রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৩৮+৩৯

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat

প্রিয় রুদ্রাণী,
প্রিয় ভালোবাসার বউ,

শুধু শুধু এতো রাগ করছো কেন রুদ্রাণী? রাগলে যে তোমার নাক লাল টমেটোর মতো হয়ে যায় জানো! একদম পুরো রুদ্রাণীর মতো রাগে জ্বলজ্বল করে উঠো। আমি তো তোমার এইরকম রূপ দেখে বার বার তোমার ভালোবাসায় পরে যাই। কখনো লজ্জায় লাল হয়ে যাও আবার কখনো রাগে লাল হয়ে যাও। আমার মনে হয় তুমি ইচ্ছে করেই এমন রুদ্রাণীর রূপ ধারন করো যেন রুদ্রাণীর উত্তাপে এই নিরীহ রৌদ্রকে জলসে দিতে পারো। ঠিক বলেছি না!

[বিঃদ্রঃ ভেবো না ভুলে দুবার প্রিয় লিখেছি। সত্যি বলতে তোমাকে কি বলে সম্মোধন করবো সেটা নিয়ে আমি খুবই কনফিউজড। তাই বেশি না ভেবে দুইবার প্রিয় লিখলাম। রুদ্রাণী নামটা আমার ভালোবাসার তাই এটা বাদ দিতে পারছি না। আর ভালোবাসার বউ লিখেছি তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে কিছুক্ষণ পরেই তুমি আমার বউ হবে। যেন-তেন বউ না এক্কেবারে খাঁটি ভালোবাসার বউ। লাল টকটকে রুদ্রাণী বউ হাহাহ..]

ইতি
তোমার হবু জামাই(রৌদ্র)

রৌদ্রর দেওয়া চিরকুট পড়ে আরশি আনমনেই হেসে দিল। সব রাগ অভিমান নিমিষেই হারিয়ে গেল ভালো লাগার ভিড়ে। রৌদ্রর চিঠি পড়ে আরশির মন সব সময়ই ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। আরশি চিঠির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ডক্টর রোদ ঠিকই বলে চিঠির মধ্যে আলাদা এক অনুভূতি আছে যা মুখের কথায় কখনো অনুভব করা যায় না। এই লোকটার চিঠি পড়ে তার উপর রেগে থাকা বড়ই দায়। অসভ্য লোকটার জন্য ঠিক মতো রাগ করেও থাকতে পারি না। হুহ আস্ত এক অসভ্য ডাক্তার।

“এই আশু কোথায় হারিয়ে গেলি! এভাবে মুচকি মুচকি হাসছিস কেন?”

কাসফিয়ার চেচিয়ে বলা কথায় আরশির হুশ ফিরলো। অপ্রস্তুত হয়ে অগোছালো ভাবে বললো-

“কই না তো কিছু না।”

কাসফিয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে আরশির দিকে চেয়ে বলল-

“চিঠিতে কি লেখা আছে যে মুহুর্তেই তোর রাগ চলে গেল?”

আরশি হকচকিয়ে চিঠিটা দ্রুত হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরলো। একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল-

“না না কিছু না। এমনিতেই রাগ কমে গেছে।”

কাসফিয়া কিছু বলার আগেই আদ্রাফ দরজার কাছে এসে বলল-

“কাসফি একটু এদিকে আয় তো।”

আদ্রাফের কন্ঠ শুনে নীলা দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কাসফিয়া আদ্রাফের সামনে আসতেই আদ্রাফ তাড়া দিয়ে বলল-

“কাসফি আমার সাথে একটু চল তো। আমার জামাকাপড়ের ব্যাগ তোদের বাসায় রাখা। ব্যাগটা নিয়ে আসতে হবে তাড়াতাড়ি চল।”

কথা গুলো বলেই আদ্রাফ কাসফিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। নীলা তাদের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে চোখমুখ শক্ত করে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আদ্রাফ আর কাসফিয়াকে এখন একসাথে দেখলে আগের মতো চোখ ভিজে আসে না। বরং চোখে কঠোরতা ফুটে ওঠে। চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। আরশি নীলার দিকে শান্ত চোখে চেয়ে আছে। মেয়েটা আগের মতো নেই। অল্পতেই আবেগী হয়ে পরা মেয়েটা এখন নিজের সকল অনুভূতি, আবেগ আর কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে শিখে গেছে। এখন আর চোখের মধ্যে পানি টলমল করছে না। কান্না করতে করতে হয়তো চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।

“নিলু তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। এখানে আমার কাছে এসে বস।”

নীলা চুপচাপ গম্ভীরমুখে আরশির পাশে এসে বসলো। আরশির দিকে তাকিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে জিজ্ঞেস করল-

“কি বলবি আশু? তাড়াতাড়ি বল।”

আরশি নীলার গম্ভীরমুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। হাতের কাগজটা দিকে নজর দিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“তুই যে দিন দিন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিস সেটা কি তুই বুঝতে পারছিস!”

“শোন আশু তুই যদি এখন ওই লোকের তরফ দারি করিস তাহলে আগেই বলে রাখি ওনার কথা আমার একদমই সহ্য হয়। প্রথম দিনই আমার সাথে কতো বাজে ভাবে ব্যবহার করেছে তুই জানিস! আমি তো ওনাকে চিনিই না তবুও কেন আমার সাথে এমন ব্যবহার করেছেন! আমি তো ওনার সাথে যেচে কথা বলতে চাইনি। উনি নিজেই তো আমার সাথে ধমকে কথা বলা শুরু করেছিলেন।”

” আমি এসবের কথা বলছি না নিলু। তুই কিছুদিন খুব গম্ভীর হয়ে থাকিস, কথা কম বলিস আর অল্পতেই রেগে যাস৷ তুই তো আগে এমন ছিলি না নিলু। আমি তো তোকে বলেছি তোর কোনো কথা থাকলে আমার সাথে শেয়ার করবি। তোর কষ্ট হলে আমাকে বলবি। হয়তো আমি তোর কষ্ট দূর করতে পারবো না কিন্তু তোর মন থেকে কষ্টে বোঝা একটু হলেও তো কমবে তাই না!”

নীলা কিছুটা সময় চুপ থেকে মাথা নিচু করে জড়ানো কন্ঠে বললো-

“আমি আর পারছি না আশু। প্রতিনিয়ত ভালো থাকার অভিনয় আমি করতে পারছি না। আমি সব মেনে নিয়েছি। আদ্রাফ আমার না আর কখনো আমার হবেও না আমি জানি। কাসফিয়া আর আদ্রাফ একে অপরকে ভালোবাসে। আদ্রাফের ভালোবাসা আমার জন্য না এটাও আমি জানি। সব মেনে নিয়েছি আমি সব। এসব কিছু নেমে নিয়ে এখন আমি আর আগের মতো থাকতে পারছি না। আর না পারছি হাসি খুশি থাকার অভিনয় করতে।”

নীলার কন্ঠস্বর আটকে আসছে কথা গুলো বলার সময়। শরীরর কেঁপে উঠছে তার। চোখ দুটো লাল আকার ধরন করছে। তবুও চোখে পানির ঝলক দেখা যাচ্ছে না। আরশি নীলার কাধে হাত রেখে নরম গলায় বললো-

“আমি তোকে অভিনয় করতে বলছি না নিলু। তবে তোর এটা খেয়াল রাখতে হবে তোর ব্যবহারে যেন কেউ কষ্ট না পায়। তোর রাগ বা মন খারাপ দেখে যেন অন্য কারও মন খারাপ না হয়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ আমরা অনেকেই তোকে নিয়ে চিন্তিত। আমরাও তোকে ভালোবাসি। এখন তুই যদি একজনের ভালোবাসা না পেয়ে আমাদের সবাইকে দূরে ঢেলে দিস এটা কি ঠিক হবে? একজনের জন্য কি তুই আশেপাশের সবার ভালোবাসাকে ইগ্নোর করবি নিলু? এটা কি আমাদের প্রতি প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে না নিলু!!”

নীলা চুপ করে আছে। তার মাথা পুরো এলোমেলো লাগছে। আমার এখন কি করা উচিত আর কি করা উচিত না কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু আশুর বলা কথা গুলো একদমই ঠিক। আমি তো সত্যিই তাদের সাথে অন্যায় করছি। নীলা চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নিল। মুখে হাল্কা হাসির রেখা টেনে বলল-

“আমি চেষ্টা করবো আশু। নিজেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। আমি চাই না আমার জন্য তোরা সবাই মন খারাপ করে থাক।”

আরশি একটা মুচকি হাসি দিয়ে নীলাকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো। নীলা দুষ্টুমি করে আরশির হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিতে চাইলেই আরশি দ্রুত চিঠিটা দূর সরিয়ে ফেলে। নীলা সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-

“চিঠিতে কি লেখা আছে রে আশু? আমাকে দেখাতে চাচ্ছিস না কেন!”

আরশি নীলার হাতে চাপড় মেরে বলল-

“তোর মাথা আছে গাধী।”

নীলা দু হাত আড়াআড়ি ভাজ করে নাক ফুলিয়ে বলল-

“আমি গাধী না তুই গাধী।”

আরশি হেসে দিল। তার সাথে তাল মিলিয়ে নীলাও হাসলো।

—————————

“এই যে ভাইয়া একটু এদিকে আসুন তো। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

নীলার কথা শুনে নির্বান ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো। নীলার মুখে এমন মিষ্টি মধুর সুরেলা ডাকে তার প্রচুর সন্দেহ হচ্ছে। এই মেয়ের সাথে তো তার কখনো এতো সুন্দর করে কথা হয়নি। নির্বানকে কপাল কুচকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলা আবারও নম্র কন্ঠে বলল-

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? এদিকে আসুন কথা আছে আপনার সাথে।”

নির্বান তার ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসলো৷ বারান্দায় নীলার দিকে এগিয়ে গেল। নীলা নিচে বাগানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বিনয়ের সাথে বলতে লাগল-

“আসলে আপনাকে সরি বলার ছিল। কিছুদিন দিন ধরে আমার মন মেজাজ কিছুটা বিগড়ে ছিল তাই আপনার সাথে নিজের অজান্তেই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি।”

“মন খারাপ কেন? ব্রেকআপ হয়েছে বুঝি!”

নীলার কথার মাঝে নির্বান হুট করেই প্রশ্ন করে বসলো। নীলা নির্বানের দিকে একঝলক তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে ফেললো। কিছুটা সময় চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো-

“নাহ তেমন কিছু না। যাইহোক আবারও সরি। আপনি আমার থেকে বড় তার উপর আবার এ বাসার মেহমান। আপনার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করা আমার একদমই ঠিক হয়নি। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ভুলবশত আপনার মনে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করবেন।”

নির্বান হতবাক হয়ে গেছে। বিস্মিত চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে। নীলার মুখটা মলিন হয়ে আছে। বড্ড বেমানান লাগছে নীলার এই মলিন চেহারাটা। নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মৃদু বাতাসে চুল গুলো সামনের দিকে এসে পড়ছে আর তার সাথেই নীলার মুখে বিরক্তির রেশ ফুটে উঠছে।

“বার বার সরি বলতে হবে না তোমাকে। আমি কিছু মনে করিনি। ওইদিন আমারই ভুল ছিল ব্যস্ততার জন্য শুধু শুধুই তোমার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলাম। আর এখন তো আমরা বেয়াই-বেয়াইন হতে যাচ্ছি একটু আধটু রাগারাগি এসব তো নরমাল।”

নীলা নির্বানের দিকে চোখ তুলে তাকালো। একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল-

“আচ্ছা এখন আসি রেডি হতে হবে।”

নীলা চলে যাচ্ছে হঠাৎই পেছন থেকে নির্বান বলে উঠলো-

“সবই তো ঠিক আছে তবে নেক্সট টাইম থেকে আমার আর কখনো ভাইয়া বলে ডাকবে না।”

নীলা থমকে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে নির্বানের দিকে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো। নির্বান গম্ভীর গলায় বলল-

“আসলে আমি তোমার ছাইয়া হতে চাই না।”

নীলা বিস্ময়ের চোখে নির্বানের দিকে চেয়ে বলল-

“মানে!”

নির্বান একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল-

“মানে আজকাল ভাইয়া বলতে বলতে যে কখন ছাইয়া হয়ে যায় কেউ-ই যানে না। তাই বলছি ভাইয়া ভাইয়া ডাকো না।”

নীলা নির্বানের কথা শুনে বোকার মতো গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে। নির্বান একটা চোখ টিপ দিয়েই চলে গেল। নীলা ভ্রু কুচকে নির্বানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। পাগল নাকি এই লোক! সব সময় কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলে। যত্তসব ফাউল! নীলা বিরবির করতে করতে চলে গেল রুমে।

—————————

লাল রঙের জামদানী শাড়ি গায়ে জড়ানো। মেকাআপ বিহীন মুখ। চোখে হাল্কা কাজল। খুলে রাখা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। লাল শাড়ির সাথে তাল মিলিয়ে লজ্জায় আরশির গাল গুলোও লাল আভা ধারণ করছে। অস্বস্তিতে দু হাত অনবরত কচলাচ্ছে। লাল কাচের চুড়ি গুলো বার বার ঝনঝন শব্দে বেজে উঠছে। রৌদ্র ঘোর লাগা চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রর পাশ থেকে নির্বান ভ্রু কুচকে বলল-

“আর কতো দেখবে ভাই! আংটিবদলের কাজটা সেরে ফেলো তাড়াতাড়ি।”

ড্রয়িংরুমে সবার সামনে রৌদ্রর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকাতেই আরশির অস্বস্তির পরিমান দফায় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নির্বানের কথায় রৌদ্র চোখ ফিরিয়ে নিতেই আরশি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। রৌদ্র মা আরশির পাশে এসে আরশিকে ধরে সোফা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। রৌদ্রর দিকে একটা আংটি এগিয়ে দিয়ে বলল-

“রৌদ্র আংটি পড়িয়ে দিয়ে আরশিকে।”

রৌদ্র আংটিটা হাতে নিয়ে আরশির দিকে একঝলক তাকালো। সবাই তাড়া দেওয়া রৌদ্র আরশির হাত ধরে আংটি পড়াতে নিবে তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সবাই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। আবারও কলিং বেল বাজতেই অতিমাত্রায় বিরক্ত হয়ে নীল দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat

আংটিবদলে বাধা পরায় ড্রয়িং রুমের সকলের মুখে বিরক্তি রেশ। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এটা কোনো কলিং বেল নয় বিরক্তির বেল বেজে উঠেছে। সবাই হতাশ হয়ে ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। নীল দরজা খুলতেই সাদা টুপি, পাঞ্জাবি পরা এক হুজুর সাহেব সালাম বিনিময় করে ভিতরে আসলেন। আদিব হাসান লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিনয়ের সাথে কথা বলছে। আরশি বিস্মিত হয়ে সব দেখে যাচ্ছে। লোকটাকে দেখেই তার বুক ধক করে উঠলো। আজ কি তাহলে সত্যি সত্যিই আকদের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে? এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কি আমার জীবনটা পুরো পালটে যাচ্ছে? সবাই আবারও উৎসুক হয়ে আংটিবদলের জন্য এক হয়ে দাঁড়ালো। রৌদ্রর বাবা তাড়া দিয়ে বললেন-

“রৌদ্র আরশি মামুনিকে আংটি পড়িয়ে দে। তারপর আবার আকদের কাজ শুরু করতে হবে।”

রৌদ্র মাথা নাড়ালো। আরশির দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল রৌদ্র। আরশি রৌদ্রর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে হাতের দিকে দৃষ্টি রাখলো। বড়রা সবাই তাড়া দিচ্ছে। আর আরশির বন্ধুরা সকলে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। আরশি এখনো স্থির চোখে রৌদ্রর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আরশির মনে চলছে হাজারো চিন্তা ভাবনা। ডক্টর রোদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? আমার এই ব্যর্থতা নিয়ে ওনার সাথে নতুন জীবন শুরু করা কি ঠিক হবে! আমার জন্য উনি কোনো কষ্ট পাবে না তো!!

“আরশি মা কি ভাবছো? তুমি কি বিয়ের জন্য রাজি না? কোনো প্রব্লেম থাকলে আমাকে বলতে পারো।”

আদিব হাসানের কথায় পুরো ড্রয়িং রুমে চিন্তার ঝড় ভয়ে গেল। সকলের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। নীল আরশির পাশে এসে দাঁড়ালো। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মুখে হাসি টেনে আদিব হাসানের উদ্দেশ্যে বলল-

“নাহ নাহ তা হবে কেন! আশু বিয়েতে রাজি বলেই তো রেডি হয়েছে। তাই না আশু!”

নীল আরশিকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে আবারও বলল-

“এই আশু হাত বাড়িয়ে দে। শুধু শুধু সবাইকে চিন্তায় ফেলছিস কেন?”

আরশি কপাল কুচকে নীলের দিকে তাকালো৷ নীল চোখের ইশারায় হাত বাড়িয়ে দিতে বলছে। আরশি রৌদ্রর দিকে তাকালো। কালো শার্ট গায়ে জড়ানো। হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। চুল গুলো কিছুটা এলোমেলো হয়ে কপালে এসে পরে আছে। সবার মুখে চিন্তার ছাপ থাকলেও রৌদ্রর ঠোঁটের কোণে লেগে আছে হাল্কা হাসির রেখা। আরশি রৌদ্রর হাসির দিকে তাকিয়েই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। রৌদ্রর হাসি মুখ খানিকটা প্রসারিত হয়ে এলো৷ আরশির হাত আলতো করে ধরে আরশির অনামিকায় আংটি পড়িয়ে দিল। সাথে সাথে ড্রয়িং রুম জুড়ে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। হাত তালি আর হাসির শব্দ বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে ভারি খাচ্ছে। আরশি মাথা তুলে সবার দিকে নজর বুলিয়ে নিতেই মুচকি হাসি দিলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল আকদের কাজ। সোফায় চুপচাপ বসে আছে আরশি। তার পাশেই আছে ডক্টর রোদ। হুজুর সাহেব কিছুটা সময় তার বড় খাতায় লেখালেখি করার পর আরশিকে কবুল বলতে বলা হলো। কবুলের কথা শুনেই আরশির হার্ট খুব জোরে জোরে লাফাচ্ছে। অস্থিরতায় দু হাত কচলানো শুরু করে দিয়েছে। পাশ থেকে নীলা আর কাসফিয়া বলল-

“আশু কবুল বলে দে।”

আরশি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা তুলে শান্ত গলায় বললো-

“ডক্টর রোদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

সবাই ভ্রু কুচকে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশির মা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“এখন আবার কিসের কথা আরশি?”

রৌদ্র আরশির পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বিনয়ের সাথে বলল-

“মিস আরু হয়তো আমার সাথে কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে চায়। আমার কোনো আপত্তি নেই বিয়েটা ওনার মতামতেই হবে।”

রৌদ্রর কথায় সবাই শান্ত হয়ে গেল। পাশ থেকে রৌদ্রর মা নরম গলায় বললেন-

“সমস্যা নেই আমরা সবাই অপেক্ষা করছি। তোমরা যাও রুমে গিয়ে আলাদা করে কথা বলে আসো।”

সবার অনুমতি নিয়েই তাদের দুজনকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো। আরশির রুমে এসে রৌদ্রর পুরো রুম ঘুরে ফিরে দেখছে। আরশি চুপচাপ ভ্রু বাঁকিয়ে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সে নিজের মতো রুমে হাঁটাহাঁটি করছে। দু হাত পকেটে গুজে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-

“আপনার রুমটা তো খুব সুন্দর মিস আরু।”

রৌদ্রর কথায় আরশির ভ্রু কুচকে এলো৷ বিরক্তির স্বরে বলল-

“আমি এখানে আপনাকে রুম দেখাতে নিয়ে আসিনি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।”

রৌদ্র হাল্কা হেসে ভাবলেশহীন ভাবেই বলল-

“হুম হুম আপনি বলুন আমি শুনছি।”

রৌদ্রর নির্লিপ্ততা দেখে আরশি খানিকটা শক্ত গলায় বলল-

“আপনি কি দয়া করে একটু সিরিয়াস হবেন!”

রৌদ্র আরশির দিকে এক নজর তাকিয়ে বিছানায় বসে পরলো। পায়ের উপর পা তুলে বেশ ভাব নিয়ে বলল-

“কি বলবেন জলদি বলুন।”

“আপনি কি সব ভেবেচিন্তেই আমাকে বিয়ে করছেন ডক্টর! আমি আপনাকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি আমি ব্যর্থ। আমি একটা অসম্পূর্ণ মেয়ে।”

রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলল-

“আপনার তো মা হওয়ার চান্স আছে। কিন্তু আমি তো পুরোই ব্যর্থ, বাবা হতে অক্ষম। এই জন্যেই কি আমাকে বিয়ে করতে আপনি এতো ভাবছেন মিস আরু?”

আরশি ভড়কে উঠলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“আমি কখনোই আপনার এসব নিয়ে ভাবিনি ডক্টর। কোনো কিছু না জেনে শুনেই কথা বলছেন কেন আপনি!”

রৌদ্র হাসলো। একটু জোরেই হাসলো। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আরশির তীক্ষ্ণ চোখ রৌদ্রর হাসি পর্যবেক্ষণ করছে। রৌদ্র আরশির মুখোমুখি হয়ে শীতল কন্ঠে বলল-

“আপনি আমার ব্যর্থতা নিয়ে ভাবছেন না অথচ আমাকে ঠিকই বাধ্য করছেন আপনার এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে ভাবতে। এটা কি ঠিক হচ্ছে মিস আরু?”

আরশি কিছু বলল না। নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো তার বলার মতো কিছু নেই। রৌদ্র আরশিকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো। রৌদ্র আরশির একদম কাছে এসে আরশির গাল দু’হাতের মাঝে আগলে নিল। আরশির মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বললো-

“তুমি কি ভুলে গেছো আমি তোমাকে কি বলেছিলাম! আমি শুধু তোমাকে চাই আরু।”

রৌদ্র আরশির গাল থেকে হাত নামিয়ে নিল। আরশির দিকে খানিকটা ঝুঁকে কানে ফিসফিস করে বলল-

“মৃত্যু আমৃত্যু আমি শুধু তোমাকে চাই। তোমার ব্যর্থতা, মন খারাপ সব কিছু চাই। তোমার চোখের অশ্রুজল, তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি দুটোই চাই। তোমার লজ্জা, অস্বস্তি, রাগ সব কিছু চাই। শুধু তোমার ঘৃণা নয় ভালোবাসাটা-ই চাই।”

রৌদ্র কথা গুলো বলেই হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরশি এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশির হাত আপনা আপনি আরশির গালে চলে গেল। দু’হাত দিয়ে নিজের গাল ঢেকে আছে। আচমকাই নীলা রুমে এসে অস্থিরতার সাথে বলল-

“আশু তাড়াতাড়ি চল সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”

আরশি কিছু বললো না। আগের মতোই গালে হাত দিয়ে মূর্তি মতো দাঁড়িয়ে আছে। নীলা আরশির দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-

“কিরে গাল ঢেকে রেখেছিস কেন! তাড়াতাড়ি চল।”

নীচ থেকে ডাকাডাকির শব্দ ভেসে আসতেই নীলা হন্তদন্ত হয়ে আরশির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। নীচে এসে আরশিকে আবারও রৌদ্রর পাশে বসিয়ে দিল। রৌদ্র আড়চোখে আরশিকে দেখছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে। আরশি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। হুজুর সাহেব আবারও আরশিকে কবুল বলতে বলল। আরশি চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিল। নিজেকে শান্ত করে নিম্ন স্বরে কবুল বলে ফেলল। পর পর তিনবার কবুল বলেই আরশি নিজের জীবন রৌদ্রর সাথে জড়িয়ে নিল।আরশির কবুল বলার পর রৌদ্র কোনো সময় ব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গেই কবুল বলে দেয়। আকদ ভালো ভাবে সম্পূর্ণ হতেই পুরো বাড়ি জুড়ে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। আরশিকে একে একে সবাই জড়িয়ে ধরছে, অভিনন্দন জানাচ্ছে। রৌদ্র আর আরশিকে নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাই নিজেদের মতো করে আড্ডায় মেতে উঠলো।

———————

আকাশে গোলাকার চাঁদের আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। চাঁদটা কিছুক্ষন পর পর কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঁকি দিচ্ছে। শীতল হাওয়া বইছে চারপাশে। পুরোটা ছাদ জুড়ে আরশির বন্ধুদের হৈচৈয়ের শব্দে পরিবেশ গরম হয়ে আছে। রৌদ্র আর আরশি চুপচাপ বসে আছে তাদের মাঝে। আজ রাত সবাই আরশির বাড়িতেই থাকবে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয় আদিব হাসান একপ্রকার জোর করেই রৌদ্রদের রেখে দিয়েছে। বড়রা সবাই নিচে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছে আর ছোটরা সবাই ছাদে আড্ডার আসর জমিয়েছে৷ আড্ডার এক পর্যায়ে কাসফিয়া হুট করেই রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করল-

“আচ্ছা ভাইয়া আপনি কি এর আগে কখনো কাওকে ভালোবেসেছেন? না-কি আশুই আপনার প্রথম ভালোবাসা!”

কাসফিয়ার সাথে সবাই তাল মিলিয়ে রৌদ্রর কাছে উত্তর জানতে চাইছে। রৌদ্র আরশির দিকে এক পলক তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-

“নাহ আরু আমার প্রথম ভালোবাসা না। এর আগেও আমি একজনকে ভালোবেসেছি। আর এখনো তাকে ভালোবাসি।”

রৌদ্রর উত্তরে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। সবার মাঝেই গম্ভীরতা এসে ভর করেছে। রৌদ্র এমন কোনো উত্তর দিবে সেটা কেউ-ই আশা করেনি৷ বিশেষ করে আরশি। আরশি তো বিস্ফোরিত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। ডক্টর রোদ এর আগেও একজনকে ভালোবেসেছেন আর এখনো ভালোবাসেন! কিন্তু উনি তো আমাকে বলেছিলেন উনি এর আগে কখনো প্রেম ভালোবাসা করেনি। আমিই তার জীবনে প্রথম মেয়ে। তাহলে কি রোদ আমাকে মিথ্যা কথা বলেছে!! আরশি মনে নানানরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখে মুখে কৌতুহল নিয়ে রৌদ্রর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। নীল উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

“আপনি আমাদের সাথে মজা করছেন তাই না ভাইয়া?”

রৌদ্র দু হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে গম্ভীরমুখে বলল-

“এসব নিয়ে কখনো মজা করা যায় না।”

কাসফিয়া কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করলো-

“তাহলে কি?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here