বিকেলের ঢাকাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। বাড়ির ছাদে, কার্ণিশ বেয়ে চিলেকোঠার ঘরে খেলা করে রোদ্দুর। খানিকটা ছড়িয়ে যায় গলি গলিতে। বিকেলগুলো যেন মায়া ছড়ায়। রোজ বিকেলেই আমি হাঁটতে বের হই। একা একা হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগে। কোনো দিন মোহাম্মদপুর, শংকর, জিগাতলা কি রবীন্দ্রসরোবর।কোনদিন মানিকমিয়া এভিনিউ, ফার্মগেট, চন্দ্রিমা,নভোথি
য়েটার, হাতিরঝিল কি
আফতাব নগর ছাড়িয়ে বনশ্রী। আমার হাঁটতে ভালোলাগে। এই হাঁটা রোগের জন্যই আমি চৈতিকে পেয়েছি। বিকেলের রোদ্দুরমাখা বারান্দায়।
.
চৈতিকে আমি প্রথম দেখি বসিলাতে। বারান্দায় কালচে খয়েরী একটা শাল গায়ে বসে ছিল। এক হাতে কফিমগ, অন্যহাতে বই। চোখে চশমা। হালকা লয়ে রবীন্দ্রসংগীতের সুর কানে আসছিল বারান্দা থেকে। বিকেলের রোদ্দুর গাছের ফাঁকা দিয়ে এসে ওর গালে ঝাপিয়ে পড়েছে। এত অসহ্য সুন্দর আমার সহ্য হচ্ছিল না। আবার চোখও সরিয়ে নিতে পারছিলাম না। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার বাড়িরই তো রাস্তা। কই? মেয়েটিকে তো আগে দেখিনি? আমার হাঁটা চুলোয় গেল। আমি কালো মার্বেল পাথর কুঁদে তৈরি দেবীর মত ওকে দেখতে লাগলাম। সন্ধ্যার আজান পড়তেই ও আড়মোড়া ভেঙে ভেতরে চলে গেল। আমি আমার রুমে ফিরে আসলাম।মন বুঁদ হয়ে রইলো ভালোলাগায়।
.
তারপর থেকে রোজ বিকেলেই চৈতিকে দেখতাম। সেই কালো খয়েরী শাল, চোখে চশমা, হাতে বই। তবুও আমার দেখতে ভালোলাগতো। ইচ্ছে হতো দেখি। ইচ্ছেরা দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে অসীমে পৌঁছাচ্ছিল। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হতো খুব। একদিন সে সুযোগ পেয়েও গেলাম। বিকেলের আগেই আমি ওর বাড়ির বিপরীতের খোলা মাঠে এসে বসতাম। একদিন দেখি ও রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। ইতস্ততভাবে এদিকওদিক দেখছে। আমি এগিয়ে গেলাম।
-আপনি কি কিছু খুঁজছেন?
মেয়েটা চমকে উঠলো। তারপর হাসলো। এবার আমার চমকানোর পালা। হাসলে মেয়েটির গালে টোল পরে। ঠোঁটের নীচে অদ্ভুত একটা ভাঁজ পরে।
-হ্যা। আমি ওই মাঠটায় যেতে চাই। আমাকে একটু ধরে নিয়ে যাবেন?
চৈতি হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।আমি সেই প্রথম চৈতির হাত ধরি।কি নরম, তুলতুলে হাত চৈতির। মাঠে পৌঁছে ও বুকভরে শ্বাস নিল। জিজ্ঞেস করলো,
-আছেন এখনো?
-হ্যা
-ধন্যবাদ
-নিতে পারছি না।
চৈতি অবাক হয়ে ঘুরে তাকালো। আমি ওর চোখ দুটি দেখলাম।কি শান্ত, সুগভীর। আমি যেন সমুদ্র দেখছিলাম।
-কেন?
-হাত ধরে নিয়ে আসার প্রতিদান শুকনো ধন্যবাদ?
ও হেসে ফেললো।
-তো কি চান শুনি?
-আপনার সাথে একটু গল্প করতে।
-একটু টা কতটুকু?
এবার দুজনেই হেসে ফেললাম।চৈতিই বললো,
-চলুন বসি ওই কোণটায়।
-বেশ
.
সেদিনই জেনেছিলাম ওর নাম। চৈতি। চৈত্রর মত। চৈতি। কিন্তু ও আগাগোড়া ছিল বসন্ত। অনেক পরে ওকে বলেছিলাম,
-তোমার নাম চৈতি না হয়ে বাসন্তী হলে ভাল হতো।
ও হেসেছিল।বলেছিল,
-বসন্ত তো ক্ষণজন্মা।
মেয়েটার সাথে কথায় পারতাম না।
মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত গলায় বলতো ‘অপু, একটা গান শোনাও তো।ওই গানটা। ‘
আমি জানতাম ও কোন গানটা গাইতে বলতো। আমি টুং টুং করে গিটার বাজিয়ে গান ধরতাম,
‘রোদ উঠে গেছে, তোমাদের নগরীতে।
আলো এসে নিভে গেছে তোমাদের জানালায়।
আনন্দ উৎসব, চেনা চেনা সবখানে।
এরই মাঝে চলো মোরা হারিয়ে যাই। ‘
.
দিন দিন চৈতির দেখার ক্ষমতা কমছিল।আমি জেনেছিলাম অনেক পরে। চৈতির চোখের মোটর নার্ভ গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ও কে কিছু বললে বলতো,
-কটা দিন পর তো আর পড়তে পারবো না। তাই যতটুকু পারছি পড়ে নিচ্ছি।
আমি হতাশ হয়ে চুপ করে যেতাম।মাঝে মাঝে ও যখন চশমা খুলে চোখ বড় বড় করে বলতো,
-অপু, একটু কাছে আসো তো।তোমাকে দেখি।
আমার খুব অস্থির লাগতো। আমি ওর কাছে এগিয়ে যেয়ে ওর হাত শক্ত করে ধরতাম।ওই উল্টো আমাকে শান্তনা দিত ‘আমি আছিতো অপু।ভয় নেই।’
.
আমি চৈতির পাশে বসে আছি। চৈতি কুয়াশা খাচ্ছে। ও দুহাত ছড়িয়ে বসে আছে হা করে।
-কি হলো?তুমি কুয়াশা খাবে না?
-উঁহু
-কেন?
-আমি কুয়াশা খেলে তোমার খাওয়ায় টান পরে যাবে।
চৈতি খিলখিল করে হেসে উঠলো। খোলা মাঠে কিন্নরকন্ঠের মত ছড়িয়ে গেল সে হাসি। আমি মনে মনে বললাম
‘চৈতি, আমি সবসময় এভাবেই তোমার পাশে থাকবো।মিলিয়ে নিও তুমি। ‘
চৈতির কাঁধে হাত রাখলাম।
-চলো। অনেক কুয়াশা খেয়েছ।
চাঁদটা এখন ঠিক মাথার উপরে । ঘুমন্ত নগরী জোৎস্নার আলোয় মাখামাখি। মনেহচ্ছে লোকজন ঢাকা ছেড়ে বনে চলে গেছে জোৎস্নার টানে। চারিদিকে স্তব্ধীভূত নৈঃশব্দ্য। চৈতি আমার হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। নিজেদের কেন জানি পৃথিবীর শেষ মানব-মানবী মনে হচ্ছে।।
গল্পঃশেষ সময়
লেখা:ইশরাত জাহান অনিন্দিতা