#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_২১
ফোনে যখন মিলল না কারো কোনো সাড়া তখন সভ্য উতলা হয়ে ফোন করলো সাবিহার বাবা আশরাফুল ইসলামকে। মুহূর্তেই ব্যাক্ত হলো সব কথা। উন্মুক্ত হলো ফোন রিসিভ না করার হেতু। কেবলই সভ্য জানলো না সাবিহা এক নিষ্ঠুর মানবের পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তুমুল যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে পবনে মিশিয়ে দিচ্ছে বেদনা, কষ্ট, ক্লেশ। সভ্য তৎক্ষনাৎ খেলার মাঠ ছাড়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলো। কোচ, টিম থেকে অনুমতি নেওয়ার জন্য ছুটলো এরশাদ। যা গার্ড এসেছিল সভ্যর সাথে তাদের ব্যাস্ত করে দেওয়া হলো ফ্লাইটের জন্য। যাত্রা দিতে হবে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে।
.
গুণে গুণে আজিজের পায়ের শক্ত দু’টো লাথি যখন সাবিহার পেটে পরলো ঠিক তখন সাবিহা ব্যাথার ভার সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান শূন্য হয়ে পরলো। পেট আর বাচ্চার দশা তখন এতোটাই করুণ যা বর্ণনাতীত। আজিজ সাবিহার অবচেতন দেহের পানে নিষ্ঠুরতম দৃষ্টি তাক করে বিশ্রী ভাষা ছুড়তে লাগলো। বলে উঠলো আরো
— তোর সভ্য থাকলে ওকেও মেরে পুঁতে যেতাম। আমাকে মারে ও? ওর বড্ড বেশি সাহস। তোর অহংকার আর ওর সাহস শেষ করে গেলাম। থাক।
কথাটা বলেই আজিজ গটগট করে হাঁটা দিলো পেছন ঘুরে। সঙ্গে তাল মেলালো ড্রাইভার। শুধুই ঈষৎ সিক্ত মৃত্তিকার বুকে অবচেতন হয়ে পরে রইলো সাবিহা। সভ্য প্রায় চার মাস আগেই সাবিহার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তার ইনকামের টাকা দিয়ে কেনা প্রথম গাড়ি। যেদিন কেনা হলো তার দু-দুটি পরই লাইসেন্স ঠিকঠাক করে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় সভ্য। ফোন করে সাবিহাকে বলেছিল
” এখনো ততটা ধনী ব্যাক্তি হইনি। তবুও তোমাদের জন্য পাঠালাম। যেন আমার ঘরের মানুষগুলোর কষ্ট না হয়। তারা যেন তাদের প্রয়োজনে কাজে লাগায়।”
বেশ আকুলতা ছিল সভ্যর এ কথায়। সাবিহার চোখ ভিঁজে উঠেছিল। সভ্য অস্পষ্ট করে এটাই যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল তাকে যে, সে সাবিহার প্রথম দিকের বলা কথাগুলো থেকে অনেক বেশি কষ্ট কুড়িয়ে পেলেও ভালোবাসে তাদের তিনজনকে মন প্রাণ উজাড় করে।
ভাবতেই বুকটা হুহু করে ওঠে যেজন্য সভ্য গাড়ি পাঠিয়ে দক্ষ দেখে একটা ড্রাইভার ঠিক করলো মোটা অংকের বেতন দিয়ে। বাসা ভাড়া করে দিলো সাবিহার পাশাপাশি বাসায়। পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। যেন খুব দ্রুত, খুব জলদি ড্রাইভার এসে সাবিহার কঠিন মুহূর্তে ঢাল হয়ে দাড়াতে পারে। অথচ আফসোস সেই লোক ঢাল না হয়ে সাবিহার হলো আজ কাল। সভ্যর হলো সর্বনাশের কারণ। মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সে বিকিয়ে দিয়েছে নিজেকে আজিজের কাছে দশ দিন আগে। শর্ত মোতাবেক সে সুযোগ বুঝে সাবিহাকে তুলে এনে ফেলে দিলো আজিজের হাতে। সভ্য যেন দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিল। ভাগ্য কি তবে এটাই? নাকি সাবিহার ভয়ঙ্কর পাপের প্রতিফল। সভ্যর কিঞ্চিৎ অপরাধের ফল।
রাস্তায় উঠে আজিজ দাড়িয়ে গেলো। ড্রাইভারও উঠছিলো তার সাথে। আজিজ গাড়ি স্টার্ট দিতেই আচমকা শুরু হলো হৈ হুল্লোড়। বড্ড চমাকলো আজিজ। কিছু মহিলা সোরগোলে এগিয়ে যাচ্ছে গাছের বাগানের দিকে। কিছু পুরুষ ছুটে আসছে আজিজের গাড়ির কাছে। দিশেহারা হলো আজিজ। ড্রাইভারের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। তবে কি কেউ দেখে ফেলেছে? কিন্তু রাস্তা হতে প্রায় একশো কদম দূরে ড্রাইভার সাবিহাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল। ভাবনার যখন অন্তরআত্মা কাপিয়ে দেয় ড্রাইভারের ঠিক এমন সময় হুট করে আজিজ গাড়ি টান দিয়ে পগারপার। শা শা করে সে ছুট লাগিয়েছে। ভয়াবহ ভাবে মোচড় দিয়ে উঠলো মাঝ বয়সী ড্রাইভারের কলিজা। ক্রমশ মানুষ এগিয়েই আসছে। শক্ত কোনো উপায়ান্তর নেই। বোকার মতো ড্রাইভারও দৌড়াতে লাগলো। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। লোকের জুগো ছোড়াছুড়ি আর রাস্তার ইট পাথরের ঢিলে সে নুইয়ে পরে ধরা পরলো লোকদের হাতে।
এতোক্ষণে অবচেতন সাবিহাকে কিছু জন ধরাধরি করে গাড়ির নিকট আনলো। শীতের কুয়াশায় সকাল দশটায় তাও আবার শুক্রবারে লোকজনের চলাচল খুব কমই ছিল রাস্তায়। এরই মাঝে ভাগ্য ক্রমে কেউ দেখেছিল আজিজকে, শুনেছিল সাবিহার চিৎকার। অতঃপর আরো কিছু জন। অতঃপর কেউ বাজারের দিকে ছুটে গিয়ে লোকজন হাঁক ডাক করে উপস্থিত করলো।
.
সভ্যরই গাড়িতে সাবিহাকে উঠিয়ে কেউ একজন ড্রাইভ করে দ্রুত সাবিহাকে হসপিটালে আনলো। মুহূর্তেই গেটে সাবিহাকে আনতে আনতেই হুড়মুড় করে পরলো সাবাই। ইতিমধ্যে আশ্চর্যজনক ভাবে উপস্থিত হয়ে গেছে বিশ পঞ্চাশেক রিপোর্টার। সুখ্যাত মডেল তারকা, হিরো সাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের নব খেলোয়াড় সাজিদ আহমেদ সভ্যর বউ সুখ্যাত মডেল, পূর্বতন টিকটকার সাবিহা সুলতানার এদশা? নিউজ তো অবশ্যই এবার আকাশে বাতাসে উড়বে। পেপার, মিডিয়ার শীর্ষ নিউজ হয়ে দাড়িয়ে যাবে। ক্যামেরারা ফ্লাশের দরুন হঠাৎ হঠাৎ আলো ছড়াচ্ছে। ছুটে এসেছে যেন হসপিটালের অধিকাংশ নার্স, ডক্টর। বাইরের শোরগোল কানে যেতেই দ্রুত এসে তারা ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিতে লাগলো সকলকে। সাবিহা বেডে ঠাঁই দিয়ে জলদি ঠেলতে লাগলো চিকিৎসা জন্য। বন্ধ চোখের এলোমেলো সাবিহা কেবলই শুয়ে রইলো চোখের কোছে শুকিয়ে যাওয়া জল নিয়ে।
সাবিহার নিউজ যখন ছড়িয়ে পরলো পুরো দেশে সভ্য তখন প্লেনে বসে ছটফট করে। মন তার চিন্তায় কাতর। অজানা তার এসবের পুরোটাই। শুধু প্লেনে ওঠার আগ মুহূর্তে কিছু মহিলা গার্ড গুছিয়ে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে রাজশাহী। সাবিহার নিকট। সে সার্বক্ষনিক কিছু মহিলা গার্ড রাখতে চেয়েছিল সাবিহার নিকট কিন্তু সকলেই মানা করলো। মা আর শাশুড়ি থাকতে কাউকে লাগবে না বা লাগছে না সাবিহার। সভ্যও তো আট মাস থেকে নয় মাসের প্রতিটা দিন সাবিহার পাশেই ছিল। তা বাদে আজকের এই সময়টাতেও সভ্য সাবিহার পাশেই থাকতো। কিন্তু হুট করে খেলার আহ্বানে ফেঁসে গিয়েছিল সে। বিপদ গুলো বুঝি এভাবেই আসে। একটু ফাঁকফোকর পেয়ে বিনা নোটিশে, অসময়ে, আচমকা আশ্চর্যজনক ভাবে।
.
রওনক, রাহেলা ইসলাম আর আশরাফুল ইসলাম মেয়ের এহেন খবর আর খোঁজ অবশেষে পেলেন নেট থেকেই। ছুটে এলেন তারা। হসপিটালের গেটে ঢুকতেই তাদেরও ঘিরে ধারা হলো। সাংবাদিকের জবরদস্তি। আটকে পরা দশা আশরাফুল ইসলামের কিন্তু রাহেলা ইসলাম ছুটছেন তো ছুটছেনই। মা কে আর কেউ আটকাতে পারেনি। আশরাফুল ইসলামের যখন প্রায় উর্ধশ্বাস উঠে তখন সভ্যর কিছু গার্ড কোত্থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলো। তারাও হয়তো অনলাইনে এমন সংবাদ শুনে স্যারের নির্দেশের আগেই ছুটে এসেছে রাজশাহী। মহিলা গার্ড দাড়িয়ে আছে ওটির সম্মুখে। ডাক্তার নার্স ভেতরে ছোটাছুটি করে সাবিহার ট্রিটমেন্ট করে। করুণ দশা সকলের। ফারজানা বেগমও সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন একটু পর। রাহেলা ইসলাম কান্নায় ভেঙে পরেছে। সাবিহার বাবার এক ডাকে শতশত পুলিশ আসবে। সভ্যর শক্তপোক্ত গার্ড, অধিক যত্নের ভিড়েও আজ সাবিহার এই পরিস্থিতি। শুধুই তুচ্ছ হয়ে চোখে ধরা দেওয়া অতীতের জন্য। মাত্র রঙ আর বেরঙের তফাৎ থেকে আজ এতোকিছু।
.
অনেক সময় পেরিয়ে গেলো। প্রায় দু ঘন্টা। সভ্য বাদে হসপিটালে অবস্থানরত সাবিহার আপনজনের বুকে শুধু বয়ে গেলো কষ্ট, দুশ্চিন্তার ঢেউ। বাকি সবার মাঝে উত্তেজনা কৌতুহল। কেন সাবিহার এদশা হলো। মিডিয়ায় কখনো গোপনেও জানা যায়নি সভ্যর কোনো শত্রু আছে। বরং সকালের সাথে সভ্য সম্পর্ক ভালোই। কারো সাথে গভীর নয় আবার কারো সাথে হিংসাত্মক, শত্রুতা পূর্ণ নয়।
— শুনুন? আমার কেবিনে আসুন প্লিজ
হঠাৎ এক চল্লিশোর্ধ্ব মহিলার ডাক। আশরাফুল ইসলামের উদ্দেশ্যে। হকচকিয়ে উঠলেন সাবিহার বাবা। মহিলাটা ডাক্তার। উনিই ডেলিভারি করলেন সাবিহার।
— জ্বি বলুন আমার মেয়ের কি অবস্থা?
ডাক্তারের কেবিনে ঢুকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন আশরাফুল ইসলাম। মহিলা চেয়ার টেনে বসলেন। গম্ভীর তার চোখ মুখ। রাহেলা ইসলাম দরজার নিকট পর্যন্ত ছিটে এসেছেন আশরাফুল ইসলামের পিছু পিছু। ফারজানা বেগমও আছে। ডাক্তার মহিলাটা চেয়ারে বসেই নজর করলেন সকলকে। অতঃপর একটু সময় নিয়ে এক নির্মম কথা।
— বাচ্চা দুটোই মৃত। মারা গেছে। মেয়ের পেটে সজোরে কিছু দিয়ে আঘাত হয়েছে মেবি।
কথাটা সকলের কানে পৌঁছাতেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। অধিক কষ্ট পেলেন, ভয়ে আতঙ্কে জর্জরিত হলেন ফারজানা বেগম। সভ্যর কথা ভেবে। ছেলে তার কিভাবে নেবে এই সংবাদ? ভাবতেই বুক কেঁপে উঠে। সাবিহা-সভ্যর মিলনান্তর কাহিনী গড়েছিল বাচ্চারা। যেন রহমত হয়ে এসেছিল।
— মেয়ের অবস্থাও খুব বাজে। একদমই খারাপ। জানিনা তারও কি হবে। চব্বিশঘণ্টা না যাওয়া পর্যন্ত তাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।
আবারও একটা হৃদয়ছেদ্য কথা ডাক্তারের।
চলবে…..
( 🙂💔🙂💔🙂💔🙂💔)