শেষ অধ্যায়ে তুমি পর্ব -৩৬+৩৭

#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩৬

রাফি কোথায় গেছে কেউ জানে না। ইনায়ার প্রেগনেন্সির খবরটা লিরা, ফাইজারা শুনেও ভালো খারাপ কিছুই বলেনি কিন্তু তারাও চাইছিলো রাফি ফিরে আসুক তাই এই খবরটা জানানোর জন্য রাফির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। রাফি সব ধরনের সোশ্যাল সাইট থেকে ডিএক্টিভেট সাথে মোবাইল নাম্বারটাও বদলে ফেলেছে। রাফির বাবা-মাকে যখন প্রেগনেন্সির খবরটা দেওয়া হয় তখন তারা জানায় রাফি তাদের কাছ থেকে সর্বশেষ দেড় লাখ টাকা নিয়েছে তারপর আর যোগাযোগ করেনি তাই তারাও জানেনা রাফি কোথায় আছে।

রাফি ওখান থেকে যাওয়ার আগে ইনায়ার বাবা-মাকে সবকিছু বলে গেছে, তারাও ভাবতে পারছে না তাদের মেয়ে এরকম করতে পারে। এরপর যখন তারা রাফি চলে যাওয়ার খবর জানতে পারে তখন তারা ইনায়াকে বলেছিল দেশে ফিরে আসতে কিন্তু ইনায়া এখানেই থাকবে বলে আর ফিরে যায়নি। ইনায়া সারাক্ষণ নিজের রুমে মনমরা হয়ে পড়ে থাকে।
_________
নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। মিহাল দিনের বেলা সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও রাতের বেলা তার শূন্য লাগে নিজের কাছে তখন নিজের রুমের সাথে গার্ডেনের দরজা খুলে বসে থাকে বা স্টাডি টেবিলে বসে থাকে। এখন মিহাল নিজের রুমে একা থাকেন আর সাথে রিজভী থাকে কারণ বাংলাদেশ থেকে অর্কর কাজিন প্রিতিশা ও তার দুইটা ছেলে বন্ধু এসেছে পড়াশোনা করতে তাই তারাও এখানে বাংলোতে এসে উঠেছে।

কেটে গেছে তিনমাস। তূরের এখন ছয় মাসের ভরা পেট। এই সময়েও সে ভার্সিটি, বুটির হাউস সামলাচ্ছে সাথে ভার্সিটিতে রিসার্চ নিয়ে কাজ করছে।
এইতো কিছুদিন আগে, মিহালকে মিহালের ইউনিভার্সিটির একটা মেয়ে প্রপোজ করেছে। মিহাল অবশ্য না করে দিয়েছে সরাসরি কিন্তু তূর কি এতো সোজা ভাবে মানার পাত্র!
এলেক্সকে তো সারাক্ষণ মিহালের নজরদারি করার জন্যই রেখে দিয়েছে! মিহালকে যে প্রপোজ করেছে এটা যখন এলেক্স তূরকে জানায় তখন সে বলে ভিডিও কলে ওই মেয়ের কাছে নিয়ে যেতে আর এলেক্স তাই করে।
যখন ওই মেয়ের সাথে তূর এলেক্সের ফোন দিয়ে ভিডিও কলে কথা বলছিল তখন মিহাল দূর থেকে দেখে এলেক্স আর ওই মেয়েটাকে দেখে, যেই মেয়েটা সকালের দিকে মিহালকে প্রপোজ করেছে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে।

মিহাল তখন এগিয়ে যায় কিন্তু তারা কার সাথে ফোনে কথা বলছে তা বুঝতে পারেনি। ওদের দুজনের কথা বলা শেষ দেখে মিহাল একটু আড়ালে লুকিয়ে যায় যাতে এলেক্স ওকে না দেখে। এলেক্স যাওয়ার পর মিহাল ওই মেয়েটার সামনে যায়, ওই মেয়েটা মিহালের দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে বলে,
মেয়েটা: তুমি সত্যিই অনেক ভাগ্যবান। ঈশ্বর তোমাদের সুখী রাখুক।

কথাটা বলে মেয়েটা চলে যায় আর মিহাল অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু পরমুহুর্তে মুচকি হেসে সেও সেখান থেকে চলে যায়।
_________
এই তিনমাসে ইনায়ার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রেগনেন্সির সময় কারো থেকে মানসিক শান্তি পায়নি। এমন না যে বাংলোর কোন সদস্য ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে! মোটামোটি সবাই ওর সাথে টুকটাক কথাবার্তা ও খাওয়ার সময় ডেকে আনা সব করেছে। ইনায়াকে ওর ঘর থেকে প্রিতিশাই বেশি ডেকে আনত আর বাকিরা আগের মতো না চললেও ভালোই দেখবাল করতো।

কিন্তু শেষমেশ বাচ্চাটা থাকেনি! মিসক্যারেজ হয়ে গেছে আড়াই মাসের মাথায়। ইনায়া অনেক আগেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে যখন তানজিনাও ইনায়ার ঘারে সব দোষ দিয়ে দিছে! আর এখন তো নিজের প্রথম বাচ্চা হারিয়ে সে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে কারো সাথেই কথা বলতে চায় না।
মাঝে মাঝে ইনায়া রাতের বেলা চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে যায় তারপর কাঁদতে থাকে। সে কখনোই ভাবেনি তার অন্যায়ের এইভাবে শাস্তি পাবে সে! একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরেছে সাথে নিজের প্রথম বাচ্চার মিসক্যারেজ, যা ওকে ভিতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে।
ইনায়ার মিসক্যারেজ হওয়ার পর ওর বড় ভাই এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে কিন্তু ইনায়া যাবেনা, সে এখানেই রাফির জন্য অপেক্ষা করবে।

মিহাল সেদিন ওই মেয়েটার কথা শুনে এলেক্সের উপর কিছুটা নজর রেখেছে যাতে এলেক্স বুঝতে না পারে। সেখান থেকেই মিহাল এটা বুঝতে পেরেছে তূর কোথায় আছে এলেক্স তা জানে এবং তার (মিহাল) সমস্ত খবর তূরের কাছে সাপ্লাই এলেক্স করে। সব জানার পরে মিহাল এলেক্সের সাথে ভালো বন্ধুত্ব করার জন্য এলেক্সের সাথে ভালোভাবে মিশা শুরু করছে যাতে এলেক্সকে জিজ্ঞাসা না করেই তূরের খোঁজ পাওয়া যায়!!

আর তূর, সে তো সারাদিন ব্যাস্ত থাকার পর রাতে মিহালের ছবি দেখে দেখে কাঁদে ও সাথে অনাগত বাচ্চার সাথে একা কথা বলে পরে একসময় ঘুমিয়ে যায়। ছয় মাসের প্রেগনেন্সিতে সে কিছুটা গুলুমুলু হয়েছে।
ডাক্তার বলেছে তূরের টুইন বেবি হবে😍। টুইন বেবি হওয়ার কারণে তূরের পেট স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বড়। এলেক্সের মা ও নানী তো তূরকে সারাক্ষন খাওয়ার উপর রাখতে চায় যতক্ষণ বাসায় থাকে। ভোরে থেকে উঠে একটু কোরআন পড়ে, একটু বেলা হলে এলেক্সের নানীর সাথে একটু গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করে।

—–এভাবেই কেটে গেছে আরও তিন মাস। তূরের এখন হাঁটতে একটু কষ্ট হয় কারণ নয় মাসের প্রেগনেন্সি। ডাক্তার বলেছে আর বিশ-পঁচিশ দিন বা পনেরো দিনের মধ্যে বেবি হবার চান্স আছে তাই এখন একটু সতর্ক থাকতে বলেছে।

তূরের আগেও মিহালের জন্য অনেক কষ্ট হতো আর এখন তো আরো বেশি কষ্ট হয়। তূর ভাবে সে যদি মারা যায় তাহলে মিহাল ও বাচ্চাদের কি হবে? এলেক্সের কাছ থেকে যেটুকু খবর পেয়েছে সে যে, মিহাল সারাক্ষণ অনেক টেনশনে থাকে আর চোখের নিচে অনেক কালি পড়ে গেছে। আমেরিকায় এসে মিহাল যেটুকু একটু স্বাস্থবান হয়েছিল এখন আবার অনেকটাই শুকিয়ে গেছে আগে যেমন ছিল। মিহালের মুখ চোখ দেখে মনে হয় রাতে সে ঘুমায় না ঠিক মতো।
এগুলো শুনে তূরের অনেক কষ্ট হয় কিন্তু সে বেবী হবার আগে ওখানে যাবে না। তুর এখনো ইনায়া ও রাফির ব্যাপারে কিছুই জানেনা। এলেক্স তাকে জানায়নি যাতে তূর টেনশন না করে।

মিহাল নিজে হিসাবে ব্যাস্ত, সে এখন আরো বেশি টেনশনে থাকে কারণ নয় মাস হয়ে গেছে তূরের, এরপর যে কোন সময় ডেলিভারি হতে পারে। যদি ডেলিভারি ডেট হবার আগেই পেইন ওঠে তাহলে কি হবে সেসব ভাবতে ভাবতেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। মিহাল এলেক্সকে অনেকবার ইনডাইরেক্টলি বলার চেষ্টা করেছে তূরের খবরটা দিতে, কিন্তু এলেক্স আছে পাত্তাই দেয় না!!

_________
নয় মাস পনেরো দিন, এবার আর মিহাল ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না, সে সরাসরি গিয়ে এলেক্সকে জিজ্ঞাসা করে,
মিহাল: এলেক্স, আমার জানা মতে তুমি জানো তূর এখন কোথায় আছে?

মিহালের কথায় এলেক্স অনেকটা ঘাবড়ে যায় তাও সে নিজেকে ঠিক ভাবে প্রেজেন্ট করে বলে,

এলেক্স: কি সব বলছো মমেহাল! আমি কিভাবে জানবো নূর কোথায়!
মিহাল: দেখো এলেক্স তুমিও জানো আর আমিও জানি যে তূরের ডেলিভারি ডেইট খুব নিকটবর্তী। ওর যেকোন সময় ডেলিভারি পেইন হতে পারে তখন ওকে কে সামলাবে বা হাসপাতালে নিয়ে যাবে? আমার মাথা কাজ করছে না, প্লিজ বলো।

এলেক্স: তুমি ভুল ভাবছো, আমি জানিনা নূর কোথায় আছে। আর নূর যেখানে আছে নিশ্চয়ই ভালো আছে, নিজে সুরক্ষা বুঝেই আছে।

মিহাল এবার নিজের এক হাত দিয়ে চুল গুলো টেনে খুব শান্ত ও গম্ভীর ভাবে বলে,

মিহাল: আমি অনেক আগে থেকেই জানি তোমার সাথে তূরের যোগাযোগ আছে, তাও আমি চুপ করে ছিলাম কিন্তু এখন আর চুপ করে থাকতে পারছি না। তুমি সহজে বলবে নাকি আমি তোমাকে অন্য উপায় বলতে বাধ্য করবো?

কথাটা শুনে এ্যালেক্সের ভ্রু কুঁচকে আসে।
এলেক্স: অন্য উপায়ে বলতে?
মিহাল বাঁকা হেসে বলে,
মিহাল: জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!

এরপর মিহাল রিজভীকে ইশারা করে কিছু একটা, রিজভী তখন ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। মিহালের ইশারাতেই রিজভী সামনের দিকে এগিয়ে আসে আর এলেক্সকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে।
হঠাৎ করে কেউ জাপটে ধরায় এলেক্স ভয় পেয়ে যায়। এই সুযোগে মিহাল এলেক্সের সামনের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নেয়। এলেক্সের সেলফোনটা যেহেতু আইফোন তাই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে খুলবে। মিহাল এলেক্সের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয় জোর করে এরপর তূরের নাম্বার খুঁজে ফোন করে। তিনবার রিং হওয়ার পর তূর রিসিভ করে,
তূর: হ্যালো এলেক্স, তুমি হঠাৎ করে এই সময় ফোন দিলে আমি মাত্র বাড়িতে ঢুকছি।

তূরের আওয়াজ পেয়ে মিহাল যেন নিজের বুকের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া দোল খেয়ে যায়। মরুভূমির বুকে এক ফোটা পানি যেমন তৃষ্ণার্তের শুষে নেয় ঠিক তেমনি মিহালের কান এতোদিন তূরের আওয়াজ শোনার জন্য যেনো ব্যাকুল হয়ে ছিল।

সময়টা এখন ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে, তাই দারুন শীত এসেছে প্রকিতিতে। তূরের গলার আওয়াজ শুনে মিহালের মনে এক উষ্ণ অনুভূতিরা জেনো জেগে উঠেছে। তূর ফোনের অপর পাশ থেকে কয়েকবার এলেক্সের নাম নিয়েও যখন কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছে না তখন সে কিছুক্ষণ চুপ করে বলে,

তূর: মমিহাল!
মিহাল নিজের নামটা তার মায়াবী মেঘকন্যার মুখ থেকে অনেকদিন পর শুনে আর তার অধরে খেলে যায় প্রশান্তির মুচকি হাসি। কিছুটা মলিন কন্ঠে বলে,
মিহাল: চিনতে পারলে অবশেষে!

তূরতো ওদিকে নিঃশব্দে অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে আর শেষে মিহালের বলা কথাটা শুনে তার হেঁচকি উঠে যাওয়ার অবস্থা।
মিহাল বুঝতে পারে তূর কাঁদছে। কাঁদুক! সে কি বলেছিল তার থেকে দূরে যেতে? বলেনি তো! কেন দূরে গিয়ে এতদিন এত কষ্ট দিলো নিজেকে, আমাকে (মিহাল) সাথে অনাগত বাচ্চাকে!

মিহাল: এখন কাঁদছো কেনো? ভালো থাকার জন্যই তো দূরে গিয়েছিলে।
তূর কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। কথাগুলো যেন দলা পাকিয়ে কান্না রূপে বেরিয়ে আসছে।
মিহাল: কি হলো, এখনো চুপ করে থাকবে? নাকি আরো কষ্ট দেওয়া বাকি আমাকে?

তূর জড়ানো গলায় বলে,
তূর: আসবে আমার কাছে? আসো না প্লীজ! আমার না তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে আর যদি দেখতে না পাই!

তূরের শেষের কথা শুনে মিহালের নাকের পাটা শক্ত হয়ে যায় আর এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। রিজভী ইতিমধ্যে এলেক্সকে ছেড়ে দিয়েছে এ্যালেক্স আর রিজভী মিলে এখন ওদের কথাবার্তা বোঝার চেষ্টা করছে, মিহালের কথা রিজভী বুঝতে পারলেও তূর অপরপাশ থেকে কি বলছে তা শুনতে পারছে না। আর এলেক্স, সে তো কিছুই বুঝতে পারছে না।

মিহাল তূরকে ধমক দিয়ে বলে,
মিহাল: এই মেয়ে একদম চুপ। কি সব বলতাছিস তুই? এসব কথা আর একবার ও মুখে আনবি না! আর যদি আনিস তোর জবান আমি ছিড়ে ফেলবো। এতদিন দূরে থেকে সেই এখন খারাপ খারাপ কথা বলতেছে!

মিহালের ধমকে তূর সামান্য কেঁপে উঠলেও শেষের কথা গুলো শুনে মুখে হাসি ফোটে।
মিহাল: আমি এখনই রওনা দিবো। তুমি একটু সাবধানে থাকবা।

এই বলে ফোন কেটে দেয়। ফোনটা এ্যালেক্সের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
মিহাল: ধন্যবাদ, এতদিন তূরের খেয়াল রাখার জন্য দূর থেকে হলেও। আর দুঃখিত তোমার সাথে এরকম ব্যবহার করার জন্য।
এলেক্স হাসি মুখে বলে,
এলেক্স: আরে বাদ দাও তো আমি একটুও কিছু মনে করিনি। তোমরা দুজন ভালো থাকো আর অনাগত বেবীরা ও ভালো থাকুক এটাই তো আমি চাই।
এরপর রিজভী ও এলেক্সকে নিয়ে বাংলোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেখান থেকেই সবাইকে নিয়ে লস এঞ্জেলেস এর উদ্দেশ্যে রওনা হবে।
#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩৭ (মিলন তিথি)

বাংলোতে যেয়ে যখন সবাইকে বলে তূর কোথায় আছে তখন সবাই সেখানে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠে। যেহেতু এখন ডিসেম্বর মাস সেমিস্টার ব্রেক চলছে আর চার-পাঁচ দিন পর নতুন বছর আসতে চলেছে।
নতুন বছরে ফ্রেন্ডকে ফিরে পাবে সাথে নতুন অতিথি। তূরের মতো যদি রাফি কোথায় আছে তা জানা যেতো!

ইনায়া মনেমনে উুসখুস করছে যাওয়ার জন্য কিন্তু ভয় হয় তার, যদি তাকে মানা করে দেয়! কিন্তু সে তো যেতে চায় কারণ তূরের কাছ থেকে মাফ চাইতে হবে না হলে সে আত্মগ্লানিতে শান্তি পাবে না।
হ্যাঁ, ইনায়া নিজের করা প্রতিটা অন্যায় বুঝতে পেরেছে এবং সে মন থেকে মাফ চাইতে চায়। শারীরিক ও বাহ্যিক শাস্তি থেকে মানসিক শাস্তি টা বেশি ভয়ঙ্কর কারণ এই শাস্তি বাহিরের কেউ দেখতে পারে না শুধু যে ভোগে সেই দেখতে ও বুঝতে পারে।
—–
সবাই নিজেদের ব্যাগ প্যাক করে নিয়েছে, নতুন বছরটা একটা নতুন শহরে শুরু করার জন্য। সেমিস্টার ব্রেকের কারণে তাওহীদ, নাদিয়ারাও এসে পড়েছিল বাংলাতে এখন তারাও নিজেদের ব্যাগ প্যাক করে নিচ্ছে একেবারে “লস এঞ্জেলেস” থেকেই তারা ক্যালিফোর্নিয়াতে ফিরবে।

সবাই যখন নিজেদের ব্যাগপ্যাক ড্রইংরুমে এনে রেখেছে তখন ইনায়া নিজের রুমের দরজার সাথে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রণক ও রিজভী সেটা দেখে মিহালকে বলে, মিহালেরো দেখে মায়া লাগে।
ইনায়ার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে গারো কালি পড়েছে আর এতটাই রোগা হয়েছে যে ওরে দেখলে আগের ইনায়ার সাথে মিলানো যায় না।

মিহাল নিজের হাতের ট্রলি ব্যাগটা রেখে ইনায়ার কাছে যেয়ে বলে,
মিহাল: ইনায়া!
হঠাৎ করে ইনায়া মিহালের ডাকে হকচকিয়ে যায়। কিন্তু কিছু না বলে সে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মিহাল: তোমার ব্যাগ প্যাক করোনি? ব্যাগ কই তোমার দাও গাড়িতে উঠাতে হবে তো!

এই কথাটা শুনে ইনায়ার মুখে অস্পষ্ট হাসি ফুটে এরপর সে জলদি করে নিজের রুমে গিয়ে আলমারি থেকে কাপড় ট্রলিব্যাগ ভরতে থাকে।

ইনায়াকে এভাবে খুশিমনে ব্যাগ গুছাতে দেখে সবাই খুশি হয়। মেয়েটা নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় শাস্তিটা পেয়েছে নিজের অনাগত বাচ্চাকে হারিয়ে আর স্বামীর থেকে দূরে থেকে।

_________
রাত একটার দিকে টানা দশ ঘণ্টা জার্নি করে সবাই লস এঞ্জেলেসে এলেক্সের মায়ের বাসায় পৌছায়। তূর যেহেতু এলিক্সের মা “এলিজাকে” ওদের সবার আসার খবর দিয়ে দিয়েছে তাই তূর ও এলেক্সের মা ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছে। এলেক্সের নানী বৃদ্ধ মানুষ তাই তাকে সাড়ে দশটার দিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এলেক্সের মা তূরকে অনেকবার বলেছে, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে যেতে সে (এলেক্সের মা এলিজা) অপেক্ষা করবে কিন্তু তূর কি সেই কথা শুনে!!

তূরের এক কথা, সেও অপেক্ষা করবে। ছয় মাস! ছয় মাস যাবত তার স্বামীকে দেখে না আর আজকে যখন মিহাল আসবে তাকে দেখবে, তখন সে (তূর) কিভাবে ঘুমাবে!

–রাত সোয়া একটার দিকে যখন গাড়ির হর্নের আওয়াজ পায় তখন তারা নিশ্চিত হয় ওরা সবাই চলে এসেছে। তূরতো খুশিতে দৌড় দিতে নিয়েছিল কিন্তু নয় মাসের ভারী শরীর নিয়ে কি আর দৌড়ে যাওয়া যায়! তাই আস্তে আস্তে দরজার দিকে যাচ্ছে। মিসেস এলিজা ইতিমধ্যে দরজা খুলে ফেলেছে।
দরজার বাইরে দেখা যাচ্ছে সবাই হাতে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসছে। তূরের চোখ তো মিহালকে খুঁজে চলেছে নিরন্তর।

মিহাল ইচ্ছা করেই সবার পেছোনে আসছে কিন্তু ঠিকি দরজার ভেতরে দাঁড়িয়ে তূরের উৎকণ্ঠতায় ভরা মুখ দেখেছে।

একে একে সবাই বাড়ির ভিতরে ঢুকে। তূর সবার সাথে মুচকি হেসে কুশল বিনিময় করে। মিহাল এখনো বাড়ির ভিতরে ঢুকেনি। এদিকে তূরের চোখ সেই কখন থেকে মিহালকে খুঁজছে।

সবাই খুব ক্লান্ত হওয়ায় সোফাতে গা এলিয়ে দেয় আর তূর এখনো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে মিহালকে খুঁজছে।

ক্লান্ত শরীরেও সবাই এটা খেয়াল করে মিটিমিটি হাসছে কারণ তারা জানে মিহাল ইচ্ছা করেই ভিতরে আসছেনা।

প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে তূরের চোখে অশ্রুরা এসে ভর করে। তূর পিছনের ঘুরে ছলছল নয়নে ওদের সবার দিকে তাকায়। তূরের এভাবে তাকানো দেখে সবাই এবার হেসে দেয়। নাদিয়া এসে তূরকে জড়িয়ে ধরে বলে,

নাদিয়া: তূর বেবি, তুমি অনেক মোটা হয়ে গেছো। এখন আর তোমাকে আমি জড়িয়ে ধরতে পারি না!
তূর:—
নাদিয়া: আরে বাবা রিলাক্স! মিহাল লুকিয়ে আছে।

কথাটা বলে নাদিয়া মিহালকে ডাক দেয় আর মিহাল ডাক শুনে ভিতরে আসে। মিহাল ভিতরে এসে তূরের থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে আর নাদিয়া নিজের জায়গায় চলে যায় আবার।

একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তূর মিহালকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। মিহালের মুখে ফুটে উঠেছে এক চিলতে আনন্দের হাসি। এভাবেই তারা মান- অভিমানের পালা শেষ করে।

এলেক্সের মায়ের বাড়িটা বেশি বড় না হলেও ছয়টার রুম আছে। ছয়টার রুমের একটা তূর ও মিহালের। আরেকটাতে এলেক্সের মা, নানী ও এলিনা। দুইটা রুমে সাত জন মেয়ে। বাকি দুইটা রুমে এগারোজন ছেলে কোনমতে ফ্লোরেও বিছানা করে আছে।
অর্কর কাজিন ও কাজিনের দুই ফ্রেন্ড তারাও ওদের সাথে এসেছে।

মিহাল তূর যে রুমে থাকে সেখানের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ট্রাউজার পরে ও ঘারে তোয়ালে ঝুলিয়ে বেরিয়েছে। বেরিয়ে দেখে তূর বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে।

মিহাল তোয়ালেটা ঘাড় থেকে সরিয়ে পাশের টেবিলটার উপর রাখে এরপর তূরের সামনে দাঁড়িয়ে তূরকে তীক্ষ্ম চোখে অবলোকন করছে।

তূর এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে বুঝতে পারছে না তাই প্রশ্নাত্বক দৃষ্টিতে মিহালের দিকে চেয়ে আছে। এইবার মিহাল বলে,

মিহাল: তুমি গুলুমুলু হয়েছে ঠিক আছে কিন্তু তোমার পেটটা একটু বেশিই বড় তাই না!

কথাটা শুনে তূর কপাল কুঁচকে তাকায়। তূরের এভাবে তাকানোর মানে হচ্ছে, তুমি আমাকে মোটা বললা!!

মিহাল সেটা বুঝতে পেরে বলে,
মিহাল: আরে নারে বাবা! আমি তোমাকে মোটা বলি নাই। আমি বলতে চাইছিলাম কি, আমি কায়রা আপুকেও প্রেগনেট অবস্থায় মানে নয় মাস অবস্থায় দেখছি, তখন তার পেট এতটাও বড় লাগে নাই।

তূর কথাটা শুনে মুচকি হাসে আর সে এটা বুঝে গেছে মিহাল জানেনা টুইন বেবির কথা।
তূর: কায়রা আপুর তো একটা বেবি হয়েছে তাই তার পেট এতো বড় লাগে নাই কিন্তু আমার তো আর একটা না!

মিহাল অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
মিহাল: মানে!!
তূর মুচকি হেসে বলে,
তূর: We are expecting twins!!

মিহালের যেনো বিস্ময়ে মুখ হা আর বন্ধ হচ্ছে না। সে মুখ হা করেই তূরের দিকে তাকিয়ে আছে আর তূর তা দেখে মিটমিটি হাসছে। বিস্ময় কাটিয়ে মিহাল বলে,
মিহাল: সত্যি বলছো তুমি! আমাদের টুইন বেবী হবে? মানে একসাথে দুইজন “বাবা” বলে ডাকবে!

কথাটা বলেই মিহালের চোখ দিয়ে অশ্রুরা গড়িয়ে পরে। তূর মিহালের হাত ধরে মিহালকে পাশে বসায়।
তূর: জ্বী জনাব, আমাদের টুইন বেবী হবে।

মিহাল খুশিতে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা! বসা থেকে উঠে একবার এদিকে হাঁটে তো আরেকবার ওদিকে হাঁটে। একটা বাচ্চা আসার খুশি যতটা হয়, দুইটা বাচ্চা আসার খুশি তার থেকে দ্বিগুন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর মিহাল হুট করে তূরের সামনে এসে বসে পরে আর তূরের পেটে মুখ গুঁজে দেয়। হঠাৎ আচমকা মিহালের কাজে তূরের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়।

মিহাল কিছুক্ষণ তূরের পেটে মুখ গুঁজে থেকে তারপর পেটে কান পেতে ভিতরে কি হচ্ছে শুনার চেষ্টা করে।
এই সময়টা আসলেই অমূল্য। অনাগত সন্তানের আশায় বাবা-মা দুজনই উদগ্রিব হয়ে থাকে।
তখনই মিহালের মাথায় একটা প্রশ্ন আসে,
মিহাল: এই! তোমার কোন লাইফ রিস্ক নেই তো?

মিহালের করা প্রশ্নে স্পষ্ট ভয়ের আভাস পায়। প্রতিউত্তরে তূর মাথা নাড়িয়ে না জানায়।
_________
এসে গেছে নতুন বছর সাথে নিয়ে এসেছে অনেক খুশি আর কারো জীবনের মোড়।

যেদিন মিহাল শুনতে পেয়েছে তূরের টুইন বেবী হবে তার পরের দিনই লস অ্যাঞ্জেলসের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে তূরকে, জানার জন্য বেবিদের অবস্থা ও তূরের আসলেই কোনো রিস্ক আছে কিনা? ডাক্তার যখন বলল, সবকিছু স্বাভাবিক কিন্তু রোগীকে ডেলিভারির সময় অন্তত দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া লাগবে আরে ডেলিভারির সময় যেহেতু আসন্ন তাই এই কয়েকদিন অনেক খেয়াল রাখতে হবে।

এলেক্সের মা তূরে অনেক খেয়াল রেখেছেন। উনি যথেষ্ট কেয়ারিং একজন মহিলা ও মা। কিছু ভুল বোঝাবুঝির জন্য উনি ওনার স্বামী থেকে দূরে আছেন কিন্তু ভুল বুঝাবুঝির ব্যাপারটা জানতে পেরেও স্বামীকে সন্দেহ করার আত্মগ্লানিতে এখন পর্যন্ত সেখানে ফিরে যায়নি।

☆☆
জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন, হঠাৎ করে রাফি এসে হাজির এলেক্সের মায়ের বাড়িতে।

এলেক্সের মায়ের বাড়ি ঠিকানা রাফি পেয়েছে এলেক্সের মাধ্যমে কারণ লস এঞ্জেলেসে আসার পরের দিনই এলেক্স তার বাবাকে ফোন দিয়ে বলে ভার্সিটি অথরিটিকে রিকোয়েস্ট করতে যে, “রাফির কোন ইউনিভার্সিটিতে ক্রেডিট ট্রান্সফার হয়েছে সেটা জানাতে। অন্তত ভার্সিটির অথরিটি যেন রাফির ওয়াইফের কথা চিন্তা করে জানায়। ”

এভাবেই এলেক্স জানতে পারে রাফি কোথায় আছে পরে রাফি যে ইউনিভার্সিটিতে ক্রেডিট ট্রান্সফার করেছে সেই ইউনিভার্সিটিতে এলেক্সের ছোটবেলার বন্ধু আছে তার মাধ্যমে রাফিকে জানায় সে যেনো এখানে আসে।

রাফিও এতদিন ফ্রেন্ডদের থেকে ইনায়ার থেকে দূরে যেয়ে ভালো ছিলনা। রাফি নিজের ফ্রেন্ডদেরকে যতটা ভালোবাসে ইনায়াকে তার থেকে কম ভালোবাসে না বরং কিছুটা বেশি ভালোবাসে। কিন্তু ইনায়ার করা কাজ গুলো সত্যি অনেকটাই নিন্দনীয় ছিলো যা রাফি দূরে না গেলে ইনায়া উপলব্ধি করতে পারতো না।

রাফি দূরে না গেলে ইনায়া বুঝতে পারত না, “তূর মিহালকে ছাড়া প্রেগনেন্ট অবস্থায় কিভাবে আছে! তানজিনা যখন মিহালকে অপমান, ভালবাসার অমর্যাদা, ইনডাইরেক্টলি বুঝিয়ে দিত মিহালের সাথে থাকতে চায় না তখন মিহাল যদি একটা মৃত্যুশয্যায় থাকা মেয়ের ভালবাসা পূর্ণ করতে তাকে বিয়ে করে আর বিয়ে করেও প্রথম বউকে কষ্ট না দেওয়ার সব রকম শর্ত পালন করে কিন্তু তাও প্রথম বউটা তাকে ছেড়ে চলে যায় তখন কেমন লাগে!”

রাফি জানে ইনায়া নিজের অন্যায় বুঝতে পেরেছে আর এলেক্সও তাকে সিওর করেছে ইনায়া উপলব্ধি করতে পেরেছে সেটা।

রাফি ফিরেছে কিন্তু একা ফিরেনি! রাফির সাথে একটা বিদেশী মেয়ে যাকে দেখে মনে হচ্ছে সাত মাসের প্রেগনেন্ট!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here