#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#১৬তম_পর্ব
ঠান্ডাটা বাড়ছে। একটা শাল থাকলে মন্দ হতো না। ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ শাল জড়িয়ে দেয় তাকে। নবনীতা পাশে ফিরতেই দেখে ঢুলু ঢুলু নয়নে তার পেছনে শান্ত দাঁড়িয়ে আছে। শালটা জড়িয়ে দেবার পর ও শান্তের হাতের বেস্টনি নবনীতাকে ঘিরেই থাকে। হুট করেই বলে,
“আমি হয়তো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি নবনীতা। আমার একটা রোগ হয়েছে। খুব জটিল রোগ।“
শান্তের কথাটা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে নবনীতার। অবাক চোখে তাকাতেই সে বলে,
“আমি “তুমি” নামক রোগে আক্রান্ত। এমনটা কেনো হলো বলতো নবনীতা?”
শান্তের চোখে চোখ রাখে নবনীতা। ঘোর লাগা চোখে শান্ত তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে সেই উষ্ণ হাসি। নবনীতার মনে হলো তার শীতল হৃদয়ে এক ওম অনুভূতি হচ্ছে। লোকটার কথাগুলো এলোমেলো লাগছে তার। তার ক্ষত হৃদয়ে যন্ত্রণা করছে। ক্ষীণ যন্ত্রণা। এই ক্ষীণ যন্ত্রণার কারণ তার অজানা। এক ভালোলাগার স্মিত হাওয়া দোলা দেয় মনে। শান্তের দৃষ্টি বুকে গিয়ে লাগছে। কিন্তু যখম হৃদয়ের স্মৃতিগুলো সূচালো। অনুভূতি নামক পদার্থটা নীল ভালোবাসার সাথে মিলে বিষাক্ত এক স্মৃতি তার বুকে খোদাই করা। নবনীতার মুখের ভাবটাই বদলে গেলো। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শান্তের থেকে। তার হাতের বেস্টনী থেকে মুক্ত করে নিলো নিজেকে। তারপর বারান্দা থেকে রুমে চলে গেলো সে। নবনীতার এমন কাজে অবাক হলো না শান্ত। এমন কিছুটাই আশা করেছিলো সে। নবনীতার হৃদয়ের আঙ্গিনাতে নিজের ঠাঁই হওয়াটা এতোও সহজলভ্য নয়। তবুও বেহায়ামনটা মানতে চাইলো না। আলো আধারের মেলায় এলোচুলের নীল রমনীকে আলিঙ্গন করার লোভটা সামলাতে পারলো না সে। তার সুগভীর কাজলকালো নয়নে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ভয় করলো না শান্ত। উনত্রিশ বছর পার হতে চললো, কিন্তু এই অনুভূতিটা একেবারেই নতুন তার কাছে। এই শ্যামলী মেয়েটি তাকে একটু একটু করে নিজের মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে। এখন চাইলেও সেই মায়া থেকে নিস্তার নেই শান্তের। এটা কে কি বলে? ভালোলাগা? প্রেম? নাকি ভালোবাসা?
_________________________________________________________________
বর্ষায় পাহাড় নতুন রুপ নেয়। মেঘ, পাহাড় এবং বর্ষণের এক অনন্য মেলবন্ধন হয় এই বর্ষা কালে। আজ হঠাৎ করেই বৃষ্টি নেমেছে সাজেকের বুকে। সাদা তুলো কালো রঙ্গে ছেয়েছে এই উপাত্যাকার উপর। দুপুরের দিকে প্লান ছিলো কংলাক পাহাড় পাড়ি দেবার কিন্তু এই বর্ষায় কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছে না ট্যুর ম্যানেজার। খাড়া পাহাড় সম্পূর্ণ কাঁদায় ছেয়ে গেছে। বাংলাদেশের উঁচু পাহাড় দের মাঝে এই পাহাড়টা অন্যতম। সুতরাং বর্ষার আদলে একটা ভুল কদম আর আনুষ তলিয়ে যাবে নিরুদ্দেশের দেশে। ইউটিউবে শীতে সাজেক বহুবার দেখেছে নবনীতা। কিন্তু এই প্রথম বর্ষায় সাজেক স্বচক্ষে দেখছে সে। কি মায়াবী অপরূপা এই ধরণী। হাজার হাজার ফুট উপর থেকে বর্ষার লীলা নবনীতাকে আরোও আকর্ষণ করছে। সবথেকে অদ্ভুত তার বর্ষা একেবারেই ভালো লাগে না। শুধু কাঁদা প্যাঁচ প্যাঁচ, স্যাতসেতে আবহাওয়াই তার কাছে মনে হতো বর্ষা। কিন্তু সাজেকে এসেই, আসল বর্ষার দেখা মেলেছে তার। এ যেনো অন্য এক মায়াবী খেলা। বারান্দায় দোলনায় দোল খেতে খেতে সে উপভোগ করতে লাগলো বর্ষার এই দৃশ্য আর আওড়ালো আনমনে,
“আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিল মেঘকে
আর মেঘ কী ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।
সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘেকে বললে
আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
আজ তোমাকে স্মান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।“
হঠাৎ কানে এলো,
“কফি চলবে?”
নবনীতা পেছনে ফিরে দেখলো শান্ত দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ইন্সট্যান্ট কফির দুটো মগ। গরম পানি জোগাড় করে বহু কষ্টে বানিয়েছে সে। নবনীতা হাত বাড়িয়ে দিলো। শান্ত টুলটা টেনে ঠিক বসলো নবনীতার পাশে। সকালের পর থেকে তেমন কথা তাদের হয় নি। একা আসার কিছু অসুবিধার এটি অন্যতম। অপর মানুষটি চুপ করে থাকলে আমরা কথা বলতে পারি না। শান্ত ও সেই অসুবিধাতে পড়েছে। নবনীতা কথা বলতে না চাইলে শান্ত গায়ে পড়ে কথা বলতে পারছে না। এখানে নেটওয়ার্ক ও খুব একটা ভালো না যে অফিসের কাজগুলো করবে। আবার বৃষ্টি হবার কারণে বাহিরেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না তার। তাই নবনীতার সাথে দু একটা কথা বলেই সময় কাটানোটা বুদ্ধিমানের। নবনীতা কফির মগে চুমুক দিলো। খুব একটা মন্দ হয় নি কফিটা না। শান্ত তখন কথার সূভনা করে,
“তোমার বৃষ্টি ভালো লাগে?”
“কেনো বলুন তো?”
“সেই দুপুর থেকে বসে আছো কিনা। তাই?”
“উহু, বৃষ্টি আমার কখনোই ভালো লাগতো না। এই প্রথম বৃষ্টি ভালো লাগছে। আপনার?”
“আমার বৃষ্টি খুব ভালো লাগে জানো তো। স্নিগ্ধ স্নান যাকে বলে। সব দূষণকে মূহুর্তেই শেষ করে ফেলে এই বৃষ্টি।“
“আপনার মতো মানুষ বৃষ্টি ভালোবাসবে, কল্পনা করি নি।“
“এমন অনেককিছুই আছে, যা তুমি জানো না। সমস্যা নেই জেনে যাবে।“
“অপেক্ষায় রইলাম।“
“পিয়াজু খাবে?”
“এখানে কোথায় পাবেন?”
“খাবে কি না বলো?”
“খাওয়াই যায়।“
শান্ত মুচকি হাসি হেসে উঠে গেলো। ঘন্টা খানেক বাদে তার আগমন ঘটলো, হাতে একটা ঠোঙা। বেঁচারা ভিজে একাকার। সাদা টিশার্ট টা গায়ে লেগে গেছে তার। নবনীতা তাড়াতাড়ি টাওয়াল নিয়ে এগিয়ে যায়। উগ্রীব কন্ঠে বলে,
“কাকভেজা হলেন কি করে?”
“কাউন্টারে ছাতি ছিলো না। এভাবেই গিয়েছি”
“পাগল আপনি?”
“একটু। গরম গরম পিয়াজু এনেছি। বসে খাওয়া যাবে।“
বলেই ভুবন ভুলানো হাসিটা হাসলো শান্ত। শান্ত মাথা মুছতে থাকে। তখন নবনীতা ঠোঙা খুলে দেখে সত্যি এবড়ো থেবড়ো ডালের বড়া। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“পিয়াজু পেলেন কি করে?”
“সিক্রেট বলা যাবে না।“
“ইস, আসছে আমার জেমস বন্ড”
“হাহাহা, বেশি খেয়ো না। আজ ব্যাম্বো চিকেনের ব্যবস্থা হচ্ছে। ডিনারে জম্পেস খাবার।“
নবনীতা ঠোঙ্গা থেকে একটা বড়া মুখে দিলো। মায়ের হাতের পিয়াজুর মতো স্বাদ তো নাই। একেবারেই বেস্বাদ। মশলাটা কম। পাহাড়ীরা একেই কম মশলায় রান্নাটা বেশি করে। পিয়াজুটায় আরেকটু মশলা হলে হয়তো ভালো হতো। শান্ত বেঁচারার মুখের দিকে চেয়ে নবনীতা মুখ বানালো না। নয়তো এই পিয়াজু তার খাওয়া হতো না। দাঁড়িওয়ালা হনুমানটা এই বৃষ্টিতে ভিজে কম কষ্ট করে নি সে। তার এই কষ্টটুকুর জন্য এসামান্য বড়াটা খাওয়াই যায়।
সকাল ৫.৩০টা,
সাজেকের খাঁড়া রাস্তায় হেটে যাচ্ছে নবনীতা এবং শান্ত। হেলিপ্যাডের দিকে এগোচ্ছে তারা। পনেরো মিনিট পর সূর্যোদয় হবে। তাই এখন ই রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে গেছে তারা। আজকে সাজেকে শেষ দিন। কালকের পুরো দিনটা বৃষ্টি খেয়ে ফেলেছে। কংলাক পাহাড়টা আর ওঠা হলো না তাদের। আর্মির স্কটের সাথে সাথে বেড়িয়ে পড়বে তারা। এরপর যাবে কক্সবাজার। তাই আজ পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখার ইচ্ছটায় মাটি দিতে পারলো না নবনীতা। আর কবে দেখা হয় কে জানে। হ্যালি প্যাডে যখন পৌছালো তখন মানুষের ভিড় লেগেছে সেখানে। ক্যামেরা, মোবাইল নিয়ে ছবি তুলতে ব্যাস্ত। প্যাডের এক কোনায় গিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকলো নবনীতা। সহস্র মেঘের চাঁদর যেনো। সাদা মেঘের কোমল বিছানা দেখা যাচ্ছে। সুর্যের কিরণ এখনো দেখা মেলে নি। হয়তো পূর্ব গগণে কিছু সময়ের মাঝেই যে উঠবে। সাদা চাঁদর সরিয়ে লাল রক্তিম গোলাকার চাকতি উঠবে গগনে। নবনীতা অধীর আগ্রহ তাকিয়ে আছে। আর শান্ত তাকিয়ে আছে নবনীতার দিকে। চট করে ফোনটা বের করে সে। সাদা কুর্তিতে এলোকেশীকে ক্যামেরাবন্দি করে সে। মিনিট তিনেক বাদে সূর্যোদয় হয়। লাল চাকতিটা মেঘ চিরে বের হয়। এ যেনো অপরুপ মায়া। নবনীতার চোখ চকচক করেছে। সে এই বিস্ময় এই প্রথম দেখলো। তার বাচ্চা মেয়ের মতো উচ্ছ্বাসিত মুখটিও ক্যামেরা বন্দী করলো শান্ত। এরপর বললো,
“নবনীতা এদিক তাকাও।“
নবনীতা ফিরতেই দুজনের একটা সেলফি তুলে নেয় সে। সাজেকে নিজ মোবাইলে এই প্রথম কাপল ছবি তুলে শান্ত। নবনীতার সাথে এই ছবিটা চিরকাল রেখে দিবে নিজের ফোনে। নবনীতা শান্ত এর কাজে বাঁধা দেয় না। এই ট্যুর টা সত্যি ই অতুলনীয়।
সূর্যোদয় শেষে নবনীতার কিছু ছবি তুলে দেয় শান্ত। এর মাঝেই দেখা হয় শ্রাবণের সাথে। শ্রাবণ তার ক্যামেরায় সাজেকের বহু সৌন্দর্য তুলে রেখেছে। আজ সে ফিরবে ঢাকা। শান্তের সাথে দেখা হতেই জড়িয়ে ধরে সে। নবনীতার মুখভাব পালটে যায় শ্রাবণকে দেখে। শ্রাবণের সাথে তার গত পরশুর কথাটা বলা হয় নি শান্তকে। শান্ত কিভাবে প্রতিক্রিয়া করবে তা জানা নেই তার। সেজন্য ই বলা হয় নি। নবনীতা শ্রাবণের সামনে থাকতে বিব্রতবোধ হতে থাকে। তাই সে শান্তকে বলে,
“আপনারা কথা বলুন, আমি পলি ভাবির সাথে কথা বলে আসছি।“
বলেই নবনীতা পলি এবং নন্দিনীর কাছে চলে যায়। তারাও সুর্যোদয় উপভোগ করতেই এসেছিলো। শান্তকে একা পেয়ে হুট করেই শ্রাবণ বলে উঠে,
“তোদের মধ্যে আই মিন, তোর আর নবনীতার মধ্যে সব ঠিক আছে তো?”
শ্রাবনের প্রশ্নে হতচকিত হয় শান্ত। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“আসলে, তোর ওয়াইফ এর ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে তোকে………….
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে দিবো। কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]
মুশফিকা রহমান মৈথি