখ বড় করে ধমক দিল,
” তুমি কিছু দেখতে পাচ্ছো না তো অরিন৷ এভাবে কিভাবে হাঁটবে?”
অরিন জবাব না দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে লাগলো। কিছুটা সামনে যেতেই উঁচু জায়গায় উষ্টা খেয়ে পড়ে গেল। ইলহান তৎক্ষণাৎ অরিনকে জোরপূর্বক কোলে নিয়ে লিফটে উঠলো। রুমে এসে অরিন বিছানায় বসে একাধারে কেঁদে যেতে লাগলো। ইলহান ফার্স্ট এইড ট্রিটমেন্ট করলো অরিনের মাথায়। কেটে যাওয়া জায়গাটা ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দিল। তারপর ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” আমি কি জানতে পারি তুমি কেনো কাঁদছো?”
অরিন ঠাটিয়ে চড় দিল ইলহানের গালে। তার সাথে কথা বলতেও অরিনের ঘৃণা লাগছে। আবার সে জিজ্ঞেস করে অরিন কেনো কাঁদছে! চড় খেয়েও ইলহানের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। সে অরিনের পা দু’টো বিছানায় তুলে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো,” সোফিয়া তোমাকে কি বলেছে আমি জানি না। তবে এটা নিশ্চিত খারাপ কিছুই বলেছে। এখন আমি কিছু বুঝাতে গেলেও বিশ্বাস করবে না। তাই বুঝাতে চাইছি না। তুমি বরং শুয়ে থাকো। কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকো।”
ইলহান চলে যাওয়ার সময় অরিন তীব্র রোষে চিৎকার করে বললো,” সোফিয়া শুধু শুধু খারাপ কথা কেনো বলবে তোমার নামে? তার কি লাভ এতে?”
” আমাকে পছন্দ করে। তোমার আমার মধ্যে ঝামেলা হলেই তো সে খুশি। তুমি বোকা তাই ওর সব কথা বিশ্বাস করেছো। একটা অপরিচিত মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারলে কিন্তু নিজের হাসব্যান্ডকে বিশ্বাস করতে পারছো না।”
” হ্যাঁ, এই পৃথিবীর সবাই তোমাকে পছন্দ করে। তোমার নামে খারাপ কথা বলে। আর তুমি হচ্ছো ধোঁয়া তুলসী পাতা। তোমার কখনও কোনো দোষ থাকে না। নিষ্পাপের পাহাড় তুমি তাই না?”
ইলহান ম্লান হাসি দিল। কোনোরকম উত্তর না দিয়েই রুম থেকে চলে গেল। অরিনের সারা শরীরে জ্বলুনি অনুভব হচ্ছে। সোফিয়ার প্রত্যেকটি কথা তার মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাস্তবতা অরিনের দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর। অন্বয় সাহেব বলেছিলেন নারীদেহ ইলহানের নেশা৷ কিন্তু অরিন এখন জানে সবটাই ইলহানের পেশা। তার রক্তে মিশে আছে প্রতারণা। অরিন বিরবির করে নিজের মনেই বলে উঠলো,” তোর ওই সুন্দর চেহারা আমি এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দিবো শয়তান! তারপর দেখবো কোন সুন্দরী আসে তোর কাছে। তোর নোংরামী জন্মের মতো ঘুঁচানোর জন্য অরিনের একটা পদক্ষেপই যথেষ্ট।”
অরিন মোবাইল হাতে নিয়েই অন্বয়কে ফোন করলো।
” অন্বয় সাহেব, আমার সাথে আপনার জরুরী দরকার ছিল না? আমি এখনি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। কাইন্ডলি আপনার এড্রেসটা আমাকে সেন্ড করুন প্লিজ।”
ইলহান ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল। অরিন হাতব্যাগ কাঁধে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যেতে লাগলো। ইলহান হকচকিয়ে বললো,” কোথায় যাচ্ছো অরিন?”
জবাবে অরিন এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো যে ইলহান কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। অরিন এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। নিচে একটা মাইক্রো দাঁড়িয়ে ছিল। অন্বয় এই গাড়ি অরিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। অরিন ডানে-বামে না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। ইলহান এখন নিশ্চয়ই তার পেছন পেছন আসবে, তাকে ফলো করবে। করুক। অরিনের আজ কোনোকিছুতেই যায়-আসে না। তার সম্পূর্ণ পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেছে। তার জীবনটা ছন্নছাড়া। সে এখন ছন্নছাড়া মানবী।
অন্বয়ের এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামতেই একটা সুন্দরী হোটেল গার্ল অরিনকে রিসিভ করতে এলো। সে খুব আন্তরিকভাবে অরিনকে স্বাগতম জানালো। দেখে মনে হলো অরিনের আসার অপেক্ষাতেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল। নিজেকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছিল অরিনের। অন্বয়ের রুমে ঢুকতেই অরিন অপ্রসন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো। অন্বয় কোমড়ে তোয়ালে বেঁধে গোসলে যাচ্ছিল ঠিক ওই সময় অরিন চলে আসায় তাকে দরজা খুলতে হলো। অরিন আমতা-আমতা করে বললো,” আমি কি পরে আসবো?”
” না,না, পরে কেনো আসবেন? ভেতরে এসে বসুন। আমার দুই মিনিট লাগবে।”
অরিন ভেতরে ঢুকতেই অন্বয় ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো,” আপনার কপালে কি হয়েছে অরিন? ব্যান্ডেজ কেনো?”
অন্বয়কে দেখে এতোটাই বিচলিত মনে হলো যেনো অরিনের কপালের এই আঘাতের জন্য তিনি দুনিয়া ধ্বংস করে দিতে পারেন। অরিন মুচকি হেসে বললো,” আমি একটা জরুরী কাজে আপনার কাছে এসেছি। কথাটা বলতে আমার দুই মিনিট লাগবে। আপনি যদি আমার কথাটা শোনার পর গোসলে যান তাহলে বেশি ভালো হয়।”
অন্বয় কৌতুহল প্রকাশ করলো,” কি জরুরী কথা?”
অরিন সোফায় বসে ইস্পাতের চেয়েও শক্ত মুখে বললো,” আমি আমার হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতে চাই অন্বয় সাহেব। এই কাজে আপনার সাহায্য আমার দরকার।”
অন্বয়ের মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। কিন্তু সেই আনন্দ গোপন করার যথাসাধ্য চেষ্টা সে করলো। এমন একটা দুঃখজনক সংবাদ শুনে অন্বয়ের মোটেও খুশি হওয়া উচিৎ না। ব্যাপারটা অরিনের জন্য অবশ্যই দুঃখজনক। তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মানে নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু জানতে পেরেছেন। অন্বয় সেই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,
” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ?”
অরিন ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,” আপনার কি আমার সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করতে চাইছেন?”
” একদম না। আমি শুধু বিস্তারিত জানতে চাইছি।”
অরিন সমস্ত ঘটনা এক নিঃশ্বাসে প্রকাশ করলো। বলতে বলতে তার চোখে জল চলে আসলো। দুঃখে নয় বরং রাগে। অন্বয় কোমরে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,” একটা অপরিচিত মেয়ের কথার উপর ভিত্তি করে ডিভোর্সের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?”
” অদ্ভুত! আপনি নিজেই তো বলেছেন ইলহান আমায় খুন করতে চায়। সে চরিত্রহীন, লম্পট, প্রতারক। আমি তাকে ডিভোর্স না দিয়ে কি হাসিমুখে নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবো?”
” আমি সেটা বলিনি। আমি চাইছিলাম ইলহান মাহদী আপনার কাছে রেড হ্যান্ডেড ধরা খাক। তিনি নিজের মুখেই যেনো সব স্বীকার করেন। অন্যকারো জবানবন্দীর চেয়ে উনার নিজস্ব জবানবন্দী আমাদের জন্য বেশি উপকারী। ”
” সেটা তো আপনাদের কাজ। হাজতে নিয়ে উদুম কেলানি দিলে সব এমনিতেই স্বীকার করবে সে।”
অন্বয় হাসতে লাগলো অরিনের কথায়। অরিনের হাসিটা সহ্য হলো না। তার আপাতত কিছুই সহ্য হচ্ছে না। বাতাসও বিষাক্ত লাগছে। সবকিছুতে মিশে আছে যন্ত্রণাময় স্পর্শ। অরিন ক্রুদ্ধ স্বরে বললো,
” আপনার কাছে সালফিউরিক এসিড পাওয়া যাবে?”
” সালফিউরিক এসিড দিয়ে কি করবেন?”
” ডিভোর্সের আগে আমি ইলহানের মুখ ঝলসে দিতে চাই। যাতে ওই সুন্দর চেহারা দেখিয়ে অন্যকারো বিশ্বাসের সুযোগ সে নিতে না পারে। আমি তাকে এভাবেই মুক্তি দিয়ে আরও অন্যায় করার সুযোগ দিবো ভেবেছেন? ওর মতো প্রতারকের তো বেঁচে থাকারই কোনো অধিকার নেই। আমি ঠিক করেছি ও যখন ঘুমিয়ে থাকবে, আমি ওর মুখে এসিড ঢেলে দিবো।”
অরিনের কথাগুলো শুনে অন্বয় বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে তো মারাত্মক মনে হচ্ছে। অন্বয় যতটুকু ভেবেছিল অরিন তার চেয়েও সাংঘাতিক। সে ঘাড় একটু কাত করে বললো,
” আসলেই কি এসিড ঢালবেন?”
অরিন এক কথায় জবাব দিল,” হ্যাঁ।”
” দেখুন মিসেস অরিন, এসব করতে যাবেন না। এটা খুব রিস্কি। তাছাড়া আপনি কেনো আইন নিজের হাতে নিবেন? তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমরা আছি। আমি আছি!”
অরিন চিৎকার করে বললো,” আপনি আমাকে সালফিউরিক এসিডের ব্যবস্থা করে দিন অন্বয় সাহেব। আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না।”
অরিনের তেজ দেখে অন্বয় নিভে গেল। হতাশ গলায় বললো,
” আচ্ছা, আমি গোসলটা শেষ করে আসছি। আপনি ততক্ষণ আরও ভালোভাবে চিন্তা করুন। আমরা এই বিষয়ে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করবো।”
অরিন বসে অনবরত নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। তার এতো অসহ্য কেনো লাগছে? পৃথিবী লন্ড-ভন্ড করে ফেলতে মন চাইছে! অন্বয় চলে যাওয়ার পাঁচমিনিট পরেই তার মোবাইল বেজে উঠলো। অরিন ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো নাম্বারটা বাবা লিখে সেইভ করা। অন্বয় সাহেবের বাবা ফোন করেছেন হয়তো। অরিনের তখন নিজের বাবা-মায়ের কথা মনে হলো। তারা যখন এই সর্বনাশের কাহিনী জানবেন তখন কিভাবে সহ্য করবেন? আদৌ সহ্য করতে পারবেন কি? ইলহানকে নিয়ে মায়ের কত গর্ব ছিল। বাবা কত খুশি ছিলেন। তাদের এতো গর্ব, খুশি আকাশে উড়ে যাবে সত্যিটা জানার পর। অন্বয়ের ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। আবার ফোন আসলো। অরিন এবার মোবাইলটা নিয়ে ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে বললো,” অন্বয় সাহেব, আপনার ফোন এসেছে। মনে হয় জরুরী কিছু। বার-বার ফোন দেওয়া হচ্ছে। ”
ওই পাশ থেকে অন্বয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,” রিসিভ করে বলে দিন আমি শাওয়ারে আছি। পরে কথা বলবো।”
” আমি বলবো? কিন্তু মনে হয় ফোনটা আপনার বাবা করেছেন। তিনি যদি জিজ্ঞেস করেন আমি কে তখন কি বলবো? আপনার ক্লায়েন্ট?”
কোনো জবাব এলো না। অরিন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। ফোন এখনও বাজছে৷ অরিন এইবার রিসিভ করে বললো,
” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, ম্যাম স্যারকে একটু ফোনটা দেন।”
অরিন বুঝতে পারলো এটা অন্বয় সাহেবের বাবা নয়। অন্য বাবা।
” আপনার স্যার এখন ওয়াশরুমে। শাওয়ারে আছেন।”
” তাহলে ম্যাম, আপনি কষ্ট করে গাড়ির চাবিটা দক্ষিণ সাইডের জানালা দিয়ে ফেলুন৷ আমি নিচে অপেক্ষা করছি। আমাকে ইমারজেন্সী কাজে যেতে হবে। চাবিটা মনে হয় স্যারের ক্লোজেটের ড্রয়ারে আছে।”
অরিন এইবার বুঝলো এটা সেই ড্রাইভার যে মাইক্রোতে করে অরিনকে এখানে নিয়ে এসেছিল। অরিন প্রশ্ন করলো,” আপনার গাড়ির চাবি অন্বয়সাহেবের ক্লোজেটে থাকবে কেনো?”
” আমিই স্যারের কাছে চাবি দিয়েছিলাম। ওইটা আমার গাড়ির চাবি। চারির রিং এ আমার নাম লিখা আছে। আপনার আমার কথা বিশ্বাস না হলে স্যারকে জিজ্ঞেস করুন।”
অরিন অপ্রস্তুত হলো। অবিশ্বাসের জন্য সে বলেনি। তার কাছে ঝামেলা লাগছে অন্বয়ের ক্লোজেট খুলে চাবি বের করার বিষয়টা। তবুও সে বাধ্য হয়ে কাজটি করলো। ক্লোজেটের ড্রয়ার এতোই শক্ত যে টান মেরে খুলতে গিয়ে উপর থেকে টপাস করে একটা ডায়েরী মেঝেতে পড়ে গেল। অরিন চাবিটা জানালা দিয়ে ড্রাইভারের কাছে হস্তান্তর করে ডায়েরীটা তুলতে আসলো। অর্ধখোলা ডায়েরীটির একটা অংশ দেখে অরিন চোখের পলক থেমে গেল। থেমে গেল হৃদস্পন্দনও। কয়েক মুহুর্তের জন্য অরিন স্তব্ধ হৃদয় নিয়ে ডায়েরীর বাকি লেখাগুলো পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো৷ যে লেখাটা দেখে অরিন বিস্মিত হয়েছিল তা হলো,” অরিন, মাই ব্ল্যাক পার্ল! আমি কি তোমাকে কোনোদিনই পাবো না?”
প্রথম পেইজ থেকে অরিন ডায়েরি পড়া শুরু করলো। ক্লোজেটের দরজা বন্ধ করতেও ভুলে গেল।

” কালো মুক্তো বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব সত্যিই আছে কি-না আমার জানা নেই৷ তবে আজ থেকে আমি বিশ্বাস করবো, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কাল্পনিক বস্তু বলে যদি কিছু থাকে তা হলো কালো মুক্তো। আজ আমি স্বচক্ষে কালো মুক্তো দেখেছি। তাকে দেখে আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য পৃথিবী ভুলতে বসেছিলাম। ওই মুহুর্তটুকু সে নিজেই আমার পৃথিবী হয়েছিল। একটা জিনিস আমি খুব ভালো করে অনুধাবন করেছি। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া সম্ভব। লভ এট ফার্স্ট সাইট এক্সিটস! কটকটে কালো রঙেও কোনো নারীকে এতো মোহনীয় লাগতে পারে? কারো অন্ধকার চেহারায় এতো জৌলুস থাকতে পারে? ওই ঝকমকে সাদা চোখে কিছু একটা নিশ্চয়ই ছিল। কোনো অলৌকিক শক্তি! নাহলে ওই চোখের দিকে চেয়ে আমি এতো এলোমেলো হয়ে পড়লাম কেনো? আমার হৃদয়ের তোলপাড়, অস্বাভাবিক উৎপাত, সবকিছুর রহস্যই তো সেই অপরূপ কালো রঙ! সেই ঝকঝক হাসির কালো মেয়েটি। যার মুখটা দেখলে মনে হয় ঘন কালো রাতের আকাশে চকচকে দু’টো উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। অপূর্ব সুন্দর সেই দৃশ্য! তার চোখ দু’টো ঠিক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। তার হাসি ঝর্ণার মতো সুন্দর। তার চুলে আছে নেশা, দৃষ্টিতে আছে প্রেম, ঠোঁটের ভাজে আছে মায়া। আমি প্রথম দেখাতেই ভালোবেসেছি তাকে। এক সমুদ্র ভালোবাসা আমার শুকনো বুকে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে হঠাৎ। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ আমি সেই প্রেমের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি অবিরাম। আমাকে কে বাঁচাবে এবার? কালো মুক্তোর সেই সুন্দরী কি এই কথা জানে? তার প্রেমে পড়ে কারো আধমরা অবস্থা। একটা মানুষ প্রথমবার তাকে দেখেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার শরীরে তীব্র জ্বর। এই জ্বর সারানোর দায়ভার কি সে নেবে?”

অরিন বন্ধ করে ফেললো ডায়েরীটা। ছি! বিতৃষ্ণায় তার বমি চলে আসলো। একটা বিবাহিত মেয়েকে নিয়ে কেউ এমন পরিকল্পনা করতে পারে? অন্বয় তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।
” আপনাকে একটা জরুরী বিষয় জানানোর দরকার ছিল অরিন..”
অন্বয় তার কথা শেষ করতে পারলো না। অরিনের হাতে ডায়েরি দেখে তার বুক ধ্বক করে উঠলো। হাত-পা স্থবির হয়ে আসলো। ভেতর থেকে অপ্রতিরোধ্য আওয়াজ শুরু হলো, ধাকধাক, ধাকধাক! অরিন রক্তিম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” আপনার সেই কাল্পনিক কালো মুক্তোটি কি আমি?”
অন্বয় নিশ্চুপ চোখে চেয়ে রইল। নিঃশব্দতা দেখেই অরিন বুঝে গেল তার ধারণা সঠিক। চোখমুখ কুচকে তীব্র ঘৃণাভরা কণ্ঠে সে উচ্চারণ করলো,” ছি! আপনি এতোটা জঘন্য? এতো নোংরা আপনার চিন্তা-ভাবনা? একজন বিবাহিত মহিলাকে নিয়ে আপনি এসব কিভাবে চিন্তা করলেন?”
অন্বয় রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করলো,
” মিসেস অরিন..”
অন্বয়কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অরিন ডায়েরিটা ছুড়ে মারলো মেঝেতে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। কাকে বিশ্বাস করতে এসেছিল সে? এই পৃথিবীর সব পুরুষ চরিত্রহীন। কাউকে ভরসা করা যায় না। কাউকে না! অন্বয় হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়লো। মিসেস অরিন তাকে ভুল বুঝেছেন। মারাত্মক ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে এখানে। অন্বয় এই ডায়েরির কথাগুলো অরিনকে নিয়েই লিখেছে এটা সত্যি। কিন্তু তখন সে জানতো না যে অরিন বিবাহিত। অন্বয়ের বাবা আমানত শিকদার অরিনের শ্বশুর শায়িখ সাহেবের বাল্যকালের বন্ধু। আমানত সাহেব একজন প্রবক্তা। শ্যানিন একবার একটা কেইস নিয়ে আমানত সাহেবের কাছে এসেছিল। তখন তিনি শ্যানিনকে অন্বয়ের জন্য পছন্দ করে ফেলেন। অন্বয় তখন লন্ডনে ছিল। দেশে ফেরার পর আমানত সাহেব একদিন ছেলেকে নিয়ে শায়িখ সাহেবের বাড়ির দাওয়াতে গেলেন। তিনি ছেলেকে বলেছিলেন শায়িখ সাহেবের মেয়ে শ্যানিনকে ভালো করে দেখতে। যদি তার শ্যানিনকে পছন্দ হয় তাহলে আমানত সাহেব বিয়ের প্রস্তাব দিবেন। অন্বয় তো শ্যানিনকে আগে কখনও দেখেনি। সে অরিনকেই ভেবে নিয়েছিল শ্যানিন। তার হবু বউ। বিয়েতেও সে রাজী হয়েছিল অরিনের জন্যই। কিন্তু যখন তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে মেয়ে দেখতে গেল তখন অন্বয়ের মাথায় বাজ পড়লো। কারণ তার জন্য নির্বাচিত পাত্রীটি তার পছন্দের মেয়ে ছিল না। অন্বয় যখন জানতে পারলো অরিন বিবাহিত, তাকে পাওয়ার আশা করাও অন্যায় তখন যেনো তার সমস্ত পৃথিবীই উল্টে-পাল্টে গেল। এতো বড় আঘাত সহজে সামলাতে পারলো না সে। ভেঙে পড়লো। বিয়েতেও নিষেধ করতে পারছিল না কারণ আগেই সে বাবাকে কথা দিয়েছিল এই মেয়েই বিয়ে করবে। অন্বয়ের জীবন মরুভূমির মতো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল৷ সেই মরুভূমিতে আশার আলো ফুটলো যখন অরিন প্রথমবার তার কাছে একটা কেইস নিয়ে এসেছিল। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় অরিনকে একটা গাড়ি প্রায়ই ফলো করতো। অরিনের সন্দেহ যখন গাঢ় আকার ধারণ করলো তখন সে বিষয়টা অন্বয়কে জানালো। অন্বয় পরিচিত ছিল। তাছাড়া বেশিরভাগ সময় অন্বয় শ্যানিনের সাথে কথা বলার বাহানায় অরিনের সাথে কথা বলতো। তাদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। অরিন তার সন্দেহের কথা বাসায় জানাতে ভয় পাচ্ছিল কারণ এতে তার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ হতে পারে। অন্বয় তদন্ত করে যখন জানতে পারলো ইলহানের চরিত্রের ব্যাপারে তখন তার মনে নতুন করে আশা জাগলো। সে পুনরায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো ব্ল্যাক পার্লকে নিয়ে। আর আজকে যখন অরিন জানালো সে ইলহানকে ডিভোর্স দিতে চায় তখন অন্বয়ের মনের ঝলমলে স্বপ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবকিছু আবার ভেঙে যাবে। অরিন যে তাকে ভুল বুঝেছে। এই ভুল সে কিভাবে ভাঙবে?

চলবে

-Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here