সঞ্চারিণী
আফনান লারা
১৪.
রামিসা ভূত দেখেছে মনে হয়।নাকি অন্য কিছু।হয়তবা সে পরীক্ষায় ফেল হবার কথা জেনে গেছে ফলাফল প্রকাশের আগেই।ঠিকসেরকম মুখ করে বসে আছে।শাওন হাত নাড়িয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো পারবে কিনা।রামিসার কপাল এই মুছে তো এই ভিজে যায় ঘামে।হাতের উল্টো পিঠ ও ভেজে গেছে মুছতে মুছতে।শেষে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।আমতা আমতা করে শুধু বললো পারবে।তারপর ছুটে চলে গেলো রুম থেকে।ওর ছুটে যাওয়া দেখে শাওনের বেশ হাসি পেলো।হাসতে হাসতে রশ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,’রেডি হও।তোমাকে খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো আমি’
রশ্নি গম্ভীর গলায় বললো,’তা হয়না’
শাওন পাত্তা দিলো না।রশ্নি মারা যাবার পর থেকে ঠিক যতবার সে বিয়ের কথা বলেছে ততবারই রশ্নি এই একই কথা বলে আসছে।তা হয়না শাওন।তা হয়না।হতে চাইলে সব হয়।
শাওনের বাবা রেগে গেলেন রামিসা যখন ফিসফিস করে তার বাবা মাকে কিসব বললো তা দেখে।উনারা চোখ বড় করে শুধু শুনে গেলেন।কিছু বলছেন না দেখে তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করলেন সমস্যা টা কি।
রামিসার বাবা উত্তরে বললেন,’ও কিছুনা।রামিসার সঙ্গে শাওন মজা করেছে।আমার মেয়ে বড়ই সহজ সরল তো এসব বুঝেনা।ভয় পেয়ে গেছে।তা শাওনকে ডাকুন।বিয়ের কথাও তো পাকা করতে হবে নাকি??’
শাওনের বাবা সোজা গেলেন শাওনকে নিয়ে আসতে।খুশি আর ধরেনা তার।রামিসা যখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলো তিনি তো একেবারে ভয়ে চুপসে গিয়েছিলেন
এখন কোনো ভয় নেই।শাওনের মুখ দিয়ে হ্যাঁ বের করতে হবে তাহলে শান্তি।
শাওন তার ফুলগাছগুলোর মধ্যে যেসব পোকামাকড় যুক্ত পাতা আছে সেগুলোকে কেচি দিয়ে কেটে কেটে নিচে ফেলছে।অবসরে তার এই ছোট্ট বাগান সে নিজেই সামলায়।রেদোয়ানের কেস শেষ হলে তার বাসার বিদেশী ফুল কটা নিয়ে আসা যাবে।তার তো একূল ওকূল দেখার কেউ নেই।শুধু শুধু ফুলগুলো পড়ে থেকে মরবে কেন?তার চেয়ে বরং আমি তাদের যত্ন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবো।ঠিক আমার রশ্নির মত করে।’
-‘শাওন!’
শাওন পেছনে তাকিয়ে বাবাকে দেখে মনে করলো উনারা চলে গেছেন।বাবা বুঝি এখন ঝাড়তে এসেছে।মুখে হাসি ফুটে এগিয়ে গেলো সে।মাথায় ছিল হলুদ রঙের ক্যাপ।সেটাকে বিছানায় ফেলে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাবা ওকে সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন,’আমি অনেক খুশি শাওন।উনারা বিয়েতে রাজি।এবার তুুই হ্যাঁ বলে দে তাহলে সব ওকে’
শাওনের মনে হলো কারেন্টের শক লেগেছে।এত ভালো করে ভয় দেখিয়ে কিনা বিয়েই পাকা হয়ে গেলো।বাবা ছলছল চোখে শাওনের মুখ থেকে হ্যাঁ শোনার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চেয়ে আছেন।শাওন ঢোক গিললো।তার আর বুঝতে বাকি নেই আজ সব কিছুর রফাদফা হয়ে তারপর শেষ হবে।
.
-“বুঝলাম তোর লজ্জা করছে বাবার সামনে বলতে।ঠিক আছে, তোর বোনকে তো বলতে পারবি?এই তৃনা এদিকে আয় তো মা’
-‘বাবা শুনো।আমি এই বিয়ে করতে পারবোনা’
বাবা শাওনের হাত ছেড়ে দিলেন।নিশ্চুপ হয়ে আছেন তিনি।শাওন পাশে তাকিয়ে রশ্নিকে দেখতে পেলো।ওর থেকে চোখ হটিয়ে বাবার হাত সে নিজেই ধরলো এবার।শান্ত গলায় বললো,’আমি রশ্নিকে অনুভব করি বাবা।আমার পক্ষে ওকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না।আর তুমি তো জানোই আমি রশ্নির ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস?’
-‘তোমার এসব ভীমরতি এবার বন্ধ করো।অনেক হয়েছে।ফার্মগেটের কাছে একটা হসপিটালে আমার বন্ধুর ছেলে আছে।ভালো ডাক্তার।হসপিটালটা তুমি চিনো হয়ত।কাল সকালেই তুমি সেখানে যাবে।তোমার মানসিক চিকিৎসা দরকার।মন থেকে তোমার ঐ মেয়েটাকে বের করতে হবে।ডাক্তার দেখিয়ে এসে আমাকে বাবা বলে সম্বোধন করবে।তার আগে আমাকে মুখ দেখাবেনা।যে মেয়ে মারা গেছে তাকে নিয়ে এত কেন??বুঝলাম তাকে তুমি দেখতে পাও কিন্তু তাই বলে সব কিছুতে তাকে টানবে কি জন্যে?তোমাকে বুঝতে হবে তাকে তুমি দেখতে পেলেও তার সাথে বাস্তবের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।আমরা তাকে দেখিনা।একটা সাধারণ মানুষ তাকে দেখেনা।আমি আর কিছু শুনতে চাইনা।যা বললাম তুমি করবে।শুভ রাত্রি ‘
বাবা চলে গেলেন।শাওন পাশে তাকিয়ে রশ্নিকে দেখতে পেলোনা।রাগ করে কই গেছে কে জানে।
-‘তবে বাবার কথায় তার রাগ হবার কথা নয়।তার রাগ হয়েছে আমি বিয়েতে মত দিলাম না সে জন্যে।কারণ সবার মতন সেও চায় আমি যেন এবার বিয়ে করে ফেলি।তা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।’
—–
পরেরদিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে দ্রুত গতিতে পায়ে হেঁটে মেধা হাজির হসপিটালে।হাতের প্লাস্টার চেঞ্জ করবে তাই।ডাক্তার নাফিস তার হাতের প্লাস্টারটা চেঞ্জ করবেন।এটা একজন নার্স ও পারবে।কিন্তু তিনি নিজেই করছেন কারণ তার মেয়ে আর মেধা ক্লাসমেট ছিল।একসাথে অনেক জায়গায় যাওয়া হয়েছে দুই পরিবারের।বাসাও কাছে।
চেনা অনেক দিনের।কাছের মানুষদের নিজের হাতে সেবা করার আনন্দ অন্য দিকে।শাওন ও এসেছিলো একই হসপিটালে।বাবা যে ডাক্তার দেখাতে বলেছে সে আজ সকালেই সুইজারল্যান্ড চলে গেছে।তাই বাবার কথা রাখতে অন্য একটা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো তাকে।এই ডাক্তারের নাম তৌকিরউল্লাহ।তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট(Psychiatrist)
শাওনকে এক দেখাতেই চিনে ফেললেন।কদিন পরেই ওকে টিভিতে দেখা যায় এটাও বললেন।শাওন চুপ করে তার কথা শুনে যাচ্ছে।শাওনকে চেনেন এটার ব্যাখা শেষ করে অবশেষে তিনি বললেন,’তো বলো তোমার কি সমস্যা? সহজ ভাষায় বলবে’
-‘আমার সমস্যা নেই।আমি রশ্নিকে দেখতে পাই এটা বাকিরা সমস্যা মনে করে’
-“ওহ,রশ্নি।সে কে?’
-‘সে আমার গার্লফ্রেন্ড’
-‘ছিল?নাকি এখনও আছে’
-‘মারা গেছে।তবে আমি তাকে দেখতে পাই।এমন কি সে এখন আপনার এই রুমের জানালার ধারের ফুলদানিটা ছুঁয়ে দেখছে’
তৌকিরউল্লাহ নড়েচড়ে বসলেন।তারপর টাই ঠিক করে বললেন,’কবে থেকে তাকে দেখতে পাও?’
-“যেদিন সে মারা গেছে সেই রাতেই ওকে আমি আমার রুমে দেখতে পেয়েছি।তারপর থেকে সবসময় দেখি।’
-‘তুমি ওকে টাচ করতে পারো?’
-“হ্যাঁ’
-“কিরকম টাচ করতে পারো?’
শাওন চোখ তুলে তাকালো তৌকির উল্লাহর দিকে।তৌকির উল্লাহ বললেন,’ঠিক বুঝেছো।আমি ওসব টাচের কথাই জিজ্ঞেস করছি’
শাওন হালকা কেশে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো রশ্নি নেই।লজ্জা পেয়েছে।তৌকির উল্লাহ এখনও তাকিয়ে আছেন দেখে শাওন ঠিক হয়ে বসে বললো,’নাহ আসলে আমি ওকে এখনও সেরকম করে টাচ করিনি’
-“করিনি বলতে করতে চাও নি?’
-‘চেয়েছি।কিন্তু পারিনি।’
-“সে রাজি না?’
-“না আসলে সেটা নয়।আমি ওকে টাচ করতে গেলেই ও চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে যায়।’
-‘তারপর কখন আসে?’
-“যখন আমি ওকে টাচ করার সব ভাবনা মাথা থেকে ছাড়িয়ে ফেলি ঠিক তখনই ওকে পাশে দেখতে পাই’
-‘বুঝলাম।কঠিন প্যাঁচ!আচ্ছা তুমি ছাড়া আর কেউ রশ্নিকে দেখতে পেয়েছে?মানে ধরো ওর ছায়া অথবা ও কিছু ধরলো সেটাকে শূন্যে দেখতে পাওয়া??’
-‘আমি দেখেছি স্যার।আমি আমি!’
শাওন মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেধা দাঁড়িয়ে আছে।শাওনকে এই কেবিনে ঢুকতে দেখে মিনিট দশেক পর কান পেতে ছিল শুনবে বলে।আগের কিছুই শোনেনি শুধু লাস্টের লাইনটা সে শুনতে পেলো।শাওন চোখ বড় করে বললো,’তুমি এখানে কি করো?আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবেনা একদম।’
তৌকিরউল্লাহ মেধাকে বসতে বললেন।মেধাকে কাল টিভিতে দেখেছিলেন সেটাও বললেন তারপর উপহাস করে বললেন,’আজ দেখি সব সেলিব্রেটি আমার দরজায়।আচ্ছা ওসব পরে হবে।তুমি বলো কি দেখেছিলে?’
-‘স্যার ওর কথায় পাত্তা দিবেননা।ও ভুলভাল কথা বলে।ওর কথার কোনো লজিক নাই।’
-‘আমি দেখেছিলাম উনার শার্টের বোতাম আপনা আপনি লেগে যাচ্ছে’
তৌকির উল্লাহ চোখ বড় করে ফেললেন।শাওন নিজেও থেমে গেলো মেধার কথা শুনে।
-‘আসলেই কি তাই?মেধা কি করে রশ্নিকে….’
-‘কি বলছো।আমি তো ভাবলাম শাওনের হয়ত রোগ তাই দেখছে।কিন্তু তুমি কেন দেখলে তা তো বুঝলাম না।তুমি কি কোনোভাবে রশ্নিকে চেনো?’
-‘আমি এই নাম সবার আগে উনার মুখে শুনেছিলাম তাছাড়া আমার জীবনে এই নামের কারোর সাথে পরিচিত হইনি’
-‘বিষয়টা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে আসছে।আমি বুঝছিনা ঠিক কি চিকিৎসা দরকার।যাই হোক শাওন, তুমি রশ্নিকে এখন ডাকতে পারবে?আমি কিছু দেখতে চাই’
শাওন রশ্নিকে ডাকলো।মিনিট দুয়েক পর রশ্নি শাওনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।মেধা রুমের কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’আমাকে কাছে আসতে বলবেন না।উনার সঙ্গে ভূত আছে।আমি দূর থেকেই যা বলার বলবো’
তৌকির উল্লাহ হাত ভাঁজ করে বললেন,’শাওন তুমি রশ্নিকে বলো এই কলমটার মুখ খুলতে’
রশ্নি কলমটা হাতে নিলো তারপর মুখ খুললো।তিনি বললেন,’কি হলো?কিছু দেখলে মেধা?’
-‘মেধা তোতলাতে তোতলাতে বললো,’শ্যাওলা স্যার থুক্কু আই মিন শাওন স্যারের ভূতুড়ে প্রেমিকা কলমের মুখ খুলে আবার লাগিয়ে রেখে দিয়েছে।যা দেখলাম সব শূন্যের উপরে।’
শাওন মাথা তুলে বললো,’সি ইজ রাইট’
তৌকির উল্লাহ গ্লাস থেকে ঢাকনা সরিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিলেন।মেধার ও গলা শুকিয়ে গেছে।তার মনে হচ্ছে সে মরে যাবে আর নয়ত কঠিন রোগ হয়েছে তার। শাওনের মতন।
ভূতটাকে সে দেখতে পায়, শাওন দেখতে পায় আর কেউ দেখেনা তার মানে সেও একদিন পাগল হয়ে যাবে শাওনের মতন।
চলবে♥