সঞ্চারিণী
আফনান লারা
১৭.
-‘আজ যেভাবে লড়েছো আমার বেশ ভালো লেগেছে।গর্ব করে বলতে পারছি এই ক্যান্ডিডেটকে আমি নিজে চয়েস করে এনেছি।তুমি আমার পছন্দের মান রাখলে।সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখলাম, কি করে সব সামলে নিয়েছিলে।আসলেই তুমি এক হাতেই সব পারবে।আমি তোমার ট্রেনিং করা বাস্তবে দেখেই তো তোমাকে নিয়োগদান করেছি।এমনি এমনি গিয়াস কিছু করেনা। শুধু তাই নয়।শাওনকেও আমি নিজে পছন্দ করে নিয়েছিলাম।তুমি তো একা হাতে পাঁচ ছয়জনকে শুট করেছো।শাওন একা বিশজনের বেশিজনকে থামিয়ে দেওয়ার ছেলে।তার ট্রেনিং দেখে নয় বরং অনেকবছর আগে একটা মর্মান্তিক ঘটনায় আমি স্বচক্ষে ওকে লড়তে দেখে আমার অফিসের সিনিয়র অফিসার বানিয়ে নিয়েছিলাম।আর আজ এতগুলো বছর ধরে ও আমার নাম ধরে রেখেছে।আশা করি তুমিও আমায় নিরাশ করবেনা।বিশ্বাস আছে’
মেধা মুচকি হেসে বললো,’থ্যাংক ইউ স্যার।আজ আমি আসি তাহলে?’
-“ঠিক আছে যাও’
—-
মেধা চলে গেলো।শাওন বাসায় ফিরলো নয়টার দিকে।দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই বাবাকে দেখলো সোফায় বসে আছেন।মনে হচ্ছে ওর অপেক্ষায় ছিলেন এতক্ষণ।শাওন বাবার সামনে বসলো চুপচাপ।বাবা জিজ্ঞেস করলেন সে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল কিনা।এটা শুনে পকেট থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাবার হাতে ধরিয়ে দিলো সে।বাবা ঔষুধগুলোর নাম ভালো কররে পড়ে বললেন,’কিনে আনছো নাকি আবার এক মাস পর গিয়ে কিনবে?’
-“কিনছি।এই যে প্যাকেট’
-‘তৃনার আম্মু শাওনকে খাবার দাও।জলদি ডিনার করে ঔষুধ খাবে সে’
শাওন উঠে চলে আসলো তার রুমে। আগে ফ্রেশ হবে তারপর যা হবার হবে।
রশ্নি ঔষুধ গুলো এক এক করে দেখছে।শাওন শাওয়ার অন করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আয়নাতে চোখ রাখতেই মেধার কথা মাথায় আসলো।
-‘দুটো দিক মানতে পারছিনা।মেধাকে রহস্যময়ী মনে হয় আবার একেবারে সাধা সিধেও মনে হয়
কোনটা সঠিক?ওর অধ্যায়ের রহস্য খুঁজে আনতে হবে তা নাহলে অন্য কেসে মন বসাতে পারবোনা।’
——-
-‘শুনলাম তুমি নাকি আজকে একা হাতে কয়েকজনকে শুট করেছিলে?’
ভাতগুলোকে নাড়াতে নাড়াতে মেধা মাথা নাড়ালো বাবার প্রশ্নে।বাবা নড়েচড়ে বসলেন।সবাই এবার চুপ।তিনি আবার বললেন,’চাকরি কেমন লাগছে তোমার?’
-‘ভালো’
-‘আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে শুনেছো?’
মেধা চোখ তুলে চমকে বললো,’নাহ শুনিনি।কখন হলে?আর কোথায়?’
-‘পটুয়াখালীতে।’
-‘বাবা আমার পক্ষে তো যাওয়া সম্ভব হবেনা’
-‘সেটা জানি।তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবেনা।আমরা পটুয়াখালী চলে যাবো।মৌমিতার স্কুলেও টিসি করিয়ে নেবো।তোমায় একা থাকতে হবেনা।তোমার ফুফাতো বোন সাবরিন এসে থাকবে।আপার সাথে কথা হয়েছে।তাদের বাসায় এত মানুষের মাঝে তোমার থাকা ডিফিকাল্ট হবে বলে আমি এই সিদ্ধান্ত নিলাম,তাছাড়া সাবরিনের ভার্সিটি এখান থেকে কাছে বলে আপা সহজেই রাজি হয়েছেন।খাওয়া দাওয়া তো সব বুয়া সামলাবে।বুঝলে?ছুটি পেলে পটুয়াখালি চলে আসবে’
-‘হুম।’
মেধা উঠে রুমে চলে আসলো।বাবা মাকে ছেড়ে একা থাকাটা এটাই নতুন তা কিন্তু না।একবার তার ট্রেনিংয়ের জন্য অনেকদূরে গিয়ে দু তিন মাস থাকতে হয়েছে তাদের ছেড়ে।সুতরাং অভ্যাস আছে।মা ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত। মৌমিতা মেধাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজুড়ে দিয়েছে।তার কান্না থামার শেষ নেই কোনো।মেধা ল্যাপটপে টিপাটিপি করতে করতে মৌমিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কাল বাদে পরশু চলে যাবে সবাই।তার একটা বিষয় ভেবেই বিরক্তি পাচ্ছে।কারণটা হলো ফুফাতো বোন সাবরিন যে কি জিনিস।ঘুমায় সেখান থেকে উঠে পড়তে বসে।বই হাতে রেখে আবার ঘুমায়।ওর পড়া দেখলে নিজেরই পড়তে বসতে ইচ্ছে করবে।কিন্তু ঐ যে আমার তো পড়াশুনা শেষ আর কি পড়বো?তবে ওকে দেখলো হুদাইও কোনো বই কিনে এনে পড়তে ইচ্ছে করবে।পাঁচদিনের জন্য একবার সে বেড়াতে এসেছিল।আমার এক লাইব্রেরী বই কেনা শেষ।
এমন ও হতে পারে খেতে বসে ওকে সহ খাইয়ে দিতে হবে।পড়ুয়া মেয়ে কিনা।তার আবার খেতে বসার সময় আছে?আমি না খাওয়ালে দেখা গেলো সে খাবেই না।মরে পড়ে থাকবে।
আচ্ছা আমি একা থাকলে কি এমন হবে?আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সাহস আছে কারোর?’আজকে রাতের ঘুম নষ্ট হবে ঐ সাবরিনের কথা ভাবতে ভাবতে’
——
পরেরদিন সকাল দশটা বাজে অফিসের সবাই এসে হাজির হয়েছে,এমনকি মেধাও।
আজ সঠিক সময়ে কিনা মেধাও এসে পড়েছে অথচ শাওন ফেরেনি।সমস্যা সেটা ছিলনা।সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো গিয়াস স্যারের আদেশ।তিনি মেধাকে একটা ক্যাব ধরিয়ে দিয়ে বললেন সোজা শাওন স্যারের বাসায় যেতে।তারপর তার সঙ্গে তারই গাড়ীতে করে রেদোয়ানের বাসায় পৌঁছাতে।
-‘আমার আর শাওন স্যারের বোঝাপড়া তিনি আরও মজবুত করতে চান।হঠাৎ এই মূহুর্তে সামিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম মনে হলো আমার কাছে।আমি না গিয়ে সামিয়া গেলে ভালো হতোনা?বললাম স্যারকে।কিন্তু স্যার বললেন সামিয়ার সঙ্গে শাওন স্যারের রেষারেষি নেই কিন্তু আমার আছে ষোলআনা।তাই বাধ্য হয়ে শাওন স্যারের বাসায় যাচ্ছি এই প্রথমবার।’
আজিমপুর এসে সবাইকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে শাওনের বাসার ঠিকানা পেলো সে।কলিংবেলে চাপ দিয়ে এদিক ওদিক তাকানোর আগেই দরজা খুলে গেলো।একটা বাচ্চা এসে দরজা খুলেছে।মেধার গায়ের পোশাক দেখে সে চেঁচিয়ে মাকে ডাক দিলো
কারণ শাওন অফিসে যাওয়ার সময় যে পোশাক পরে মেধা ঠিক একই পোশাক পরে আছে।তৃনা ছুটে এসে বললো,’কি হয়েছে আরিফা?’
দরজার ওপারে মেধাকে দেখে চুল ঠিক করে হালকা হেসে আবার বললো,’আপনি শাওনের অফিসের লোক?’
-“হ্যাঁ।আসলে স্যার আজকে দেরি করছেন তো।তাই গিয়াস স্যার আমাকে বললেন উনাকে সাথে নিয়ে আসতে’
-‘আসুন না ভেতরে আসুন।বসুন।আমি শাওনকে ডেকে দিচ্ছি।আসলে কাল রাতে কড়া ডোজের ঔষুধ খেয়েছো তো তাই এখনও ঘুমাচ্ছে’
মেধা সোফায় বসলো।আরিফা মেধার পাশে বসে বললো,’তুমি ভাইয়ার মতন গুল্লি করো সবাইকে?’
-“হ্যাঁ।’
-‘কোথায় করো গুল্লি?একেবারে মাথায়?’
-‘নাহ।হাতে -পায়ে।যেন সে মারা না যায় সে বুঝে শুট করতে হয়’
-‘ওহ।তুমি গুল্লি খেয়েছো কখনও?’
-“না’
-“খাবেনা?’
মেধা মুখটা ঘুরিয়ে বসলো।
-‘কি জ্বালাতন।এরকম বকবক করা মেয়ের পাল্লায় পড়তে হলো শেষে।এত প্রশ্ন করে কেন?তার ভাইয়ারে করতে পারেনা?শ্যাওলা স্যার কখন আসবে?আর দু মিনিট বসলে এই মেয়ে আমাকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালের রেগুলার রুগী বানিয়ে দেবে।’
-‘কি হলো বলো।তুমি গুল্লি খাবেনা?’
-“আমি খাবো কেন?আমি বরং গুল্লি করবো’
-“কেন সবসময় তুমি দিবা?তোমাকেও গুল্লি খেতে হবে।হবেই হবে।ভাইয়াকে বললো তোমায় গুল্লি করতে’
মেধা মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো।তৃনা শাওনের রুমের পর্দা সরিয়ে ওকে কয়েকবার ডেকে ছুটে গেলো রান্নাঘরে।
-‘শাওনের অফিসের লোক মেয়েটা।ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতে হবে।কাল রামিমেরা অনেক মিষ্টি এনেছিলো।ওগুলো দেওয়া যাবে আর নুডুুলস রাঁধবো?চা তো আছেই’
তৃনাকে ব্যস্ত হতে দেখে মেধা উঠে ছুটে গেলো বলার জন্য যে সে নাস্তা করেই এসেছে।কিছু খাবেনা।শাওনের রুম সামনে পড়ে।ঠিক সেসময়ে শাওন বের হচ্ছিলো।আচমকা মেধার সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুজনে দুদিকে ছিঁটকে পড়লো।
আরিফা হাতে তালি দিয়ে লাফাতে লাফাতে বললো,’ইয়ে!!ক্রাইম ব্রাঞ্চের দুটো অফিসার পড়ে গেছে।ইয়ে!!”
মেধা ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো লজ্জা পেয়ে।শাওন ও উঠে গিয়ে বললো,’দেখে হাঁটতে পারোনা?তোমাকে দিয়ে কোনো কাজ ঠিকভাবে রীতি মত হয়না।আমায় বাসায় কেন আসলে? ঝাড়ি খেতে তোমার ভালো লাগে?’
-“মোটেও না।গিয়াস স্যার আদেশ করলেন।তা নাহলে আমি আসতাম না এদিকে।আপনার যদি বিশ্বাস না হয় স্যারকে প্রশ্ন করতে পারেন কল করে’
-“থাক থাক।ওসবের দরকার নেই।তৃনা আপু জলদি নাস্তা দাও আমায়’
শাওন গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।তৃনা নুডুলস বানাতে বানাতে বললো,’টেবিলে আছে।নিজে নিয়ে খা।আমি তোর কলিগের জন্য একটু হালকা পাতলা নাস্তা বানাই’
-‘আরে আপু ওসব করিওনা।আমি খেয়ে এসেছি’
-‘খেয়ে এসেছো তো কি হলো?আমি নুডুলসে্ ডিম দিয়ে ফেলেছি।আর নামানো যাবেনা।’
শাওনের মা ভেতরের রুম থেকে দেখতে আসলেন কে এসেছে।মেধাকে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে ঠিক করে বললেন,’ওহহহ তুমি বুঝি শাওনের অফিসের? ‘
মেধা সালাম দিয়ে মাথা নাড়ালো।উনি মেধাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন পাশে
চলবে♥