শেষ_বিকেলের_মায়া (১) . কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

0
659

“চুক্তির বউ হতে হবে তোমাকে। এই হলো এগ্রিমেন্ট পেপার। এখানে সোজা সোজি লেখা আছে এক বছর পর তোমাকে আমি ডিভোর্স দিয়ে দিব। আর তুমি এই শর্ত মেনেই আমাকে বিয়ে করছো।”

ফারিহা অবাক চোখে সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। ব্যক্তিটি পুনরায় বলল,”তুমি কি রাজি এই শর্তে?”

“স্যার আপনার কথার মানে আমি বুঝলাম না।”

“সিম্পল, তোমার মায়ের ট্রিটমেন্ট এর জন্য ২৫ লাখ টাকা লাগবে তাই তো?”

“জি স্যার।”

“আমার শর্ত হচ্ছে আমাকে বিয়ে করতে হবে। অবশ্য বিয়েটা একটা এগ্রিমেন্টের বিয়ে। তোমার মায়ের ট্রিটমেন্ট এর জন্য ২৫ লাখ ৪০ লাখ ইনফেক্ট যত টাকা লাগবে আমি দিব। সিঙ্গাপুর পাঠানোর সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে দিব। শুধু এগ্রিমেন্ট মোতাবেক আমাকে এক বছরের জন্য বিয়ে করতে হবে।”

ফারিহা ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইল। মায়ের অপারেশনের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে ফারিহা এসেছে রিহানের সাথে দেখা করতে। সেখানে বলা হয়েছিল ১০ লাখ টাকার একটা চুক্তি হবে। তাই কোনো কিছু না ভাবেই ছুটে আসে সে। কাল ও ডক্টর বলেছে সিঙ্গাপুরে ট্রিটমেন্ট করালে ওর মা ভালো হয়ে যাবে। আর তার জন্য প্রয়োজন ২৫ লাখ টাকা।

“মিস ফারিহা আপনি কি রাজি?”

ফারিহা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। কাঁধের মলিন ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল,” আম সরি স্যার। আমি এই ধরনের এগ্রিমেন্ট এ রাজি নই। আমি আসছি।”

“এজ ইউর উইস।”

ফারিহা চলে গেল। রিহান তাচ্ছিল্য হেসে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল। প্রচন্ড যন্ত্রণায় মাথা যেন ফেঁটে যাচ্ছে। গত সাত দিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। হন্তদন্ত হয়ে পেপারে গোপন নিউজটা ছাপিয়েছে। অনেকেই আসে কিন্তু রিহানের কাছে সবাই কেই ইরিটেড লেগেছে। ফারিহা নামক মেয়েটিকে যোগ্য মনে হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা শর্ত শুনেই লাপাত্তা হয়ে গেল! মাথা যন্ত্রণায় অসহ্য লাগছে সব। কপালে ধীর হস্তে মালিশ করতে করতে কারো নাম্বারে ডায়াল করল সে।
“হাই সুইটহার্ট। আম সরি, এক্সচুয়ালি বিয়েটা নিয়ে প্রচন্ড চাপে আছি।”

“ও বেবি প্লিজ এক বছর ই তো ম্যানেজ কর কোনো ভাবে। তুমি তো জানোই আমি আমার কোর্স টা কমপ্লিট না করে বি ডি তে ব্যাক করতে পারছি না।”

“আই নো দ্যাট। বাট কিয়া হাউ ক্যান আই ম্যানেজ? মম আর ড্যাড তো উঠে পড়ে লেগেছে আমার বিয়ের পেছনে।”

“উফ রিহান এত টেনশন করছো কেন? তুমি তো বললেই এগ্রিমেন্টের বিয়ে করবে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”

“এক্সচুয়ালি…”

“নো মোর ওয়ার্ড। আমি তোমাকে ট্রাস্ট করি ডার্লিং। আই নো তুমি কোনো মেয়েকেই টাচ করবে না।”

“থ্যাংকস সুইট হার্ট। ওকে এখন রাখছি কেমন?”

“ওকে ডার্লিং। উমম্মামমা।”

ব্যস্ত নগরীর ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ফারিহা। চোখে অশ্রুর ধারা। পরিস্থিতি আজ ওকে কোথায় নামিয়ে আনল? টাকার জন্য একটা মানুষের চুক্তির বউ হবে! ফারিহার ইচ্ছে হচ্ছে মাটিতে পা ছড়িয়ে কান্না করতে। বাবার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। দেড় বছর আগে ও বাবা নামক মানুষটার ছায়া ছিল। মধ্য বিত্ত সংসারে হেসে খেলে জীবন পার করছিল। কিন্তু বাবার হঠাৎ করে চলে যাওয়া যেন সমুদ্রের ঢেউ হয়ে ওদের উপর পড়ল। দাদার সম্পতি থেকে বঞ্চিত করা হলো ওর কোনো ভাই নেই বলে। বাবার যা ছিল তা বিক্রি করে চলে আসল ঢাকার শহরে। এখানে এসে কোনো মতে এইচ এস সি পরীক্ষা দিল। মায়ের হঠাৎ অসুস্থতায় আরো এলোমেলো হয়ে গেল। পড়া হলো না ভার্সিটি তে। যা টাকা ছিল তা মায়ের চিকিৎসা তেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু হায় কপালের দুঃখ কি আর সহজে যায়? ছয় মাস আগে মায়ের হার্ট ব্লক হয়েছে ধরা পড়ল। ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে কোনো মতে সংসার চালাচ্ছিল সে। অপারেশন করার টাকা কোথায়? মাস খানেক আগে কিডনির সমস্যা ও ধরা পড়ল। সব এলোমেলো হয়ে গেল। মা কে জীবিত দেখতে হলে প্রয়োজন প্রায় ২৫ লাখ টাকা। ফারিহা আপন মনে ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে আসল। ছোট্ট টিন চালের এক বাসাতে ভাড়া থাকে। আশে পাশের সব কিছুই বস্তির মতো। দরজা খুলে রুমে ঢুকতেই মায়ের খ্যাক খ্যাক কাশির শব্দ। ফারিহা ছুটে গেল মায়ের কাছে। মা মলিন বিছানা তে শুয়ে আছে। ফারিহার দু চোখ ভরে উঠল। মা কিছু বলতে যাবে তখনি কাশি উঠে গেল। কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে র ক্ত বের হয়ে আসল। ফারিহা বিচলিত হয়ে পানি খাওয়াল। মা লম্বা করে শ্বাস টানতে লাগলেন। ফারিহা মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

“আমি বোধহয় আর বাঁচবো না রে মা।”

“মা এমন কথা একদম বলবে না। তুমি বাঁচবে অনেক বছর বাঁচবে। তুমি না বাঁচলে আমাকে কে দেখবে বল তো? আমার জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে মা।”

কথা গুলো বলতে বলতে মা কে জড়িয়ে ধরল ফারিহা। চোখ দিয়ে নোনা জলের ধারা নেমে যাচ্ছে। মা খ্যাক খ্যাক করে কাশতে লাগলেন। ফারিহা ধীর হাতে পিঠে মালিশ করল। কাশি থামতেই ফারিহা মা কে শুয়ে দিল।
“অত টাকা কোথায় রে মা? আমি জানি আমার বড়ো কোনো অসুখ হয়েছে।”

“এমন টা বলতে নেই মা। তোমার শরীরের এমনি কিছু সমস্যা আছে। অপারেশন করালে তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”

“অপারেশনের টাকা পাব কোথায়? তুই দিন রাত খেটে সংসার চালাচ্ছিস। আর কি করবি রে মা?”

ফারিহা শুকনো হাসল। মায়ের বুকে মাথা রেখে বলল,”তোমাকে আমি বাঁচাব মা। তোমার ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি অত ভেবে না তো। এখন রেস্ট নাও।”

মাকে সান্ত্বনার বানী শুনিয়ে দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকল ফারিহা। পানির কল ছেড়ে দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। জীবন এত কঠিন কেন? বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে আসল ফারিহা। দরজা খুলতেই মধ্য বয়সী এক মহিলা বললেন,”কত বার কইতে হইব পানি কম খরচ কর। মাসে পানি বিল কত আহে খেয়াল আছে? তিন মাসের ভাড়া ও তো বাইজা আছে। নেহাত ই মা মেয়ে বছর দেড়েক ধরে থাকোস তাই এখনো থাকতে দিছি।”

“মাফ করবেন খালা। আর বেশি পানি খরচ করব না।”

“যা সামনে মাসে কিন্তু ভাড়া দিতে হবে। না হলে বাসায় আর থাকতে পারবি না।”

ফারিহা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। ভদ্র মহিলা প্রতি মাসেই এমন কথা বলেন। কিন্তু মাস শেষে বাসা থেকে বের করে দেন না। বাইরে টা উগ্র মেজাজের হলে ও ভেতরে সুন্দর এক মন রয়েছে। সে মৃদু হাসল। কৃতঙ্গতার চোখে ভদ্র মহিলার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল।

“স্যার স্যার সকালের মেয়েটা আপনার সাথে আবার দেখা করতে এসছে।”

“কোন মেয়েটা?”

“ঐ যে ফর্সা করে চিকন মেয়েটা কি যেন নাম ফা…”

“ফারিহা?”

“ইয়েস স্যার।”

“ভেতরে পাঠিয়ে দাও।”

লোকটা চলে যেতেই রিহান ভ্রু কুঁচকে চেয়ার ঘুরিয়ে নিল। কেন যেন মনে হয়েছিল ফারিহা আসবে। তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করে নি। রিহান তাচ্ছিল্য হাসল। তখন তো বেশ ভাব দেখিয়েছিল। এখন গেল কোথায় এত ভাব? সেই তো রিহান জোয়ার্দার মাহাদীর কাছে আসতেই হলো। প্রথমে নাকোচ করার শাস্তি তো পেতেই হবে মিস ফারিহা আফরোজ।

“মে আই কাম ইন স্যার?”

“ইয়েস।”

গুটি গুটি পায়ে রুমে ঢুকল ফারিহা। রিহান চেয়ার উল্টো রেখেই বলল,”কি দরকার?”

“স্যার এক্সচুয়ালি আমি না মানে বলছিলাম যে…..।”

ফারিহাকে তোতলাতে দেখে রিহান চেয়ার ঘুরিয়ে নিল। মেয়েটির উদ্দেশ্যে গ্লাসটা এগিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করল। ফারিহা ঢক ঢক করে পানি গিলে ফেলল। রিহান সামান্য ভাবনাতে পড়ল। মেয়েটার মুখ এতটা শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

ফারিহা লম্বা করে শ্বাস নিচ্ছে। রিহান চোখের ইশারায় বসতে বলল। তবে মেয়েটি বসল না। বরং সমস্ত সংকোচ কাটিয়ে বলল,”স্যার আমি এগ্রিমেন্ট পেপারে সাইন করতে রাজি।”

রিহানের ঠোঁটের কোণ জুড়ে মৃদু হাসি দেখা গেল। তবে সে হাসি ভেদ করে সামান্য রগরগা কণ্ঠে বলল,”বাট এগ্রিমেন্ট টা তো আমি অন্য কাউকে…।”

রিহানকে কিছু বলার সুযোগ দিল না ফারিহা। সঙ্গে সঙ্গে রিহানের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। ঘটনাটা এতটাই দ্রুত ঘটল যে রিহান অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। বিষয়টা মাথায় খেলার আগেই ফারিহার কান্নামিশ্রিত গলা ভেসে আসল।
“স্যার প্লিজ স্যার। আমার খুব প্রয়োজন , আমার মা কে বাঁচাতে হবে। প্লিজ স্যার আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। আপনি যা যা বলবেন আমি তাই করব। প্রয়োজনে এক বছর কেন সারা জীবন আপনার বাসার চাকরানি হিসেবে এগ্রিমেন্ট সাইন করব। দয়া করুন আমায়। আমার মা কে বাঁচাতে হবে। প্লিজ স্যার।”

ফারিহার এমন কথা তে রিহান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মেয়েটা ২৫ লাখ টাকার জন্য সারা জীবন চাকরানি হতে ও রাজি! তার মানে সত্যি এর মা অসুস্থ। রিহান সামান্য দূরে সরে গেল। গলা ঝেরে বলল,”উঠ, তোমার মায়ের অবস্থা কেমন?”

ফারিহা নাক টানতে লাগল। গুটিয়ে যাওয়া জামাটা টেনে বলল,”ভালো না স্যার। একটু আগে ও র ক্ত বমি করছে। স্যার প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। আমি সমস্ত এগ্রিমেন্ট পেপারে সাইন করব। প্লিজ স্যার। দয়া করুন।”

“ওকে। শান্ত হও। এত হাইপার হওয়ার প্রয়োজন নেই। আগে আমার কথা শোনো।”

ফারিহা মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। রিহান বসতে বললেই চট করে বসে পড়ল। ফারিহার দিকে একটা ছবি এগিয়ে দিল রিহান। ফর্সা, লম্বা দেখতে স্মার্ট একটা মেয়ে পরনে ওয়েস্টার্ন ড্রেস। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ সুন্দরী। ফারিহা ছবি টা দেখে রিহানের দিকে বাড়িয়ে দিল।
“এটা আমার গার্লফ্রেন্ড। একটা সমস্যার জন্য ও বাংলাদেশে আসতে পারছে না। এই দিকে আমার মম ড্যাড আমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। আর কিয়ার কথা এখন আমি বাসাতে কাউ কে জানাতে পারছি না। যার জন্য এই এগ্রিমেন্টের বিয়ে।”

ফারিহা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। কোন ধরনের লজিক এটা! রিহান ছোট করে দম ফেলে চোখ বন্ধ করল। বা হাতে কপাল ঘষতে ঘষতে বলল,”লেট মি এক্সপ্লেইন। আমি আমার মম ড্যাড কে বলব আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তোমাকে ই বিয়ে করতে চাই। সব থেকে বড়ো কথা তুমি এতিম খানা তে বড়ো হয়েছ।”

রিহানের কথা তে ফারিহা নাক কুঁচকে নিল। রিহান চোখ খুলে বলল,”আমি তোমাকে চুজ করেছি কারণ তোমার ফ্যামিলেতে শুধু তোমার মা আছে। সব কিছু ম্যানেজ করতে সহজ হবে। আমি এখানে তোমার মা কে জড়াতে চাই না। আর তাছাড়া আমার মম ড্যাড এতিমদের প্রতি দূর্বল। তাই তোমাকে সহজেই মেনে নিবে। আমাদের বিয়ে টা হয়ে যাওয়ার বছর খানেকের মাঝে কিয়া চলে আসবে। এর আগে ও আসতে পারে। তো কিয়া চলে আসলে আমি বলব আমাদের বিয়েটা কোনো বিয়েই নয়। তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। আর আমি কিয়া কে বিয়ে করে নিব। বুঝতে পেরেছো?”

ফারিহা মাথা ঝাঁকাল। কিছুক্ষণ ভেবে ভীত গলাতে বলল,”বাট স্যার আপনি তো আপনার ফ্যামিলির পছন্দে ও বিয়ে করতে পারেন?”

“স্টুপিট তাহলে আমি কিয়া কে কি করে বিয়ে করব? আমার মম ড্যাড যার সাথে বিয়ে দিবে তার সাথে তো কোনো এগ্রিমেন্ট হবে না? হবে কি? তখন আমি কি করব। তার জন্য ই তো এত প্ল্যান। তুমি রাজি কী না সেটা বল।”

ফারিহা ফোঁস করে দম ফেলল। জীবনকে পুতুল খেলার মতো সাজাবে সে। বর , ঘর সব ই হবে কিন্তু দিন শেষে যার কোনো মূল্য ই নেই। এছাড়া কোনো উপায় নেই। মা কে বাঁচাতে হলে এটা মেনে নিতেই হবে। রিহান হাত দিয়ে তুরি বাজাতেই চমকে তাকাল ফারিহা। মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের জীবনের সব থেকে বড়ো সিদ্ধান্তটা নিল।

“আমি রাজি।”

রিহানের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেল। সাত দিনের চিন্তার অবসান হলো আজ। তৃপ্তি সহকারে ঘুমাবে। মাঝে এক বছর বাকি। তারপর কিয়ার আর ওর মাঝে কোনো দুরুত্ব থাকবে না।

#শেষ_বিকেলের_মায়া (১)
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

| প্রিয় পাঠক সাধ্য মতো রেসপন্স করবেন। আর পরবর্তী পর্ব পেতে পেজে ফলো ও গ্রুপে জয়েন করুন।|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here