#রিকশা
।।৫।।
“তো আপনি যখন এতই ভালোবাসেন, এত বেশি মিস করেন, তাহলে ফিরে যাচ্ছেন না কেন তার কাছে?” অবাক হয়ে জানতে চাইল শাহরিয়ার।
সুইমিং পুলের পানির দিকে তাকাল শুভ্রা। সুইমিং পুলের পাশে রাখা ছোট মাঝারি বড় পানির পাত্র থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে সেখানে।
পাত্রগুলোর নিচ থেকে বুদবুদের মত পানি উঠছে। পাশের প্রদীপসজ্জার আলো প্রতিফলিত হয়ে সেই পানিকে তরল গলিত অগ্নিলাভার রূপ দিয়েছে।
সেই পানির দিকে তাকিয়ে চোখের কোণা মুছে নিলো শুভ্রা। অশ্রু লুকানোর কোনো চেষ্টা করল না।
“আমি আর যাব না ওর কাছে!”
“কিন্তু কেন?”
বলক দিতে থাকা ভাতের হাঁড়ির মত পানির পাত্রের দিকে তাকিয়ে রইল শুভ্রা। আবারও ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসছে দুঃসহ সব স্মৃতির দল।
একা একাই সব করত শুভ্রা। চেক আপে একাই যেত, একাই কিনে খেত ওষুধ, পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল।
ভুলেও কিছু বলত না পারভেজকে। কথা বলা বন্ধ হয়েছিল সেই রাতের পর থেকেই।
আর দূরত্বটাও বেড়েছিল দিন দিন। এক বিছানায় শুলেও দুজনের মাঝখানে রাখার জন্য কোলবালিশ কিনে এনেছিল শুভ্রা।
এক সপ্তাহ পর এক শুক্রবার সকালে ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় এলো পারভেজের বড় বোন। পারভেজের সম্মান রক্ষার জন্যই শুভ্রা অভিনয় করতে লাগল সব ঠিকঠাক আছে।
আপার সামনে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলল পারভেজের সাথে, রাতে রান্নার ভালো আয়োজন করবার জন্য বাজারে কী কী আনতে হবে লিস্ট দিলো। বুয়াকে বলল কিছুটা বেশি সময় থাকতে।
এক রুমের ফ্ল্যাট তাই রাতে খাওয়ার পর বেরিয়ে গেল পারভেজ, কোনো এক বন্ধুর বাসায় থাকবে বলে। আপার ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট ছিল পরের দিন, তাকে শোয়ার আয়োজন করে দিয়ে তাকে শুয়ে পড়তে বলে শুভ্রা সেই রাতে বসেছিল ঘরের অন্য কোণায় টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে অফিসের একটা কাজ নিয়ে।
কিন্তু ঘুমের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না আপার মধ্যে। উলটো গল্প করতে শুরু করে দিলো শুভ্রার সাথে।
কথায় কথায় বাড়তে লাগল ঘনিষ্ঠতা, ক্রমশ আন্তরিক আলাপ গিয়ে পৌঁছাল শুভ্রার স্যালারি, সেভিংস, ক্যারিয়ার প্ল্যান এই সব কিছুতে। শুভ্রার খারাপ লাগছিল না এই আন্তরিকতা, ভালো মনেই উত্তর দিচ্ছিল সবকিছুর।
আচমকাই প্রশ্ন করে বসল আপা, “কয় মাস চলে তোমার?”
মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল শুভ্রার মুখ। তার পেট উঁচু হতে শুরু করেনি তখনো, ঢিলা ঢালা কামিজের নিচে ওড়না বড় করে মেলে দিলে বোঝার সাধ্য ছিল না কারো যে সে অন্তঃসত্তা।
“আরে লজ্জা পাচ্ছ কেন? তিন বাচ্চার মা, এইটুকু বুঝব না? তুমি যে তখন খেতে পারলে না, গন্ধ শুঁকে রেখে দিলে তখনই বুঝে ফেলেছি! এখন বল কয় মাস চলে?”
“দশ সপ্তাহ।“
“মাত্র? তাহলে তো এখনো সময় আছে! এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে ফেললে তো অসুবিধা হবে তোমাদের! এটাকে ফেলে দেওয়া যায় না?”
চমকে উঠেছিল শুভ্রা। তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছিল, “পারভেজ শিখিয়ে গেছে আপনাকে এই সব আজেবাজে কথা বলতে?”
থতমত খেয়ে বলেছিল পপি আপা, “কী যে বল! ও শিখিয়ে যাবে কেন? আমার বিবেচনা আছে না? আমি তো আমার বিবেচনা থেকে বললাম!”
“ইউ জাস্ট গো টু হেল উইথ ইওর ড্যাম বিবেচনা!”
“দেখো, কথা বার্তা সাবধানে বলবে! তোমরা বড়লোক বলেই মাথা কিনে নাওনি একেবারে! কার সাথে কথা বলছ হিসাব করে কথা বলবে! আমি তোমার মুরুব্বি!”
“মুরুব্বি তো মুরুব্বির মতই থাকেন না! আমার পারসোনাল ব্যাপারে নাক গলাতে আসেন কেন?”
আর একটাও কথা না বলে উলটো দিকে ফিরে শুয়ে পড়েছিল পপি আপা। আর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সামনে ধরে রাখা ল্যাপটপে মনোনিবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল শুভ্রা।
কাজটা হয়ত হয়ে যেত এক ঘন্টার মধ্যে। সর্বোচ্চ দেড় ঘন্টাই লাগতে পারত।
কিন্তু রাগে গনগনে হয়ে থাকা মাথায় ডাটা এন্ট্রি আর এনালাইসিস ঢুকছিল না সহজে। যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল সর্বোচ্চ রাত দেড়টার মধ্যে, বার বার ভুল আর ভুলের সংশোধন করতে করতে তা গিয়ে শেষ হলো ভোর রাত চারটায়।
আবার জেদ করে ইস্তফা দিয়ে শুয়ে পড়তেও ইচ্ছে করছিল না। এই কাজটা আজকের মধ্যেই শেষ করবে, এটা তার পরিকল্পনা ছিল।
আপা না আসলে, রান্না খাওয়া গল্প গুজবে কিছুটা সময় নষ্ট না হলে আজ দিনের মধ্যেই কাজটা শেষ করে ফেলতে পারত শুভ্রা। এখন আর এই কাজটাকে টেনে টেনে পরের দিন পর্যন্ত নিতে ইচ্ছে করছিল না তার।
প্ল্যানের ব্যত্যয় ঘটা ছোট বেলা থেকেই পছন্দ নয় তার। আগামীকাল শনিবার, অফিস ছুটি শুভ্রার।
একটু রাত হলেও কাজটা শেষ করেই ঘুমাবে ঠিক করেছিল ও। গভীর রাতে খিদে লাগলে খাওয়ার জন্য মাথার কাছে বিস্কিটের টিনে তার প্রিয় ওরিও বিস্কিট রেখেছিল শুভ্রা।
কাজটা শেষ করে বিস্কিটের প্যাকেট খুলে কামড় বসাতে বসাতে মনে হলো শুভ্রার, আচ্ছা সে বোধ হয় একটু বেশিই ওভার রিএক্ট করে ফেলেছে। হতেই তো পারে পারভেজ উনাকে কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়নি, হয়ত আপা যা বলেছে নিজের থেকেই বলেছে।
কাল সকালে উঠেই আপার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ওরিও বিস্কিটের প্যাকেট ডাস্ট বিনে ফেলে পানি খেয়ে মুখ মুছে ঘুমাতে গিয়েছিল সে।
রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে দেরি হয়েছে, পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে শুভ্রা দেখে ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে দেখে সময় দেখাচ্ছে বেলা সাড়ে এগারোটা।
হায় সর্বনাশ! ধড়মড় করে উঠে বসেছিল শুভ্রা।
এটা কোনো কথা হলো? ছি, আপা কী ভাববে?
“ঘুম হলো?”
এটাচড বাথরুম থেকে চুলে টাওয়েল জড়িয়ে বের হয়েছিল পপি আপা। মুখে মিষ্টি হাসি।
শুভ্রা অপরাধী ভঙ্গিতে হেসে বলেছিল, ‘ডাকেন নাই কেন আপা?”
“তুমি আরাম করে ঘুমাচ্ছিলে, দেখে ডাকতে ইচ্ছা করল না। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছ নাকি? এই শরীরে অনিয়ম করলে চলবে? এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে তো পেটেরটাও উপাস থাকবে!”
আপার গলায় ঝরে পড়ছিল স্নেহ, সত্যিকারের বড় বোনের মতই। বরং শুভ্রার মায়ের পেটের আপন বোন শায়লা এর চেয়ে অনেক বেশি কাট কাট করে কথা বলে শুভ্রার সাথে।
লজ্জিত বোধ করেছিল শুভ্রা। “আপা, আমি আসলে…”
“থাক থাক, স্যরি বলতে হবে না! আমিই স্যরি, তোমাদের ব্যাপারের মধ্যে কথা বলা উচিত হয়নি আমার! যাও যাও ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি নাস্তা বানিয়ে রেখেছি, পরোটা। কালকে রাতের মাংস দিয়ে হয়ে যাবে।“
মাথার গোলাপি টাওয়েল খুলে জানালার পাশে টানানো দড়িতে মেলে দিতে দিতে বলেছিল আপা। আর শুভ্রা বিছানা ছেড়ে গিয়েছিল ওয়াশরুমে ফ্রেশ হয়ে আসতে।
তারপর…
সবকিছু এখনো এত ধোঁয়াশা মনে হয় শুভ্রার। কী হয়েছিল আসলে?
কেন ওয়াশরুমে পা দিতেই উলটে পড়ে গিয়েছিল ও? ওয়াশরুমের দরজার ঠিক সামনে গাদা খানিক সাবান পানি পড়ে পিচ্ছিল হয়েছিল কেন?
যা হওয়ার নয় তাও হয়, তাও বুঝি মেনে নিতে হয় মানুষকে। সেই পিচ্ছিল বাথরুমে উলটে পড়ে শুভ্রার দুই পায়ের ফাঁক বেয়ে নেমেছিল রক্তের স্রোত আর শুভ্রা চেয়ে চেয়ে দেখছিল তার স্বপ্নের অপমৃত্যু।
পারভেজ আসেনি। চিৎকার করে যখন কাঁদছিল শুভ্রা, আসেনি পারভেজ।
অফিস থেকে বের হতে পারেনি নাকি। যার ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকে সেই মহিলার সাহায্য নিয়ে টেনে হিঁচড়ে শুভ্রাকে বাসার কাছের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিল পপি আপাই।
অস্বীকার করতে পারবে না, আপা কাঁদছিল খুব। শুভ্রা কাঁদছিল চিৎকার করে।
আর আপা কাঁদছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ক্লিনিকে যাওয়ার পর পরই ইমার্জেন্সি আল্ট্রা সনোগ্রাফি করে জানা গেল হার্ট বিট নেই শুভ্রার পেটের বাচ্চাটার।
একদিন যে কথাটা বলেছিল পারভেজ, ব্লাড ক্লট, অবশেষে এতগুলো দিন পর সে কথাই সত্যি হলো আজ! শুভ্রার সাধের বাচ্চা, এত ঝগড়াঝাটি আর অশান্তির বাচ্চা সত্যি সত্যিই পরিণত হলো হৃদস্পন্দনহীন শুধু একটা নিষ্প্রাণ রক্তপিণ্ডে!
(প্রিয় পাঠক, গল্পটা পড়তে ভালো লাগলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার নতুন বই “নাটাই ঘুড়ি”। লিংক কমেন্টে সেকশনে।)