#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩০
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“কিরে বল কি বলবি। কি এমন ইম্পর্টেন্ট কথা আছে তাড়াতাড়ি বল।”
নীল গম্ভীরতার সাথে আরশির দিকে তাকালো। বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে শক্ত গলায় বললো-
” আশু তুই আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবার খুব প্রিয়। আমাদের সকলেরই খুব ভালো ফ্রেন্ড তুই। আর আমি তোকে আমার অনেক কাছের একজন মানুষ মনে করি। কারন আমি তোকে কখনো নিলুর চেয়ে কম কিছু মনে করি নি। নিলু আমার কাছে যতটা ইম্পর্টেন্ট ঠিক ততটাই তুই আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট। আমি চাই না তোর কোন ক্ষতি হোক। তাই যা করবি ভেবেচিন্তে করিস। এখন হয়তো মনে মনে তোর প্রশ্ন জাগবে যে আমি আমার নিজের বোনেরই খেয়াল রাখি না তাহলে তোর উপর কেন এতো শাসন করছি!! যদি এমন প্রশ্ন তোর মনে আসে তাহলে শুনে রাখ আমি নিলুর ব্যাপারে সব কিছুই জানি। নিলু কাকে ভালোবাসে, কখন কান্না করে, কখন ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েও হাসিমুখে ঘুরে বেড়ায় সবই আমি জানি। তবে কিছু বলিনা। কারন আমি জানি নিলুর সাথে আদ্রাফকে নিয়ে কথা বললে নিলু খুব বিব্রতবোধ করবে। তাই সব কিছু জেনেও চুপ করে আছি। কিন্তু আমি চাই না নিলুর মতো তুইও কষ্ট পাস। নিলুর মতো তুইও একা একা কান্না কর সেটা আমি চাই না। তাই আগে থেকেই সতর্ক করে দিচ্ছি।”
আরশি নীলের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে নীলের মুখে এমন কঠোর ভাবে কথা বলে শুনে। আরশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নীলের দিকে। নীলের মতো দুষ্টু সব সময় হাসিঠাট্টায় মেতে থাকা ছেলেটার ভিতর এতো দায়িত্ববোধ!!! আরশি সন্দিহান কন্ঠে বলল-
“তুই এতো শাসন করা আর বোনদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা কবে থেকে শিখলি নীল??”
“নিলুর কষ্ট দেখে।”
নীল আরশির কাধে হাত রেখে শান্ত গলায় আবারও বললো-
“নিলুর কষ্ট দেখেছি এখন আবার তোর কষ্ট দেখতে পারবো না। আদ্রাফকে কিছু বলিনি কারণ নিলুর কষ্টের পেছনে ওর কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু তোর ওই চিঠির মানুষের জন্য যদি কখনো তোকে একটুও কষ্ট পেতে দেখি তাহলে ভাবিস না উনি আমাদের বড় বলে ওনাকে আমি ছেড়ে দিব। আমি সব সময় চেয়েছি তোকে আর নিলুকে ভালো রাখতে কিন্তু আমি পরপর দু বার ব্যর্থ হয়েছি। তোকে আমি ওই নরপশুর কাছ থেকে রক্ষা করতে পারিনি আর নিলুকে ওর ভালোবাসার মানুষ এনে দিতে পারিনি। আমার এই ব্যর্থতা আমাকে ভিতর ভিতর কুড়ে খাচ্ছে আশু। একজন ভাই হয়েও আমি কিছু করতে পারলাম না। জানিস তোদের বাসা থেকে আসার সময় আংকেল আন্টি আমার হাত ধরে বলেছিল আমি যেন তোর খেয়াল রাখি। আমি সেদিন খুব বুক ফুলিয়ে বলেছিলাম আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তোর খেয়াল রাখবো। তাই তোকে সতর্ক করে দিচ্ছে। ওই লোক যদি তোর সাথে কোনো প্রকার খারাপ ব্যবহার করে তাহলে তুই সবার আগে আমাকে জানাবি। আর আমার কাছ থেকে যদি কোনো কিছু লুকিয়ে রাখিস তাহলে একটা থাপ্পড়ও মাটিতে পরবে না মনে রাখিস।”
আরশি ঘাড় বাকিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে গোমড়া মুখে বলল-
“ইশশ আসছে আমাকে হুমকি দিতে!! তোর সাহস কি করে আমাকে এভাবে হুমকি দেওয়ার?? আমার আপন ভাই থাকলেও হয়তো এতো কড়া শাসন করতো না। তুই নিজের চেহারাটা দেখেছিস একবার!! তুই নিজেই একটা বাচ্চা পোলাপান তুই আবার আমাকে শাসন করিস কিভাবে??”
নীল রাগান্বিত চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠে বলল-
“আরেকটা ফালতু কথা বলবি তো এক থাপ্পড় খাবি। চুপ থাক বেয়াদব মাইয়া।”
রৌদ্র আরশিকে খুঁজতে খুঁজতে অডিটোরিয়ামের দিকে এসে পরেছে। নীল আর আরশির সব কথাই রৌদ্র আড়াল থেকে শুনে ফেলেছে। নীলের কথা গুলো শুনে রৌদ্রর মুখে আপনা আপনিই হাসি ফুটে উঠলো৷ রৌদ্র ওদের দিকে এগিয়ে না গিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে ওখান থেকেই চলে আসলো। আরশি নীলের সাথে কথা বলে রৌদ্রর কাছে ফিরে আসলো৷ হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মতো ফোনে কথা বলছে রৌদ্র। আরশি সরু চোখে রৌদ্রর কথা বলার ভঙ্গিমা পরোক্ষ করছে। রৌদ্র আরশিকে দেখে চোখের ইশারা সাথে আসতে বলেই হাঁটা শুরু করলো। আরশিও রৌদ্রর পেছন পেছন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। ভার্সিটি থেকে বের হতেই রৌদ্র কানের কাছ থেকে ফোন নামিয়ে পকেটে রেখে দিল। আরশির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল-
“তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠুন আমাকে এখনই হসপিটালে যেতে হবে।”
“তাহলে আমি কেন যাবো আপনার সাথে??”
“আপনিও আমার সাথেই হসপিটালে যাবেন। আমি আমার কাজ শেষ করেই আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিব। ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমার কেবিনে বসে অপেক্ষা করবেন। এখন আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে বসুন।”
আরশি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে বসে পরলো।
—————————
“কাসফি তোর কাছে ঐ ডক্টরের ফোন নাম্বার আছে??”
“হ্যাঁ আছে কিন্তু তুই কি করবি??”
কাসফিয়া কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো। নীল নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিল-
“ডক্টরের ব্যাপারটা আমার বেশ সুবিধার মনে হচ্ছে না। তাই ওনার সাথে দেখা করবো।”
কাসফিয়া ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন ভাবলো। চিন্তিত গলায় বললো-
“আমারও কেমন যেন লাগছে। মানে উনি কখনো বাবা হতে পারবে না বলেই কি আশুর সব কথা জেনেও মেনে নিয়েছে না-কি সত্যি সত্যিই আশুকে পছন্দ করে তাই মেনে নিয়েছে!! এই ব্যাপারটাই বুঝতে পারছি না আমি।”
নীল গম্ভীর গলায় বললো-
“হুম সেটা জানতেই দেখা করবো ওই লোকের সাথে। তুই আরশিকে এসব নিয়ে কিছু বলিস না।”
“চিন্তা করিস না আমি আশুকে কিছু বলবো না তবে তোর সাথে আমিও যাবো।”
নীল ভ্রু বাঁকিয়ে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-
“তুই গিয়ে কি করবি!!”
“কি করবো মানে কি!! আশু একটা মানুষের প্রতি দিন দিন দুর্বল হয়ে পরছে আর আমি সেই মানুষটার সম্পর্কে সব কিছু জানবো এটাই তো স্বাভাবিক। ডাক্তারের ব্যাপারটা এতদিন স্বাভাবিক মনে হলেও এখন আমার কেন যেন কিছুটা খটকা লাগছে। তাই আমি নিজে ওনার সাথে কথা বলতে চাই আশুকে নিয়ে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুই নিজেই ওনাকে ফোন করে বলিস কাল দেখা করতে। এখন আমি যাই নিলু হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“ওকে যা।”
নীল বেঞ্চি থেকে উঠে দ্রুত পায়ে চলে গেল। কাসফিয়া চুপচাপ বসে আছে একা একা। আদ্রাফ কিছু একটা কাজের জন্য স্যারের সাথে কথা বলতে গেছে তাই বসে বসে আদ্রাফের জন্য অপেক্ষা করছে।
——————————
প্রায় পনেরো মিনিট ধরে রৌদ্রর কেবিনে অপেক্ষা আরশি। রৌদ্র সেই যে পনেরো মিনিট আগে আরশিকে বসিয়ে দিয়ে গেছে এখনো তার আসার কোনো নামগন্ধ নেই। আরশিকে রৌদ্র নিজের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে আরশি এখনো সেইভাবেই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। খানিকটা সময় পর রৌদ্র কেবিনে এসে আরশির সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
“সরি একটু দেরি হয়ে গেল। আপনি নিশ্চয়ই বোর….”
“ভাইইইই এটা তোমার পাশের বারান্দার মেয়ে না??”
আচমকা নির্বানের কথা শুনে আরশি আর রৌদ্র দুজনেই চমকে উঠলো। আরশি জড়োসড়ো হয়ে মাথায় নিচু করে ফেলল। অভ্যাসগত ভাবেই অস্বস্তিতে হাত কচলাতে লাগলো। রৌদ্র কিছু বলার আগেই নির্বান কেবিনের দরজা থেকে এগিয়ে আসলো। প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়েই আবার বলল-
“কি হলো কিছু বলছো না কেন!! উনি তোমার চেয়ারে বসে আছে কেন??”
রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো-
“তোর এতো কিছু না জানলেও চলবে।”
নির্বান সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষন আরশি আর রৌদ্রকে দেখে বলল-
“ভাই!!! তোমরা নিশ্চয়ই প্রেম করছো তাই না!! আর এই কারনেই তুমি একা একা হাসতে, অদ্ভুত আচরণ করতে!! আমাকে আগে বললে না কেন?? তুমি এটা ঠিক করলে না ভাই।”
নির্বানের কথায় আরশি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। নির্বান আবারও হতাশ হয়ে বলল-
“ইশশ ভাই তুমি জানো আমি প্রথম দেখেই ওনার উপর ক্রাশ খেয়েছিলা। আর তুমি শেষে কি-না আমার ক্রাশের সাথেই প্রেম শুরু করলে?? ভাই তোমার কি একটুও কষ্ট লাগলো না তোমার ছোট্ট ভাইয়ের এই ছোট্ট একটা ক্রাশকে চুরি করতে!! আর এই যে কি যেন নাম আপনার বলেছিলেন!! আরশি?? তুমি এটা একদমই ঠিক করলে না। চিঠি আমি লিখে দিলাম কিন্তু আমার প্রেমে না পরে তুমি আমার এই গম্ভীর ভাইয়ের প্রেমে পরলে কিভাবে??”
নির্বানের কথা শুনে আরশির জান যায় যায় অবস্থা। এই ছেলে ইচ্ছে করেই তাকে লজ্জায় ফেলছে সেটা আরশির আর বুঝতে বাকি রইলো না। রৌদ্র নির্বানের পিঠে জোরে একটা চাপড় মেরে বলল-
“নির্বান দুষ্টামি বন্ধ কর। নাহলে এক্ষুনি মামার কাছে ফোন করে বিচার দিব।”
“হুহ্ তুমি কি বিচার দিবে!! আমি নিজেই আরশির শাশুড়ীকে ফোন করে সব কিছু বলে দিব।”
রৌদ্র নির্বানের কান ধরে টান দিতেই নির্বান চেচিয়ে বলে উঠলো-
“আরে ভাই ব্যথা পাচ্ছি তো। ছাড়ো প্লিজ। আচ্ছা আর কিছু বলবো না।”
রৌদ্র নির্বানের কান ছেড়ে দিয়ে বলল-
“আবার এসব আজেবাজে কথা বলা শুরু করলে তোর কপালে মাইর আছে।”
নির্বান মিনমিনিয়ে বলল-
“আমি তো আমার ভাবির সাথে একটু মজা করছিলাম। উনি যে কি পরিমান লজ্জা পায় তা তো আমি প্রথম দিন বুঝে গিয়েছিলাম। ওইদিন লজ্জায় তাড়াহুড়ো করে আমার সামনে থেকে পালিয়ে গিয়েছিল তাই আজ একটু সুযোগ পেয়েছি তার লজ্জা কাটানোর। দেখো ভাই এখনো কিভাবে লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে। ভাই তুমি কি সত্যিই এই বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রেম করো না কি!!!”
নির্বানের কথা শুনে আরশির মনে হচ্ছে এখানে আসাই তার জীবনের বড় ভুল। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হবে জানলে কখনই এখানে আসতো না। আরশি লজ্জায় মাথা নুয়ে রেখেছে। আর হাত কচলাতে কচলাতে হাত লাল করে ফেলেছে। রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে আরশির এমন অবস্থা দেখে নির্বানকে ধমকের স্বরে বললো-
“নির্বান চুপ কর তো। আর মিস আরু আপনি তো মনে হচ্ছে এখনই হাতের চামড়া উঠিয়ে ফেলবেন মনে হচ্ছে।”
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩১
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“এই যে পাশের বারান্দা তুমি এতো লজ্জা পাও কেন?? লজ্জায় তো তুমি লাল টমেটো হয়ে যাচ্ছো।”
নির্বানের কথায় আরশির লজ্জা আর অস্বস্তির পরিমাণ যেন দফায় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। রৌদ্র এবার কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠেই বলল-
“নির্বান এভাবে কাউকে বিব্রত করা ঠিক না। তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস তবু্ও কেন অবুঝের মতো করছিস!!”
নির্বান এবার থেমে গেল। স্বাভাবিক হয়ে শালীন কন্ঠে বললো-
“আচ্ছা সরি। আচ্ছা পাশের বারান্দা এখানে কি করছে??”
রৌদ্র গম্ভীরমুখে বলল-
“তোর এতো কিছু জানতে হবে না। তুই এখানে কেন এসেছিস তা বল।”
নির্বান শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে আরশির বরাবর চেয়ারটায় বসে পড়লো। পায়ের উপর পা তুলে বেশ ভাব নিয়ে বলল-
“পাশের বারান্দা এখানে তাই হয়তো চলে এসেছি মনের টানে। কেমন আছো পাশের বারান্দা??”
আরশি এতোক্ষনে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও নির্বানের কথায় ভ্রু কুচকে ফেললো। সংকুচিত হয়ে বলল-
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু বার বার আমাকে পাশের বারান্দা বলছেন কেন?”
রৌদ্র নির্বানের পাশের চেয়ারে গাঁ এলিয়ে বসে পরল। নির্বানের উত্তর দেওয়ার আগেই রৌদ্র শান্ত গলায় বললো-
“কারন আপনি পাশের বারান্দায় থাকেন। এই সহজ ব্যাপারটাও বুঝতে পারছেনা আপনি!”
আরশি রৌদ্রর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-
“তা খুব করেই বুঝতে পারছি তবে পাশের বারান্দায় থাকি বলে কি আমাকে পাশের বারান্দা বলে ডাকবে না-কি অদ্ভুত!!”
নির্বার সোজা হয়ে টেবিলের উপর হাত রেখে আরশির দিকে সরু চোখে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“তোমার সাথে নামটা খুব মানায় তাই ডাকি। কিন্তু তুমি তো দেখছি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের মুড চেঞ্জ করে ফেল। কিছুক্ষণ আগে লজ্জায় লাল হচ্ছিলে আর এখন রাগে লাল হচ্ছো। তোমার রূপ পরিবর্তন দেখে আমি তো আবার ক্রাশ খেলাম তোমার উপর।”
আরশি বিষম খেল। কাশতে কাশতে নির্বানের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। নির্বানের মুখে দুষ্টু হাসি লেগে আছে। আরশি মনে মনে বলল- “এই ছেলে তো নীলের থেকেও বড় বদেরহাড্ডি। বার বার আমাকে কিভাবে লজ্জা দিচ্ছে। বড় ভাইয়ের সামনে এসব বলতে কি একটুও লজ্জা করছে না এই ছেলের??”
“এইইইই পাশের বারান্দা কি এতো ভাবছো??”
নির্বানের আর্কষণ কাড়া ডাকে আরশির ধ্যান ভাঙলো। আরশি নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো-
“নাহ কিছু না। ডক্টর আমি বাসায় যাবো।”
আরশি লাস্টের কথাটা রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল-
রৌদ্র আরশির কথায় কোনো প্রতিত্তোর দিল না। নির্বানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“আজ হঠাৎ করে তুই এখানে আসলি কি মনে করে?? মামি পাঠিয়েছে না-কি!!”
“এমনি ইচ্ছে হলো তোমার সাথে দেখা করতে তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।”
“আচ্ছা তাহলে বাসায় চল। আজ আমার সাথেই না হয় থাকবি।”
নির্বান একটা দুষ্টু হাসি দিল৷ আড়চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-
“হুম ভালোই হবে। রাতে আমরা সবাই মিলে পাশাপাশি বারান্দায় থেকে আড্ডা দিব। বাই চান্স ক্রাশের নতুন কোনো রূপ থাকলে সেটাও দেখে ফেলতে পারবো।”
রৌদ্র চোখ গরম করে নির্বানের তাকালেই নির্বান চুপসে যায়। আরশি চুপচাপ ওদের দুজনের কথা শুনছে। নিজেকে এখন সমুদ্রে ডুবন্ত থাকা এক মানুষের মতো মনে হচ্ছে। অস্বস্তির সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে আরশি। এই দু’জন মানুষের কাছ থেকে দূরে গেলেই হয়তো স্বস্তির শ্বাস নিবে।
“আচ্ছা মিস আরু চলুন এখন। নির্বান তুইও চল।”
আরশি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। নির্বান কিছুটা অবাক হয়ে সন্দেহের গলায় বললো-
“ছিঃ ভাই তুমি এখনো পাশের বারান্দাকে আপনি করে বলছো!! এভাবে কথা বললে প্রেম হবে কিভাবে!!! তোমাকে আমি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি যে এতো বোকা তা তো জানতাম না।”
আরশি বিস্ফোরিত চোখে নির্বানের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রৌদ্র দিকে তাকালো। রৌদ্র দাঁড়িয়ে ডান হাতে নিজের চুল গুলো ঠিক করে বলল-
“কিছু কিছু জিনিস সবার থেকে আলাদা অন্যরকম থাকাই খুব ভালো। সাধারণের চেয়ে অসাধারণ কিছুই মানুষের মনে গভীরভাবে জায়গায় করে নেয়।”
আরশি কিছু বুঝতে না পেরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নির্বান প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে রৌদ্রর কাধ জড়িয়ে ধরে কানে কানে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
“ভাই তুমি সত্যিই পাশের বারান্দাকে পছন্দ কর??”
রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“বাসায় চল তারপর সব জানতে পারবি।”
রৌদ্র আর নির্বান একসাথে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আরশিও তাদের পেছন পেছন চুপচাপ যাচ্ছে। গাড়িতে সারা রাস্তা কেউ কোনো কথা বলেনি। নির্বান তার মুখ খুললেই রৌদ্রর রামধমক খেয়ে আবার চুপ হয়ে যায়। বাসায় পৌঁছানোর সাথে সাথেই আরশি কোনো কথা না বলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায়। নির্বান জানালা দিয়ে মাথা বের করে খানিকটা চেচিয়ে বলল-
“ভাবি রাতে কিন্তু বারান্দায় আড্ডা দিব। মনে থাকে যেন।”
আরশি নির্বানের দিকে একপলক তাকিয়ে বাসায় চলে যায়। রৌদ্রর কল আসায় কিছুক্ষণ কথা বলার পর বলল-
“কাল একটু ব্যস্ত আছি। তবে আপনারা চাইলে আজ বিকেলেই দেখা করতে পারি।”
অপরপ্রান্তের মানুষটার সাথে কিছুক্ষন কথা বলেই রৌদ্র ফোন কেটে দিল। নির্বান কিছুটা নিরাশ৷ হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কোথায় যাবা ভাই? আমি কি একা একা থাকবো নাকি তোমার বাসায়??”
রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো-
“বেশিক্ষণ না এক দেড় ঘন্টার জন্য যাবো।”
—————————
ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে বসে আছে রৌদ্র। তার ঠিক সামনের দুই চেয়ারে বসে আছে নীল আর কাসফিয়া। নীলের চোখমুখ শক্ত। মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ স্পষ্ট। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে রৌদ্রর দিকে। কাসফিয়া জোড়ালো শ্বাস ফেলে একবার নীলের গম্ভীরতা পরক্ষ করছে আবার রৌদ্রর হাসিমুখের দিকে তাকাচ্ছে। এই প্রথম রৌদ্রর হাসি দেখে কাসফিয়া কিছুটা অবাক হলো৷ তবে অবাকের চেয়ে বিরক্তির পরিমান দ্বিগুণ। এই মুহূর্তে রৌদ্রর এই মুচকি হাসিটাই হয়তো নীলের গম্ভীরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কাসফিয়া একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল-
” আসলেই আপনার সাথে আমাদের কিছু কথা ছিল।”
রৌদ্র শান্ত গলায় বললো-
“হুম তা শোনার জন্যই তো আমার এখানে আসা। বলো কি বলবে তোমরা।”
নীল টেবিলের উপর দু’হাত উঠিয়ে গম্ভীরতার সাথে জিজ্ঞেস করল-
“আপনি আশুকে পছন্দ করেন আর বিয়ে করতে চান কথাটা কি সত্যি??”
রৌদ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। মুখে গম্ভীরতা এনে বলল-
“নাহ কথাটা পুরোপুরি সত্যি না।”
নীল আর কাসফিয়া চমকালো। দুজনের চোখে কৌতুহলের তারা খেলে গেল। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল নীল।
“তাহলে সত্যি কোনটা??”
রৌদ্র নীলের দিকে তাকালো। দুহাত ভাজ করে শীতল কন্ঠে বললো-
“আমি আরুকে শুধু পছন্দ করি আর বিয়ে করতে চাই কথাটা এমন না। আমি আরুকে ভালোবাসি প্রচন্ড ভালোবাসি। আর বিয়ে করে সারাজীবন আরুকে আগলে রাখতে চাই।”
রৌদ্রর এমন ভ্রুক্ষেপহীন কথা শুনে কাসফিয়া কিছুটা লজ্জা পেল। নীলের মাঝেও পরিবর্তন হলো। গাম্ভীর্যের ছাপ মুছে গিয়ে এখন শান্ত শীতল চাহনিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ ছাড়াই আরশিকে ভালোবাসার কথা বলেছে তা শুনে কিছুটা মুগ্ধ হলো নীল। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে গম্ভীরতা এনে জিজ্ঞেস করল-
“সত্যিই আশুকে ভালোবাসেন না-কি আপনার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই বলেই আশুকে বেছে নিয়েছেন!! আজ থেকে একটা কথা মাথায় ভালো করে গেঁথে রাখুন। আশু হয়তো নিজেকে ব্যর্থ বলে দাবি করে তবে ব্যাপারটা এমন না। তাই আশুকে ব্যর্থ মনে করে যদি ভেবে থাকেন আপনি আশুকে দয়া করবেন তাহলে এটা কখনো আমরা কেউ মেনে নিব না।”
নীলের কথায় রৌদ্রর চোখ রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। দু হাত মুষ্টি বদ্ধ করে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ সংযত করার চেষ্টা করলো। নীল আর কাসফিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। দু’জনেই রৌদ্রর উত্তরের অপেক্ষা করছে। রৌদ্রর নিজের ঠোঁটে এক কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বলল-
“প্রথমত, আরু আমার ভালোবাসা, কোনো পন্য দ্রব্য নয় যে আমি ওকে আমি বেছে নিব। আরু আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। আমার একমাত্র ভালোবাসা আরু। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেতে চাই বেছে নিতে চাই না। দ্বিতীয়ত, আমি আরুকে কখনো ব্যর্থ মনে করিনি। আমি আরুকে ভালোবেসে আপন করতে চাই দয়া করে না। তোমরা দু’জন নিশ্চয়ই আরুকে অনেক ভালোবাস তা-ই না!!”
নীল আর কাসফিয়া মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো।
“তোমরা যদি সত্যিই আরুর ভালো চাও তাহলে আমি এখন যা বলবো তা কখনো তোমরা আরুর কে বলতে পারবে না। কি!! রাজি তো আমার কথায়!!”
কাসফিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে নীলের দিকে তাকালো। নীল চোখের ইশারায় সম্মতি জানাতেই কাসফিয়া নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
“কি কথা বলুন।”
রৌদ্র পেছনের দিকে হেলান দিয়ে কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল-
“আমি আরুর সমস্যাটা নিয়ে ডক্টরের সাথে অনেক আগেই কথা বলেছিলাম। ডক্টর বলেছে আরুর তেমন কোনো প্রব্লেম নেই হরমোনের প্রব্লেম আছে আর সেই কারনেই হয়তো গর্ভধারণের ক্ষমতা একটু কম। তবে আরুর মা হওয়ার চান্স আছে হয়তো রিক্স আছে কিন্তু চিকিৎসা করলে সেটা ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা-ই বেশি। আর আমি যতটুকু বুঝলাম আরু ভেবেই নিয়েছে ও কখনো মা হতে পারবে না। নিজেকে সবার কাছে ব্যর্থ বলে দাবি করছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এই সুন্দর জীবন থেকে। শুধু মাত্র ভবিষ্যতে মা হতে না পারলে আশে পাশের মানুষ কষ্ট পাবে, সমাজের মানুষ তিক্ত কথা বলবে সেই ভয়ে।”
রৌদ্র থেমে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের উপর থাকা কফির মগে এক চুমুক দিয়ে নীলের দিকে তাকালো। দুজনের চোখে প্রচন্ড আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষা করছে রৌদ্রর কথা বলার জন্য।
“আমি যখন আরুকে বিয়ের কথা বলি তখন আমাকেও এইসব নানানরকম কথা বলে বিয়ের জন্য না করে দিয়েছিল। তবে কিছুটা সময় চুপ থেকে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েই কথাটা বলেছিল। আর আমি তখনই বুঝে গেছি আরু নিজের মনে একটু হলেও আমাকে জায়গা দিয়েছে। আর এইজন্যই আমাকে প্রত্যাখ্যান করার আগে নিজের মনকে প্রত্যাখ্যান করেছে আমার প্রতি কোনো প্রকার অনুভূতি অনুভব করতে। আরুর চুপ থাকার মধ্যেও অজস্র কথা লুকিয়ে থাকে সেটা আমি বুঝতে পারি। অনুভব করতে পারি আরুর চুপ থাকা। আর আমাদের দুজনের ভালোর জন্যই আমি আরুকে ঠকাচ্ছি।”
নীল অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“ঠকাচ্ছেন মানে?? কিভাবে ঠকাচ্ছেন আশুকে!!”
চলবে….