শেষ বিকেলে তুমি আমি-২১+২২

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_২১

আমি যেন শুধু অবাক হয়ে দেখে গেলাম। আমারও বিয়ে হলো। দ্বিতীয় বার বিয়ে হলো একই মানুষটার সাথে। এইতো সেদিনই সে বলেছিলো, চলে যাও, মুক্তি দাও, আমি চাই না তোমাকে। বিচ্ছেদ ধেয়ে আসছিল আমাদের সম্পর্কে। কিন্তু আজ সে স্বেচ্ছায় বিয়ে করলো আমাকে। আমি ঠিক নিষেধ করতে পারলাম না। মুখ ফুটে কথাটা বলেই স্মরণ আমার হাত টেনে নিয়ে বসে গিয়েছিল পাটিতে। সেখানেই এতোগুলা মানুষের সামনে বিয়ে। সকলে যেন বেশ উৎফুল্ল ছিলো। কেউ একজন বলেছিল

” দুই নাম্বার বউ তো, তাই বেশি আদরের মনে হচ্ছে। একজন কে হারিয়ে এখন আর এটাকে চোখের আড়াল করবে না। ”

প্রিয়া তার পরিচয়, পরিস্থিতি ভুলে বলেছিল

” ভাইয়া তো জিতে গেছে আমার বান্ধবী কে পেয়ে। আসলে সত্যি কথা এটা। দ্বিতীয় বার বিয়ে করলে ঐ বউ সুন্দর হয়। ”

হাসির একটা মুহূর্ত পেরিয়ে গেছে প্রিয়ার কথায়। স্মরণ প্রত্যুত্তর করেছিল। মিহি স্বরে, নিভু নিভু কন্ঠে। যা কেবল যেন আমারই কানে বেজেছিল। সে বলেছিল আমার দিকে চোখ রেখে। আমাকে শোনাতেই

” হতে পারে অথৈয়ের সমান সুন্দর। তবে বেশি নয় আমার কাছে।”

.
বিয়ের ঘরোয়া অনুষ্ঠানের ইতি ঘটলো। প্রিয়া আর ওয়ারেসিয়াকে থাকার জন্য দেওয়া হলো একটা রুম৷ বাকিদের অন্যান্য রুমে থাকার ব্যাবস্থা হলো। তবে আমার ঘরে কেউ থাকার উদ্দেশ্যে এলো না একটা মানুষ ব্যাতিত অন্য কেউ। শুধু স্মরণ এলো। আমার লজ্জা, দ্বিধা আর এক ঝাঁক অস্বস্তির জন্য টেকা হলো না রুমের মধ্যে। রাত একটা বাজতে চলছে তখন। চলে গেলাম বেলকনিতে। বেশি সময় হয়নি বসে আছি। মিনিট দশেক হবে। এরই মাঝে হুট করে পেছন থেকে কেউ এসে বলে উঠলো

— এবার দেখি কিভাবে ছেড়ে যাও আমাদের বাবা আর মেয়েকে ছেড়ে? সব রাস্তা বন্ধ করে দিলাম।

আমি পেছন ফিরে তাকালাম। স্বভাব বশে আমি তাকে কিছুই বলতে পারছি না। বোবা হয়ে শুধু দাড়িয়ে রইলাম। আমার নিস্তব্ধতায় সে যেন একটু মন খারাপ করে বসলো। আকাশের পূর্ণ চাঁদের দিকে দৃষ্টি রেখে ভাবতে বসলো যেন কিছু। আমি আড় চোখে পরখ করতে আরম্ভ করলাম। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলে সে আচমকা আমাকে বলল

— অঙ্কন তোমাকে ভালোবাসতো। ও সেদিন আমার কাছে এসে বলে, তোমাকে পটানোর টিপস দিতে। আমি মানতে পারিনি বিষয়টা। কেমন অস্থির হয়ে পরেছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার ঘরে থাকা জীবন্ত একটা কিছু হারিয়ে যাবে। আমার ঘর শূন্য হয়ে যাবে। মানা যায় না।

এই অজানা তথ্যটা শুনে আমি চমকে তাকালাম তার দিকে। সে দৃষ্টির নড়চড় করলো না। একই অবস্থানে স্থির থেকে সে বলল

— দ্বিতীয় বারও ভালোবাসা যায়? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার কথা বললে মানতে পারি না।

স্মরণের কথা শুনে আমার হৃদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে গেলো। শীতল হাওয়া বইছিল বেলকনিতে। তবুও ঘেমে উঠালাম নিমিষেই। আমার এই করুণ অবস্থা স্মরণ অবলোকন করল কিনা জানি না। তবে সে আচমকাই আমার এক হাত টেনে নিয়ে স্থাপন করলো তার বুকের বা পাশে। মাথা থেকে পা অব্দি আমার কেঁপে উঠলো। স্মরণ নির্বিঘ্নে শান্ত কন্ঠে বলছিল

— বিট হচ্ছে? এটার একটা ভাষা আছে। সেই ভাষা কি তুমি বুঝতে পারছো?

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। স্মরণ করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার প্রতি। আমার বড্ড মায়া হলো। হঠাৎ মনোনিবেশ করলাম এলোমেলো মনটাকে টেনে হিঁচড়ে একীভূত করে তার বুকে। যেন উপলব্ধি করলাম, সে ভালো নেই। অনেক দিনের কষ্ট তার বুকে জমা তো আছেই সেই সাথে কিছুদিন হলো যেন তা বিক্ষিপ্ত হয়ে উড়িয়ে বেড়াচ্ছে তার বক্ষে।

— আমার পক্ষে সম্ভব না তোমাকে অথৈয়ের মতো ভালবাসা। আমি যদি তোমাকে অন্য ভাবে ভালোবাসি ক্ষতি হবে? তুমি কি খুব রাগ করবে তোমার কাছে আমার দুঃখ গুলো লুকিয়ে রাখলে? হ্যা তোমাকে তো আমার প্রয়োজনই। আর প্রিয়জনকেই তো প্রয়োজন হয় লাইফে তাই না?

চোখ ছলছল করে উঠলো আমার। স্মরণ পলকহীন তাকিয়ে রইলো আমার পানে। অতঃপর নিজে থেকেই মুক্ত করে দিলো আমার হাত। পুনরায় মনের দুঃখ গুলো নিয়ে ঠাট বজায় রেখে বলল

— যদি রাজি থাকো তাহলে ফিরে চলো। নইলে আমি জোর করবো না। তোমার ইচ্ছে। তবে হ্যা, এভাবেই থাকতে হবে। অন্য কেউ এসে হাত বাড়ালে আমি টলারেট করবো না।

শেষোক্ত কথা ব্যাক্ত করার মুহূর্তে সে ঝুঁকে পরলো কিছুটা। অনেকটা কাছে চলে এলো আমার। আমি পিছু হটলাম। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাড়িয়ে পরলাম। ভাবছিলাম প্রস্থান পথ ধরবো কিন্তু আমার ভাবনার ঘোর বিরোধীতা করে সে শান্ত মনে আমার শাড়ির আচলের একাংশ বন্দী করলো তার হাতের মুঠোয়। গিট ফেলল তাতে। হাতে পেচিয়ে নিয়ে এক টানে তার আর আমার মাঝে থাকা দূরত্বটা ঘুচিয়ে ফেলল নিমিষেই। আমি হুমড়ি খেয়ে পরতে গিয়েও বেঁচে গেলাম। তার সাথে ধাক্কা লাগলো আমার। সে বরাবরের মতোই অজানা কোথাও দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো

— ডোন্ট মুভ। এখানেই থাকো।

মিনিট পাঁচ উশখুশ করে কাটলো আমার। সে শান্তই রইলো। আকাশের চাঁদে যেন অমৃত পেয়েছে সে এমন করেই তাকিয়ে রইল। আমিও একটা সময় স্থির হয়ে গেলাম। উশখুশ ভাব উবে দিয়ে দাড়িয়ে রইলাম তার পাশে। চোখ লেগে গিয়েছিল কিনা তা সঠিক বলতে পারবো না। তবে হুট করে যেন আমার মস্তিষ্ক সজাগ হলো ফোনের চিৎকারে। চকিতে সোজা হয়ে দাড়াতে গিয়ে বুঝলাম আমি ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। স্মরণের কাঁধে মাথা রেখে ঝিমোচ্ছিলাম।

— হ্যালো আমার প্রিন্সেস?

ফোন রিসিভ করে হাতে ধরে নিজের সম্মুখে রেখে ঝলমলে হাসি নিয়ে কথাটা বলল স্মরণ। ওপাশে ছোঁয়ার কন্ঠ

— বাবা? তুমি কোথায়? তোমাকে দেখা যাচ্ছে না।

— এক মিনিট মা।

স্মরণ হাঁটতে শুরু করলো লাইট অন করার জন্য। তার সাথে আমার হাত বাঁধা থাকায় আমিও যাচ্ছিলাম তার সাথে। তবে তার বিপরীতে। সে ভুল পথে যাচ্ছিলো। মাঝখানে টানাটানি বেঁধে গেলো। সে ভ্রু কুঁচকে আধো আলোতে পেছন ফিরে আমার দিকে চাইলো। আগের দিনগুলোর মতোই কাঠকাঠ কন্ঠে বলল

,– কি সমস্যা? টানাটানি করছো কেন? লাইট অন করবো তো!

আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিলো তার। কিন্তু সে তা না করে উল্টো রেগে অগ্নি ঝাড়াচ্ছে চোখ দিয়ে। একটু আগেও তো কেমল ছিল। ভালোবাসা নিবেদন করছিলো। হুট করে আবার ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। সে এমন কেন? ঘাড়ের কোনো একটা রগ কি তার বাঁকা আছে?

— লাইট এদিকে।

আমি মিহি স্বরে বললাম। তখন সে পা বাড়ালো এদিকে। তবুও উঁচু মাথায়। নুইয়ে পরে না। নিজের ভুল স্বীকার করতে ভারি নারাজ সে।

লাইট অন করার সঙ্গে সঙ্গে ছোঁয়া আমাকে দেখে ভীষণ রেগে গেলো। মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। প্রায় এক সপ্তাহ পর মেয়েটার মুখ দেখলাম। এ ক’দিনে যে আমি তাকে একেবারেই ভুলে থেকেছি তা নয়। তবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যার্থ হয়েছি গভীর রাতে। স্মরণের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে কথা বলছে সে। কিন্তু আমকে পাত্তা দিচ্ছে না। মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না সে অভিমানের আস্ত এক পাহাড় গড়েছে আমার নামে। স্মরণ বিছানায় বসে মেয়ের সাথে কথা বলছিল। আমি তার পাশ ঘেঁষে বসলাম। ছোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম

— আমার সাথে কি কথা বলা যাবে? সময় হবে? নাকি ভুলে গেছে কেউ আমাকে।

ছোঁয়া ওপাশ হতে উত্তর দিলো

— আমি পঁচা মেয়েদের সাথে কথা বলি না। যে আমার বাবাকে আর আমাকে কষ্ট দেয় তার সাথে আমার কথা বলতে ভালো লাগে না।

আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। স্মরণ আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো। ছোঁয়া অভিযোগের ঝড় তুলেছে। আমি তার ঝড়ে উড়ে যাওয়ার দশায়। তবুও শান্ত হয়ে শুনছিলাম। তাকে বোঝালাম একেবারে তো চলে যাইনি? আমাদের দেখা হবে, কথা হবে, আমরা আবারও শাড়ি পরে ঘুরবো। সে দমে দমে থমকে দিলো রাগ। শান্ত হলো। ভাব জমতে শুরু করলো আমার সাথে। এরই মাঝে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি স্মরণ শুয়ে পরেছে। সে ঘুমিয়ে গেছে আমার আচলে হাত বাধা অবস্থাতেই। আচ্ছা মানুষটার সাথে কি ফিরে যাওয়া যায়? নতুন একটা অধ্যায়ের সূচনা কি করা যায়? তার দুঃখ গুলো আমার কাছে ভীষণ যত্নে লুকিয়ে রেখে তার পাশে থাকা যায় না?

চলবে…#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_২২

স্মরণের অসময়ের এই ঘুম দীর্ঘ হতে দিতে পারলাম না আমি। তার হাতের মুঠোয় আটকে রাখা শাড়ির আঁচল আলগোছে ছাড়াতে গিয়ে ব্যার্থ হলাম দারুণ ভাবে। এক ঝলক তার পানে তাকাতেই বুকে শুরু হয়ে ছিলো ধুকপুক ধুকপুক। আঁচল ছাড়ানোর দরুন তার হাত স্পর্শ করতে গিয়ে আরো বিপত্তি বাঁধলো আমার। ধুর ছাই! প্রিয় মানুষ গুলো বড্ড খারাপ হয়। হার্ড অ্যাটাকের কারণ হয় তারা। হৃদপিণ্ডের জন্য এরা ভীষণ ক্ষতিকর। শতবার চেষ্টায় নয়, মাত্র দুবারের মাথাতেই তার হাতে আচমকা আঁচড় পরলো আমার। সে তড়িৎ গতিতে যেন জেগে উঠলো। শুধু চোখ খুলেই খ্যান্ত নয়, উঠে বসে পরলো। আমি ভয়ে একহাতে মুখ চেপে ধরলাম নিজের। স্মরণ নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো। সব ধ্যন জ্ঞান সজাগ করে নিয়ে আমার দিকে কেমনতর এক দৃষ্টি ফেলেই ছেড়ে দিলো শাড়ির আচল। আমি গুটিয়ে নিলাম আঁচল । সে ঠাস করে আবারও শুয়ে পরলো। আমি আবারও অনিচ্ছা নিয়ে তার ঘুমের বিরোধীতা করে বললাম

— সেহেরি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

স্মরণ বন্ধ চোখ টেনেটুনে খুলে তাকালো আমার দিকে। ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল

— আসছি।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলছিল। প্রিয়ায় বাবা, অঙ্কনের বাবা, অঙ্কন, রিফাত উপস্থিত ছিলো সেখানে। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে আমি কিচেনে যাচ্ছিলাম। চলতি দশায় একবার না চাইতেও চোখ গেলো অঙ্কনের পানে। আকস্মিক ভাবে চোখাচোখি হয়ে গেলো। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে যেন ছুটতে লাগালাম। রান্নাঘরে চাচি আম্মাসহ তার সদ্য হওয়ার বেয়াইন ছিলেন। প্রিয়ার মা ছিলো। অঙ্কনের মাও ছিলেন। সকলে গল্পে গল্পে কাজ করছে। আমি টুকটাক কিছু করতে চাইলে বাঁধা দিলো সকলে। শুধু ছোট একটা দায়িত্ব দিলো। প্রিয়া আর ওয়ারেসিয়াকে ঘুম থেকে ওঠানোর দায়িত্ব। দায়িত্ব মাথায় নিয়ে যথারীতি যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু করে দিলাম ওদের রুমে গিয়ে। একটাকে টেনে ওঠাতেই আরেকটা ঠাস। আরেকটাকে বকতে গেলেই অন্যটা কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমের সাথে হাত মেলাচ্ছে। আমি তাদের এ নাটক বেশি সময় সহ্য করতে পারলাম না। ধৈর্য হারিয়ে প্রিয়ার মেরুদণ্ড বাঁকা করার মতো একটা কিল মেরে হনহন করে কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে নড়চড় হীন দাড়িয়ে রইলাম। মারের বিকট শব্দ শুনে ওয়ারেসিয়া চমকে উঠে বসে পরলো। প্রিয়াও উঠে পরেছে। সে এক মিনিটের জন্য যেন কোমায় চলে গেলো। অতঃপর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বুলি ছুড়লো

— আরে ভাই মাত্রই হৃদয় পোড়া ডাক্তার আমাকে আই লাভ.. বলছিল। ইউটা বলতে দিলি না। এরপর আমি ওরে বলতাম
” আত্তে তুয়ারে বেশি গঅম লাগে”

কথাটা বলেই প্রিয়া ছলছল চোখের অভিব্যাক্তি মুখে জমিয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর একটা ভেংচি কাটলো। বিছানা থেকে নেমে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। ওয়ারেসিয়া তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। হুট করে বলে উঠলো

— তুই আজকে ভাইয়াকে বলিসনি? দ্বিতীয় বার বিয়ে হলো তোদের। ভাইয়াও তোকে বলেনি? তোদের তো বিড়াট সুযোগ।

— কি বলবে?

— এই যে, আঁত্তে তুয়ারে বেশি গঅঁম লাগে। আমি তো রিফাতকে বলছি। প্রিয়া আপু গত রাতে আমাকে বলেছে এটা আমাদের সংস্কৃতি। এটা নতুন সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের মেয়ে হয়ে স্বামীকে প্রথম রাতে চাটগাঁইয়া ভাষায় ভালোবাসা জানাতে হয়। তাহলে নাকি নিজের ভাষার প্রতি যেমন আমাদের মনে টান থাকে তেমনি নাকি স্বামীরও আমাদের প্রতি অনেক টান হয়।

আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম ওয়ারেসিয়ার মুখে প্রিয়ার যুক্তি শুনে। মাথা ঘুরে উঠলো এমন প্যচযুক্ত, জটিল যুক্ত যুক্তি শুনে। ও আবার সংস্কৃতির পেছনে কবে পরলো?

— গত রাতে আমার দুইশো পেইজের খাতা একশো পেইজ করে ফেলেছে প্রিয়া আপু। শুধু অঙ্কন ভাইয়ার নামে চিঠি লিখেছে আর ছিড়ে ফেলেছে।

কথাটা বলেই ওয়ারেসিয়া ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে বিছানা ছাড়লো। চলে গেলো আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরের বাইরে। প্রিয়া আর চিঠি? এ যেন মরুভূমিতে পানি। আমি মনে ঝাঁক ঝাঁক বিস্ময়ের আনাগোনা নিয়ে বিছানা গুছিয়ে রাখার জন্য হাত বাড়ালাম বালিশের দিকে। প্রিয়ার বালিশটা তুলে ওয়ারেসিয়ার বালিশের ওপর রাখাতেই চোখে ধরা দিলো উন্মুক্ত একটা চিঠি। পৃষ্ঠা ভরা খোলা চিঠি। চোখের পলক পরছিলো না আমার। অন্যের ব্যাক্তিগত জিনিস দেখতে নেই কথাটা বিবেক ভেতর থেকে বলে উঠলেও নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলাম অস্পর্শে।

প্রিয় ডাক্তার,

কিভাবে চিঠি লিখতে হয় আমি জানি না। পরীক্ষার খাতায় চিঠি লেখা ছাড়া কখনো যে চিঠি লিখতে বসেছি এই কথা আমার ক্ষেত্রে একটুও সত্য নয়। কখনো এমন হয়েছে, এপ্লিকেশন না দিলে স্যার ছুটি দেবে না জেনেও এপ্লিকেশন না দিয়ে অসুস্থ শরীর দিয়ে বসে থেকেছি স্কুল, কলেজে। আর যদি পালিয়ে আসার সুযোগ পেতাম তাহলে তো কথাই নেই। সেই আমি আজ চিঠি লিখছি। শুধু আপনার জন্য। আমি হাজার দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনাকে বোধ হয় আমি মন দিয়ে ফেলেছি। ভুল নিশ্চয়ই করিনি তাই না? আমি তো আমার কর্তাকেই মন দিলাম। হোক না কর্তার মন পোড়া, কর্তার হৃদয়ে দগদগে ক্ষত। কিন্তু ভালোবাসা তো অদগ্ধ হৃদয় দেখে হয় না। যখন স্মরণ ভাইয়া এসে বলল খেয়া তার বউ। তখন আপনার মুখের অভিব্যাক্তি আমি দেখেছি৷ বুঝতে কষ্ট হয়নি আপনি খেয়াকে ভালোবাসেন। আচ্ছা কর্তা এটা শুনবেন না? আমি আপনাকে কখন মন দিয়েছি? গত রাতের দশ মিনিটের ঝগড়ার মাঝে মন দিয়ে দিয়েছি। এই ঝগড়ার পর আমার মনে হয়েছিল, আমার এই হৃদয় পোড়া ডাক্তারের বউ না হলে জীবনে বড়সর একটা বিপর্যয় ঘটবে৷…….

ভীষণ মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো মন একীভূত করে পড়ছিলাম আমি। মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম। এরইমাঝে হুট ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ। আমি তৎক্ষনাৎ হাতের পাশে থাকা বালিশটা অবলীলায় ছেড়ে দিলাম চিঠির ওপর। আড়াল হলো আগের মতো। প্রিয়া স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে এসে আমার নিকট দাড়িয়ে বলল

— চল।

আমি হুম বলে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। এই মেয়েটাও এতো গভীর অনুরাগে ডুব দিয়ে পত্র লিখতে পারে? অকল্পনীয় ছিল। প্রিয়ার সঙ্গে হাটা শুরু করলাম ডাইনিং-এ যাওয়ার জন্য। অবাধ্য, বেয়াদব মন তখনও প্রিয়ার চিঠির কাছে পরে ছিলো। পুরো চিঠি দেখার জন্য আনচান করে উঠা মনকে শাসিয়ে নিলাম। ছোট খাটো অন্যায় করার পরও আমার মনের কোনো অপরাধ বোধ নেই যেন। সে বরং শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে, যাক! মেয়েটা অবশেষে কাউকে ভীষণ ভাবে ভালোবাসতে চায়। আর ছেলেটা এই ভালোবাসা মোটেও ফিরিয়ে দিতে পারবে না। বিয়েতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিমত দেখিনি। সেও নিশ্চয়ই চায় সব দমিয়ে নতুন একটা মনের মালিক হতে। সব ভুলে কারো হাতে হাত রেখে এই ছোট জীবন সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে।

.
খাবার টেবিলে তিন জামাইয়ের জন্য করা হয়েছিল অল্প সময়ে যথেষ্ট আয়োজন। অঙ্কন, রিফাত পাশাপাশি বসেছিল। আর তাদের পাশে একটা চেয়ার ফাঁকা ছিলো স্মরণের জন্য। মেয়েরা কেউ ওদের সাথে খাওয়ার টেবিলে নেই। বাবারা সব বসে গেছে জামাইদের নিয়ে। মায়েরা মেয়েদের নিয়ে বসেছে চাচি আম্মার রুমে। কেউবা বিছানায়, কেউ চেয়ারে, কেউ একটা সিঙ্গেল সোফায়। চাচি আম্মা আর প্রিয়ার মা ছিলেন খাবার পরিবেশন করার দায়িত্বে। ভীষণ ব্যাস্ত ছিলেন তারা নতুন জামাইদের নিয়ে। আমি প্রিয়ার পাশে বসে ছিলাম বিছানায়। হাতে খাবারের প্লেট ছিলো। হাত ধুয়ে এসে প্লেট ধরবো আমি এমন সময় হঠাৎ চাচি আম্মা ডেকে বলে উঠলেন

— খেয়া, স্মরণ কোথায়? দেখছি না তো? তুইকি ডাকিসনি?

আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। এই মানুষটাকে না ডেকে এলাম আমি।

— সেহেরীর সময় শেষ হয়ে যাবে তো। জলদি ডেকে নিয়ে আয়। সবাই বসে আছে।

আমি যাচ্ছি বলে রওনা হলাম নিজের ঘরে। রুমে প্রবেশ করে লাইট অন করে পিছু ফিরতেই বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো। ধীর গতিতে চোখে ঘুরিয়ে আনলাম পুরো রুম থেকে। কিন্তু সে কোথাও নেই। আশ্চর্য হলাম। এটুকু সময়ের মাঝে সেহেরীর আগ মুহূর্তে সে কোথায় যাবে? বেলকনি, ড্রয়িং রুম, ছাদ, চারটে বেড রুম আমি ধুকপুক করা বুক নিয়ে নিঃশব্দে খুজলাম। হতাশ হলাম আমি। সে নেই। ভীষণ রেগেও গেলাম এই মুহূর্তে। সে কি চলে গেছে? চলে গেলেওবা কাউকে বলে গেলো না কেন? এটা কেমন হেঁয়ালি?

চলবে… ইনশাআল্লাহ 🤍

( গল্প চলতে চাইছে চলুক। নাকি? শুধু ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা করবেন। আর গল্প কেমন হচ্ছে এটা বলবেন। তাহলেই সব ভালো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here