#সন্ধ্যামালতী (২১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
সানজিদার কথায় চরম রকমের শকড আয়াশ। অবাকের চরম পর্যায়ে। সে নিজেই চেয়েছিলো সানজিদার সাথে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে। একজনকে মনে রেখে তো অন্যজনের সাথে সংসার, প্রণয় কিছুই হয় না। কিন্তু সানজিদা নিজেই যে তাকে বিয়ে করতে চাইবে না সে ভাবতেও পারেনি। খুশিতে, উত্তেজনায় সে বলে,
‘কি বললে?’
সানজিদা খানিকটা অবাক চোখে তাকায়। আয়াশের পুরো মুখে খুশির ফোয়ারা বইছে। সানজিদা ফের বলে, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।’
আয়াশ খুঁজে পায় না কি বলবে! এতো সহজে সে সন্ধ্যাকে পেয়ে যাবে? সত্যি নাকি স্বপ্ন! উত্তেজনায় আয়াশ গড়গড় করে বলে, ‘এটা আগে বলো নাই কেন? আগে বললে তো আরো আগেই সব ঠিক হয়ে যেতো।’
সানজিদা মাথা নিচু করে বলে, ‘দেখো আমি জানি তোমার বিয়ে, ভালোবাসা এগুলোতে ইন্টারেস্ট নাই তবুও আম্মুর জন্য আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে। আমি ভয়ে তোমাকে কিছু বলতে পারিনি। অনেক ন্যাকামো করতাম, গায়ের সাথে ঘেষে থাকতাম যাতে তুমি আমাকে খারাপ ভেবে বিয়েটা ভেঙে দাও কিন্তু ওগুলো তোমার ওপর কোনো ইফেক্টই করতো না। হতাশ হতাম। কিন্তু সন্ধ্যা মেয়েটা আসার পর থেকে তোমার মধ্যে পরিবর্তন পেয়েছি। মামির সাথে কথা বলে সিউর হলাম তুমি আসলেই সন্ধ্যাকে ভালোবাসো৷ তাই আজ সাহস করে বলতে এসেছি।’
আয়াশ সানজিদার কথায় চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। খুশিতে তার হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। আর কোনো বাঁধা নেই তার আর সন্ধ্যার এক হওয়ায়।
সন্ধ্যা আফরার রুমে এসে চুপ করে বসে আছে। আফরা এটা ওটা বললেও তার উত্তর খুব কম দিচ্ছে। আফরা সন্ধ্যার চুপ থাকাটা পর্যবেক্ষণ করে। বলে, ‘তুই এতো চুপ কেন সন্ধ্যা? কিছু হয়ছে?’
‘কই! না তো। কিছুই হয়নি। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আন্টি?’
‘হ্যাঁ কর।’
সন্ধ্যা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে আমতা আমতা করে বলে, ‘ছাঁদে যেতে দেখলাম একটা মেয়েকে। কে উনি?’
আফরা হেঁসে বলে, ‘ওটা আমার ননদের মেয়ে সানজিদা।’
সানজিদা নামটা শুনতেই সামান্য কেঁপে ওঠে সন্ধ্যা। লিজা আর জেরিনের কাছে সে শুনেছিলো আয়াশের ফিয়ন্সের নাম সানজিদা। আফরা হয়তো খেয়াল করলো সন্ধ্যার অস্থিরতা। সে মৃদু হেঁসে সন্ধ্যার গালে হাত রেখে বলে,
‘জানিস সন্ধ্যা আমার ননদ সাথী ছিলো একটা চরম রকমের ভালো মেয়ে। এতো মায়া ছিলো মুখটাই যে ওর মুখের দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যেতো। আয়াশের প্রিয় ছিলো সাথী। আমার ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই ভীষণ চাপা স্বভাবের। তবে সে সাথীর সাথে ছিলো খোলা বইয়ের মতো। সাথী অন্ত প্রাণ আয়াশ। সাথীর তখন বয়স কত হবে! এই ধর ২৩ কি ২৪। সানজিদার বাবার সাথে তখন তার প্রণয় হয়। দু পরিবার থেকেই বিয়ের আয়োজন করা হয়৷ বিয়ে হয়। সানজিদা হয় কিন্তু পাল্টে যায় সানজিদার বাবা। পরনারীতে আসক্ত হয়ে সাথীকে মে’রে ফ্যানের সাথে ঝু’লিয়ে দেয়।’
শেষের লাইন বলতে গিয়ে কথা আটকে যায় আফরার গলায়৷ চোখ বেয়ে ঝড়ে অজস্র অশ্রু। সন্ধ্যার চোখও ছলছল করে ওঠে। আফরা কয়েক সেকেন্ড থেমে বলে, ‘সাথীর মৃত্যুর পর আমার ছেলেটা এলোমেলো হয়ে গেলো। প্রাণ প্রিয় ফুফুর এমন ঝুলন্ত লা’শ দেখার পর থেকে একদম চুপ হয়ে যায়। সেদিন থেকে আয়াশের এই ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস ঠুনকো হয়ে গেছিলো। সানজিদা আমার কাছেই বড় হয়ছে ২ বছর হলো ‘ও’ হোস্টেলে থাকতেছে। আয়াশ সানজিদাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো এই কারণে যাতে সাথীর মতো সানজিদার অবস্থা করুণ না হয়।’
সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ফুফুর স্বামীর শাস্তি হয় নি?’
আফরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘টাকার জোড়ে আইনের বিচার থেকে বেঁচে গেলেও আল্লাহর বিচার থেকে বাচতে পারেনি। বছর খানেক পরই এক্সিডেন্টে প’ঙ্গু হয়ে গেছে। কেউ দেখতেও যায় না। সানজিদা নিজেও কখনো যায়নি।’
সন্ধ্যার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। মানুষ গুলো এমন বদলে যায় কেনো? প্রণয়ের বিয়েতেও কেন পর’কিয়ায় লিপ্ত হয়? এ সমাজ এতো নিচে কেন নেমে যায়? কেন মেয়েরা ভালোবেসে বিয়েতেও এতো কষ্টের সম্মুখীন হয়? কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। অথচ প্রশ্নগুলো এ সমাজে ভীষণ রকম সত্যি। ভালোবাসতেও এখন অনেকে ভয় পায়! স্বাভাবিক নয় কি?
সন্ধ্যা আফরার কাছে থেকে উঠে নিজের রুমে যায়। দেয়ালে টাঙানো সাথী আর আয়াশের হাসি মুখের ছবি দেখে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। সত্যিই মানুষটার মুখে কি নিদারুণ মায়া অথচ উনার পরিণতি কতটা ভয়ংকর! ঠিক কতটা সময় সন্ধ্যা সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিলো তার জানা নেই। হঠাৎ করেই মাথায় উদয় হয়, ‘তার পরিণতি কি হবে? সেও কি এই সাথীর মতো কোনো ফ্যানের সাথে ঝু’লে যাবে কখনো?’ পরক্ষণেই নিজেকে শাষায়। আয়াশ তাার সাথে কখনোই এমন করবে না, কিন্তু..তবুও একটা প্রশ্ন রয়ে যায়। আয়াশ কি আদৌও তাকে বিয়ে করবে?
___________
সন্ধ্যার পর আয়াশের দেওয়া শাড়ি পড়ে বসে আছে সন্ধ্যা। সাথে ম্যাচিং গহনা, কানের দুল, চুড়ি, পায়েল সব পড়েছে। আয়াশের কথা অনুযায়ী সে চুল গুলো খোলায় রেখেছে। যদিও গরম তবুও কিছু করার নেই। সকালে সন্ধ্যা সোফায় বসে টিভি দেখছিলো সে সময় আয়াশ একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে তার কাছে আসে। বলে, ‘এগুলো পড়ে রেডি হয়ে থাকবা সন্ধ্যার পর। আমি এসে নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ চুল গুলো খোলা রাখবে।’ ব্যাস শেষ! সন্ধ্যাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে চলে যায়। সন্ধ্যা গাল ফুলায়। একবার ভাবে এসব কিছুই সে পড়বে না আবার ভাবে আয়াশ যদি রেগে যায়! দোমনা করতে করতে শেষমেশ তৈরী হয়ে বসে থাকে। সন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই আফরা এসে দরজায় নক করে। সন্ধ্যা দরজা খুলে দিতেই আফরা হা করে তাকায়। অবাক চোখে বলে,
‘মাশাল্লাহ। কি সুন্দর লাগছে রে তোকে! কারো নজর না লাগে।’
সন্ধ্যা লাজুক হাসে। আফরা হেঁসে বলে, ‘জলদি নিচে যা। আয়াশ দাঁড়িয়ে আছে।’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। লজ্জায় মিইয়ে যায়। মাথা নিচু করেই একপ্রকার ছুটে রুম থেকে বের হয়। পেছন থেকে আফরা জোড়ে বলে, ‘আস্তে যা পড়ে যাবি তো! আর সাবধানে যাবি সাবধানে ফিরবি।’
সন্ধ্যা হেঁসে পেছনে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামে। আয়াশ তখন গাড়িতে হেলান দিয়ে ফোন টিপছে। সন্ধ্যা দুর থেকে একবার আয়াশের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের দিকে তাকায়। দুজনেরই ডার্ক ব্লু কালার শাড়ি আর পাঞ্জাবি। সন্ধ্যার শাড়িতে একদম হালকা কাজ ঠিক তেমনই আয়াশের পাঞ্জাবি তেও হালকা কাজ করা। সন্ধ্যা চাপা হাসে। এগিয়ে যায় আয়াশের কাছে। আয়াশ সন্ধ্যার উপস্থিতি টের পেতেই দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে তাকায় না। সন্ধ্যা খানিকটা ভ্রু কুঁচকায়। তারপর নিজেকে সামলে বসে পড়ে৷ আয়াশও ঘুরে এসে বসে। কোনোমতেই সে সন্ধ্যামালতীর দিকে তাকাবে না। এ মেয়ে ভ’য়ংকর! আয়াশ বেচারা না তাকিয়েও থাকতে পারছে না আবার তাকাতেও পারছে না। নিজেকে সামলে কোনো মতে গাড়ি স্টার্ট দেয়। সন্ধ্যা মৃদু কন্ঠে বলে,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি!’
আয়াশ উত্তর দেয় না। সন্ধ্যার রাগ হয়। রাগে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসে থাকে। আয়াশ একবার আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবার গাড়ি ড্রাইভে মন দেয়। গাড়ি এসে থামে একটা শুনশান রাস্তায়। আশে পাশে কোনো জনমানবের ছায়াও নেই। সন্ধ্যা এমন অন্ধকার, শুনশান জায়গা দেখে ভয় পায়। ঢোক গিলে বলে,
‘এটা কোন জায়গা শহুরে ডাক্তার?’
আয়াশ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘নামো। নামলেই বুঝবা এটা কোন জায়গা!’
‘আপনি এমন ফাঁকা জায়গায় আনছেন কেন আমারে? মে’রে টেরে ফেলবেন নাকি?’
আয়াশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সাথে সাথেই তার হার্টবিট বেড়ে যায়। কপালের ভাজের জায়গায় পুরো মুখে ফুটে উঠে মুগ্ধতা। সন্ধ্যার ভীতু চাহনীতে আরো বেশি হৃদয় কাঁপানো সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। চোখে মুখে এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা। আয়াশ বিড়বিড় করে বলে,
‘আসলেই তুমি এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যাবেলার সন্ধ্যামালতী। তাকে যে রুপেই দেখি সে রুপেই স্নিগ্ধতায় ঘেরা থাকে মুখ।’
সন্ধ্যার ডাকে হুশ ফিরে আয়াশের। নিজেকে স্বাভাবিক করে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায়। সন্ধ্যাও সাহস করে নেমে যায়। আয়াশ সন্ধ্যার কাছে এসে বলে, ‘চলো!’
সন্ধ্যা কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না। জায়গাটা তার ভীষণ ভালো লাগে। চারদিকে নিরবতায় কেমন গায়ে কাটা দেওয়ার মতো অনুভূতি আর পাশে যদি থাকে প্রিয় মানুষ তাহলে তো কোনো কথায় নাই। দুজনেই নিশ্চুপ ভাবে হাঁটতে থাকে। এই নিরবতায় ছেদ পড়ে আয়াশের কথায়।
‘আচ্ছা সন্ধ্যা সৌন্দর্যের সঙ্গা কি তোমার কাছে?’
সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। অন্ধকারে মুখ দেখতে পায় না। অবয়বটাই ভেসে ওঠে শুধু। এটা কেমন প্রশ্ন তা সন্ধ্যার বুঝে আসে না। এই সময় এটা কোনো প্রশ্ন হলো! সন্ধ্যা তবুও নিজেকে সামলে বলে, ‘যার মন সুন্দর সেই প্রকৃত সৌন্দর্যের মালিক।’
আয়াশ নিঃশব্দে হাসে। আলতো হাতে সন্ধ্যার হাত আগলে নেয়। কেঁপে ওঠে সন্ধ্যা। আয়াশ ঠোঁট কামড়ে হাসে। সে হাসি দেখতে পায় না সন্ধ্যা। অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। আয়াশ ফের বলে,
‘যাকে ভালোবাসো তার কোন সৌন্দর্য দেখো?’
চমকে ওঠে সন্ধ্যা। এমন প্রশ্নের জন্য যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না তার কাপুনিতেই টের পায় আয়াশ। সন্ধ্যা বলে, ‘এসব কি প্রশ্ন করতেছেন শহুরে ডাক্তার!’
‘কেন? তোমার অসুবিধা হচ্ছে?’
সন্ধ্যা চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটার পর সন্ধ্যা নিজেই বলে, ‘যাকে ভালোবাসি তাকে ঠিক কি কারণে ভালোবাসি জানি না। তবে নারীদের প্রতি তার সম্মান, তার ব্যাক্তিত্ব হয়তো এসব দেখেই তার প্রতি অনুভূতির সৃষ্টি। আর ভালোবাসার মানুষকে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। হোক সে সুন্দর বা অসুন্দর। তার বাহ্যিক সৌন্দর্যও তখন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আর মন সুন্দর হলে তো পুরো পৃথিবীটাই হাতের মুঠোয় মনে হয়।’
আয়াশ মুগ্ধ হয়ে শোনে। বলে, ‘যদি কখনো তার সৌন্দর্য, ব্যাক্তিত্ব হারিয়ে যায় তবুও কি তোমার ভালোবাসা অটুট থাকবে! নাকি ফিকে পড়ে যাবে?’
সন্ধ্যা মৃদু হাসে, ‘ভালোবাসা কি কমার বস্তু নাকি? যদি আবেগ হয়ে তাহলে কমে যাবে কিন্তু যদি ভালোবাসা হয় তবে তা সময়ের ব্যবধানে বাড়বে বয় কমবে না। তাছাড়া মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য, ব্যাক্তিত্ব আজীবন থাকে না। একসময় ঠিকই তা হারিয়ে যায়।’
সন্ধ্যা কথা শেষ করার সাথে সাথেই আয়াশ সন্ধ্যার হাত ছেড়ে দেয়। আয়াশের কোনো সাড়াশব্দও কানে আসে না সন্ধ্যার। ভীত গলায় ডাকতে থাকে , ‘শহুরে ডাক্তার! কোথায় আপনি? আছেন তো আপনি!’
উত্তর আসে না আয়াশের। সন্ধ্যা আয়াশের অবয়বও টের পায় না। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে৷ দুপা এগোয় আর আয়াশকে ডাকতে থাকে। একসময় হুট করেই কেঁদে ওঠে সন্ধ্যা। সাথে সাথেই পুরো জায়গাটা আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সন্ধ্যা চমকে তাকায়। ফ্যালফ্যাল করে পুরো ডেকোরেট দেখতে থাকে। সরু রাস্তার দুপাশে সুন্দর করে গেইট সাজানো। পুরোটা লাইটিং করা। দারুণ লাগছে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও আয়াশের খোঁজ পায় না। আবারও ডাকতে ডাকতে দুপা দুপা করে এগোয়। একটা জায়গায় গিয়ে দেখে সেখানে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ সাজানো। তার ওপর একটা চিরকুট। সন্ধ্যা নিচু হয়ে চিরকুট তোলে। সেখানে লিখা, ‘ ভালোবাসার এক বিশাল রাজ্যে স্বাগতম সন্ধ্যামালতী।’ সন্ধ্যা গোলাপের পাপড়ি ছুয়ে দেয়। তারপর উঠে আবারও এগোয়। একটু দুরে দেখতে পায় অনেকগুলো সন্ধ্যামালতী একসাথে রাখা। সন্ধ্যা সেখানে ছুটে যায়। সন্ধ্যামালতী ছুঁয়ে দেখে। একগাল হেঁসে আরো একটু এগোয়। রাস্তা শেষ করে একটা বিশাল মাঠে পা রাখে সন্ধ্যা। পুরো মাঠটা অন্ধকারে মোড়ানো। সন্ধ্যা কয়েকবার ডাকে আয়াশকে। ডাকতে ডাকতেই এসে পড়ে মাঠের মাঝখানে। পায়ের সাথে কিছু বেঁধে গেলে নিচের দিকে তাকাতেই লাইট অন হয়ে যায়।গোলাপের অনেক গুলো পাপড়ি ওপর থেকে পড়ছে৷ সামনে তাকাতেই আরো একবার হতভম্ব হয় সন্ধ্যা। আয়াশ হাটু মুড়ে বসে সন্ধ্যামালতী ফুল হাতে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আয়াশ গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘এই যে মিস সন্ধ্যাবেলার সন্ধ্যামালতী আপনি কি আমার মিসেস হবেন? আমার এসব ভালোবাসা, বিয়ে এগুলোতে ছিলো ভীষণ রকম তিক্ত অনুভূতি কিন্তু আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে এই তিক্ত অনুভূতি একটা মিষ্টি অনুভূতিতে বদলে গেছে। আপনাকে ছাড়া আমি নিজের অস্তিত্ব টের পায় না৷ কবে এতো মিশে গেলেন আমাতে? আপনার ‘শহুরে ডাক্তার’ ডাকটা আমার হৃদয় কাঁপিয়ে তোলে। আপনি কি কান পেতে শুনবেন সেই কাঁপা কাঁপা শব্দগুলো? আপনি কি আমার হৃদয় দোলানো অনুভূতি প্রখর হওয়ার কারণ হবেন? আমার ভালোবাসায় নিজেকে রাঙাবেন? ভালোবাসবেন আমাকে? বিয়ে করবেন আমাকে?’
সন্ধ্যা উত্তেজনায়, আনন্দে কেঁদে ফেলে। দু হাতে মুখ চেপে শব্দ করে কেঁদে মাথা নাড়ায়। আয়াশ চোখ দিয়ে ইশারা করে ফুল গুলো নিতে। সন্ধ্যা ফুল গুলো নিতেই হাত টেনে ধরে আয়াশ। পকেট থেকে একটা রিং বের করে বলে, ‘উইল ইউ ম্যারি মি সন্ধ্যামালতী?’
সন্ধ্যা হুট করেই হাটু মুড়িয়ে বসে আয়াশকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে থাকে হিচকি তুলে। আয়াশ বোঝে এ অশ্রুর কারণ তাই তো বাঁধা দেয় না। প্রশান্তি নিয়ে হেঁসে আঁকড়ে ধরে তার সন্ধ্যামালতীকে৷ অনেকটা সময় কাটে এভাবেই।
‘আর কতক্ষণ তোরা জড়ায় ধরে থাকবি? এবার তো ছাড়। আর সন্ধ্যারে রিং পড়া।’
কথাগুলো কানে আসতেই ঝটকা মেরে সরে যায় আয়াশ সন্ধ্যা। আয়াশ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায় তার বন্ধুমহলের দিকে। আয়াশকে তাকাতে দেখে রানা, আকাশ, তমাল, লিজা, জেরিন, সাফি সবাই দাঁত কেলিয়ে হাসে। ওদিকে সন্ধ্যার তো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। গাল দুটো রক্তিম আভা ধারণ করেছে। আয়াশ অবাক কন্ঠে বলে,
‘তোরা! এখানে!’
রানা দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘আয়াশ সন্ধ্যা যেখানে রানাবাহিনীরাও সেখানে।’
সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। আয়াশ কান চেপে ধরে বলে, ‘থাম সবগুলা। তোরা আমারে শান্তি দিবি না তাই না! কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার জন্য সব জায়গায় চইলা আসবি?’
লিজা ভেংচি কেটে বলে, ‘বন্ধুরা থাকেই শান্তি কেড়ে নিয়ে অশান্তির মুখ দেখানোর জন্য। বাই দ্যা ওয়ে কাবাবে হাড্ডি না থাকলে কি জমে বল!’
‘জ্বি জমে। কারণ মানুষ হাড্ডি ফেলেই দেয়।’
সবাই হতাশ দৃষ্টিতে তাকায়। আকাশ বলে, ‘তুই তো আর আমাদের ফেলতে পারবি না। এবার কথা কম কইয়া সন্ধ্যারে রিং পড়া।’
সবাই গোল হয়ে দাঁড়ায়। লিজা সন্ধ্যাকে আয়াশের সামনাসামনি করে দাঁড় করায়। সন্ধ্যা তখনো লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। জেরিন হাসতে হাসতে বলে, ‘দোস্ত এ তো লজ্জাবতী লাজুকলতা। সন্ধ্যা তোমার নাম সন্ধ্যামালতী না হয়ে লাজুকলতা হলে ভালো হতো।’
সবাই হেঁসে ওঠে। আয়াশ সন্ধ্যাকে রিং পড়ায়। রানা বায়না ধরে বলে, ‘এখন আমাগো ট্রিট দে।’
আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোদের কেন ট্রিট দিবো?’
‘ওমা! তোদের দুইটারে মিলানোর পরিকল্পনা তো প্রথমে আমরাই করছি নাকি! আমাদের বুদ্ধির জন্যই তো আজ এতো কিছু।’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আয়াশ। বাকি সবাই দাঁত কেলায়। আকাশ বলে, ‘দোস্ত বিয়ে করবি কবে?’
‘এই মাসেই।’
তমাল গালে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার মতো চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ওহ রে বাবা এতো তাড়াতাড়ি!’
আয়াশ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ এতো তাড়াতাড়িই করবো। সন্ধ্যাকে দিয়ে বিশ্বাস নাই দেখা গেলো কোথা থেকে কে এসে ওকে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে তখন আমার দেবদাস হতে হবে। সো নো রিস্ক!’
সবাই মুখ টিপে হাসে। জেরিন আর লিজা পাশ থেকে সন্ধ্যাকে পচাচ্ছে। আয়াশ সন্ধ্যার হাত টেনে নিজের কাছে এনে বলে, ‘তোরা এবার যা।’
আকাশ ভেংচি কেটে বলে, ‘ছেলের তর সয় না!’
‘হ্যাঁ জানোসই তো। এবার ভাগ হা’রা’মিরা।’
লিজা আর জেরিন দুইপাশ থেকে সন্ধ্যাকে টেনে নিজদের কাছে এনে বলে, ‘এখন কোনো টাইম স্পেন্ড হচ্ছে না। যা হওয়ার তা বিয়ের পর হবে।’
আয়াশ হতাশ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর সন্ধ্যাকে বলে, ‘কাল আমরা গ্রামে যাবো।’
সন্ধ্যা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কেনো?’
আয়াশ বাঁকা হেঁসে বলে, ‘তোমার কাগজপত্র আনবো আর গ্রামের রহস্য সমাধান করে আসবো!’
#সন্ধ্যামালতী (২২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________
সন্ধ্যা আর আয়াশ আজ গ্রামে এসেছে। এতগুলো দিন পর নিজের গ্রামকে দেখে আবেগী হয়ে পড়ে সন্ধ্যা। সাথে ভেসে ওঠে অনেক তিক্ত স্মৃতি। মা আর দাদার নিথর দেহ গুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। চোখ দুটো মুহুর্তেই ছলছল করে। আয়াশ হয়তো সন্ধ্যার অনুভূতি গুলো বোঝে তাই তো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সন্ধ্যার হাত। সন্ধ্যা নিজেকে সামলে নেয়। আয়াশ আর সন্ধ্যা প্রথমে সন্ধ্যার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। গ্রামের কম বেশি মানুষ আয়াশ সন্ধ্যাকে একসাথে দেখে খানিকটা অবাকই হয়। অনেকে কানাকানি করে আবার অনেকে এসে কুশল বিনিময় করে। সন্ধ্যাদের বাড়িতে এসে সন্ধ্যা ঘরের তালা দেখে খানিকটা মাথা চুলকায়। আয়াশ বলে,
‘তোমার কাছে তো মনে হয় চাবি নাই!’
সন্ধ্যা দুদিকে মাথা নাড়ায়। সে সময় দৌড়ে আসে বকুল আর বাদল। বকুল এসেই কাঁদতে কাঁদতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে। বাদল অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। সন্ধ্যা কি বলবে বুঝতে পারে না। এক হাত দিয়ে বকুলকে আঁকড়ে ধরে। বকুল কাদতে কাঁদতে বলে, ‘তুই কোথায় চলে গেছিলি সন্ধ্যা? তোকে আমরা কত খুঁজেছি কোথাও পাইনি। মা তো কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গেছিলো।’
সন্ধ্যা কিছু বলতে গিয়েও বলে না। বকুল সন্ধ্যাকে ছেড়ে দেয়। বাদল আর বকুল তখনো আয়াশকে খেয়াল করেনি৷ তারা আছে সন্ধ্যাকে নিয়ে। বাদল বলে, ‘কোথায় চলে গেছিলি? আর আমাদের একবার জানাসনি কেন?’
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। পেছন থেকে আয়াশ বলে, ‘সন্ধ্যা আমাদের বাড়িতে ছিলো।’
কথাটা কানে আসতেই বাদল আর বকুল একবার আয়াশের দিকে আরেকবার সন্ধ্যার দিকে তাকায়। অবাক কন্ঠে বাদল বলে, ‘আপনি এখানে?’
আয়াশ হেঁসে এগিয়ে আসে। বলে, ‘অনেক দুর জার্নি করে আসছি আগে একটু ফ্রেশ হয়ে নেই? তারপর না হয় বলি পুরোটা!’
বাদল বোকার মতো তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ায়। তারপর গম্ভীর স্বরে বলে, ‘সন্ধ্যা উনাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি চল। এবাড়িতে এমনিও থাকতে পারবি না অনেক ধুলোবালি জমে গেছে।’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশ আর বাদল সামনে হাঁটতে থাকে পেছন পেছন বকুল আর সন্ধ্যা আসে। বকুল নিজের অবাকতা কাটিয়েই উঠতে পারেনি। তখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা বকুলের পেটে গু’তো দিয়ে বলে, ‘মুখ বন্ধ কর। পরে তো সব শুনতেই পারবি।’
বকুল অভিমানে গাল ফুলায়। সন্ধ্যা নিঃশব্দে হাসে। বকুলদের বাড়ি পা রাখার সাথে সাথেই ছুটে আসে বকুলের মা। সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে থাকে। সাথে তো এতো এতো অভিযোগ রয়েছেই। সন্ধ্যার হঠাৎ ই ভীষণ অপরাধবোধ হয়। এতো গুলো মানুষকে সে কষ্ট দিয়েছে অথচ মানুষ গুলো তাকে কত ভালোবাসে! আয়াশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে বকুলের মায়ের যত্ন। সন্ধ্যা মেয়েটাই এমন না ভালোবেসে থাকা যায় না অথচ এই মেয়েটাই পৃথিবীতে কত দুঃখ পেয়েছে! বাদল নিজের ঘরে আয়াশকে নিয়ে যায়। আয়াশ ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতে করতে বাদলকে বলে,
‘গোসল কোথায় করবো! আগের বার তো চেয়ারম্যান আঙ্কেলের বাড়িতে ছিলাম ওখানে ওয়াশরুম ছিলো। এখন?’
বাদল বেশ ভদ্রতার সাথে বলে, ‘আমাদের বাড়িতে তো শহরের ওয়াশরুম নেই তবে কলপাড় আছে। চারদিক দিয়ে ঘেড়া আছে আপনি নিশ্চিন্তে গোসল করতে পারেন। আসুন!’
আয়াশ মাথা নাড়িয়ে বাদলের সাথেই কলপাড় যায়। বাদল নিজেই পানি তুলে দেয় বালতিতে। মগ দিয়ে সে কলপাড়ের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে। আয়াশ কিছুক্ষণ ভাবে তারপর নিজের মতো গোসল করে নেয়। আয়াশের গোসল শেষে সন্ধ্যাও গোসল করে। গোসল শেষে বের হতেই বকুলের মা আয়াশ আর সন্ধ্যাকে খেতে ডাকে। আয়াশ এদের এতো আতিথিয়তা দেখে ফিসফিস করে সন্ধ্যাকে বলে,
‘মনে হচ্ছে প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে আসছি আর তারা জামাই আদর করতে ব্যস্ত।’
সন্ধ্যা লজ্জায় গুটিয়ে যায়। গাল দুটো রক্তিম আভা ধারণ করে। আয়াশ ঠোঁট চেপে হাসে। দুজনের খাওয়া শেষে আয়াশ বাদলদের সন্ধ্যাকে কিভাবে পেয়েছে তার বিষয়ে পুরোটাই বলে। বাদলের চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। বকুল আর তার মাও অজানা অভিমানে মাথা নিচু করে থাকে। সন্ধ্যা তো অপরাধবোধে সেই কখন থেকেই মাথা নিচু করে আছে। বাদল গম্ভীর স্বরেই বলে,
‘যদি এ’ক্সিডেন্টে বড় কিছু হতো কি করতি শুনি? ডাক্তার সাহেবের কাছে না পড়ে যদি খারাপ কোথাও পড়তি কি হতো? তোর শহরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো একবার কি আমাদের বলতে পারতি না?’
বাদলের কন্ঠে গাম্ভীরতা, অভিমান, স্নেহ, শাষণ সবটাই টের পায় আয়াশ। কিন্তু এ অভিমানের কারণ খুঁজে পায় না। তবে কি বাদল সত্যিই সন্ধ্যাকে ভালোবাসে! আয়াশের ভাবনায় ছেদ পড়ে সন্ধ্যার কথায়। সন্ধ্যা মিনমিনে স্বরে বলে,
‘আমার ভুল হয়ে গেছে বাদল ভাই। আমার আসলেই এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু কি করতাম বলেন! এখানে আমার মা আর দাদার জন্য শ্বাস আটকে আসতো। আর দুদিনও এখানে থাকলে শ্বাস আটকে মা’রা যেতাম।’
‘সেইটা একবার আমাদের বলে দেখতি!’
বকুলের মা অভিমানী কন্ঠে বলে, ‘আমাগো কেন কইবো বাদল! আমরা হের কে লাগি ক?’
সন্ধ্যার চোখ ছলছল করে উঠে। পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বাদলের মা’কে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘এভাবে বলো না চাঁচি। মা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে তো তুমিই মায়ের মতো ভালোবাসা দিচ্ছো। এখন তো আমার তোমরা ছাড়া কেউ নাই।’
বকুলের মাও জড়িয়ে ধরে। অভিমান কান্না হয়ে গলে পড়ে। কিন্তু বকুলের অভিমান তখনো ভাঙেনি। শেষে সন্ধ্যা বকুলের সামনে কান ধরে অনেকবার সরি বলেছে তখন গিয়ে মেনে নিয়েছে মেয়েটা। পাশ থেকে আয়াশ বলে,
‘সব রাগ, অভিমানের ছুটি এবার সন্ধ্যা চলো ঘুরে আসি।’
বাদল, বকুল, সন্ধ্যা আর আয়াশ মিলে গ্রামের পথে বের হয়। সন্ধ্যা মাথায় কাপড় টেনে কবরস্থানের দিকে নেমে যায়। পেছন পেছন বাকি ৩ জনও যায়। সন্ধ্যা ভেতরে না ঢুকলেও বাহির থেকে মন ভরে প্রিয় মানুষগুলোর কবর দেখে। চোখ দুটো কান্নায় ভেঙে আসে। তবুও নিজেকে সামলে নেয়।
সন্ধ্যার খানিক আগে বকুলকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আয়াশ, সন্ধ্যা আর বাদল এসে বসেছে চেয়ারম্যানের বাড়ির সেই পুকুর ঘাটে। শান বাঁধানো পাথরে বসে কিছুক্ষণ কাটে নিরবে। এই নিরবতায় এক ভয়ংকর কথা বলে বসে আয়াশ,
‘চেয়ারম্যানের ছেলে, মেম্বারের ছেলে, পুরোনো মেম্বার, চেয়ারম্যানের ভাই সবাইকে আপনিই ওমন নৃ’শং’স ভাবে মে’রেছেন তাই না!’
চমকে উঠে বাদল আর সন্ধ্যা। আয়াশ স্বাভাবিক। সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘আপনি কি বলছেন এসব? মাথা খা’রাপ হয়ে গেছে নাকি!’
আয়াশ মৃদু হাসে। বলে, ‘আমি না জেনে কিছু বলি না সন্ধ্যা। যথেষ্ট খোঁজখবর, খোজাখুজির পর সবটা জানতে পেরেছি। প্রমাণ ছাড়া কিন্তু আসিনি বাদল ভাই৷’
বাদল চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলে। কিছু বলতে নিলে বাদল আটকায়। বলে, ‘লুকোচুরি তো অনেক হলো এবার তাহলে সত্যিটাই না হয় শুনুন! তা সব প্রমাণ থাকার পরেও আমাকে পুলিশে না দিয়ে এভাবে শান্ত গলায় আমারই গ্রামে বসে প্রশ্ন করছেন!’
আয়াশ বাঁকা হাসে। বলে, ‘যারা মা’রা গেছে তারা একটাও মানুষ ছিলো না তাই আপনাকে পুলিশে দেওয়ার অতো তাড়া নেই আমার। আমি শুধু কারণগুলো জানতে চাই। তারপর না হয় ভেবে দেখবো আপনাকে পুলিশে দেওয়া যায় কি না!’
বাদল তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে। সন্ধ্যা আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে বাদলের মুখের দিকে। বাদল বলতে শুরু করে,
‘নয়না ছিলো সন্ধ্যার ফুফাতো বোন। আমার কিশোর, যৌবন পুরোটাই কাটে ওই মেয়ের মুগ্ধতায়। তার সন্ধ্যার মতো এতো বেশি সৌন্দর্য ছিলো না তবুও সে ছিলো অসম্ভব মায়াবতী এক মেয়ে। নয়নাকে আমি ভালোবাসি বলার পর সেও সায় দেয়। বেশি না হবে ৬ মাস আগের কথা। সেদিন সন্ধ্যা আর মুন্নি প্রাইভেট পড়তে যায়নি। সোনিয়া আর নয়না গেছিলো। ভাগ্যবশত ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর সেদিন জা’নো’য়া’র গুলো আমার প্রণয়িনী আর আমার বোনের মতো মেয়েটাকে….’
গলায় এসে কথা আটকে যায়। সন্ধ্যার চোখ ততক্ষণে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। রাগে তার পুরো শরীর কাঁপতেছে। আয়াশ লক্ষ্য করে সে কাপুনি৷ শক্ত করে ধরে সন্ধ্যার হাত। বাদল আবার বলতে শুরু করে,
‘সোনিয়া আর নয়নার বাবা মা যখন এ গ্রামের কাছে বিচার চাই তখন তারা আশাহত হয়। গ্রামের কু’ত্তা গুলা তখন টাকার লোভে অন্ধ হয়ে গিয়ে ওদেরকে যা তা ভাষায় গা’লি দেয়। পুলিশের কাছেও গেছিলো কোনো লাভ হয়নি। সেখান থেকেও গায়ে খা’রাপ মেয়ের ত’কমা লাগিয়ে বাড়ি ফেরে দুজন৷ কপাল এতোটাই খারাপ ছিলো যে সে সময় ছিলাম আমি শহরে। এসব কিছুই আমি জানতাম না। ভালোবাসার মানুষটাকে যে বুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলবো, ‘তুমি একটুও ভেঙে পড়ো না। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। আমি তোমাকে ভীষণ রকম ভালোবাসি।’ এটুকুও বলার সুযোগ পায়নি। তার আগেই নয়নার সাথে সাথে সোনিয়াও একটা গাছের ডালের সাথে নিজেদের ঝু’লিয়ে দেয়। বকুল সেদিন মোড়ের ফোন থেকে আমাকে ফোন করে জানায় এসব। এসব শোনার পর এতোটাই শকড হয়ে গেছিলাম যে আমি সাথে সাথে সেন্স হারায়। রুমমেট হসপিটালে নেয়। শহর থেকে ফিরতে ফিরতে ততক্ষণে নয়নার লা’শ কবরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখানেও ওই শ’য়’তা’ন গুলো ব্যাগড়া দিয়েছিলো। ওদের কবর দিতে দেবে না বলেছিলো কিন্তু নয়নার বাবা মা আর সোনিয়ার বাবা মা ওদের পায়ে ধরে কবর দিতে নিয়ে যায়। আমি শেষ বারের মতো আমার নয়নাকে দেখতেও পারিনি। সোনিয়া সারাদিন ভাইয়া ভাইয়া করতো সেই বোনের মতো মেয়েটাকেও দেখতে পায়নি। শুনেছিলাম সন্ধ্যা দুদিন সেন্সলেস ছিলো সোনিয়া আর নয়নার মৃ’ত্যুর পর। আমিও চুপচাপ ছিলাম। ২ দিন পর সন্ধ্যা আর রিনি এসে ডেকে নিয়ে যায় আমাকে। নয়নার ঘরে ব্যাগের ভেতর আমার জন্য একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলো। সেটাই পেয়েছিলো সন্ধ্যা আর রিনি।’
অবাকের সপ্তম পর্যায়ে আয়াশ। সে ধারণা করেছিলো বাদলের বিষয়ে সন্ধ্যা জানে কিন্তু এভাবে যে সেও যুক্ত আছে কল্পনাও করেনি। আবার বাদলের জন্য ভীষণ খারাপ লাগা কাজ করছে। বাদল চুপ থেকে আবার বলা শুরু করে,
‘চিঠিতে নয়না তার সাথে ঘটা ঘটনা গুলো লিখে গেছিলো। মেয়েটার চোখের পানির ছোপ ছোপ দাগ চিঠিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। জানেন ওই জা’নো’য়া’র গুলো শুধু ওদের চরি’ত্রহী’না নাম দিয়ে ক্ষ্যান্ত হয়নি। সবার অলক্ষ্যে এসে নয়না আর সোনিয়াকে বাজে বাজে কথা, বাজে বাজে প্রস্তাব দিয়ে গেছে। এমনকি ওই পুরোনো মেম্বার শা’লা কু’ত্তার বা’চ্চাও আমার নয়নার দিকে হাত বাড়িয়েছিলো। এতসব সহ্য করতে না পেরে শেষমেশ এমন পদক্ষেপ নেয়। এমন হাজার হাজার মেয়ে আছে যারা প্রতিদিন ধ’র্ষ’ণে’র শিকার হয়ে আ’ত্ম’হ’ত্যার পথ বেছে নেয়। সেদিন মাথায় রক্ত উঠে গেলো। ওদের বাঁচার কোনো অধিকার নেই। মাথায় শুধু এটাই চলছিলো। ব্যাস সেদিন রাতেই ওদের দেহ থেকে গলা আ’লাদা করে দিলাম। টু’করো টু’করো করে ফে’লে রাখলাম সেই গাছ তলায় যেখানে সোনিয়া আর নয়না আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছিলো। মনে মনে প্রচুর শান্তি পেয়েছিলাম সেদিন। শুধু এমন ২ জন সোনিয়া নয়না না অনেক মেয়ের সাথে এরা খারাপ করেছে। মে’রে ফেলেছে। সে হিসেবে অনেকগুলো মেয়ের জীবন বাঁচিয়ে দিলাম।’
প্রশান্তির হাসি হাসে বাদল। গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে বাদলের একেকটা বাক্য। আয়াশ কি বলবে বুঝতে পারে না। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফের শুধায়, ‘মুন্নিকে কেন মে’রে’ছেন?’
বাদলের চোখ মুখ রাগে পরিণত হয়। দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠ করে বসে থাকে। পাশ থেকে সন্ধ্যা বলে, ‘বি’শ্বা’স’ঘা’ত’কদের বেঁ’চে থাকার অধিকার নেই শহুরে ডাক্তার।’
আয়াশ সন্ধ্যার কন্ঠে কেঁপে ওঠে। সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে রাগে, কান্নায় চোখে রক্ত জমে গেছে। নাকের ডগা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। বাদল কোনো উত্তর দেয় না। আয়াশ অবাক কন্ঠে বলে, ‘মুন্নি কি করেছিলো?’
সন্ধ্যা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কি করেনি? বন্ধু নামের কলংক ‘ও’। নারী নামের কলংক। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের স’র্বনা’শ করতে ওস্তাদ একদম। আজকে ওই মেয়ের জন্য আমাদের নয়না আর সোনিয়া আমাদের মাঝে নেই। বি’শ্বাস’ঘা’ত’ক একটা!’
সন্ধ্যার কথা শেষ হতেই বাদল বলে, ‘যেদিন মেম্বারের ছেলে আর চেয়ারম্যানের ছেলেকে মে’রে’ছি সেদিন ওরা স্বীকার করে যে ওদের সোনিয়া আর নয়নার সাথে এসব করতে উৎসাহ দিয়েছিলো মুন্নি। কথাটা শুনে মাথায় বাজ পড়ার মতো হয়েছিলো। মুন্নি আমাকে পছন্দ করতো, সে নয়নার সাথে আমার সম্পর্কটা মানতে পারেনি৷ তাই এসব করেছে। রাগে ঠিক করলাম পরেরদিনই ওর মা’থা কে’টে নিবো কিন্তু আফসোস ‘ও’ সেদিনই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলো। আমি সামলে নিলাম নিজেকে। যেদিন ‘ও’ গ্রামে আসছে সেদিন রাতেই ওকে পু’তে রেখে দিয়েছি। এতে আমার এতটুকু আফসোসও নেই। যা করেছি তা কোনোদিক দিয়েই আমার কাছে ভুল নয়। ওরা বেঁচে থাকলে এমন হাজারটা মেয়ের জীবন ন’ষ্ট করতো। অকালে মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দিতো।’
আয়াশ গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে সন্ধ্যার মা আর বাবাকে কেন মা’র’লেন?’
চমকে ওঠে সন্ধ্যা। ভয়ে হাত পা কেঁপে ওঠে। এবার যে আরো একটা সত্যি জানবে শহুরে ডাক্তার! এরপর কি হবে?
চলবে..
()