লাবণ্যপ্রভা
পর্ব-৮
১৪.
তুনিড়ের সাথে দেখা হয়েছিল নাটকীয় ভাবে। আমি বিশ্বাস করি যে জীবন টা কোন অংশে নাটকের চেয়ে কম নয়। বরং কখনো কখনো জীবন নাটক কিংবা সিনেমাকেও হার মানায়।
জীবনে যা কিছু ঘটে সব টা উপরওয়ালার ইচ্ছেতে। আমরা সেটা না চাইলেও ঘটবে। উপরওয়ালার ইচ্ছেতেই আবার তুনিরের সাথে দেখা হলো।
আসিফ কাজ করতো ডিফেন্সে। দিল্লীতে ওর ট্রান্সফার হয়ে গেলে আমিও সেখানে চলে গেলাম মেয়েকে নিয়ে। আমার তখন বাইরে কাজ নেই বললেই চলে। দুটো সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখা আর চুটিয়ে সংসার করা ছাড়া আর তেমন কাজ নেই। এই জীবন টা খুব উপভোগ করছিলাম আমি।
সময়ের সাথে সাথে বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো হলেও আমি আর ঢাকায় ফিরলাম না। বাবা অবসর নেবার পর থেকে ছোটবোন নবনীর ওখানেই থাকত। তাই আমার সেই চেনা গলি, জন্মস্থানের সাথে আমার আর সম্পর্ক ছিলো না বললেই চলে।
আগে মানুষ আমাকে প্রচুর চিঠি পাঠাতো। তাদের সমস্যা গুলো বলতো, আমি সাধ্যমতো সল্যুশন দেয়ার চেষ্টা করতাম। কেউ কেউ রেডিওতে ফোন করেও বলতো। কিন্তু সময়ের সাথে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পর এখন আর কেউ চিঠি পাঠায় না। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে নিজেদের সমস্যা লিখে পাঠাতো। অনেকে অনেক ফেইক আইডি থেকে মেসেজ দিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতো। তাই আমিও এরপর বেছে বেছে মেসেজের উত্তর দিতে শুরু করলাম।
এরকমই একদিন একটা মেসেজ পেলাম ফেসবুকে। মেসেজ টা ছিলো,
“আপনি আর কোনো বই লেখেন নি কেন??”
এইটা ছিল আমার জন্য কমন প্রশ্ন। আমি রিপ্লাই দিলাম,
– যেহেতু ওটা একটা মেয়ের জীবনের কাহিনী আর সেটা আমার জানা তাই লিখেছিলাম। এরপর আর অন্যকিছু লেখার কথা ভাবিনি। মুলত আমি এটা থেকে অনেক বেশী ফেম পেয়েছিলাম তো তাই আর অন্যকিছু লেখার ভরসা হয়নি।
মেয়েটা আমাকে সাথে সাথেই রিপ্লাই দিলো,
-কিন্তু আপনি তো এরপর বহু নাটক, টেলিফিল্মের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন।
আমার মেজাজ খারাপ হলো। ব্যাপার টাকে কেমন যেন কৈফিয়ত চাওয়ার মতো মনে হলো।
আমি আবারও মেসেজে প্রশ্ন করলাম, আপনি কে?
মেয়েটি উত্তর দিলো দ্রুত, আমি আপনার মতোই একজন মেয়ে মানুষ।
আমার এবার খুব বেশি মেজাজ খারাপ লাগলো মেয়েটার ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলায়। আমি আর তাই রিপ্লাই দিলাম না।
মেয়েটি আবারও মেসেজ পাঠালো। এবার লিখলো,
-আপনি কি আমার গল্প টা শুনবেন? আশা করি এই গল্প টা লিখলে আগের থেকেও বেশি পপুলারিটি পাবেন।
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি করে বলুন তো আপনি কে??
-মেয়েটি এবার রিপ্লাই দিতে সময় লাগালো।
একটু পরেই লিখলো, আমি সত্যিকারের লাবণ্যপ্রভা।
আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষন লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি কিছু লেখার আগেই মেয়েটা আবার আমাকে লিখলো,
-সত্যিকারের লাবণ্যপ্রভা এইজন্য বললাম কারন আমার নাম টা জন্মের পর ই রাখা হয়েছে।
পরের মেসেজ টা দেখে একটু অবাক হওয়ার সাথে সাথে বিরক্ত ও হলাম। লাবণ্যপ্রভা নামে ফেসবুকে একাউন্টের কোনো অভাব নেই। এরা বিভিন্ন সময়ে আমাকে মেসেজ দিয়ে জ্বালিয়ে মারতো। এটা কি সেরকম কেউ! কিন্তু কথার মধ্যে কেমন যেন একটু গড়মিল আছে। মেয়েটা আমাকে বলছে যে তার নাম টা জন্মের পর থেকেই রাখা হয়েছে। এই কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সে আমার নামের ব্যাপার টা জানে।
আমার রিপ্লাই দিতে দেরি দেখে মেয়েটি আবারও লিখলো,
-বইয়ে যে কাহিনী টা লেখা সেটা আপনার নিজের জীবনের তাই না?
আমি এবার সাথে সাথেই রিপ্লাই দিলাম,
-আপনার সেটা কেন মনে হচ্ছে বলুন তো??
-আপনার বই টা একবার না বারবার পড়েছি। আপনি বইয়ের প্রতিটি ঘটনা এতো নিখুঁত ভাবে লিখেছেন যে বোঝাই যাচ্ছে নিজের জীবনের ঘটনা। অন্যের মুখ থেকে শুনে কি এতো টা নিখুঁতভাবে বর্ননা করা যায়।
এইবার আমি চরম বিরক্ত হয়ে লিখলাম,
-কেন আপনার নিজের ভাবনা চাপিয়ে দিচ্ছেন বলুন তো। ওটা আমার নিজের জীবন কাহিনী নয়। ওটা অন্য একজনের জীবন কাহিনী।
এবারও সাথে সাথে রিপ্লাই দিলো,
-আপনি কি একবার আমার কাহিনি টা শুনবেন?
-না। আমি আগ্রহী নই।
– তবুও আমি শোনাতে চাই।
আমি মেয়েটাকে ব্লক করে দিলাম। ব্লক দিয়ে মনে হলো ভুল করেছি।
মেয়েটা কিভাবে জানল যে লাবণ্যপ্রভা আমার নিজের নাম না। সেটা জানা উচিত ছিলো।
১৪.
এরপর আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মেয়েটার কথাও ভুলে গেলাম। হঠাৎ আবার একদিন লাবণ্যপ্রভা নামের আইডি থেকে মেসেজ পেলাম। এবার আইডি টা দেখলাম। আইডিটা পুরোনো। মেয়েটা হলিক্রসে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে। পুরো একাউন্ট ঘুরে কলেজ ড্রেসে বিভিন্ন হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখলাম। মুখটা কেমন পরিচিত মনে হলো। লাস্ট তিনমাসের পোস্ট গুলো দেখে বুঝলাম যে মেয়েটার সাথে কোনো কিছু ঘটেছে।
আমি মেসেজ টা ওপেন করলাম। সেখানে লেখা ছিলো,
-আপনি কি “ল” অফ এট্রাকশন সম্পর্কে জানেন?
এবার সত্যি সত্যি মেয়েটার সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করল।
আমি মেসেজ দিলাম, তোমার গল্পটা শুনতে চাই?
মেয়েটা সাথে সাথে রিপ্লাই দিলো, আপনি কি আমাকে নিয়ে লিখবেন প্লিজ।
যদিও মেসেজে টাইপ ছিলো। তবুও আমি কল্পনায় মেয়েটিকে অনুনয় করতে দেখলাম। বললাম,
-ভালো লাগলে অবশ্য ই লিখবো।
মেয়েটি লিখে পাঠালোঃ
আমার নাম লাবণ্যপ্রভা৷ হয়তো নাম টা আপনার নামের কারনেই রাখা হয়েছিল। আমি আমার বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। আমার মা আমার আগে একটা ছেলের জন্ম দিয়েছিল কিন্তু সে বাঁচেনি। আমার মা নরম, মিষ্টভাষী স্বভাবের। তার জীবন টা খুব একটা সুখের ছিলো না। সে ছিলো ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। তাই খুব করে চাইতো একটা ভালো পরিবারে বিয়ে হোক। কিভাবে যেন বাবার সাথে প্রেম হয়েছে তারপর বিয়েও৷ কিন্তু আমি জন্মের পর থেকেই দেখি যে বাবা মায়ের সম্পর্ক টা ঠিক কেমন যেন। সাত বছরে বয়সে আমরা বাংলাদেশে আসি। আমার বাবার পৈতৃক বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। আমাদের সাথে দাদিও থাকতেন। মা বাবা দেশে আসার পর প্রচুর ঝগড়া করতেন। আমি আলাদা ঘরে থাকতাম। মাঝরাতে এসব ঝগড়া শুনতাম। এভাবে চলছিলো দুটো বছর।
একদিন মা আমাকে ডেকে বলল, লাবণ্য আমার বাথরুমের আয়নার পেছনে একটা ডায়েরি লুকিয়ে রাখা আছে। আমি যখন না থাকব তখন তোমার দায়িত্ব হচ্ছে ডায়েরি টা সরিয়ে রাখা।
আমি তার কথার মানে তখন বুঝলাম না। বুঝলাম পরদিন সকালে। যখন মাকে গলায় দড়ি দেয়া অবস্থায় ঝুলতে দেখলাম।
হঠাৎ করে মা মারা যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই আমার অবস্থা খারাপ হলো সেই ডায়েরির কথা মনে রইলো না। সপ্তাহ খানেক বাদে একদিন ডায়েরি খুঁজতে গেলাম কিন্তু পেলাম না। মায়ের মৃত্যুর কারন হিসেবে বাবা সবাইকে বলেছেন যে, মায়ের মানসিক সমস্যা ছিলো। কিন্তু আমার শান্ত মাকে কখনো মানসিক ভাবে অসুস্থ মনে হয়নি।
১০ বছর বয়সে আমি হোস্টেলে চলে গেলাম। কারন আমার বাবার নতুন স্ত্রী আমার থাকা পছন্দ করলেন না। বাবাও তাই হোস্টেলে দিয়ে আসল।
হোস্টেলে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম একা থাকা কাকে বলে। আমার শিল্পপতি বাবা প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা দিয়েই দায়িত্ব পালন করতো। বিশেষ দিনগুলি ছাড়া বাড়িতে যাওয়া হতো না। এরপর দাদিও মারা গেলেন। আমার কাছের বলতে কেউ নেই। অল্প বয়সে মোবাইল, ল্যাপটপ পেলাম সেগুলোর সাথেই আমার দিন কাটতে লাগল। হোস্টেলে অনেক মেয়েদের সাথে থাকলেও তেমন কোনো বন্ধু ছিলো না।
নাইনে পড়ার সময় ফেসবুকে একটা ছেলের সাথে আমার পরিচয় হলো। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। মাঝে মাঝে টুকটাক কথা হতো ওর সাথে। ছেলেটা বলেছিল ও ইউনিভার্সিটি তে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বন্ধুত্ব থেকে একসময় প্রেমেও পড়লাম। যেহেতু আমার বন্ধু ছিলো না সেহেতু আমি সবকিছু ওর সাথেই শেয়ার করতাম। ও আমাকে নিষিদ্ধ ব্যাপার গুলোও বুঝিয়েছে। নারী পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে প্রথম ওর কাছেই জেনেছি।
একসময় আমাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়েও গেল। আর তারপর ওর আসল রুপ বের হয়ে গেল। ও ভিডিও করে সেটা দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতো। আমার পক্ষে অত টাকা দেয়া সম্ভব ছিলো না তাই সে আমাকে হোটেলেও নিয়ে যেত বিভিন্ন মানুষের কাছে। কয়েকদিন আমি গেলাম ও কিন্তু তারপর আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই আমি আর ওর কথায় রাজি হয়নি।
ভিডিও টা ভাইরাল হয়ে গেল। আমার জীবনের সাথে সাথে আমার বাবা আর তার স্ত্রীর জীবন ও দুর্বিষহ হয়ে গেল। হোস্টেলে থাকা সম্ভব ছিলো না তাই আমি বাড়ি ফিরে এসেছি। স্বাভাবিক ভাবেই বাবার স্ত্রী আমার ফিরে আসা মেনে নেয় নি তবুও আমি থাকতে লাগলাম।
আমার বন্দী জীবন ও খুব একটা ভালো কাটতে লাগল না। মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। তাই স্টো রুমে মায়ের জিনিসপত্র খুঁজতে গিয়ে সেই ডায়েরি টা খুঁজে পেলাম।
সেই ডায়েরি পড়ে বুঝলাম যে আমার জীবনে যা কিছু হয়েছে সেটা হওয়ার ই ছিলো। ল” অফ এট্রাকশন অনুযায়ী যখন কাউকে কিছু দেয়া হয় কিংবা কারো ভালো বা খারাপ করা হয় সেটা দ্বিগুণ হয়ে নিজের কাছে ফেরত আসে।
আমার সাথেও তেমন ঘটেছে। আমার বাবার করা কর্মের জন্য আমি শাস্তি পাচ্ছি। আসলে শাস্তি টা ঠিক আমি পাচ্ছি না। উপরওয়ালা আমাকে উদ্দেশ্য করে শাস্তি টা দিচ্ছে।
এতো দীর্ঘ মেসেজের পর আর কিছু লিখল না মেয়েটা। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-তোমার বাবা কিভাবে শাস্তি পাচ্ছে??
মেয়েটা এবারে সময় নিয়ে রিপ্লাই দিলো,
-আমার এই ঘটনায় যতটা সাফার আমি করছি তার থেকেও বেশি তাকে করতে হচ্ছে। সোসাইটি তে তার যে সম্মান ছিলো সেটা নষ্ট হয়েছে৷ লোকজন বলছে আমাকে দিয়ে আমার বাবাই দেহ ব্যবসা করাতো হোস্টেলে রেখে। আমার স্টেপ সিস্টার কে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে৷ এমন কি সোসাইটি থেকে ও বাবাকে বের করে দেয়া হবে শুনে বাবা সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল।
আমি মেয়েটার পাঠানো মেসেজ বার বার পড়লাম। কোথাও একটা খটকা আছে। মেয়েটা কিছু একটা চেপে গেছে।
বার বার পড়ার পর আমি খটকা টা ধরতে পারলাম। খটকা টা প্রথম লাইনে। আমি লাবণ্যপ্রভা, হয়তো আপনার নামের কারনেই আমার নাম লাবণ্যপ্রভা রাখা হয়েছিল। এই লাইন টার মধ্যে কোনো একটা কিন্তু আছে।
আমার বইয়ের নাম অপরাজিতা। ক্যারেক্টারের নাম ও অপরাজিতা। সেই হিসেবে বই পড়ে অপরাজিতা না রেখে লাবণ্যপ্রভা কেন রাখল??
দ্বিতীয় খটকা হচ্ছে, মেয়েটা কিভাবে এতো জোর দিয়ে বলছে যে, এটা আমার জীবনের গল্প। আর আমার লাবণ্যপ্রভা নাম টাও নিজের রাখা??
একটা ইন্টার পড়ুয়া মেয়ের এতো বুদ্ধি থাকার কথা না। তবে মেয়েটা যে ট্যালেন্টেড সেটা গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতা দেখেই বুঝে ফেলেছি।
ল’ অফ এট্রাকশনের ব্যাপার টা ও জেনেছে ওর মায়ের ডায়েরি পড়ে। তাহলে কি সেখানেই ও আমার কথা জেনেছে!! নিশ্চয়ই ওর মা আমাকে চেনে।
আমি মেয়েটাকে মেসেজ দিয়ে জানতে চাইলাম, ওর মায়ের নাম কি??
মেয়েটা রিপ্লাই দিলো না। আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে গেলাম। একদিন পর মেয়েটা রিপ্লাই দিলো।
মেসেজ দেখে আমি বজ্রাহত হলাম। এর থেকে অবাক জীবনে আর হইনি। আমি বার বার ল্যাপটপের স্ক্রিন দেখলাম।
যেখানে স্পষ্ট লেখা ছিলো, আমার মায়ের নাম প্রগতি ফ্রান্সিস আর বাবার নাম তুনির হাসনাত।
চলবে…….
সাবিকুন নাহার নিপা