#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৩
পরী আপাদের ওখান থেকে আসার পর দেখলাম আম্মার আচরণ খানিকটা ঠান্ডা ধরনের। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন কম। ভাবলাম হয়তো মনির জন্য তার মন খারাপ। একটা দিন এমনই গেল। আমিও তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। নাবিদ অবশ্য আমার বেশী থাকা নিয়ে রাগ করলো না। স্বাভাবিক ই রইলো। কিন্তু আম্মার রাগের কারণ ধরতে পারলাম।
দুপুরে খেতে বসে আম্মা বললেন,
“তোমার আপার ওইখানে শুনলাম ভালোই বেড়াইলা। ”
টাপুর টুপুর এসে খুব গল্প করেছে। খালামনি ওদের অনেক আদর করেছে। মেলা থেকে ক্লিপ, মালা, জামা কিনে দিয়েছে।
আমি হেসে জবাব দিলাম,
“হ্যাঁ আম্মা, আপাও এমন জোর করলো যে দুদিনের জায়গায় চারদিন থাকতে হলো। ”
“বুঝলাম। যাবার সময় মুক্তারে একবারও বললা না, ক্যান ওরে নিলে তোমার আপার খরচ কী খুব বেশী হয়ে যাইতো?”
আমার কথা আটকে গেল। বিয়ের পর আম্মার ত্যাড়া কথার সম্মুখীন হলাম প্রথম। এর আগে আমার সঙ্গে এমন ত্যাড়া কথা বলে নি। আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম,
“ওর তো কলেজ ছিলো তাই…
আম্মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,
“তুমি মুখের বলা তো বলতে পারতা। বিয়া হইয়া আসার পর দেখলাম না তো আমার মেয়েদের সঙ্গে তোমারে সেইরাম মিশতে। ক্যান দুনিয়ায় তুমি একলাই সুন্দর। ”
আমি আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। প্রচন্ড কষ্টে গলা বুজে এলো। চোখ বেয়ে কষ্টগুলো ঝরে যাচ্ছে অবিরাম। সত্যি বলতে মুক্তাকে বলতে চেয়েও আমি বলিনি। আমি আপার কাছে গিয়েছিলাম দুটো দিন সব ভুলে আরাম আয়েশ করার জন্য। এটাও কী আমার দোষ ছিলো!
সেদিন আর রিনিদের পড়ানো হলো না। আমার কান্নাভেজা মুখ দেখে রিনি গিয়ে নাজমা ভাবীকে বলল। ভাবী বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। জোর করে ছাদে নিয়ে গেলেন। অনেক বার প্রশ্ন করলেন, আমি কিছু বললাম না। পরী আপা সবসময় একটা কথা বলেন, ঘরের কথা কখনো পরের কাছে কইতে নেই জরী। আমি চুপচাপ থাকি। নাজমা ভাবী বলেন,
“জরী, তুমি যে জায়গায় এখন দাঁড়িয়ে আছ, এই জায়গায় টুম্পা আসতো কাঁদার জন্য। কখনো কিছু বলতো না। তবুও আমি টের পেয়ে যেতাম অনেক কিছু। কান পাতলে দোতলার অনেক কিছুই কানে আসতো। এই বাড়িতে টুম্পাও এসেছিল তোমার মতো অল্প বয়সে। অনেক কিছু সহ্য করেছে, প্রতিবাদ করে খারাপও হয়েছে। তোমার সঙ্গে সেরকম কিছু যেন না হয়। ”
নাজমা ভাবী আমার মন ভালো করার জন্য অনেক কিছু করলেন। আচার খাওয়ালেন, তার বাপের বাড়ির গল্প করলেন। তবুও আমার মন ভালো হলো না।
**
নাবিদ অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখে চমকে উঠলো। বলল,
“কী হয়েছে জরী?”
আমি নাবিদের কাছ থেকে সরে যেতে চাইলাম। ও আমাকে ছাড়লো না। আমি বললাম,
“ছাড়ো, আমার কিছু হয় নি। ”
“কিছু না হলে, চোখ লাল কেন? কাঁদছিলে কেন?”
“এমনি। ”
“এমনি এমনি কেউ কাঁদে না জরী। আম্মা কিছু বলছে?”
আমি নাবিদের চোখের দিকে তাকাই। দুই ফোটা পানি আমার গাল বেয়ে পড়ে। চোখে চোখ রেখে বলি,
“আমি তো লক্ষি মেয়ে, লক্ষি মেয়েরা কখনো শাশুড়ী, সংসারের নিন্দে করে না। ”
নাবিদ চোখ নামিয়ে নেয়। রাতে আমার গলা দিয়ে কিছু নামে না। নাবিদ জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারে না। রাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে আমাকে। আমি টের পাই যে নাবিদও আমার মতো সারারাত জেগে থাকে। নীরবে কষ্টটুকু ভাগ করে নিতে চায়।
***
পরদিন সকালে অফিসে যাবার সময় নাবিদ আম্মাকে বলে যায়,
“জরীর শরীর ভালো না। ও রেস্ট নিক। ”
আম্মা হ্যাঁ, না কিছু বলে না। আমি কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার সময় বাবা জিজ্ঞেস করেন,
“কলেজে যাও? তোমার না শরীর খারাপ? ”
“তেমন কিছু না বাবা। গত সপ্তাহে একদিনও যাওয়া হয় নি। আজ যাওয়া দরকার। ”
“কিছু খাইয়া যাও। ”
“কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। খিদে পেলে বাইরে খাব। ”
আমি গলির মোড়ে এসে রিকশা খুঁজি। তখন বাবা আসেন। বলেন,
“একটু দাঁড়াও। ”
বাবা আসেন তিন, চার মিনিট পর। হাতে একটা পলিথিন। আমার হাতে দিয়ে বলেন,
“খালি পেটে থাকতে নাই মা। খাইয়া নিও। ”
আমার মন টা ভরে যায়। একটা সংসারের সবগুলো মানুষ একরকম কেন হয় না!
***
কলেজে এসে শুনি প্রথম ক্লাস টা হবে না। এই সুযোগে ক্যান্টিনে যাই। এখানে ক্যান্টিনের খাবার বেশ সস্তা। অনেকেই দেখছি ডিম, খিচুড়ি খাচ্ছে। আমি পিছনের দিকে একটা টেবিলে বসলাম।বাবার দেয়া খাবারের প্যাকেট টা খুললাম। পরোটা, বুটের ডালের সঙ্গে সবজি আর ডিমভাজি।
“হাই জরী কেমন আছ? ”
কলেজে আমার কোনো বন্ধু নেই। এক দুজনের সঙ্গে হাই, হ্যালো টাইপ আলাপ আছে। যে মেয়েটা আমাকে হাই বলেছে ওর নাম সুবর্না। সুবর্নার চুলগুলো রিবন্ডিং করা। রিবন্ডিং ব্যাপার টা আমি পলাশবাড়ী কলেজে পড়ার সময় জেনেছি। সুবর্না আমার সামনের চেয়ারে বসলো। বলল,
“তোমার সঙ্গে বসলে সমস্যা নেই তো…
“না না। ”
সুবর্না মেয়েটা স্মার্ট, চটপটে। ক্লাশে ছেলেদের সঙ্গেও হেসে গল্প করে। ওর বেশীরভাগ বন্ধুই ছেলে।
সুবর্না খাবার নিলো। খিচুড়ি আর অমলেট। খেতে খেতে বলল,
“তোমার প্র্যাকটিক্যাল খাতা দেখেছি জরী। কী সুন্দর হাতের লেখা তোমার। ”
আমি হাসলাম। থ্যাংক ইউ বলতেও কেমন যেন লজ্জা লাগছিল। সুবর্না আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি করো তুমি?”
আমি জবাব দিতে সময় নিলাম। ও বলল,
“মানে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করো?”
“হ্যাঁ দুজন কে পড়াই। ”
“তাতে হয়? হাত খরচা হয়ে যায়?”
সুবর্না আমাকে দেখে বুঝলো না যে আমি বিবাহিত। আমিও আর বললাম না। খাওয়া শেষ করে যাবার সময় সুবর্না জিজ্ঞেস করলো,
“ফেসবুকে কী নামে আছ?”
“আমার তো ফেসবুক নেই।”
“কি বলো, স্মার্ট ফোন হাতে থাকা সত্যেও ফেসবুকে নেই! একটা একাউন্ট খুলে নাও। ”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
***
বাড়িতে পর পর দুদিন আমি রান্নাঘরে গেলাম না। খাবারের মেন্যু রাতে আলুভর্তা আর ডাল, দুপুরে একটা তরকারি আর মাছ। সকালের খাবারের কোনো ঠিক নেই। জামিল ভাই টাপুর টুপুর কে টিফিন কিনে দিচ্ছেন। নাবিদও বাইরে খাচ্ছে। আমি ক্যান্টিনে ডিম খিচুড়ি দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। আমি ও আম্মা কেউই কারো সঙ্গে কথা বলছি না।
বেশ কিছুদিন পর আমার সঙ্গে সুবর্নার আবারও দেখা হলো ক্যান্টিনে। আমাকে দেখে বলল,
“এই জরী পরশু দিন কলেজে আসো নাই? আমি তো তোমারে খুঁজছিলাম। ”
“আমাকে? কেন?”
“ক্লাশে কয়েকজন কে প্র্যাকটিকাল খাতা ভাগ করে দিচ্ছিলাম তখন তোমার কথা মনে পড়ছিল। ”
সুবর্না আমাকে পুরো ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলল। এসএসসি থেকে শুরু করে অনার্সের প্র্যাক্টিক্যাল খাতা লিখে ও ওর হাত খরচের কিছুটা ম্যানেজ করে। ঠিকঠাক লিখতে পারলে, মাসে তিন চার হাজার টাকা পাওয়া যাবে।
আমি সুবর্নার কাছ থেকে খাতা আনা শুরু করলাম। বাড়িতে কাউকে কিছু বললাম না, নাবিদ কেও না। শুধু পরী আপা জানে। রিনি আর সিয়ামের সঙ্গে আরও তিনজন পড়তে আসতে শুরু করলো।
মাস শেষে দেখলাম হাতে হাজার দশেকের মতো টাকা আসছে। কলেজের প্রয়োজনে ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছিল। অল্প কিছু টাকা হাতে রেখে বাকীটা ব্যাংকে জমাতে শুরু করলাম।
আম্মার সঙ্গে আমি কথা বলি বুঝেশুনে। সেও আমার সঙ্গে লাগে কম। মুক্তার আজকাল প্রায় ই টাকা পয়সার দরকার হয়। দুইশ, একশ, পঞ্চাশ৷ নিলে সেই টাকা ফেরত দেবার আর প্রয়োজন মনে করে না।
একদিন বারন করে দিলাম। বললাম,
“তোমার ভাই বলেছে, ওর থেকে নিতে। তুমি বরং ওর থেকে নিও।”
এই ঘটনায় মুক্তার সঙ্গে সঙ্গে আম্মার মুখও ছোট হয়ে গেল। আম্মা আমার কাছে হঠাৎ হঠাৎ টাকা চান। না বলতে পারি না। একদিন বাড়িতে ডিনারসেট বিক্রি করতে এলো। নাজমা ভাবী, নিচতলার ভাবী এরাও এলেন। আম্মাও দেখলাম কাঁপ, পিরিচ, প্লেট, গ্লাস দেখছেন। মুক্তাকে ডেকে দেখালো ডিজাইন পছন্দ হয় কি না। হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল,
“জরী, দুই হাজার টাকা নিয়ে আসো। ”
আমি প্রশ্ন করলাম, কিসের টাকা? ”
“তোমার কাছে আছে না, ওইখান থেকে দাও। ”
আমি মুখের উপর বলে দিলাম,
“না। সেই টাকা আমার কলেজে জমা দিতে হবে। ”
আম্মা ভয়ংকর আহত হলেন। ভাড়াটিয়াদের কাছে তার মুখ রইলো না। অনেক খুঁজে টুজেও দুই হাজার টাকা ম্যানেজ করতে পারলেন না। শেষমেস ডিনারসেট রাখা হলো না।
এই বিষয় নিয়ে নাবিদ কে একদফা নালিশও বোধহয় করেছে। নাবিদ আমাকে কোনো প্রশ্ন করে নি, কোনো কৈফিয়তও দেয় নি।
পরদিন সকালে জামিল ভাই বলল,
“জরী, সাবধানে থাইকো, এই বাড়িতে তোমার অবস্থা কিছুদিনের মধ্যে টুম্পার মতো হবে। ”
আম্মা ঝাপিয়ে পড়ে জামিল ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করে। বেশীদূর পারে না, জামিল ভাই আগুনে ঘি লাগিয়ে চলে যান।
***
নাবিদ কে বলে আমি আরও একটা কাজ করলাম। টাপুর টুপুর এর নামে দুই হাজার টাকার ডিপিএস করলাম। নাবিদ কে বললাম,
“আমি যদি কখনো না পারি, তাহলে তুমি এই ডিপিএস দুটো চালিয়ে নিও। মেয়েরা একদিন বড় হবে, পড়াশোনার খরচ বাড়বে। ওদের আলাদা করে কিছু স্বপ্নও থাকতে পারে। জামিল ভাই চিরকাল একা নিশ্চয়ই থাকবে না। ভাবীর সঙ্গে ডিভোর্স এর প্রসেসিং চলছে। এই মেয়েরা আফসোস নিয়ে বড় হোক তা চাই না। ”
নাবিদ খুশি হলো। বলল,
“দিন দিন তুমি আমাকে মুগ্ধই করে যাচ্ছ জরী। যে মেয়েদের জন্য তুমি এতো ভাবছ তাদের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক নেই, তবুও এতো ভাবো! একদিন তুমি এর প্রতিদান পাবে!”
প্রতিদানের আশায় আমি কিছু করছি না। ওরা সারাজীবন আফসোসের জীবন বয়ে না বেড়াক সেটাই আমি চাই।
চলবে….
(পরের পর্ব পরশু দিন।)