লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৪০
সামিরা আক্তার
** গতকালের ঘটনার পর চৈতালী আজ আদ্র কে আনে নি। আসলে সে ভয় পাচ্ছে। রাফসানের থেকে আদ্রকে দূরে রাখতে পারলেই বাঁচে। হাজার হোক রক্তের টান যাবে কোথায়।
চৈতালীর ভাবনার মাঝেই আরিফ এসে আদ্র কে চৈতালীর দিকে এগিয়ে দিলো। চৈতালী যেন আকাশ
থেকে পড়লো। চারিদিকে একবার তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো- ওকে এখানে এনেছো কেন??
– আরে ও কাঁদছিলো তো। কোনভাবেই রেখে আসতে পারলাম না।
কথাটা মিথ্যা বললো আরিফ। সে আদ্র কে ইচ্ছে করেই এনেছে। রাফসান তার ছেলেকে না চিনুক অনন্ত দেখুক।
– এজন্যই তোমাকে তখন আমার সাথে আসতে বলছিলাম। তা না তুমি দেরি করলা। এখন আবার ওকে নিয়ে আসছো। রেগে কথাটা বললো চৈতালী।
-আরে তুই রাগ করছিস কেন? ও তো ঝামেলা করে না। বরং নিজের মত খেলা করে।
চৈতালী এবার আরেক দফা রেগে গেল। কিন্তু শান্ত গলায় বললো- তুমি দেখোনি ও কাল বাপের কাছে চলে গেছিলো। আবার যদি যায়??
– ছেলে তো বাবার কাছে যাবেই চৈতালী। আজ হোক বা কাল।
কথাটা আরিফ যত শান্ত কন্ঠে বললো চৈতালী ততই ভয় পেলো। তার চোখ পানিতে ভরে উঠলো। কোনরকমে বললো- এমন কথা বলো না ভাই। ও ছাড়া আমার কেউ নেই।
– আমি তোকে কথাটা কষ্ট দেবার জন্য বলি নি চৈতালী। কথার কথা বলেছি। তুই কাঁদিস না। আদ্রকে কাল থেকে আর আনবো না। আজ ওকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
চৈতালী কান্নার কারণে কোন কথা বলতে পারলো না। শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলো। আরিফ আদ্রকে নিয়ে চলে যেতেই সেও চোখ মুছে কাজে লেগে গেলো। সবাই চলে এসেছে।
রাফসান আজ চা বাগানে আসে নি। আজ শিকদার বাড়ির সবাই এখানে আসছে। উদ্দেশ্য চৈতালীর মুখোমুখি হওয়া। রাফসান কোন অশান্তি চায় না। চৈতী যদি তার থেকে দূরে গিয়ে ভাল থাকে তাহলে সে কিভাবে চৈতালী কে জোর করবে??? আর সে জোর করেও নি। কি দরকার??
শুধু কষ্টের কথা একটাই তার বাকি জীবন কাটবে চৈতী বিহীন।
আর সেটা সে মেনে নিয়েছে। সে কষ্ট পাক তবু্ও তার চৈতী ভাল থাক। ভাল থাক ওই মানুষ টা যাকে অন্য একজনের সাথে দেখে সে কষ্টের সাগরে ডুবে মরছে।
গাড়ির হর্নের শব্দে হুশ ফিরলো রাফসানের। মৃদু হেঁসে এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। তাকিয়ে দেখলো সবাই এসেছে। অথচ জুনায়েদ কে বার বার বলে দিয়েছিল তার মা আর রাফিয়া কে যেন না আনে।
এরা দুজন চৈতালী কে মারতেও পারে। কারণ এদের কাছে রাফসান সবার আগে।
একমাত্র রেবেকা আর আসলাম শিকদারের জন্য এদের এখানে আনা। নয়তো কাউকে আনতো না।
রাফসান একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে কটেজে ঢুকলো। তার পর বললো- তোমরা ফ্রেশ হও, খাওয়া দাওয়া করো তারপর নিয়ে যাব।
– আগে চৈতালীর কাছে যাই?? অস্থির গলায় বললো রেবেকা।
– এইটুকু সময়ে তোমার মেয়ে মরবে না রেবেকা। এতদিনে যখন মরে নি। দাঁতে দাঁত চেপে বললো আয়শা বেগম।
– আহ্ মা। কি শুরু করলে। বললো রাফসান।
তারপর রেবেকার দিকে তাকিয়ে বললো- আর একটু ধৈর্য ধরো মেজোমা। আমরা অাধ ঘন্টার মধ্যেই বের হবো। চা বাগান বেশি দূর না।
তারপর আয়শা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো- মা ওখানে গিয়ে এমন কিছু করবে না বা বলবে না যেন আমি অসহায় বোধ করি। এটা আমার কাজের জায়গা।
বলেই ওখান থেকে প্রস্থান করলো সে।
ছেলের যাওয়ার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো আয়শা। সবার কথা ভাবছে অথচ নিজে যে জ্বলে পুরে যাচ্ছে একথা কাউকে বলছে না।
রাফসান রা যখন চা বাগানে পৌঁছালো তখন চৈতালী একমনে একটা হিসাব করছিল। রাফসান দূর থেকে তাকে দেখিয়ে দিতেই এক প্রকার সেদিকে ছুটতে শুরু করলো রেবেকা। তার পিছু পিছু আসলাম শিকদার।
যত ভুলই করুক চৈতালী তাদের মেয়ে।
এতদিন তাকে না দেখতে পেয়ে তাদের হৃদয় যে শুকিয়ে গেছে।
– চৈতালী!!!
হঠাৎ এমন চিরপরিচিত ডাক শুনে পিছনে তাকাতেই জমে গেলো চৈতালী। ছলছল চোখে তার মা দাড়িয়ে আছে। পিছনে বাবা।
এই ভয়টাই সে পাচ্ছিল মনে মনে। এই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য কার??
রেবেকা এক প্রকার জাপটে ধরলেন মেয়ে কে। সারা শরীরে চুমু দিতে থাকলেন। অনেক দিন পর মায়ের এমন বাধ ভাঙা আদরে ডুকরে কেঁদে উঠলো চৈতালী। তারপর কান্না মাখা গলায় বললো- বাবা,,
আসলাম শিকদার ভেবেছিলেন রাগ করবেন কিন্তু মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনে তিনিও চৈতালী কে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।
যত ভুলই করুক এটা তার মেয়ে। মেয়ের খুশিতেই তাদের খুশি। এই আড়াই বছরে মেয়ের জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছেন তারা।
আর মেয়েকে হারাতে দেবেন না।
তাদের এই কান্নার মাঝে শিকদার পরিবারের সবাই এসে উপস্থিত হলো সেখানে। চৈতালী সবার দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিললো। একবার বাবা আর এক নিজের মায়ের দিকে তাকালো।
তার পর কিছু বলতে যাবে এমন সময় রাফিয়া বলে উঠলো – তোর জামাই কই চৈতালী?? শুনলাম একটা ছেলেও হয়েছে। ভালই পারিস বল। আমরা আরও তোকে ছোট ভাবতাম।
চৈতালী অসহায় ভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাফসান শুধু নিজে ভুল বোঝে নি। সবাই কেই ভুল বুঝিয়েছে। কিন্তু এদের ভুল ভাঙানোর প্রয়োজন মনে করলো না চৈতালী।
সবাই তাকেই দোষ দিচ্ছে। কই রাফসানও তো আফরিন কে নিয়ে ভাল আছে। তার কথা তো কেউ বলছে না।
আফরিনের কথা মনে হতেই আফরিন কে খুজলো চৈতালী। আশ্চর্য নেই। আসে নি না কি??
– কি রে কি এতো ভাবছিস?? ডাক দে তোর জামাই কে। দেখি আবার কাকে ধরলি। আমার ভাইয়ের না হয় বয়স বেশি ছিলো আশা করি এটা একবারে কচি তাইতো??
– আহ্ রাফু…বড্ড বাজে বকছিস। তারপর রাফসান ম্যানেজার কে ফোন করে বলল আরিফ কে এখানে পাঠিয়ে দিতে।
চৈতালী তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। আরমান শিকদার এগিয়ে এসে চৈতালীর হাত ধরে বললেন- এমন না করলেও পারতি মা। কেন এমন করলি?? আমাদের কথা একবার ভাবলি না?? তোর জন্য আমরা কত কষ্ট পেয়েছি । স্পেশালি রাফসান। ও তো বছর খানেক ঘরবন্দি ছিলো এক প্রকার।
চৈতালী নিজের ছোট চাচার কথায় একটু অবাক হলো। বললো- মানে??
– মানে তুই সেদিন এমন কেন করলি?? রাফসানের কথা এক বার ভাবলি না??
– থাক আমার ছেলের কথা কারো ভাবতে হবে না। ওর মত স্বার্থপর মেয়ের তো আরও না। তেঁতে উঠলেন আয়শা।
আর ও কিছু বলতে গিয়েছিলেন এর মধ্যে আদ্রকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো আরিফ। এক সাথে এত লোক দেখে সে একটু হকচকিয়ে গেল। ভেবেছিল রাফসান হয়তো এমনি ডেকেছে। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আদ্রকে এগিয়ে দিলো চৈতালীর দিকে।
মায়ের কোল পেয়ে এক প্রকার ঝাপিয়ে পড়লো আদ্র।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
* পর্ব ৪১
সামিরা আক্তার
** চৈতালী আর আরিফ পাশাপাশি বসে আছে রাফসানের কটেজের ডাইনিং রুমে। চৈতালীর কোলে আদ্র। নিচে নামার জন্য সে এক প্রকার যুদ্ধ করছে মায়ের সাথে।
কিন্তু চৈতালী তাকে শক্ত করে ধরে আছে। আরিফ চৈতালীর দিকে তাকালো, চৈতালী নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর সামনের দিকে তাকালো, কতগুলো মানুষ ওদের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে।
আরিফের অস্বস্তি হতে লাগলো। কিন্তু কিছুই করার নাই। চা বাগানে নিজের পরিবারের কথাবার্তা বলবে না বিধায় ওদের এখানে নিয়ে এসেছে আসমাত শিকদার নামক লোকটা। এনে বসিয়ে রেখে সবাই একমনে দেখছে ওদের।
আরিফের মনে হলো ও জেলখানায় আছে। বিশেষ করে রাফিয়া নামের মেয়েটা এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে যেন ওকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।
সব দোষ চৈতালীর। সত্যি কথা বলে দিলেই তো হয়। আর একবার চৈতালীর দিকে তাকালো আরিফ।
চৈতালী আশেপাশে তাকিয়ে আফরিন কে খুঁজছিলো। আশ্চর্য মেয়েটা আসে নি কেন?? সবাই এলো সে এলো না? রাফসান কেও দেখলো না। এই আলোচনায় সে আসে নি। কেন আসে নি?? হঠাৎ কই গেলো???
– তোমার ছেলের নাম কি রেখেছো চৈতালী?? জানতে চাইলো জুনায়েদ।
আরিফ যেন জুনায়েদের কথায় হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক কেউ তো কথা বললো।
– ওর নাম আদ্র। চৈতালী জবাব দিলো।
– বাবা ছেলের নাম দেখি জামাইয়ের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা।
তাচ্ছিল্যের সাথে কথাটা বললো রাফিয়া।
চৈতালী এদের কথায় আরেক দফা হতাশ হলো। ইচ্ছে করলো এদের দু কথা শুনিয়ে দিতে। কেন রে তোর ভাই যখন আমাকে ঠকিয়ে প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে হোটেল রুমে রং ঢং করছিলো তখন তোরা কই ছিলি??
অবশ্য প্রাক্তন স্ত্রী বলছি কেন?? সেই তো এখন বর্তমান আর চৈতালী প্রাক্তন।
ভাবতেই বুকের ভিতর হু হু করে উঠলো তার। ওই একটা মানুষ কে সে তার জীবনের চেয়ে বেশি ভালবেসেছিলো। কিন্তু বিনিময়ে পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা অথচ দেখো এখন তার ব্যাপারে মন গড়া কাহিনি বানিয়ে তাকেই দোষ দিচ্ছে।
আরিফ কে অবাক করে দিয়ে তাদের সাথে কেউ কোন কথাই বললো না। কিছু জানতেও চাইলো না। অথচ সে ভেবেছিলো এখানে তুফান বয়ে যাবে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারলো এখানকার কেউ কথা বলতে পারে নি কষ্টে, আর কেউ রাগে।
যার কারণে ওদের সবাই দেখেছে কিছু বললো না।
শুধু এক সময় নীরবতা ভেঙে আসমাত শিকদার বললেন – তোমরা এখন আসতে পারো।
চৈতালী তার বড় আব্বুর মুখের দিকে চাইলো। এই মানুষটাও তাকে ভুল বুঝলো??
একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো সে। কাউকে সত্যটা জানাতে ইচ্ছে করলো না। এমনকি নিজের মা বাবা কেও না।
আস্তে করে মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাকে জরিয়ে ধরে বললো – আমি যাই মা।
রেবেকা কেঁদে উঠলেন। চৈতালী কে শক্ত করে জরিয়ে ধরলেন। যেন ছাড়লেই মেয়ে আবার হারিয়ে যাবে।
আসলাম শিকদার এসে বললেন -ওকে ছাড়ো রেবেকা, কয়দিন পর ওদের আমরা বাড়ি নিয়ে যাব।
চৈতালী এবার বাবাকে জরিয়ে ধরলো। আসলাম শিকদার মেয়েকে জরিয়ে ধরে নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলেন।
– একেই বলে গিরগিটি বুঝলি রাফিয়া একেই বলে গিরগিটি। আমার ছেলের সাথে এত বড় অন্যায় করলো এটা কারো চোখে পড়লো না। এখন মেয়েকে ঠিক মাফ করে দেওয়া হলো। আবার বাড়িতে নিয়ে যাবে।
বললেন আয়শা বেগম।
– আমি তো এটাই বুঝতেছি না মা। এই মেয়ে কিভাবে নিজের স্বামী জীবিত থাকতে তাকে ডিভোর্স না দিয়ে অন্য লোককে বিয়ে করে?? এই পাপ ধর্মে সইবে??
আসলাম শিকদার আর রেবেকা অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারা জানেন চৈতালী অন্যায় করছে, কিন্তু তাই বলে কি মেয়েকে মেরে ফেলবেন তারা??
আসলাম শিকদার ভাবলেন এখান থেকে গিয়েই এই বিষয়টার সমাধান করবেন।
মানুষ ভুল করে, আর চৈতালী মানুষ ফেরেশতা না।
চৈতালী ছলছল চোখে রাফিয়া আর আয়শা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই দুইজন মানুষ একসময় সে বলতে অজ্ঞান ছিলো। আর আজ কটু কথা বলতেও বাধছে না।
চৈতালী আটকে রাখা নিঃশ্বাস টা ছেড়ে দিলো। স্বার্থের বেলা সবাই এক।
আরিফ কে নিয়ে বের হয়ে আসছিলো সে। এমন সময় রাফিয়া বললো- কয়দিন পরে ডিভোর্স পেপার পাঠাবো। দয়া করে সাইন করে দিস।
চৈতালীর বুকের ভিতর কামড়ে উঠলো। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স??
কোনরকমে বললো- মানে??
– নাটক করো?? মানে বুঝো না?? তেঁতে উঠলেন আয়শা।
– মা থামুন আমরা কথা বলছি ওর সাথে। বললো জুনায়েদ।
রাফিয়া এবার চৈতালীর দিকে এগিয়ে এলো। তারপর বললো- আমার ভাই ফেলনা নয় চৈতালী। তোর জন্য গত আড়াই বছর ধরে খুব কেঁদেছে। নিজেকে ঘরবন্দী রেখেছে। সিলেটের প্রতি কোনায় কোনায় তোকে খুঁজেছে।
কে জানতো বল তুই এদিকে সংসার পেতে বসে আছিস।
একটু থেমে আবার বললো- তুই সংসার করছিস, তোর বাচ্চা ও হয়ে গেছে। আমার ভাই কেন একা থাকবে?? তার ও তো জীবন আছে। দুটো বিয়ে করতে পারলে তিনটাও পারবে।
** রাফিয়ার কথা শুনে চৈতালীর মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। রাফসাম একা কেন থাকবে?? আফরিন কই?? আর রাফসান ঘরবন্দী ছিলো মানে কি?? তাকে সিলেটের কোনায় কোনায় খুজেছে মানে??
প্রশ্নে তার মাথা কিলবিল করতে থাকলো। একটা ঢোক গিলে বললো- উনি একা কেন থাকবেন??
চৈতালীর কথায় এবার বিরক্ত হলো জুনায়েদ । বললো
– তাহলে তোমার কি মনে হয়?? তোমার মত বিয়ে করে নিয়েছে??
– কিন্তু আমি তো সেদিন ওনাকে আর আফরিন কে এক রুমে দেখেছিলাম।
– দেখে কি ভাবলি?? আমার ভাই ওই মেয়ের সাথে পরকীয়া করছে?? শোন চৈতালী দেখায় ও ভুল থাকে। ভাইয়া ঠিকই বলে তুই ভাইয়া কে কখনো ভালই বাসিস নি। ভালবাসলে আমার ভাই কে চিনতে পারতি। ভুল বুঝতি না।
রাফিয়ার কথায় চৈতালীর পুরো দুনিয়া উল্টে গেছে। জিজ্ঞাসু চোখে ওদের দিকে তাকাতেই আরমান শিকদার এগিয়ে আসলেন। তারপর সেদিন চৈতালী হোটেল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর থেকে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো ওর কাছে।
এটাও বললেন রাফসান আফরিনের কথা সেদিন শুনতে চায় নি বলে আফরিন জোরপূর্বক জরিয়ে ধরেছিল ওকে।
আর সেটা দেখেই রাফসানকে ভুল বুঝছে চৈতালী।
চৈতালীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। না বুঝে কত বড় ভুল হয়ে গেছে তার দ্বারা। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় তিন বছর।
এখন সে কি করব?? কি করলে সব ঠিক হবে??
তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।
আদ্র কে বুকে চেপে এক দৌড়ে কটেজ থেকে বের হয়ে গেলো সে। তার এখন শান্তিমত কান্না করার জায়গা চাই।
সবাই কে সালাম দিয়ে চৈতালীর পিছন পিছন আরিফও বের হয়ে গেল
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ৪২
সামিরা আক্তার
জীবন নাটকের চেয়ে বেশি নাটকীয়। রাফসান কটেজের গার্ডেনে বসে এটাই ভাবছিল। আফরিন কে সে ভালবেসেছিলো। কিন্তু সেই ভালবাসার গভীরতা চৈতালীর মত ছিল না।
সে চৈতালী কে ভালবেসেছে পাগলের মত। কিন্তু চৈতালী হয়তো সেটা বুঝতে পারে নি। কিংবা ও বোঝাতে পারে নি।
আরিফ আর চৈতালী কে একসাথে দেখার মত এত শক্ত মন তার হয়ে ওঠে নি। তাই তো আজ ওখানে সে থাকে নি।
হঠাৎ চৈতালী কে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যেতে দেখলো। পিছন পিছন আরিফ। রাফসানের বুকের ভিতর কামড়ে উঠলো। মেয়েটা কে কি ওরা খুব বেশি বকেছে??
ও কাঁদছে কেন??
রাফসানের যে চৈতালীর কান্না সহ্য হয় না। থাক না সে কষ্টে। তার জীবনের কষ্ট সে মেনে নিয়েছে। তারপরও চৈতালী ভাল থাক…..
চৈতালীরই বা কি করার ছিল। নিজের থেকে ১৬ বছরের বড় একজন কে স্বামী হিসাবে কে মেনে নিতে পারে???
রাফসান একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এবার ভিতরে যাওয়া প্রয়োজন।
রাফসান ভিতরে এসে দেখলো রেবেকা কাঁদছেন। রাফিয়া ফোনে কথা বলছে, আর বাকি সবাই চুপচাপ বসে আছে।
নীরবতা ভেঙে রাফসানই প্রথম বললো- চৈতী কে বকেছো তোমরা?? দেখলাম কাঁদছে।
– তাতে তোর কি কাঁদলে?? একদম দরদ দেখাবি না। ঝাঁঝের সাথে বলে উঠলেন আয়শা।
– মা ব্যাপারটা দরদের নয়। ওর হাজবেন্ড ছিলো সাথে। ব্যাপারটা বোঝা উচিত।
– তোমার চৈতী কে কেও কিছু বলে নি ভাইয়া। ও কাঁদছে অনুশোচনায় বুঝছো?? এগিয়ে এসে বললো রাফিয়া।
রাফসান ভ্রু কুচকে বোনের দিকে তাকালো। এর মধ্যে আয়শা বেগম বললেন- অনুশোচনা না ছাই। ওই মেয়ের সব কিছু শুনে কিছুই হয় নি বুঝলি?? নাটক করছে।
রাফসান বুঝতে পারলো চৈতালী আজ সত্যিটা জানতে পেরেছে। যে ভুল বুঝে সেদিন হোটেল থেকে চলে আসছিলো সেই ভুল যে অহেতুক সেটা বুঝতে পেরেছে।
কিন্তু তাতে লাভ কি?? তার চৈতী তো আর তার হবে না। সে অন্য কারো ঘরণী।
অন্য কারো বাচ্চার মা। অন্য কারো বুকে ঘুমায়। ভাবতেই চোখ বুজে ফেললো রাফসান। মনে হলো কষ্টের একটা পাথর তার বুকের উপর কেউ চাঁপা দিয়ে রাখছে।
একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বললো- মা তুমি কি জানো আমার জীবনে যা যা ঘটে গেছে তার জন্য তুমি আর বাবা অনেকাংশে দায়ী।
আয়শা বেগম আর আসমাত শিকদার ছেলের দিকে চাইলেন। রাফিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। অবাক কন্ঠে বললো- কি বলছো তুমি ভাইয়া??
– ঠিকই বলছি। আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে তারপরও বলছি। আমি যখন আফরিন কে বিয়ে করে আনলাম বাবা আমাকে উদ্ভট একটা শর্ত দিয়ে বসলেন সিনেমার মত। এরকম শর্ত না দিলে না আফরিন যেতো না চৈতালী আসতো।
– কিন্তু বাবা তো তোমার ভালোর জন্যই এই কাজ করেছিল ভাইয়া। মেয়েটা লোভী ছিলো। তোমাকে না ও তোমার টাকা কে ভালবাসতো।
– সেটা আমি বুঝতাম। কাটতো আমার জীবন একটা লোভী মেয়ের সাথে। তাহলে হয়তো আজকের এই দিন দেখতে হতো না। আমার স্ত্রী কে অন্য কারো ঘরে দেখতো হতো না।
রাফিয়া আরও কিছু বলতে চাইছিলো জুনায়েদ আটকে দিলো। কারণ রাফসান অতিরিক্ত কষ্টে কথাগুলো বলছে।
একটু থেমে আবার বললো রাফসান, – চৈতীকেও আমি বিয়ে করতে চাই নি। চাইনি ওর জীবনটা নষ্ট করতে। কিন্তু তোমরা দুজন আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে দিয়েছো। আমি একা ভাল ছিলাম।সব দিক থেকে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।
কিন্তু এখন তো ভিতর থেকে গুড়িয়ে গেছি। আফরিন কে ভুলতে পারলেও চৈতী কে ভোলা আমার পহ্মে কোনদিন সম্ভব নয়।
তাই আজ আমার এই অবস্থার জন্য চৈতীর সাথে তোমরাও দায়ী।
কথাগুলো বলেই রাফসান ওখান থেকে চলে গেলো। আয়শা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আসমাত শিকদারের চোখেও পানি টলমল করতে লাগলো। রাফসানের কথা বোধ হয় খুব একটা মিথ্যা নয়।
** রাফসানের ওখান থেকে এসে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে চৈতালী। এখনও কেঁদে চলেছে। শিউলি একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আবার স্বামীর কাছে ফেরত এলো। রাত হয়ে গেছে। সে আদ্রকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এই মেয়ে দরজা খুলছে না কেন?? আবার আরিফ ও চুপ করে বসে আছে।
না থাকতে পেরে সে আরিফ কে বললো- কি হয়ছে চৈতালীর?? সেই দুপুর থেকে কাঁদছে??
আরিফ মুচকি হাঁসলো। বললো- ব্যাপার না। একাই থেমে যাবে। তবে ওর আর আদ্রর বোধহয় এবার ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।
শিউলি কিছুই বুঝলো না। ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর দিকে চেয়ে রইলো।
আরিফ বললো- সময়মত বুঝবে।
রাত গভীর হলে চৈতালীর কান্না কমে আসলো। খেয়াল হলো আদ্র নেই। তারমানে শিউলি নিয়ে শুয়ে পড়েছে। আদ্রর কথা ভাবতেই আবার কান্না পেলো তার। সে কেন সেদিন রাফসানের মুখোমুখি হলোনা??
তাহলেই তো আজকের দিনটা দেখতে হতো না।
নিজের মাথার চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছা করলো। তার একটু বোঝার ভুলে কত কিছু হয়ে গেলো। তার ছেলেটা বাবার কাছ থেকে দূরে। রাফসানও ছেলের থেকে দূরে।
তার ভালবাসায় কি ফাঁক ছিলো?? তা না হলে সে কেন রাফসান কে বুঝতে পারলো না। তার তো এটা বোঝা উচিত ছিলো যে মেয়ে রাফসানকে এত কষ্ট দিয়েছে রাফসান তার কাছে কেন যাবে??
ইস্ যে কথা আজ মাথায় আসলো সে কথা সেদিন কেন আসেনি??
চৈতালী আর ভাবতে পারলো না। রাফসানের নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে?? এমনকি এখনও হয়। কারণ রাফসান তো আরিফ কে ওর স্বামী হিসাবে জানে। নিজের স্ত্রী কে অন্যের সাথে দেখে বোধহয় ভিতরে ভিতরে কষ্টের পাহাড় নিয়ে ঘোরে।
চৈতালীর নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছে করলো। সব দিক দিয়েই রাফসান কে কষ্ট দিয়েছে সে।
আরেক বার ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।
** সেদিনের ঘটনার পর দুই মাস পেরিয়ে গেছে। রাফসান আর সিলেট আসে নি। চৈতালীর দু চোখ প্রতিদিন রাফসান কে খোঁজে। রোজ সকাল বিকাল রাফসানের কটেজের আশপাশে ঘুরে আসে কিন্তু রাফসান আসে না।
যদিও এর মাঝে ওর মা বাবা এসেছিলেন ওকে নিতে। দু দুবার এসে ফিরে গেছে। চৈতালী না ওদের সাথে গেছে, না সত্যি টা ওদের বলছে। আবার রাফসানের সাথে যোগাযোগ করারও চেষ্টা করে নি।
এই পুরো ব্যাপারটাই আরিফ যারপরনাই বিরক্ত। এই মেয়ে চাইছে কি কে জানে? একবার বলেছিল চৈতালী কে। উত্তরে চৈতালী বলেছে কোন মুখে বলবো??
আরিফ আর কথা বাড়ায় নি। সাধ করে যদি কেউ দুঃখের সাগরে ভাসতে চায় তাহলে তার কিছু বলার নেই।
আদ্রকে কোলে নিয়ে আজ চা বাগানে আসতেই অবাক হলো আরিফ। রাফসান এসেছে। আরিফের চোখ চকচক করে উঠলো। সে চায় রাফসান আর চৈতালীর সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাক। আদ্র তার বাবাকে ফিরে পাক।
সে আদ্রর দিকে তাকালো। আদ্র আজকাল দুএকটা কথা বলে। এই বাবা, মামা, দাদা, এই জাতীয় কমন শব্দ।
বেশির ভাগই অস্পষ্ট। আদ্রকে বললো- ব্যাটা তুই একমাত্র ভরসা। তুই পারিস একমাত্র বাপ মায়ের সম্পর্ক ঠিক করতে। ওই দেখ তোর বাবা।
আদ্র কি বুঝলো কে জানে?? কোল থেকে নেমে গেলো।আরিফ একটু আড়ালে দাঁড়ালো।
রাফসান আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এখানে এসেছে সে ডিভোর্স পেপার নিয়ে। চৈতী সই করে দিলেই চলে যাবে। যে মানুষটা আগেই অন্য কারো হয়ে গেছে সেই মানুষটার সঙ্গে কাগজের সম্পর্ক থাকলেই কি আর না থাকলেই কি।
এই চা বাগান টাও রাখবে না। থাকলেই চৈতীর মুখোমুখি হতে হবে। এই দুই মাসে বেহায়া মন অনেক বার চৈতী কে দেখতে চেয়েছে কিন্তু সে নিজেকে আটকে রেখেছে।
হঠাৎ পায়ের উপর ছোট একটা পায়ের অস্তিত্ব অনুভব করায় নিচে তাকালো সে। আদ্র দাড়ানো। তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
সে বসে পড়লো আদ্রর কাছে। আদ্র ভাঙা গলায় বললো- বা,বা।
রাফসানের বুকের ভিতর হু হু করে উঠলো। সব ঠিক থাকলে আদ্রর বাবা তো সেই হতো। সে একমনে আদ্রকে দেখতে লাগলো।
এই দু মাসে আদ্রকে দেখতে বড় বড় লাগছে। এই বয়সী বাচ্চারা কি তাড়াতাড়ি বাড়ে?? কি জানি।
ছেলেটা আরিফ আর চৈতালীর হলেও আরিফের মত নয় আদ্র। পুরোটাই চৈতালীর মত। এক নজরে চেয়ে রইলো আদ্রর দিকে। আদ্র তার শার্ট খামচ ধরে একমনে কিছু বলছে।
হঠাৎই রাফসানের চোখ গেলো আদ্রর ভুরুর দিকে। ঠিক রাফসানের মত একটা তিল। একদম একই রকম, একই জায়গায়।
রাফসানের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। আগেও তো আদ্রকে দেখেছে কিন্তু তিলটা খেয়াল করেনি সে। কি মনে করে আদ্রর একটা ছবি তুলে নিলো।
তারপর ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো তিলটার দিকে। হাত দিয়ে ছুতে যাবে হঠাৎ কোথা থেকে এসে ছো মেরে আদ্রকে কোলে নিলো চৈতালী।
(ক্রমশ)