#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আশু চুপ করে আছিস কেন?? তুই ঠিক আছিস তো??”
আরশি ভাবনা থেকে ফিরে আসলো। মুখে মলিন হাসি টেনে বলল-
“হুম ঠিক আছি। তুই বস। এই নিলু তুইও তাড়াতাড়ি আয় বস।”
নীল কপালে চিন্তা ভাঁজ আর বিস্ময় নিয়েই আরশির ডান পাশে বসলো। আর নীলা আরশির বাম পাশে বসলো। আরশির কাধে হাত রেখে বলল-
“আশু তুই এতো সকাল সকাল ভার্সিটি এসেছিস কেন!! তুই জানিস এই নীলের ডিব্বা আমাকে ঘুম থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে কতটা ভয় দেখিয়ে বলেছে তুই না-কি সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিস। ঘুম থেকে উঠে এমন কথা শুনে কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস!!”
আরশি শীতল চোখ নীলার অস্থিরতা দেখছে। মেয়েটা অল্পতেই কতটা অস্থির হয়ে পরেছে। অথচ তার মনের আকাশে যে কত বিষন্নতার মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে তা বুঝতেই দিচ্ছে না কাউকে। নীলা কোনো উত্তর না পেয়ে বাচ্চাদের মতো ড্যাবড্যাব করে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশিকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলল-
“এই আশু কি হয়েছে তোর! এভাবে তব্দা খেয়ে বসে আছিস কেন!! তুই ঠিক আছিস তো??”
আরশির সম্বিৎ ফিরল। ভ্রু বাঁকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“আগে তুই শান্ত হ। এতো এতো প্রশ্ন করছিস আমি কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিব!!”
পাশ থেকে নীল বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“নিলুর কথা বাদ দে, তুই আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে তুই এই সময় একা একা এখানে কি করতে এসেছিস!!”
আরশি নীলের দিকে দৃষ্টি দিল। চোখেমুখে কৌতূহল। আর কপালে বিরক্তি প্রকাশের ছাপ। আরশি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“বৃষ্টির পরের এই স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশটা খুব ভালো লাগে তাই উপভোগ করতে আসলাম।”
নীলের ভ্রু জোড়া কুচকে এলো৷ চোখমুখের ভঙ্গির পরিবর্তন দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার এই উত্তরটি পছন্দ হয়নি। নীল উঠে দাঁড়ালো। নীলার দিকে তাকিয়ে বলল-
“নিলু একটু এদিকে আয় তো বোন।”
নীলের এতো সুন্দর মধুর ডাকে নীলা কিছুটা ভড়কে উঠলো। বিস্মিত হয়েই নীলের কাছে গেল। আরশি নীলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। নীল একটা মেকি হাসি দিয়ে নেকামো করে বলল-
“আশু বেবি তুমি এখানে বৃষ্টিবিলাশ আর প্রকৃতির সৌন্দর্যে উপভোগ করতে এসেছো তাই না!!”
আরশি আর নীলা দুজনেই নীলের কথায় অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে নীলের উদ্দেশ্য। আরশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীল কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচু হয়ে ঝুঁকে থাকা ডালটা ধরেই জোরে জোরে ঝাকা দিল। গাছের পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টি পানি গুলো ঝরে পরলো আরশির উপর। আরশি হতবাক হয়ে বসে আছে। বৃষ্টির অবশিষ্ট পানি গুলো এখন তার শরীরে জায়গায় করে নিয়েছে। আচমকাই এক ধমকা হাওয়া এসে আরশির গাঁ ছুঁয়ে দিয়ে দিল। সারা শরীর শীতে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আর সেই সাথে গরম তেলে পানি পরার মতো ছ্যাঁত করে উঠলো আরশি রাগ। বাজখাঁই কন্ঠে বলল-
“ওইইইই নীল হারামি কি করলি এটা!! দেখতো পুরো শরীর ভিজিয়ে দিলি।”
নীল ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল-
“তুই আমাদের কথার উত্তর দিচ্ছিস না তাই এই শাস্তি দিলাম। তুই সব সময় আমাদের কাছে কথা লুকিয়ে রাখিস কেন আশু!!”
আরশি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলল। নীলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল-
“আগে রুমাল দে। পানি গুলো মুছে নেই। আমি রুমাল নিয়ে আসি নি আজ।”
নীলা আর নীল হাত দিয়ে বেঞ্চির উপরে পড়ে থাকা পানি গুলো মুছে আগের জায়গায় বসে পরলো। নীল পকেট থেকে রুমাল বের করে দিতেই আরশি মাথা আর হাতের পানি গুলো মুছতে লাগলো। নীলা চিন্তিত গলায় বলল-
“আশু আজ তোর কি হয়েছে? তোর ব্যবহার কেমন যেন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।”
আরশি জামার ভেজা জায়গায় গুলো রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল-
“বলছি কিন্তু আদ্রাফ আর কাসফিয়া কোথায়??”
নীল কিছুটা বিরক্তির সাথে বলল-
“ওদের আসতে দেরি হবে। এখন তুই বল কি হয়েছে??”
আরশি নীলের দিকে শান্ত চোখে তাকালো।
“আমি কেন ছেলেদেরকে পাত্তা দেই না! প্রেম ভালোবাসা করি না! কেন ছেলেরা আমার সাথে একবার কথা বলেই আর আসে না! তাদেরকে আমি কি বলি! এইসব সব প্রশ্নই তো তোরা সব সময় জানতে চাস তাই না??”
নীল আর নীলা দুজনেই আরশির দিকে উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। আরশি নির্লিপ্ত ভাবে বললো-
“এইসব কিছুর পেছনে একটাই কারন আর সেটা হলো আমি কখনো মা হতে পারবো না। আমি ব্যর্থ। আমি অপূর্ণ। আর আমার এই ব্যর্থতার কথা শুনেই সবার ভালোবাসা উধাও হয়ে যেত।”
কথা গুলো বলেই আরশি একটা মুচকি হাসি দিল। নীলা আর নীলা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখেমুখে কৌতূহল, ভয়ংকর কৌতুহল। নীল বিস্ময়ে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
“আশু তুই আমাদের সাথে মজা করিস তাই না!!”
আরশি কিছু বললো না একটা বিষণ্নতায় ভরা হাসি দিল। হাসিটার মধ্যে লুকিয়ে আছে হতাশা, বিষণ্ণতা আর চাপা কষ্ট। নীল তার উত্তর পেয়ে গেল আরশির এই হাসিতে। নীলা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-
“কবে থেকে জানলি এটা??”
আরশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব খুলে বলল। আরশির গলা ধরে আসছে কথা গুলো বলার সময় তবুও নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে।
“আমি চাই না আমার ব্যর্থতার জন্য অন্য কারও জীবনে আঁধার নেমে আসুক। তাই আমি সব সময় এসব প্রেম ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি।”
আরশির শেষের এই কথা গুলোতে নীল প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। রাগান্বিত কন্ঠে বললো-
“নিজেকে বার বার ব্যর্থ বলা বন্ধ কর আশু। আর এটা তেমন কোনো বড় সমস্যা না যে তুই নিজেকে এভাবে একা একা কষ্ট দিয়ে দিয়ে যাবি সারাজীবন। সামান্য একটু হয়তো হরমোনের প্রব্লেম এটা ট্রিটমেন্টের মাধ্যমেই ঠিক হয়ে যাবে। শুধু শুধু নিজেকে ব্যর্থ বলিস না শেষ বারের মতো বলে দিলাম।”
আরশির নিচের দিকে তাকিয়েই নীলের কথা গুলো শুনলো। নীলা আরশির কাধে হাত রেখে নীলের কথায় সায় দিয়ে বলল-
“নীল তো সত্যিই বলেছে আশু। বর্তমান যুগে এসব নিয়ে তুই এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিস এটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। নীল ঠিকই বলে তুই আসলেই একটা অবুঝ বাচ্চা। তোর মাথায় শুধু গোবর একদমই বুদ্ধি নেই।”
আরশি মাথা তুলে ভ্রু কুচকে নীলার দিকে তাকালো। কিন্তু নীলাকে কিছু বললো না। ডান দিকে ফিরেই নীলের বাহুতে সজোড়ে এক থাপ্পড় মারলো। নীল মৃদুস্বরে আর্তনাদ করতেই আরশি ক্ষিপ্ত হয়ে বলল-
“হারমি তুই নিজে তো খারাপ হয়েছিস সাথে তোর বোনকেও খারাপ বানাচ্ছিস।”
“আচ্ছা এসব বাদ দে এখন বল তুই এখানে কেন এসেছিস। আজ হঠাৎ করেই তোর মন খারাপ হলো কেন??”
নীলের কথায় আরশি শান্ত গলায় বললো-
“চিঠির মানুষটার কথা তো তোরা জানিসই। কাল রাতে উনি আমাকে বিয়ের কথা বলেছে।”
নীলার আর নীল দু’জনে চমকে উঠে একসাথেই চেচিয়ে বলল-
“কিইইইইইই… কিন্তু কীভাবে??”
আরশি ওদের চেচিয়ে ওঠায় একটু বিরক্ত হয়ে নেড়েচেড়ে বসলো। কিছুটা ইতস্তত করে শুরু থেকে কাল রাতের ঘটনা পর্যন্ত সব বলা শুরু করলো। আরশির কথা শুনে দুজনের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। আরশির কথা শেষ হতেই নীল রেগেমেগে বেঞ্চি থেকে উঠে দাড়ালো। শক্ত গলায় বলল-
“তুই কি আসলেই আমাদেরকে ফ্রেন্ড মনে করিস আশু!! এতো কিছু হয়ে গেল আর তুই আমাদের কাছ থেকে সব কিছু লুকিয়ে রেখেছিস। আর তুই একটা অচেনা ছেলের সাথে যখন তখন একা ঘুরো ঘুরি কোন সাহসে করলি!!! যদি তোর কোনো ক্ষতি করে ফেলতো তখন কি হতো!!”
আরশি অপরাধীর মতো মাথা নুয়ে আছে। নিম্ন স্বরে বলল-
“ডক্টর এমন না যেমনটা তুই ভাবছিস নীল।”
“আমি কি ভাবছি না ভাবছি সেটা আসল কথা না। এতকিছুর পরেও তুই একটা অচেনা ছেলের সাথে রাতবিরেতে ঘুরতে যাস কোন সাহসে সেটা বল আমাকে। ওই রাতে তোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবলে তো আমার এখনো ভয় করে। আর তুই কি করছিস এসব??”
নীলের রাগান্বিত কন্ঠ শুনে আরশি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। নীলা কিছুটা বিরক্তি হয়ে বলল-
“আহহ নীল থাম তো আরশিকে বকছিস কেন!! চুপচাপ বস।”
আরশি মাথা তুলে নীলের দিকে তাকালো। চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। চোয়ালে শক্ত করে চেপে আছে। খোচাখোচা দাঁড়ির উপরের দিকের ফাঁকা সাদা ধবধবে গাল গুলো লালচে আকার ধরন করেছে। হাল্কা নীলচে রঙের চোখ গুলো কেমন যেন অদ্ভুত ভয়ংকর রকমের লাগছে এই মুহূর্তে। রাগে নীলের ফর্সা ধবধবে এই চেহারাটা যেন আরও ভয়াবহ রকমের মোহনীয় লাগছে। নীল আরশির পাশে বসতেই আদ্রাফ আর কাসফিয়া এসে হাজির হলো। সবার থমথমে চেহারা দেখে আদ্রাফ ভ্রু বাঁকিয়ে সন্দেহের গলায় বললো-
“কি হয়েছে তোদের?? সবার চেহারা এমন হয়ে আছে কেন?? কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে না-কি এখানে??”
নীলা আদ্রাফ আর কাসফিয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুজনকে কতো সুন্দর মানিয়েছে এক সাথে। নীলার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে। এই মুহূর্তে সবার সামনে ভেঙে পরলে তো একদমই চলবে না। নীলার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসলো এক দীর্ঘশ্বাস। আচমকাই অনুভব করলো কেউ তার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। নীলা আদ্রাফের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতের দিকে তাকালো। আরশি শক্ত করে নীলার হাত ধরে আছে। আরশির দিকে তাকিয়েই নীলা একটা মুচকি হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় আস্বস্ত করলো সে ঠিক আছে। আরশি আদ্রাফের উদ্দেশ্যে বলল-
“কাসফি আর নীলের কাছে সব জেনে নিস। ওরা সব…”
আরশি আর কিছু বলার আগেই তার দৃষ্টি পরলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রৌদ্রর দিকে। আরশি সাথে সাথেই উঠে দাড়ালো। উত্তেজিত হয়ে বলল-
” তোরা থাক আমি আসছি।”
কথাটা বলেই আরশি দ্রুত পায়ে রৌদ্রর দিকে এগিয়ে গেল। বাকি সবাই আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। নীল ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল-
“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন আয় বস।”
আদ্রাফ আর কাসফিয়া বসে পরলো। আদ্রাফ এখনো কিছু না বুঝে বোকার মতো করে বিস্ময় নিয়ে বসে পরলো।
———————
আরশি রৌদ্রর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রৌদ্রর দিকে। কেন যেন আজ রৌদ্রকে একদমই অন্য রকম লাগছে আরশির কাছে। পকেটে দুহাত গুজে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। সাদা শার্ট গায়ে জড়ানো। আর হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করে রেখে। চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলেও কিছু চুল কপালের সামনে এসে পরে আছে। গাল ভর্তি ছোট ছোট চাপ দাঁড়ি। ঠোঁটের কোণে এক অমায়িক হাসি। আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রৌদ্র ডান গালে। দাঁড়ির মাঝখানে একটা অংশ কালো হয়েছে। কিন্তু কেন?? আরশির তার সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করতে করতে রৌদ্রর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আরশি কাছে আসতেই রৌদ্রর ঠোঁটের হাসিটা প্রসারিত হয়ে গেল। আর সেই সাথে গালের মাঝ দিকটা দাঁড়িতে ঘন হয়ে আরও কালো হয়ে উঠলো। আরশি এবার ভ্রু কুচকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারলো। হাসির কারনে রৌদ্রর গালে টোল পড়েছে। আর দাঁড়ি দিয়ে ডেকে যাওয়ার সেটা কালো দেখা যাচ্ছে। “হাসলে ছেলেদের গালে টোল পড়ে নাকি!! অদ্ভুত ব্যাপার। আজ হঠাৎ করে দাঁড়ির মাঝে এই টোল কোথা থেকে উদয় হলো!! আগে তো কখনো দেখলাম না।”
“আমাকে দেখা শেষ হয়েছে আরু??”
আচমকা রৌদ্র মুখে এমন কথা শুনে আরশির ভাবনা ভেঙে গেল। পরক্ষনেই লজ্জার চাদরে মুড়িয়ে নিল নিজেকে। নির্লজ্জের মতো একটা ছেলের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে এখন নিজেরই লজ্জা করছে আরশির। লজ্জা মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে এই মুহূর্তে।
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আমাকে দেখা শেষ হয়েছে আরু?”
রৌদ্রর কথায় আরশিকে লজ্জায় আঁকড়ে ধরেছে। ঠিক যেমনটা চোরাবালি আঁকড়ে ধরে তেমন করে। এই লজ্জা থেকে বেরিয়ে আসা যেন আরশির জন্য খুবই কষ্টদায়ক। হলদেটে গায়ের চামড়া এখন লালচে বর্নে বর্নিত হয়েছে। চোখজোড়া ঘনঘন পলক ফেলছে অস্থিরতায়। রৌদ্রর আরশির অবস্থা দেখে হাসলো। ঠোঁট চেপে হাসলো। গালের মাঝখানের টোলটা দাঁড়ির আবরণে ঘন কালো হয়ে উঠেছে। পকেট থেকে ডান হাত বের করে খানিকটা ঝুঁকে পরলো। আলতো করে আরশির মাথায় হাত রাখলো। শীতল কন্ঠে বললো-
“এবার একদম পারফেক্ট রুদ্রাণী লাগছে। তবে এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ঝলসে দেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখিও না রুদ্রাণী।”
রৌদ্র আবারও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে দিল। আরশির লজ্জা ভাব কেটে এখন ঝেঁকে বসেছে বিস্ময়বোধক চিহ্ন। “আমাকে রুদ্রাণী লাগছে!!কিন্তু রুদ্রাণী দেখতে কেমন!! আমি আবার কিভাবে ওনাকে ঝলসে দিবো!! আর দুঃসাহসই বা কখন দেখালাম!!” আরশির মনে চলছে এতো এতো বিস্ময়বোধক চিহ্নের ছোড়াছুড়ি খেলা। বিস্ময়কর চাহনিতে তাকালো রৌদ্রর দিকে। প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল-
“কি বলেছেন এগুলো!! একটু সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলুন। আমি তো আপনার কথা বুঝতেই পারছি না।”
রৌদ্র ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল-
“বাচ্চাদের এতো কিছু বুঝতে হয় না। কিছু জিনিস আপাতত অজানা থাকুক। এখন আপনি বলুন আমার দিকে এতো বড় বড় চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন কেন??”
আবারও একথায় ফিরে আসাতে আরশি অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। অগোছালো ভাবেই বলল-
“কই না তো আমি কেন আপনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকব!! আপনি হয়তো ভুল দেখেছেন।”
“আপনি তো মিথ্যাও বলতে পারেন দেখছি। আমি নিজ চোখেই দেখলাম আপনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আর এখন আমার মুখের উপরেই মিথ্যে বলছেন!!”
রৌদ্রর কথায় আরশির মেজাজ বিগড়ে গেল। আর সেই সাথেই করে বসলো আরেক বোকামি। রাগে গজগজ করে বলল-
“দেখেছি তো কি হয়েছে!! চোখ আছে বলেই দেখেছি। আর আমি তো আপনাকে না আপনার গালের এই জায়গাটা দেখছিলাম।”
লাস্ট কথাটা আরশি রৌদ্রর গালের টোল পরা স্থানে আঙুল ছুঁয়ে দিয়েই বলল। রাগের মাথায় কি থেকে করেছে আরশি নিজেই জানে না। রৌদ্রর আরশির এমন কাজে থতমত খেয়ে গেল। রৌদ্র ভাবতেই পারেনি আরশি এভাবে হুট করেই তার গাল ছুঁয়ে দিবে। আরশি নিজের বোকামি বুঝতে পেরে আরেক দফা লজ্জা পেল। আকাশসম লজ্কা নিয়েই দ্রুত রৌদ্রর গাল থেকে আঙুল সরিয়ে নিল। কয়েক কদম পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমতা-আমতা করে বলল-
“মানে আপনার গালের এই জায়গায় কালো হয়েছিল তাই দেখছিলাম। কিন্তু সামনে এসে বুঝলাম এটা টোল।”
রৌদ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আরশির অস্থিরতা দেখছে। আরশির রৌদ্রর কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল-
“আপনি এখানে এসেছেন কেন?”
রৌদ্র ছোট্ট করে উত্তর দিল।
“এমনি।”
“আচ্ছা তাহলে আমি যাই, আপনিও যান এখন।”
আরশি আর এক মুহুর্ত দেরি না করে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু তার আগেই রৌদ্রর ডাকে থমকে দাঁড়ালো।
“মিস আরু।”
আরশি পেছন ফিরে রৌদ্রর দিকে তাকালো। নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
“কিছু বলবেন??”
রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
“এভাবে হুটহাট করে একা বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা যেন আর কখনো না শুনি।”
“আপনি একথা কিভাবে জানলেন??”
আরশি কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো রৌদ্রকে। রৌদ্রর মুখের গম্ভীরতা আরও বারিয়ে বলল-
“আপনার ফ্রেন্ড কাসফিয়া আমাকে ফোন করেছিল। আমি আপনার সাথে কি না জানার জন্য।”
“ওহহ”
“আপনার ফোন কোথায়?? নিশ্চয়ই বাসায় ফেলে এসেছেন!! আজ কিছু বললাম না তবে নেক্সট টাইম যেন এমন বেখেয়ালিপোনা না দেখি। কথা গুলো মাথায় রাখবেন।”
রৌদ্রর এমন শক্ত গলা শুনে আরশি কিছু বলার সাহস পেল না। ভদ্র ভাবে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। রৌদ্র আরশির মাথায় হাত রেখে বললো-
“এখন যাও আর হ্যাঁ নিজের খেয়াল রেখো।”
রৌদ্রর আরশির মাথা থেকে হাত নামিয়ে নিতেই আরশি একটা মেকি হাসি দিয়ে বড়বড় পদক্ষেপ ফেলে চলে গেল। রৌদ্র আরশির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা মুচকি হাসি। আরশি তার ফ্রেন্ডদের কাছে এসে বসতেই নীল জিজ্ঞেস করল-
“কিরে এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে! আর কার সাথে কথা বলছিলি ওখানে??”
আরশি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-
“ডক্টর মানে চিঠির মানুষ আমার পাশের বারান্দা। আজ আর এসব নিয়ে কোনো কথা বলিস না। আমার এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
নীল কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সবাই এসব বাদ দিয়ে অন্য আড্ডায় মেতে উঠলো।
——————————
আরশি বিছানায় শুয়ে অস্থিরতায় এপাশ ওপাশ করছে একটু পর পর। দু’দিন ধরে মনে হচ্ছে ঘুম তার সাথে প্রচন্ড অভিমান করেই চলে গেছে। এখন আর ঘুম দু’চোখের পাতায় ধরা দিতে চাইছে না। চোখের পাতা বন্ধ করলেই যেন রৌদ্রর বলা কথা, রৌদ্রর মুচকি হাসি আর গালের সেই অদ্ভুত টোল বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এসবের প্রতি ভয়াবহ বিরক্তি নিয়েই আরশি উঠে বসলো। পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে টাইম দেখলো। রাত একটা বেজে দশ মিনিট। আরশি টাইম দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। ফোনটা ছুরে বিছানার মাঝে ফেলে দিল। এতো রাত হয়ে গেছে অথচ ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছে না আরশি। রাগে গজগজ করে ওয়াশরুমে চলে গেল। চোখেমুখে বেশ কিছুক্ষন পানির ছিটা দিয়ে রুমে চলে আসলো। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। বারান্দায় এসে সর্বপ্রথম নজর পরলো মেঝেতে পরে থাকা নীল চিরকুটের দিকে। খুব আগ্রহের সাথেই চিরকুটটা নিয়ে পড়া শুরু করলো।
প্রিয় রুদ্রাণী,
জানো তো লজ্জায় যখন তোমার হলদেটে গাল গুলো লালচে বর্নের হয়ে ওঠে তখন তোমাকে একদমই রুদ্রাণীর মতো দেখায়। আর যখন তোমার আঙুল দিয়ে আমার গাল ছুঁয়ে দিলে তখন মনে হলো সত্যিই রুদ্রাণী রেগেছে। ভয়ংকর রেগেছে। আমাকে তার তপ্ত দাহনে ঝলসে দেওয়ার মতো ক্রোধ তার মনে জায়গা করে নিয়েছে। হুটহাট করে লজ্জায় শেষ বিকেলের শান্ত-শীতল রোদ আর কখনো রাগান্বিত হয়ে দুপুরের উত্তপ্ত সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠো। রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণীর অনুভূতি গুলো মিছিল শুরু করে দিয়েছে। রুদ্রাণীর এই অনুভূতি গুলোর প্রধান কারন কি হতে পারে তোমার জানা আছে!!!
[বিঃদ্রঃ পাখিগুলো রুদ্রাণীকে বড্ড মিস করছে। রুদ্রাণীর দেখা না পেয়ে সব গুলো পাখি চুপচাপ হয়ে গেছে। আপনি নিজের লজ্জাবোধ মনের এক কোণে লুকিয়ে রাখুন। যাতে করে আগের মতো বারান্দায় এসে পাখিগুলোর সাথে সময় কাটাতে পারেন। আমার নামে যত অভিযোগ আছে তা শোনার জন্য তো তারাই আপনার একমাত্র সঙ্গী। তাই তো পাখিটা কতো সুন্দর করে “অসভ্য” বলা শিখেছে।]
ইতি,
রৌদ্র
চিরকুটটা পড়েই আরশির হার্টবিট কয়েকটা মিস হয়ে গেল। বেসামাল হয়ে পরেছে তার মনের সকল অনুভূতি গুলো। লজ্জায় মিয়িয়ে যাচ্ছে আরশি। এ কেমন অনুভূতি!! আগে তো কখনো এমন হয় নি। আরশি নিজেকে সামলাতে পারছে না। এই নীল চিরকুট আর তার মধ্যে লেখা প্রতিটি লাইন, প্রতিটি অক্ষর খুব করে তাকে কাছে টানছে। আরশি রেলিঙের উপর হাত রেখে আকাশে দিকে তাকিয়ে পর পর কয়েকবার শ্বাস নিল। নিস্তব্ধ এই শহরে নিজেকে এখন মুক্ত পাখির মতো লাগছে। মনের মধ্যে চলছে হাজারো প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কোনো প্রশ্নের উত্তরই আরশির জানা নেই।
——————————
ক্লাস শেষে বাহিরে আসতেই দেখলো রোদ্র দাঁড়িয়ে আছে। আরশি কাসফিয়াকে বলল-
“কাসফি তুই আদ্রাফের সাথে চলে যা। ডক্টর হয়তো আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবে।”
“আচ্ছা তুই গিয়ে দেখ কি বলে।”
আরশি রৌদ্রর কাছে আসতেই রৌদ্র শান্ত গলায় বললো-
“চলুন আমার সাথে।”
“কোথায়??”
“এখন থেকে আপনি আমার সাথেই আসা যাওয়া করবেন। বেশি কথা না বলে এখন চলুন।”
আরশি কিছু বলার আগেই নীল আরশির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। এভাবে আরশিকে হাত ধরে নিয়ে যেতে দেখে রৌদ্রর চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ সংযত করার চেষ্টা করছে। নীল আরশিকে অডিটোরিয়ামের কাছে নিয়ে আসলো। আরশিকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
“আশু তোর সাথে আমার ইম্পর্টেন্ট কথা আছে।”
আরশি খানিকটা বিরক্তি ভাব নিয়ে বলল-
“কি এমন ইম্পর্টেন্ট কথা যে তুই ডক্টরের সামনে থেকে আমাকে টেনে নিয়ে আসলি!! কি বলবি তাড়াতাড়ি বল দেরি হলে ডক্টর আবার আমাকে কথা শোনাবে।”
নীলের মুখের গম্ভীরতার রেশ আরও বেড়ে গেল। আরশির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।
চলবে….