#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২০
বছরের পর বছর____
বাতাসে জানালার পর্দাগুলো উড়ছে। বাহিরে রোদ তো আছেই।আবার মন ভালো কথা বাতাসটাও।রাত আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই পাশে থাকা সায়ানকে দেখতে পেলো।কি সুন্দর পাশ ফিরে শুয়ে।রাত সায়ানের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।শিশির ওয়াশরুমের ভেতর থেকে বের হতে হতে বললো,
-“উঠে গেছেন?”
রাত হালকা হাসলো।বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,
-“উঠবই তো। আজ কত্ত কাজ!কেয়ার বিয়ে বলে কথা।দুঘন্টার জন্য চোখটা লাগলো শুধু।”
-“এত্ত কাজ করতে হবে না রাত।লোক আছে।তুমি আরেকটু ঘুমিয়ে নাও।”
ঘুমকাতুরে রাত তবুও না করলো।সে ঘুমাবে না।তার বহু কাজ বাকি।শিশিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগে,
-“আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি একটু সায়ানকে দেখে রাখো। নয়ত দৌড়ে এদিক ওদিক চলে যাবে আমায় খুঁজতে। ”
বলেই রাত দরজার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পিছনে হাতে টান পড়ায় আঁটকে যায়।পিছনে ঘুরে শিশিরের অসহায় মুখপানে তাকিয়ে ভ্রুর সাহায্যে ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
-“কি হলো?”
শিশির রাতকে এক টানে বুকে ফেলে বললো,
-“আর আমাকে কে দেখবে রাত?”
রাতের হাত গিয়ে পড়লো শিশিরের বুকে। রাতকে চুপ থাকতে দেখে শিশির রাতের বাহু ধরে বললো,
-“বলো?”
-“কি বলতাম!”
-“আমাকে কে দেখবে?”
-“তোমাকে দেখার কি আছে স্যার। তুমি কি ছোট বাচ্চা নাকি! ”
বলেই মুখ ভেংচি কাটলো রাত।শিশির রাতের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো,
-“অবশ্যই।”
এদিকে রাত তো রেগে ফায়ার।কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
-“ঠোঁটে কে চিমটি দেয়?”
-“কেন আমি!”
রাত দাঁত কটমট করে তাকালো।শিশির তো দাঁত কেলাচ্ছে। সকাল সকাল রাতকে জ্বালাতে বেশ লাগে তার। রাতের কটমট করা চেহারাটা বেশ ভালো লাগে।রাত শিশিরের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
-“সরো তো সরো।”
শিশির যেন আরো মজা পেল বিষয়টাতে। রাতের কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।কপালের চুলগুলো সরিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
-“রাত তোমার মনে হয় না যে তোমার আমার কথা চিন্তা করে কিছুক্ষণ ঘরে থাকা উচিত?”
রাত শিশিরের ভালোবাসার স্পর্শ নিতে নিতে বললো,
-“ঘরে থেকে আপনার সব উদ্ভট কান্ড সহ্য করতে হবে।আর কোনো কাজের কাজ হবে কি?”
-“তো করো সহ্য।”
বলেই শিশির রাতের হাত ধরে ঘুরাতে লাগলো।আর হাত দিয়ে মিউজিক বক্সের রিমোট নিয়ে একটা সফট টুন ছেড়ে দিলো। রাত রাগী গলায় বললো,
-“সকাল সকাল ভিমরতি ধরেছে?”
-“হ্যা।”(হেসে)
-“ছেলেটা উঠুক খালি।পরে তোমার খবর আছে।”
শিশির নিজের মত করে রাতকে নাচাচ্ছে। রাতের খারাপ লাগছে এমনটা নয়। তারও ভালোই লাগছে।কিন্তু তার শরীরটা তেমন ভালো নয়।তাই কিছুক্ষণ পরেই মাথাটা ঘুরে উঠলো।রাত মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো।শিশির তাড়াতাড়ি করে মিউজিক অফ করে রাতের হাত ধরে বললো,
-“কি হয়েছে রাত?আর ইউ ওকে?”
-“মাথাটা ঘুরছে।”
-“হঠাৎ!!”
-“না কিছুদিন ধরেই।”
শিশির রেগে গেলো। ধমক দিয়ে বললো,
-“এই মেয়ে!এতদিন ধরে মাথা ঘুরছে আর আমায় বলো নি তুমি!প্রেশার ফল করেছে মনে হয়।দাঁড়াও আমি ডিম দুধ আর ব্রেকফাস্ট আনছি।আরো না খেয়ে থাকো।”
রাত কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“আমি না খেয়ে থাকিনি।”
-“তোমায় চিনি না আমি?”(চোখ রাঙিয়ে)
শিশিরের চোখ রাঙানোতে রাত চুপ হয়ে গেলো।ঠোঁট উল্টে মাথা নিচু করে ফেললো।এদিকে শিশির রাতকে বকতে বকতে দরজার বাহিরে চলে গেলো।রাত পা তুলে বসলো।সায়ানের মাথায় হাত বুলালো।ছেলেটা হাঁটতে শিখেছে, আদো আদো গলায় কথা বলে।কি সুন্দর করে রাতকে মা বলে ডাকে।প্রথম যেদিন রাতকে মা বলে ডেকেছিল রাতের সে কি কান্না!আলাদা অনুভূতি পাচ্ছিলো সে।সেগুলো ভেবেই রাত ঘুমন্ত সায়ানের হাতে চুমু দিলো।আর বললো,
-“আর মাত্র ১ মাস। তারপর তোর ৩ বছর পূর্ণ হবে।”
রাতের কথা মধ্যেই শিশির খাবারের ট্রে হাতে রুমে ঢুকলো।রাত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এটা কিন্তু গ্রামের বাড়ি!লোকে নানান কথা বলবে। আমাকে নিচে যেতে হবে।গেলাম।”
-“যেখানে বসে আছো সেখানেই বসে থাকো।”
গম্ভীর কণ্ঠে বললো শিশির।তারপর রাতের সামনে বসে সিদ্ধ ডিম ধরে বললো,
-“নাও,আমি খাইয়ে দিই।হা করো।”
রাত কাছে যেতেই নাক ছিটকে বললো,
-“ইয়াক!বাজে গন্ধ।”
শিশির অবাক হয়ে বললো,
-“না রাত। এটা একদম ফ্রেশ।মাত্র সিদ্ধ করে আনলাম।”
-“না এটা গন্ধ।”
বলেই রাত ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো। শিশির একটু মুখে দিয়ে বললো,
-“এই দেখো গন্ধ নেই।নাও এবার তুমি খাও।”
শিশিরের জোরাজোরি তে রাতকে খেতেই হলো।এবার শিশির রাতের দিকে দুধ এগিয়ে দিলো।কিন্তু এটা তো রাত খাবেই না।কোনোমতেই না। বাধ্য হয়ে শিশির রাতকে রুটি ভাজি দিলো। অন্যসময় হলে রাত খেতো না।কিন্তু শিশিরের এভাবে বসে থাকায় রাতকে খেতে হচ্ছে। কোনোমতে গিলে রাত আধশোয়া হয়ে বসে পড়লো।শিশির হেসে বললো,
-“এখন না শরীরে জোর টা আসবে!”
রাত মুখ ভেংচি দিলো।শিশির রাতের গাল টেনে বললো,
-“ঝগড়া করার শক্তি।”
বলেই শিশির ট্রে নিয়ে উঠে পড়লো।আর বলতে লাগলো,
-“মাকে বলেছি।মা বলেছে তোমায় রেস্ট নিতে।আর একটু পর এসে মা দেখে যাবে।”
-“এটা গ্রাম। লোকে নানান কথা শুনাবে। আমি এক্ষুনি যাবো।কত কাজ বাকি।”
-“চুপ করে শুয়ে থাকো।”
রাত বসে রইলো।শিশির দরজা দিয়ে বের হবে এমন সময় পিছন থেকে ধুপধাপ আওয়াজ পেলো।শিশির পিছনে ফিরে দেখলো রাত বিছানায় নেই।ওয়াশরুম থেকে শব্দ আসছে।শিশির তাড়াতাড়ি করে ট্রেটা টেবিলে রেখে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। রাত বেসিনে গড়গড় করে বমি করছে।শিশির রাতের মাথায় হাত দিয়ে বললো,
-“তোমার বমি হচ্ছে কেন রাত?”
-“….”
-“এসো মাথায় পানি ঢালবে।”
বলেই শিশির রাতকে ঝর্ণার নিচে দাঁড় করিয়ে দিলো। রাত দুহাতে নিজেকে ঢেকে বললো,
-“তোমাকে কে বলেছে আমাকে সকাল সকাল এখানে দাঁড় করাতে!”
-“একদম চুপ!”
শিশির ধমকে উঠলো।
-“চুপচাপ গোসল করে বাহিরে এসো।”
বলেই শিশির বের হয়ে গেলো।রাত বাদ্ধ হয়ে গোসল করে বের হয়ে এলো চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে।কিন্তু তার অসুস্থতা কমলো না।মাথাটা এখনো ঘুরছে।কিন্তু শিশিরকে বলছে না। পাগল নাকি!শিশিরকে বলে বকা খাবে?শিশির রুমে পায়চারী করছে।রাতকে বের হতে দেখে বললো,
-“এখন কেমন লাগছে?”
-“বেটার।”
শিশির কিছু বলতে যাবে তখনই দেখলো সায়ান রাতের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে।সে তার মায়ের আঁচল ধরে বললো,
(বাচ্চারা একটু আদো আদো ভাষায় কথা বলে।কিন্তু এখানে আদো আদো ভাষায় লিখলে আমারি হাসি পায়😂।তাই স্বাভাবিক ভাবেই লিখছি। বুঝে পড়ে নিবেন।থ্যাংক ইউ অল🥰)
-“মা,তোমার কি হয়েছে?”
রাত হাসলো।সায়ানকে কোলে নিতে নিতে বললো,
-“কিছু না বাবা।এমনি মাথা টা ঘুরছিলো।”
সায়ান তার মায়ের গালে হাত দিয়ে বললো,
-“নিচে যাবো নিচে।”
রাত মাথা নাড়ায়।শিশির সায়ানকে কোলে নিতে নিতে বললো,
-“সায়ান তোমার মা অসুস্থ। তাই সে এখন রুমে থাকুক। চলো আমরা ঘুরে আসি।”
সায়ান কিছুক্ষণ অবুঝ নয়নে তার মায়ের অসহায় মুখপানে তাকিয়ে রইলো।তারপর বাবার গলা জড়িয়ে বললো,
-“আচ্ছা!মাম তুমি শুয়ে থাকো।আমি আসছি দাদুকে নিয়ে।”
রাত সায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।সায়ান তার বাবার গলা জড়িয়ে বাহিরে চলে গেলো। শিশির যেতে যেতে বললো,
-“প্রভলেম হলে নাম্বারে মিসড কল দিয়ো। আমি আশেপাশেই আছি।”
-“এত টেনশন করতে হবে না ধূর।”
-“বেশি বুঝিও না।”
সায়ানও বাবার নকল করে ভূবন ভুলানো হাসি দিয়ে তার মাকে বললো,
-“বেশি বুঝিয়ো না ”
রাত আর বলবে?চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।আসলেই তার মাথাটা ধরেছে ভীষণ। আস্তে আস্তে তার চোখ লেগে এলো।ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো মুহূর্তেই।
______
কেয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ।নিয়ম অনুযায়ী কেয়াকে এখনই শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে।কিন্তু গ্রাম এলাকা আর ভীষণ রাত হওয়ায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ভোরবেলায় কনেকে তুলে দেয়া হবে।আপাতত সবাই মিলে আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে। সব কাজিনরা মিলে মজা,আনন্দ-উল্লাস করবে।রাত এক পাশে দাড়িয়ে আছে।শিশির একটু দূরেই ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আর বাকি সবাই বর-কনেকে নিয়ে মজা করছে।কিছুক্ষণ পর রাতের পাশে এসে রাতের শ্বাশুড়ি আর কিছু মহিলারা দাঁড়ালো।রাত সবাইকে সালাম দিলো।চৈতী বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“এটা আমার বউমা। রাত।”
_”মাইয়া তো ভালাই।কিন্তু পোলাপাইন হইছে?”
রাতের বুক ধক করে উঠলো।এটারই ভয় হচ্ছিলো।চৈতী বেগম জোরপূর্বক হেসে বললেন,
-“একটা ছেলে তো আছেই। আর কি লাগে আমাদের আপা।”
_”হেইডা তো আছেই কেয়ার মা।কিন্তু হেইডা তো প্রথম বউডার। এই বউডার বাচ্চা গাচ্চা নাই?”
রাতের আজ উত্তর দেয়ার শক্তিই হচ্ছে না।শরীরটা এমনিই খারাপ।তার উপর এসব কথা গিলতে হচ্ছে। শিশিরকেও পাচ্ছে না। চৈতী বেগম বিষয়টা বুঝে বললেন,
-“আচ্ছা চলো আমার বেয়াইনকে দেখাই।”
-“আরে খাড়াও। আগে এইডা কও তোমার বউ কি মা হইতে পারতো না?বন্ধ্যা নাকি?এমন বউ বিয়া করাইয়া আনছো আমগোর শিশিরের লাইগ্গা।মাইয়ার কি অভাব পড়ছিলো?এমন বউ জুটে ক্যান শিশিরের কপালে?”
রাত চুপ করে মাথা নিচু করে আছে।চোখে জল টলমল করছে।সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেই মহিলাটা তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“কি গো বউ? বাচ্চাকাচ্চা হইবো না? না হইলে কও। আমরা শিশিরের আবার বিয়া দিমু।”
রাত কোনোমতে নিজেকে সামলে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
-“আপনার মেয়ের নাম জুই না?ওকে আগে বিয়ে দেন। শুনলাম ২৪ পার হচ্ছে। আগে একটা বিদায় করেন পরে নাহয় আমাদের পরিবারল দখলদারি করবেন।”
বলেই রাত সেখান থেকে দৌড় লাগায়।কারণ মহিলা আরো কিছু কথা বলবে যা গিলবার শক্তি তার নাই। সিড়ির কাছে আসতেই হঠাৎ রাতের মাথাটা ঘুরে উঠলো।একটা সিড়িতে পা দিতেই মাথায় হাত দিয়ে পড়ে গেলো।সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।না পড়েনি!পরিচিত একটা ঘ্রাণ আসছে।শিশির ধরে ফেলেছে তাকে!
#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২১
টিপটিপ করে চোখ খুলে নিজেকে বেডে শোয়া অবস্থায় পেলো রাত।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলো শিশির আর চৈতী বেগমকে। দুজনই চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পাশেই কেয়া আর রিসাব।দরজার বাহির থেকে কোলাহলের শব্দ আসছে।অর্থাৎ বাহিরেও কিছু মানুষ রয়েছে। রাতের পাশেই একজন ডাক্তার।রাত অসুস্থ গলায় বললো,
-“আমি এখানে?”
শিশির মুখটা ঘুরিয়ে বললো,
-“হাসপাতালের বেডে আশা করেছিলে?”
রাত অবাক হয়ে তাকালো শিয়িরের দিকে।চৈতী বেগম ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টায় বললেন,
-“উফফ শিশির!ও অসুস্থ। এক্ষুণি তোর বকতে হবে?”
-“তো কি করব মা?ও নিজের খেয়াল রাখে আদৌ?ছুটোছুটি সারাদিন।খাওয়া-দাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নাই। এখন যে বারংবার মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছে।
চৈতী বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রাতের পাশে বসা ডাক্তার মহিলাটি হেসে বলতে লাগলেন,
-“শিশির চৌধুরী, এটা তো আরো খুশির খবর।”
শিশিরের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো।অবাক হয়ে তার প্রশ্ন,
-“মানে?”
-“আরে এই মাথা ঘুরা তো সেই ঘুরা নয় শিশির চৌধুরী।মোট কথা হলো আপনি আবারো বাবা হতে চলেছেন।”
রাত অবাকের শীর্ষে।মুখে হাত তার।শিশির বেশ খুশি হলো।কিন্তু সেও অবাক কম হয়নি।রাতের পাশে বসতে বসতে বললো,
-“কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ডক্টর?”
চৈতী বেগম খুশি হলেন বেশ।কিন্তু হঠাৎ শিশিরের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। কেয়া তো বেশ খুশি। রাতের হাত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলছে,
-“ভাইয়া তো প্রশ্ন রাখ তো!আমাদের বাসায় আবারো ছোট্ট একজন আসতে চলেছে ভাবী। আমার যে কত্ত আনন্দ হচ্ছে।”
রিসাব এসে রাতকে কনগ্রেস জানায়। তারপর কেয়ার কানে কানে বলতে লাগে,
-“এবার আমাদের পালা।”
-“সবে তো বিয়ে হলো মশাই।”
রিসাব হেসে ফেললো। এদিকে শিশির রাতের হাত ধরে বলতে লাগে,
-“ডক্টর?রাতের কোনো রিস্ক নেই তো?”
ডাক্তার হাসিমুখে বললেন,
-“একদমই না।কিসের রিস্ক।আল্লাহ চাইলে আর নিজের খেয়াল রাখলে সুস্থ একটা বাচ্চা হবে ইনশাআল্লাহ! ”
শিশির আর কোনো প্রশ্ন করলো না।তার আর কিচ্ছু জানবার নেই।তার রাত সুস্থ থাকলেই হয়।কিন্তু রাতের মনের প্রশ্ন তো সরেনি।রাত ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“কিন্তু আপু আমরা তো অন্যকিছু জানতাম।”
-“কি জানতে?”(অবাক হয়ে)
রাত চারিদিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতেই আস্তে আস্তে সবাই বেরিয়ে গেলো।শুধু শিশির গেলো না।শিশির যে রাতের স্বামী!রাত এবার বলতে লাগে,
-“আমার ভীষণ পেট ব্যাথা করত মাসের ওই সময়টায়।তাই জন্যে ডাক্তারের কাছে যাই।কিন্তু যেদিন আমার শিশিরের সাথে বিয়ে হবে ওইদিনের তিনদিন আগে আম্মু রিপোর্ট আনে কারণ আমি কলেজে ছিলাম।সেদিন জানতে পারি যে আমি কখনো মা হতে পারবো না।”
বলতে বলতে রাতের চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। ডাক্তার রাতকে জোর দিয়ে বললেন,
-“তেমন কিছুই না মিসেস চৌধুরী। হয়ত আপনার কনসিভ করতে সময় লাগবে এমন কিছু লেখা থাকতে পারে।কিন্তু মা হতে পারবেন না তেমন কিছুই না।”
রাত তো খুশিতে আত্মহারা।চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,
-“সত্যি বলছেন!”
-“একদম!আর মিস্টার চৌধুরী? ”
শিশিরও চোখ মুছতে মুছতে বললো,
-“জ্বী?”
-“কালকে চেম্বারে আসবেন সময় করে।পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সব জানাবো।কিন্তু এটা সিউর থাকুন যে মা হতে পারবেন না এই কথাটা পুরোটাই ভুয়া।কারণ আমার তো ওনাকে সুস্থই লাগলো।”
-“জ্বী।আসুন এগিয়ে দি।”
বলতে বলতে শিশির ডাক্তারের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে।আর ডাক্তারও শিশিরকে বিভিন্ন উপদেশ দিচ্ছেন।রাত মনে মনে ভাবতে লাগলো,
-“তবে কি আম্মু আমায় ভুয়া রিপোর্ট দেখালো?কিন্তু কেন!!মা নিজের মেয়ের সাথে এমনটা কেন করবেন?”
ভাবতে ভাবতে রাত উঠতে নিলো। ঠিক তখনই সুপ হাতে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন চৈতী বেগম। রাতকে উঠতে দেখে বললেন,
-“শুয়ে থাক।উঠতে হবে না।”
-“আমার আম্মুর সাথে কথা বলতে হবে।”
-“তোর আম্মু শুয়ে পড়েছে রাত। ওনার বাতের ব্যাথা বেড়েছে। আর তোর যে এতকিছু হলো উনি টেরও পাননি। আমিই ডাকিনি। সারাদিন পর চোখটা লাগালেন।”
রাত আর উঠলো না।এই বিষয়ের জন্যে মা কে ঘুম থেকে তোলাটা ভালো দোখায় না।চৈতী বেগম রাতের দিকে সুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে।”
-“মানে!!”(অবাক হয়ে)
চৈতী বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।তারপর রাতের হাত ধরে বলতে লাগলেন,
-“তোর মা আমার কথায় তোকে মিথ্যা বলেছিল।”
বিস্ময়ে রাতের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।আস্তে আস্তে চৈতী বেগমের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।চৈতী বেগম রাতের পাশে বসে বলতে লাগলো,
-“হ্যা রাত।তোর বাবা-মাকে যখন বিয়ের প্রস্তাব দিই প্রথমে ওনারা রাজি হননি।কিন্তু শিশির আর সায়ানের কথা ভেবে রাজি হয়ে যান।তাছাড়া তোদের গ্রামের একটা বখাটে ছেলে নাকি তোর পিছু পড়েছিলো?তোর বাবা-মাকে অনেক ভয়ও দেখাচ্ছিল।তোকে বলেছে কিনা জানি না।তাই তোকে হারানোর ভয়ে তারা বিয়েতে রাজি হয়ে যান।তারপরও আমার মনে একটা খটকা থেকেই যায় যে রাত নিজে মা হলে যদি সায়ানকে ভুলে যায়?সেই ভয়ে আমি তোর মাকে মিথ্যা বলতে বলি।”
রাত মুখটা ঘুরিয়ে ফেললো। এতরাত কেঁদেছে একটা মিথ্যার জন্য!চৈতী বেগমকের একটা মিথ্যা রাতকে শত রাত্রি কান্না করিয়েছে।সে কথা রাত কি করে ভুলবে।সে নিম্ন স্বরে বললো,
-“তোমার থেকে এটা আশা করিনি মা।”
চৈতী বেগম এবার কেঁদেই ফেললেন। রাতের হাতটা আবারো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলতে লাগেন,
-“রাত তুই আমায় ভুল বুঝিস না। আমি সেই মুহূর্তে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মিতালির এসবের জন্যে!আমি চেয়েছিলাম যেন সায়ান আর শিশির ভালো থাকে! ”
-“আর আমি?”(কান্নাজড়িত গলায়)
-“যেন তুইও ভালো থাকিস।”(গালে হাত দিয়ে)
-“না মা। তুমি আমার ভালোর কথা চিন্তা করলে এত বড় মিথ্যাটা বলতে না। আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।”
-“আমাকে ক্ষমা করে দে রাত।আমি বুঝতে পারিনি তখন।আর আমি ভেবেছিলাম তুই হয়ত সায়ানের মধ্যেই নিজের সন্তানকে খুঁজে নিচ্ছিস।”
-“হ্যা নিয়েছি। আমি সায়ানের মধ্যেই নিজের সন্তানকে খুঁজে নিয়েছি।কিন্তু নিজে গর্ভে ৯ মাস রাখার পর জন্ম দেয়ার অধিকারটা অর্জন করতে পারিনি। সেই স্বাদ তো সব মা ই চায়। তুমি চাওনি?”
চৈতী বেগম মাথাটা নিচু করে ফেললেন।তার রাতকে বলা উচিত ছিলোরাত আবারো বলতে লাগে,
-“আমি মা হতে পারব,এটা জানার পরও আমি সায়ানকে মায়ের মতই ভালোবাসা দিতাম।যেদিন থেকে শিশিরের সাথে বিয়ে হয়েছে সেদিন থেকেই শিশিরকে স্বামী আর সায়ানকে নিজের সন্তান ভেবে এসেছি।পুরো সংসারটা সামলেছি।তারপরেও প্রতিদানে এটা পেলাম?”
-“আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে রে রাত। তোর কষ্টটা বুঝতে পারছি। পারলে ক্ষমা করে দিস।”
বলেই চৈতী বেগম দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। রাত কান্নায় ভেঙে পড়লো।নিজের মা-বাবা ও শ্বাশুড়ির এমন কাজে সে বেশ কষ্ট পেয়েছে।বেশকিছুক্ষণ পর রুমে ঢুকে শিশির।রাতকে এভাবে কাঁদতে দেখে শিশিরের তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।তাড়াহুড়া করে রাতের পাশে বসতে বসতে বললো,
-“কি হয়েছে রাত?কাঁদছো কেন বউ?”
-“শ..শিশির!”
বলেই রাত শিশিরের বুকে আছড়ে পড়লো।শিশির ভাবলো রাতের হয়ত এটা সুখের কান্না।মা হতে পারবে বলে।শিশির মুচকি হেসে বললো,
-“আর কেঁদো না রাত। এবার তো আমাদের সুখের সময়।”
রাত নিজেকে সামলে নিলো।নাক টেনে বললো,
-“আমি মা হতে পারব না। এই মিথ্যা কথাটা কে বলেছে জানো?”
রাত সব কথা শিশিরকে খুলে বললো।শিশির রাতের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-“দেখ রাত! আমার মায়ের চিন্তা যেমন আমাকে আর সায়ানকে নিয়ে ঠিক তেমনই তোমার মা-বাবারও চিন্তা ছিলো তোমাকে নিয়ে।তাই ওনারাও না করতে পারেনি। আর মা ও #শর্ত দিয়ে দেয়।”
-“আমাদের পুরো বিয়েটাই আছে একটা #শর্ত এর উপর।”
-“না থাকলে কি আমাদের বিয়েটা হতো রাত?আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই তো করেন।”(মুচকি হেসে)
রাত এবার একটু শান্ত হলো।এতটাও রিয়াক্ট করা উচিত হয়নি।শিশির আবার বললো,
-“পিছনে যা হইছে সব বাদ। সবব বাদদ!একদম ভুলে যাও। ”
-“হুমম।”
-“সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের একটা রাজকন্যার আগমন ঘটতে যাচ্ছে।”
রাত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“রাজকন্যা কেন?রাজকুমারও তো হতে পারে!”
-“রাজকুমার তো আছেই।এবার একটা রাজকন্যার দরকার। একদম রাতের মত।”
বলেই সে রাতের গাল টেনে দিলো।রাত হেসে ফেললো।শিশির রাতের চোখ মুছে দিয়ে বললো,
-“নো কান্না।বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। বর্তমানই আসল। বর্তমানে আমরা সবাই সুখে আছি,আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি।এটাই অনেক।”(মুচকি হেসে)
রাত শিশিরের কাঁধে মাথা দিয়ে বললো,
-“হুমম।”
শিশির টি-টেবিলে থাকা সুপের বাটিটা দেখে বললো,
-“একি সুপটা খাওনি?নিশ্চয়ই মা এনেছিলো।”
-“হুমম।”
-“এখনো এসব করবে?ঠিকমত খাবে না?”
রাত ঠোঁট উল্টে ফেললো।শিশির রাতকে সুপটা খাওয়াচ্ছে যত্ন করে।রাত মনে মনে ভাবছে,
-“এমন বর আর কই পাব?শিশিরের মত মানুষ আসলেই অনেক কম সংখ্যক রয়েছে। ”
আচমকা রাত বলে উঠলো,
-“আমার ছেলে কই? কতক্ষণ ধরে দেখি না। খায়নি ও এখনো।”
শিশির রাতকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,
-“মা খাইয়ে দিয়েছে।ও রিসাব আর কেয়ার সাথে আছে।”
-“ওরা আমার অসুস্থতার জন্যে যেতে পারলো না।”
-“বিকালে যাবে।”
-“হু।”
ঠিক তখনই টুকটুক পায়ে ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো সায়ান।পিছনেই শিশিরের একটা কাজিন। সে রাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“ভাবী,দিয়ে গেলাম ওকে।”
রাত সায় দিলো। সায়ান কি সুন্দর দৌড়ে মায়ের কাছে চলে এলো। আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে মায়ের পেটে উপর শুয়ে পড়লো।আর রাত মুচকি হেসে সায়ানের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,
-“বাবা,খেয়েছো তুমি?”
-“খেয়েছি।”
শিশির সায়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“সায়ান,তুমি পেটে শুচ্ছো কেন আব্বু? এখানে তল তোমার ছোট্ট বনু আছে। সে কষ্ট পাবে না?”
সায়ান বেশ অবাক হলো।পেটের ভিতর যে তার ছেট্ট বনু থাকতে পারে এই কথাটা তার মাথায় ঢুকেনি বা কখনও মাথায় আসেওনি।সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-“মিথ্যা বলছো কেন বাবাই।পেটের ভিতর কি বনু থাকে নাকি?”
রাত হাসছে।শিশির সায়ানকে কেলে নিতে নিতে বললো,
-“হ্যা আব্বু। এখানে তোমার ছোট্ট বনু আছে।সে আসবে,তুমি তার সাথে খেলবে।বোনকে দেখে রাখবে।”
-“কবে আসবে বাবাই। বলো না! বলো না।”
রাত এবার মুখ খুললো।হালকা হেসে বললো,
-“আসতে তো একটু সময় লাগবে।কিন্তু ততদিনে সায়ানকে ভালো হয়ে থাকতে হবে।গুড বয়ের মত। যেন বোনকে শিখাতে পারে।কোলে নিতে পারে।”
-“থাকব তো মাম।”
বলেই সায়ান তার বাবার কোল থেকে নেমে পড়লো।রাতের পেটে কান দিয়ে বললো,
-“বনু, তুমি শুনতে পারছো? তাড়াতাড়ি চলে আসো হুম? তোমাকে আমি চকলেট দিবো অনেকগুলা।”
রাত মুহূর্তটা অনুভব করছে। আর শিশির রাতকে ভরসা দিচ্ছে। মন্দ হতোনা যদি মুহূর্তটা এখানেই যেত।এত সুখ রাত কই রাখবে?
চলবে….
(