” ডিভোর্স! আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম শুভ্রতা আর আজ কি না তুমি আমার থেকে আলাদা হতে চাইছো? আমাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে? আমি ছাড়া অন্য পুরুষ যখন তোমায় ছোঁবে তখন তোমার গা ঘিনঘিন করবে না?”
ইমতিয়াজের কথার পরিপ্রেক্ষিতে শুভ্রতা নরমস্বরে বলে ওঠে,
” আমি বাঁচার মতো বাঁচতে চাই ইমতিয়াজ, তার জন্য ডিভোর্সই একমাত্র পথ।”
” তুমি যা বলবে আমি তাই করব শুভ্রতা। প্লিজ আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। তুমি তো জানো তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমিই একমাত্র আশ্রয়স্থল। ”
” হ্যাঁ আমি ছাড়া তোমাকে কেউ টাকা দিয়ে চলাবেও না, একটা ছেলের চাকরি বা কিছু করার জন্য তিনটা বছর অনেকটা সময় ইমতিয়াজ। আর তোমার ব্যবহার! সেটা আর এখন না বলি। আমার কোন শত্রুও যেন তোমার মতো ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে না করে, তোমার মতো কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করলে যে ভালোবাসা নিজে আত্মহ*ত্যা করে ম*র*বে।”
” আমি বলছি তো শুভ্রতা তুমি যা বলবে আমি তাই করব, এবার শুধু বলেই দেখ।”
” এই তিন বছরে তুমি এই কথা অনেকবার বলেছো ইমতিয়াজ। ”
” এবারই শেষ প্লিজ আমাকে এই একটাবার সুযোগ দাও।”
” তুমি আমার আমাকে কথা দিয়েছিলে আমি যেভাবে চাইবো তুমি সেভাবেই চলবে, সেটা আর কবে বলতে পারো?
আমি দেখতে এতটা খারাপ না, পড়াশোনায় এত খারাপ না যে আমি ভালো কাউকে পেতাম না। আমার ক্লাসমেটরা যদি বড় চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, বিসিএস ক্যাডার বিয়ে করতে পারে আমি তাদের সমান না হোক তবু কোন একটা অবস্থানের কাউকে বিয়ে করতে পারতাম।
তোমাকে কিছু করার কথা বললেই বলো আমি বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলাম অথচ তুমি ভুলে গেছো আমি কতবার ব্রেকাপ করতে চেয়েছিলাম, করেছিলামও আর তুমি সুইসাইড করতে গেছো বারবার।
তোমার সৎমা, অন্য কারো কাছে মানুষ হয়েছো আরো অনেক কিছু জেনেও তোমার সাথে ভালো থাকার জন্য বিয়ে করছিলাম তার দাম আমি তিন বছর হচ্ছে পাচ্ছি। খুব দাম দিয়েছো তুমি আমার ভালোবাসার। এই তিনটা বছর আমি নিজে ছোটখাটো একটা জব করে সংসার চালিয়েছি তোমাকে চালিয়েছি তোমাকে কাজের কথা বললেই সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়। আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। বিয়ের দেনমোহর তোমাকে দিতে হবে না, আমাকে যে দুই একটা গহনা দেওয়া হয়েছিল তা বিছানার ওপর বক্সে আছে দেখে নিও। আমি খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স ফাইল করব। আসছি, ভালো থেকো আর পরবর্তীতে কারো জীবনে জড়ানোর আগে তাকে ভালো রাখার দায়িত্বটা নিও।”
” যা চলে যা তুই, এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। আমি নিজেকে নিজে ঠিক চালিয়ে নেব।”
ইমতিয়াজের কথায় শুভ্রতা নিজে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে অন্তত এরকম অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটাতে হবে না তাই বিয়ের তিন বছরের মাথায় শুভ্রতা সিদ্ধান্ত নিল এবার বিবাহ বিচ্ছেদই পারে তাকে একটু বাঁচার সুযোগ করে দিতে। গাড়িতে ওঠা মাত্রই অতীত কেমন যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ইমতিয়াজ শুভ্রতার স্কুলের বান্ধবীর চাচাতো ভাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় বান্ধবীর কোন একটা পোস্টের কমেন্টে তাদের পরিচয় হয়েছিল। কমেন্ট থেকে রিপ্লাই, ফ্রেন্ডরিকুয়েষ্ট, মেসেজিং, বন্ধুত্ব, ভালো লাগা অতঃপর প্রেমে পড়া।
প্রথম যেদিন তারা দেখা করেছিল সেদিন শুভ্রতা নেভি ব্লু রঙের জামা পড়েছিল, চুল ছেড়ে দেওয়া চোখে চশমা কি যে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল সেদিন তাকে! এই প্রথমবার শুভ্রতাকে দেখেই ইমতিয়াজ প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইমতিয়াজকে মোটেও তার পছন্দ হয় না সেদিন। কেমন রোগা পাতলা চেহারা! বাড়ি এসে সরাসরি ইমতিয়াজের প্রোপোজালে ‘না’ করতে না পেরে শুভ্রতা তিন মাস সময় নেয় এটা বলে যে, ” আপনার প্রতি আমার যদি কোন অনুভূতি থাকে তাহলে এই তিন মাসের মধ্যে আমি আপনাকে নক দিব আর যদি আমি নক না দিই তাহলে ভেবে নিবেন আপনার প্রতি আমার কোন অনুভূতি নেই, তখন আপনি আমাকে আর মেসেজ দিবেন না।”
ইমতিয়াজ বুঝতে পারে শুভ্রতা হয়তো তাকে পছন্দ করে নি তাই সময় চাইছে। সেও কোন কথা বাড়ায় না শুভ্রতার কথায় রাজি হয়ে যায়।
শুভ্রতার কথানুযায়ী তিনমাস কেটে যায়। এই তিন মাস ইমতিয়াজের সাথে কথা না বলে খুব ভালো দিন কাটে তার। কিন্তু যেদিন তিনমাস পূরণ হবে তার কয়েকদিন আগে থেকেই শুভ্রতার চিন্তা বেড়ে যায় এটা ভেবে যে, ছেলেটা যদি আবার নক দেয়!
যেই ভাবা সেই কাজ তিনমাস পূরণ হওয়ার দিনই সকালবেলা তার ফোনে মেসেজ আসে। শুভ্রতাও চাপ না নিয়ে সাহস করে বলে দেয় সে সম্পর্কে জড়াবে না। ছেলেটা মেনেও নেয় কিন্তু কয়েকটা দিন একটু কথা বলতে বলে। শুভ্রতাও টুকটাক কথা বলে। এই সুযোগটাই ব্যবহার করে ইমতিয়াজ। সে যে অনাথ, তার মা নেই ইত্যাদি অনেক কথাই বলে সে শুভ্রতাকে। শুভ্রতার মনেও ইমতিয়াজের জন্য খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তাদের সম্পর্ক ও হয়ে যায়। কিন্তু সম্পর্ক হওয়ার পরই ইমতিয়াজের রাগ বাড়তে থাকে। কিছু হলেই রাগ করা, বকাবকি করা যেন নিত্যদিনের রুটিন হয়ে যায়। শুভ্রতা ব্রেকাপ করতে চাইলেই সে সুইসা*ইড করতে চলে যেত। এদিকে শুভ্রতাও তাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছিল, তার এমন ব্যবহারের জন্য না পারছিল তাকে ছাড়তে আর না পারছিল ভালোভাবে থাকতে। এদিকে শুভ্রতার বাসা থেকেও বিয়ের সম্বন্ধ দেখা হচ্ছিল। বিষয়টা ইমতিয়াজকে জানাতেই ইমতিয়াজ তার বাড়ির মানুষকে রাজি করিয়ে ফেলে বিয়ের জন্য। শুভ্রতার বাবা মাও মেয়ের কথা ভেবে একটাবারও দ্বিমত করে না। শুভ্রতাও ভাবে ইমতিয়াজ হয়তো বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে তাই সে ভালো ভালো সম্বন্ধকে পাশ কাটিয়ে ইমতিয়াজকে বিয়ে করে নেয়। বিয়ের পর থেকে শুরু হয় বড় সমস্যা কারণ ইমতিয়াজের সৎমা জানায় একসাথে এক বাড়িতে সে থাকবে না তাই তারা দুজন আলাদা বাড়িতে থাকতে শুরু করে। দুজনের মাঝে ভালোবাসা যেমন ছিল তেমন ছিল ইমতিয়াজের খারাপ স্বভাব। কিছু হলেই প্রচন্ড রেগে যেত, কোন চাকরি সে করবে না, ব্যবসার জন্য বাবার থেকে টাকা নিয়ে সেটাও কীভাবে কীভাবে খরচ করে ফেলে। এই সময়টাতেই শুভ্রতা জানতে পারে ইমতিয়াজ নে*শা করে। তবুও সে সবটা ঠিক করে নিতে চায় কিন্তু দিনকে দিন তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে থাকে। শুভ্রতা অনেকবার ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে ঠিক তখনই ইমতিয়াজ কান্নাকাটি করে তাকে আটকে রাখতো কিন্তু শেষমেশ ইমতিয়াজ এতটাই উশৃঙখল হয়ে যায় সে শুভ্রতা আর তা সহ্য করতে পারে না। তাই সে এবার সত্যি সত্যি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে সম্মান নেই, শ্রদ্ধ নেই, বলতে গেলে ভালোবাসাটাও একদম তলানিতে ঠেকেছে সেখানে আর যাই হোক ঘর করা যায় না। যেখানে প্রিয় মানুষটি ভালো থাকা কেড়ে নেয় সেখানে নিজেকেই নিজের জীবনীশক্তি হতে হয়।
শুভ্রতা একা একা পথে হাটছে। ফোনটাও নিয়ে আসে নি সে। রাস্তার পাশে একলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায়। লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি বুঝালে লোকটা পিছনে ফিরে তাকায়।
” কিছু বলবে মা?”
” আঙ্কেল আপনার ফোনটা একটু দেয়া যাবে? আমার বাড়িতে একটু কল দিব।”
” দেয়া যাবে না কেন? এই নাও।”
শুভ্রতা ফোনটা নিয়ে বাবার নম্বরে কল দেয়। কয়েকবার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হয়।
” হ্যালো বাবা…!”
” কে শুভ্রা মা?”
” হ্যাঁ বাবা, আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে বাবা? আমি আর এখানে এক মুহূর্তও থাকতে পারছিলাম না দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। আমি বাসা থেকে একেবারে বেরিয়ে এসেছি আর ফিরবো না কখনো। তুমি এই বাসার গোলির সামনের রাস্তার প্রথম দোকানটায় পাবে, আমি এখানেই আছি।”
” কি হয়েছে মা?”
” বাবা তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো আমি ফোন বা টাকা কিছুই নিয়ে বের হই নি।”
” ঠিক আছে মা তুই আধাঘণ্টা অপেক্ষা কর আমি চলে আসছি।”
শুভ্রতা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ফোন ফেরত দিয়ে সামনের দোকানটার পাশে দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। ইমতিয়াজের কথা খুব মনে পড়ছে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে, নিজেই নিজেকে বলে ওঠে, ” আর নয় শুভ্রতা, আর কত ওই মানুষটাকে সহ্য করবি? স্বামীর দায়িত্ব তার স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া, কোন স্ত্রীর দায়িত্ব নয়। আর সে তো তোর সাথে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে ওখানে আর এক ফোঁটা ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে সংসার হয় না। ইমতিয়াজ ঠিক তোকে ছাড়া বাঁচবে তোকেও বাঁচতে হবে।”
কিছুসময় পরই শুভ্রতার বাবা শাহাদাত হোসেন বাইক নিয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। শুভ্রতা এগিয়ে এসে কোন কথা না বলে বাবার বাইকে চড়ে বসে। শাহাদাত সাহেব হালকা ঘাড় বাঁকা করে মেয়ের দিকে তাকান।
” তোর বাসায় চল মা, কি হয়েছে গিয়ে দেখি।”
” না বাবা ওটা আমার বাড়ি না। তুমি প্লিজ আমাকে আর ওখানে যেতে বোলো না। ওই বাড়িটাও আমার না মানুষটাও না।”
” তোদের মধ্যে ঝগড়া তো অনেকবার হয়েছে, এভাবে তো বাড়ি ছেড়ে আসিস নি! আজ হঠাৎ কি হলো?”
” আমি আর সহ্য করতে পারছি না বাবা। তোমার মেয়েটা খুব ক্লান্ত,অনেকরাত ঠিকমতো ঘুমায় না তোমার মেয়ে।”
” আমি একবার ইমতিয়াজের সাথে কথা বলি?”
“কোন লাভ নেই বাবা। বড়জোর সে দুইদিন ভালো থাকবে, ভালো ব্যবহার করবে এরপর যেমন তেমনই হয়ে যাবে। বাবা ওর ব্যবহার এত বাজে যে আমি এখন ওর সাথে কথা বলতে ভয় পাই, ও কথার আঘা*তে ক্ষ*তবিক্ষ*ত করে ফেলে আমাকে। লাস্ট দুই বছর আমি অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। ওকে ছাড়াই আমি ভালো থাকব।”
” হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে নেই রে মা।”
” হুট করে না বাবা, আমি অনেকদিন ধরেই ভেবেছি। তুমি প্লিজ এখন এখান থেকে চলো। আমার আর ভালো লাগছে না।”
শুভ্রতার কথামতো শাহাদাত সাহেব আর সেখানে দেরি করেন না। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন কারণ তিনি জানেন ইমতিয়াজ আর শুভ্রতার সম্পর্ক অনেকদিন ধরে খারাপ যাচ্ছে। তিনি এই আশায় থাকেন যে শুভ্রতা বাসায় যাওয়ার পর ইমতিয়াজ নিয়ে আসতে গেলে তাকে বুঝিয়ে ভালো একটা জবে ঢুকিয়ে দেবে। তার মেয়ের ভালো থাকাটাই মুখ্য কারণ।
#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০২
” আপু ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়েছে ইমতিয়াজ ভাইয়া।”
ছোটবোন স্নিগ্ধার কথায় ফিরে তাকায় শুভ্রতা। স্নিগ্ধার কথায় ছোট করে একটা শ্বাস নিল সে। শুভ্রতা নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, ” টেবিলের ওপর রেখে চলে যা।”
স্নিগ্ধা তাড়াহুড়ো গলায় বলল, ” আপু একটু তাড়াতাড়ি কোরো বাহিরে ঈমতিয়াজ ভাইয়া আর উকিল বসে আছে।”
ইমতিয়াজ এসেছে! তাকে নিতে নয় সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটাতে! শুভ্রতা বাবার বাড়ি এসেছে প্রায় মাস খানেক হয়েছে। বাড়ির ফোনটা সারাক্ষণ নিজের কাছে রেখেছে সে কিন্তু কোন লাভ হয় নি। ইমতিয়াজ একটাবারের জন্যও এ বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করে নি।
স্নিগ্ধা কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শুভ্রতা সেটা নিয়ে বাহিরের রুমের দিকে পা বাড়ালো। শুভ্রতাকে আসতে দেখেই মুখে বিরক্তভাব এনে অন্যদিকে তাকায়।
শুভ্রতা প্রথমে ভেবেছিল সে ইমতিয়াজের সাথে একা একটু কথা বলবে কিন্তু তার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে খুব বিরক্ত। কিন্তু তবুও তার কিছু কথা শোনা উচিৎ । শুভ্রতা এগিয়ে যায় তাদের দিকে। পাশের সোফাতেই শুভ্রতার বাবা-মা বসে আছে। দূরেই দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা।
শাহাদাত সাহেব মেয়েকে দেখে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। এই একমাসে মেয়েটার চেহারা কি হয়ে গেছে! নিজের প্রাণোবন্ত মেয়েটাকে এভাবে আর দেখতে পারছেন না উনি।
শুভ্রতা ইমতিয়াজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
” একটু আলাদা কথা বলা যাবে আপনার সাথে?”
ইমতিয়াজ কিছু বলে না, চুপচাপ বসেই রইল । তার কোন ইচ্ছে নেই শুভ্রতার সাথে আলাদা আর কোন কথা বলার। যে সম্পর্ক ভেঙেই গেছে সেই সম্পর্কের পিছনে ছোটা বোকামি।
ইমতিয়াজকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্রতা আবার বলে ওঠে, ” বেশি সময় নেব না চিন্তা নেই। আপনি চাইলে আমার রুমে আসতে পারেন পাঁচ মিনিটের জন্য। চার বছরের সম্পর্ক আর তিন বছরের সংসারে এই পাঁচ মিনিট তো আমি পেতেই পারি তাই না? আমি আমার রুমে অপেক্ষা করছি।”
শুভ্রতা নিজের রুমে চলে গেলে ইমতিয়াজও তার পিছু পিছু চলে আসে। তার মুখ থেকে বিরক্তির ছাপ এখনো যায় নি।
ইমতিয়াজ রুমে প্রবেশ করতেই শুভ্রতা চেয়ার এগিয়ে দেয় বসার জন্য। ইমতিয়াজ বসে না, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
” আমি বসব না হাতে বেশি সময় নেই, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আর যে মেয়ে তার স্বামীকে ছেড়ে রাতের বেলা বেরিয়ে যেতে পারে তার সাথে কোন কথাই থাকতে পারে না।”
” একটা মেয়ে কি তার স্বামীকে অসম্ভব ভালোবাসার পর কম কষ্টে ছেড়ে আসে?”
” আমি তোমার কষ্ট দেখতে আসি নি মোটেও।”
” দেখাচ্ছি না তো। যার প্রতি ভালোবাসা থাকে তার সবকিছুতেই আগ্রহ থাকে। যার প্রতি ভালোবাসা থাকে না তার সব কথা এমনকি তার উপস্থিতিও বিরক্তকর লাগে।”
” ঠিকই ধরেছো, খুব বিরক্ত লাগছে আমার। আর তুমি বলেছিলে না আমি তোমার মতো কাউকে পাব না? এই মাসের মধ্যেই আমি বিয়ে করছি দেখে নিও।”
” বউকে চালানোর মতো কিছু অর্জন করে বিয়ে কোরো। শুধু শুধু জিদ করে আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট কোরো না। কি যেন বলেছিলে আমাকে অন্য পুরুষ স্পর্শ করলে গা ঘিনঘিন করবে কি না? আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করার আগে তুমিই তো অন্য নারীর হয়ে যাবে।”
” হ্যাঁ হয়ে যাব, তোমার মতো মেয়ের সাথে এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছে আমার নেই। আর তুমি নাকি আমাকে উপার্জন করে খাইয়েছো? বাড়িটা না থাকলে থাকতে কোথায়? আমি কি তোমার জন্য কিছুই করি নি?”
” হ্যাঁ করেছো তো, আমার জীবন নষ্ট করেছো। তোমার ওপর দয়া করেছিলাম আমি ভেবেছিলাম তোমাকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব, দিন চলার মতো কিছু করলেই যথেষ্ট ছিল কিন্তু তুমি সেটাও করো নি।”
” এই শোনো তোমার এসব কথা শুনতে আমি এখানে আসি নি। এসব যেন সারাদিন কানের কাছে না বলতে পারো সেই ব্যবস্থা করতে এসেছি। বড়লোক বাবার মেয়ে তাই একটু কষ্ট সহ্য করে থাকতে পারো নি এটা তোমার ব্যর্থতা। এ বাজারে চাকরি পাওয়া কত কঠিন তুমি জানো?”
” তিন বছর কি যথেষ্ট ছিল না? ”
” না ছিল না।”
” আমি সহজে তোমাকে ছাড়ি নি, তুমি ছাড়তে বাধ্য করেছো। এবার আমি মায়া ত্যাগ করলে আমাকে আর আগের মতো পাবে না। আমি অন্য মেয়েদের মতো নই যে বিরহের সাথে দিন অতীত করব। আমি জীবন উপভোগ করতে পারি, তোমাকে ভালোবাসি বিধায় অনেককিছু সহ্য করে নিয়েছি। আমার জীবনে কেউ আসতে চায় নি এমন কিন্তু না তোমার চেয়েও ভালো কেউ আসতে চেয়েছিল আমিই তোমায় ছাড়া কাউকে গ্রহণ করি নি। অপরিপক্ক বয়সে মানুষ ভুল করে, আমার ভুলটাও এমন।”
” তোমার বস্তাপঁচা কথা শুনতে আমি আগ্রহী নই। বদলে যাও, একইরকম থাকো, এমনকি ম*রে যাও আমি দেখতে আসব না। সাইন করে দাও চলে যাব, সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে একদম নেই।”
” এত পরিবর্তন! ভুল করলে ইমতিয়াজ, একদিন ঠিক পস্তাতে হবে। অন্তত আমি ভালো থাকব আর তুমি সেটা দেখে হায়হায় করবে মনে রেখো।”
” যা ইচ্ছে করো। আপাতত আমার জীবন থেকে বিদায় নাও।”
” তুমি আমাকে পেয়েও হারালে, এমন একটা সময় আসবে যখন আমাকে পাওয়ার জন্য ভিখারির মতো ঘুরলেও পাবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি কি জানো? ফিরে আসা, যেটা আমি চাই না আর তুমিও কোনদিন পাবে না।”
” ইচ্ছেও নেই।”
ইমতিয়াজের এই কথাটা যেন শুভ্রতার গায়ে জ্বা*লা ধরিয়ে দেয়। তাকে ছাড়া থাকার জিদ পেয়ে বসে। শক্ত গলায় বলে ওঠে,
” ‘আপনি’ চরিত্রটা আসলেই মাদক,
আপনাকে ছাড়লে ভালো থাকব জেনেও কেমন সদিচ্ছায় আপনাকে গ্রহণ করে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছি দেখুন! কিন্তু আর নয় এবার আমি বাঁচব, আপনাকে ছাড়া খুব ভালোভাবে বাঁচব।”
শুভ্রতা কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দুজনের দারুণ সম্মতিতে যেমন একদিন দুজন এক হয়েছিল ঠিক তেমনই দুজনের সম্মতিতে আজ দুজন আয়োজন করে আলাদা হয়ে গেল। আজ থেকে দুজনের পথ ভিন্ন, গন্তব্য ভিন্ন, দুজনের কাছে দুজনের ফিরে আসার পথ ভিন্ন।
একজন বলেছিল, ” শুভ্রা প্লিজ বিয়েটা করিস না ছেলেটা ভালো না। তুই ভালো থাকতে পারবি না ওর সাথে।”
তার কথাটা মিথ্যা প্রমাণ করতেই শুভ্রতা এতদিন ইমতিয়াজের সবকিছু সহ্য করে গিয়েছে। অন্যকে ভুল প্রমাণ করতে ভুল মানুষের সাথে সারাজীবন তো কাটিয়ে দেওয়া যায় না। যে কথাটি বলেছিল সেই নাহয় সঠিক হলো!
পরদিন বিকেলে এক কাপ চা হাতে নিয়ে জানালার পাশে চেয়ারে বসে আছে শুভ্রতা। চোখ দিয়ে তার অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। আনমনে কি সব ভেবে চলেছে সে। ইমতিয়াজ সত্যিই সম্পর্কটা শেষ করে দিল! দুজনের যে কম ভালোবাসে সেই নাকি সম্পর্কের সবটা নিয়ন্ত্রণ করে! তবে ইমতিয়াজ চাইলেই তো সম্পর্কটা আগের মতো করে নিতে পারত। এত ভালোবাসার পরও পুরুষ এরকম করতে পারে!
দরজায় নক করার শব্দ পেতেই ওরনা দিয়ে চোখটা মুছে নেয় শুভ্রতা। দরজার দিকে তাকাতেই চোখ চড়কগাছ। তার সব চাচাতো ভাই বোনেরা দরজায় দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। তাদের সাথে স্নিগ্ধাও রয়েছে, ওদের সবার লিডার এই মেয়ে। নিশ্চিত মা শুভ্রতার মন ভালো করার জন্য কিছু করতে বলায় সে গিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসেছে।
স্নিগ্ধা, নেহা, শাকিরা, রায়হান, ইরা সবাই একসাথে হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাঝখান দিয়ে আবিরা আপু রুমে প্রবেশ করল। আবিরা আপুর পিছু নিয়ে সবাই একে একে বিছানায় এসে বসলো।
” কি ব্যাপার শুভ্রতা! একা একা এখানে বসে কি করা হচ্ছে শুনি?”
” কিছু না আপু, এই তো বসে চা খাচ্ছিলাম। তোমরা সবাই এখানে যে?”
” রাতে যে গ্রুপ খুলেছি মেসেঞ্জারে, তোকেও তো এড দেওয়া হয়েছে তাহলে তুই গ্রুপে যাস নি কেন?”
” গ্রুপ? কিসের গ্রুপ? আর আমি তো অনলাইনে যাই নি। ”
” কেন? ফোন নেই তোমার আপু?”
মাঝখান দিয়ে নেহা প্রশ্নটা করে ওঠে। সবাই রাত থেকে কত মজা করছে গ্রুপে! আর শুভ্রতা কি না সেখানে নেই!
” এসব ছাড়ো, ইরা তুই কবে এলি এখানে?”
শুভ্রতা ইরাকে দেখে অবাক হয় কারণ গতকাল পর্যন্ত ও তো কেউ ছিল না এখানে। ওরা সবাই ঢাকায় থাকে, ওর বাবা কয়েক ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তারা প্রায় দশ বছর ধরে গ্রামে থাকে না তারা।
” গতকাল তো গ্রুপ খোলার পর সবার একসাথে হওয়ার কথা ছিল। আমরা যদিও বা আজ সকালেই এসেছি আগামীকাল চলেও যাব। নিহা…..”
ইরাকে আর কথা শেষ করতে দেয় না আবিরা। শুভ্রতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে গিয়েছিল সে, তাকে থামিয়ে দেওয়া হলো।
” কি বলতে চাইছিলি রে ইরা?”
ইরা এবার আবিরার দিকে তাকায়। সে যে মুখ ফসকে লুকোনো বিষয়টাই বলে দিতে গিয়েছিল। ইরা এবার আমতা আমতা করে বলে,
” তেমন কিছু না আপু, বলতে চাইছিলাম যে কিছুদিন পর আবার আসব।”
” না অন্যকিছু বলতে চাইছিলি হয়তো।”
” ও আবার অন্যকিছু কি বলতে চাইবে? বাদ দাও আপু ওসব।”
স্নিগ্ধা কথা ঘুরিয়ে নিতে ইরাকে সরিয়ে সামনের দিকে এসে বসে সে। পাশে থেকে শাকিরাও অন্য কথা তুলে যেন নিহান নামক কারো কথা এখন আর সামনে না আসে।
চলবে…..
#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#সূচনা_পর্ব(০১)