#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#৩য়_পর্ব
শারমিন বেগমের হেয়ালী কথা বুঝতে না পারলেও ভেতরে প্রবেশ করতেই থমকে যায় নবনীতা। স্নেহার মা, একজন বৃদ্ধা, সে এবং তার ছোট চাচু বসে আছে বসার ঘরে। তখনই শারমিন বেগম বলে,
“ভেতরে যেয়ে জামাটা বদলে আয়, ভালো জামা পড়িস। উনারা তোকে দেখতে এসেছেন। আর শোন জামা না শাড়ি পড়িস। একটা নীল শাড়ি আছে না তোর? ওটা পড়িস।“
মায়ের এমনধারা কথায় অবাকের অষ্টম আসমানে পৌছে যায় নবনীতা। সন্দীহান চোখে তাকায় শারমিন বেগমের দিকে। স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
“উনারা আমাকে দেখতে এসেছে মানে? আমি কি কোনো জন্তু নাকি? আর শাড়ি পড়ার কি আছে? এতো আড়ম্বড়তার কি দরকার?”
শারমিন বেগম এবার তার মাথায় একটা গাট্টা মারেন। হিনহিনে কন্ঠে বলেন,
“গবেট কোথাকার! ওরা তোর বিয়ের কথা পাড়তে এসেছেন।“
“বিয়ে” নামক শব্দটা শুনতেই মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় নবনীতার। বড় বড় চোখে বসার ঘরে তাকায় সে। স্নেহার মা সামিয়া এবং বৃদ্ধা মহিলাটি কিছু একটা নিয়ে গল্পে মজেছেন। আর তার ঠিক বিপরীতে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে শান্ত। তার ভাবভঙ্গিতে অনীহার ছাপ স্পষ্ট। এক দৃষ্টিতে মোবাইল স্ক্রল করছে সে। আশেপাশের কোনো দিকে যেনো তার নজর ই নেই। নবনীতা ধাক্কা সামলিয়েই নিচ্ছিলো তখনই সামিয়া ব্যাগ্র উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,
“নবনীতা, চলে এসেছে। যাক আমাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো।“
বলেই তিনি এগিয়ে এলেন নবনীতার দিকে। আলতো করে ধরলেন নবনীতার দুহাত। মেকি অভিযোগের সুরে বললেন,
“কি গো! আমার মেয়ে না হয় ফাকিবাজ, তাই বলে আমাকে না বলেই তাকে পড়ানো ছেঁড়ে দিবে?”
নবনীতা বেকুবের ন্যায় শুধু তাকিয়ে রইলো মহিলার দিকে। মহিলার এমন আদিক্ষ্যেতা ঠিক হজম হচ্ছে না তার। নবনীতার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি তাকে টেনে নিয়ে গেলেন সোফার কাছে। ঠিক বৃদ্ধা এবং তার মাঝে বসালেন। বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বললেন,
“কি মা? আমাদের শান্তের এর জন্য একদম পারফেক্ট একটা মেয়ে খুজেছি না? সারা ঢাকা খুজলেও এমন শান্ত, ভদ্র এবং গুনী মেয়ে পাওয়া ভার। কি শান্ত! চুপ করে আছো যে?“
সামিয়ার এমন কথায় শান্ত মোবাইল থেকে মাথা তোলে। অনাগ্রহের চোখে তাকায় নবনীতার দিকে। এতোক্ষণ কিছু না বুঝলেও এখন সবকিছু পরিষ্কার লাগছে নবনীতার কাছে। সামিয়া নিজের বেয়াদব, নির্লজ্জ, বেহায়া দেবরের জন্যই তার বিয়ের কথা পাড়তে এসেছন। এই বৃদ্ধা হয়তো তার শ্বাশুড়ী। এর মাঝেই সামিয়ার শ্বাশুড়ী হেনা বেগম বলে উঠে,
“ওকে জিজ্ঞেস করছো কেনো বউ মা, ও আর কি বলবে? আমি যাকে পছন্দ করবো আমার ছেলে তাকেই বিয়ে করবে।“
তিনি হাসি মুখে কথাটা বলেন। তার হাসিমুখের কথাটি শুনে শান্তের চোয়ালজড়া শক্ত হয়ে গেলো। সে একটু নড়েচড়ে বসলো। কিন্তু কোনো কথা বললো না। শুধু সরু চাহনী প্রয়োগ করলো নবনীতার দিকে। তারপর একটু থেমে শারমিন বেগমের দিকে তাকান। মৃদু কন্ঠে বলেন,
“ভাবি, আমার আপনার মেয়েকে খুব মনে ধরেছে। তবে আমার তো আত্নীয় স্বজন আছে। আমি চাই তাদের ও মতামত থাকুন। আগামী শুক্রবার আমি আসতে চাইছিলাম।“
“আমাদের কোনো আপত্তি নেই ভাবী। শুক্রবার হলে নবনীতার বাবাও থাকতো।“
দুজনের কথা বার্তা শুনে আর চুপ করে থাকতে পারলো না নবনীতা। পানি এখন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। চুপ করে থাকা বিপদ ছাড়া কিছু বয়ে আনবে না নবনীতার জন্য। সত্যি বলতে সে কোনো ভাবেই বিয়ে করতে পারবে না। তার ভাবনার অতুল গহীনে শুধু নীলয়কেই ঠায় দিয়েছে সে। সেখানে অন্য কারোর স্ত্রী হবার কথা সে ভাবতেই পারে না। আর শান্ত নামক অকালকুষ্মান্ড এর স্ত্রী তো কখনোই হবে না সে। যে মহিলাদের সম্মান করতে পারে না সেই ছেলেকে বিয়ে করার থেকে সারাটা জীবন আয়বুড়ো থাকা ঢের ভালো। নবনীতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথাগুলো গুছিয়ে মুখ খুললো সে। হেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বললো,
“আন্টি আমাকে ক্ষমা করবেন কিন্তু এই বিয়ে আমি করতে পারবো না।“
নবনীতার এমন কথায় অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন হেনা বেগম। অতি উৎসাহিত সামিয়া ও বেশ চমকে উঠে। হেনা বেগম ধীর গলায় বলেন,
“আমি ঠিক বুঝলাম না মা, কিহ?”
“আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করবো না। আপনার আমাকে পছন্দ হলেও আমার আপনার ছেলেকে মোটেই পছন্দ নয়। যে রাস্তাঘাটে মেয়েদের সম্মান করতে জানে না তাকে আমি কখনোই বিয়ে করবো না।“
নবনীতার কথায় হেনা বেগমের মুখে থ মেরে যায়। নিজের ছেলের দিকে তাকায় সে। শান্ত তখন স্থিরদৃষ্টিতে নবনীতার দিকে তাকায়। তার চোখ রক্ত বর্ণ হয়ে আছে। সহ্যের একটা সীমা থাকে। আরেফিন শান্তকে আজ অবধি এতোটা অপমান কোনো নারী তাকে করে নি। এখানে মেয়ে দেখার নামে তাকে এতোটা অপমানিত হতে হবে এটা জানা থাকলে কখনো এখানে আসতো না সে। মায়ের বাধ্য ছেলে সে। মায়ের কথা তার আছে আদেশ। শুধু মায়ের কথা মানতেই এখানে আসা তার। ভাবী এতো ঘটা করে মাকে এই মেয়েটির সম্পর্কে বলেছেন, যে মাও আপত্তি করে নি। মায়ের খুশির জন্য ছবি, নাম ঠিকানা না জেনেই এখানে এসেছে শান্ত। যখন নবনীতাকে আহ্লাদ করে ভাবী পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো তখন দাঁতে দাঁত চেঁপে বসেছিলো সে। ভেবেছিলো মাকে বাড়ি যেয়ে নিজের কথাগুলো বলবে। কিন্তু নবনীতা সহ্যসীমা পেড়িয়ে তাকে অপমান করতে লেগেছে তখন চুপ করে শান্ত শুধু শুনে যাবে; এটা তো হবার নয়। শান্ত ও এবার মুখ খুললো। বজ্রকঠিন কন্ঠে বললো,
“আপনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন মিস নবনীতা। আমার ভাবী সর্বদা অতি উৎসাহি। যদি আমি জানতাম এতো ঘটা দিয়ে এখানে আসা হচ্ছে আমিও কখনোই রাজি হতাম না।“
“আমি সীমা ছাড়াচ্ছি? সেদিনের চড়টা ভুলে গেছেন হয়তো। তা মায়ের সুপুত্র আপনার মা কি জানেন, বাসে আপনি মেয়েদের টিজ করে বেড়ান। তাদের আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করেন?”
হেনা বেগম শান্তের দিকে সন্দীহান নজরে চেয়ে বলেন,
“ও এগুলো কি বলছে শান্ত?”
“আষাঢ়ে গল্প। উনার নিজেকে বিশ্বসুন্দরী মনে হয়। ওনার মনে হয় পৃথিবীর সব ছেলেরা উনাকে টিজ করে। আমি পাত্তে বাসে চড়ি না। সেদিন গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে চড়েছিলাম। কথা নেই বার্তা নেই উনি আমাকে চড় লাগিয়ে দিলেন। উনার ভাগ্য ভালো আমি উনার নামে একশন নেই নি। তখন সব তেল বেড়িয়ে যেতো। আসলে তুমি তো আমাকে কু শিক্ষা দাও নি। সেকারনে আমি সেদন চুপ ছিলাম। তবে উনার শিক্ষা তো দেখতেই পাচ্ছি।“
“আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আপনি কে? মেয়েদের অসম্মান করে এখন বড় বড় বুলি। বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকে। বেরিয়ে যান এখনি। সেদিন আমাকে বের করে দিয়েছিলেন, আজ আমি বলছি এখনই বের হয়ে যাবেন।“
শান্তের কথাগুলো শুনে গায়ে আগুন জ্বলে উঠে নবনীতার। একেই তো দোষ তার, সে অসভ্যতামি সে করেছিলো। আর এখন বড় বড় কথা বলছে। নবনীতা রাগে কাঁপছে রীতিমতো। তার চোখ রক্তিম হয়ে আছে। এই লোকটাকে তার বেয়াদব মনে হতো, এখন লোকটার প্রতি নিতান্ত ঘৃণা জন্মাচ্ছে তার মনে। এতো খারাপ মানুষ হয়?
“আপনার বাসায় বসে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। মা, ভাবী ওঠো। আর মিস নবনীতা, কাউকে দোষ দেবার পূর্বে আগে যাচাই করে নিবেন। কোনোদিন যদি আপনার উপর এমন দোষ পড়ে যা আপনি করেন নি। তখন আমিও দেখবো আপনি কি করেন।“
বলেই উঠে দাঁড়ালো শান্ত। হেনা বেগমের মুখখানা অপমান ক্ষোভে লাল হয়ে আছে। সামিয়ার উৎসাহ গুলো বাতাসে মিলিয়ে গেলো। এই পুরো ঘটনায় সবচেয়ে খুশী হয়েছে স্নেহা। চাচী হিসেবে নবনীতার মতো খচ্চর স্বভাবের মাস্টারনীকে মোটেও সে মেনে নিতে পারছিলো না। ছোট বলে তার মতামতের কেউ ধার ধারছিলো না। এখন সে খুব খুশী। সবাই হাড়ি মুখে বের হলেও স্নেহার মুখ ছিলো প্রজ্জ্বোলিত। সবাই বেড়িয়ে গেলে শারমিন বেগম ছুটে যান নবনীতার কাছে। তীব্র ঝাড়ির কন্ঠে বলে,
“তোর কি আক্কেল নেই? এতো ভালো বিয়েটাকে এভাবে কেঁচিয়ে দিলি?”
“মা, আমার মাথা ব্যাথা করছে আমি রুমে যাচ্ছি।“
বলেই নিজের রুমের দিকে হাটা দেয় সে। মেয়ের এমন গা ছাড়াভাব সহ্য হয় না শারমিন বেগমের। তিনি তার চিরচরিত রেডিও শুরু করে দেন।
বাড়িতে ফিরে জুতো খুলেই নিজ রুমের দিকে হাটা দেন হেনা বেগম। সারা রাস্তা কোনো কথা বলেন নি তিনি। শুধু কড়া নজরে সামিয়াকে গিলেছেন। সামিয়া শুধু শুকনো ঢোক গিলেছে। শ্বাশুড়ী মাকে জমের মতো ভয় পায় সে। সেখানে আজ তো তার জন্য চরম অপমানের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো হেনা বেগমকে। শান্ত ও সারা রাস্তা কোনো কথা বলে নি। শুধু বাহিরে নজর দিয়ে বসে ছিলো। হেনা বেগম নিজ রুমে ঢুকতেই যাবেন তখন শান্তকে ডাক দিয়ে বলেন,
“আমার রুমে আসো।“
মায়ের কথামতো শান্ত ও তার পিছু পিছু রুমে যায়। হেনা বেগম হিজার খুলতে খুলতে বলেন,
“আজ এই অপমানের কারণটা তুমি। তোমার জন্য আমি এতো অপমানিত হয়েছি। রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমার ছেলেকে কি না ওই মেয়েটা রিজেক্ট করে, আমার শিক্ষা নিয়ে সে কথা বলে। কতো বড় স্পর্ধা! আমি অবাক হয়েছি।“
“সরি মা, আমি জানতাম না ভাবী এই মেয়েটাকে আমার জন্য বাছবে।“
“আমি কিছু জানি না। আমার বাড়ির বউ আমি এই মেয়েকেই দেখতে চাই শান্ত………………
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে দিবো। কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]
মুশফিকা রহমান মৈথি