ডিভোর্স পেপারে সাইন করে স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে অদ্রি। ডিভোর্স পেপারে সাইন করলেও ডিভোর্স হয়ে যায় না, অন্তত তিন মাস সময় লাগে ডিভোর্স কনফার্ম হতে। সেই কারণেই অদ্রি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
তিন বছরের প্রেমের পর আরো তিন বছরের বৈবাহিক সম্পর্ককে একটা সাইন ও নির্ধারিত কিছু সময়ের পর শেষ হবার পথে। সম্পর্কের এই পরিণতির কারণ অদ্রির বাচ্চা জন্মদানে অক্ষমতা।
অদ্রির সন্তান জন্মদানের অক্ষমতা বলতে পুরোপুরি অক্ষমতা না। অদ্রিকে ডাক্তার বলেছে, কিছু নির্দিষ্ট ডোজ ও সেসনে মেডিসিন নিলে এক-দুই বছরের মধ্যে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। জরায়ুতে সিস্টের কারনে এই সমস্যা। বাম ফ্যালোপিয়ান টিউবে ছোট সিস্ট আছে। ডাক্তার বলেছেন, অপারেশন ছাড়াও কয়েক ডোজে মেডিসিন নিয়ে সিস্ট অপসারন সম্ভব।
অদ্রি একজন ফার্মাসিস্ট। তাই তার অনেকটাই ধারনা আছে এসব বিষয়ে নিয়ে।
_________
অদ্রি রহমান, বাবা-মায়ের দুই মেয়ের বড় মেয়ে। অদ্রি দেখতে মাশাআল্লাহ সুন্দর। উজ্জল শ্যাম বর্ণের ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট ২৬ বছরের তরুণী। নজরকারা সুন্দরী না হলেও চেহারায় মায়া ভাব বিদ্যমান।
অদ্রি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে তখন তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে বিভান নামের একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনোমিক্স বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক যুবকের সাথে।
বিভান আহমেদ, তিন ভাই বোনের ছোট। শ্যাম বর্ণের, ৬ ফুট উচ্চতার ছেলেটির মুখে যেনো এক মায়া কাজ করে।
অদ্রিকে যখন বিভান রমনা পার্কে সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একগুচ্ছ কাঠগোলাপ নিয়ে প্রথম প্রেম নিবেদন করে সেদিন অদ্রি পারেনি বিভানকে ফেরাতে। বিভান অনেক ভালো ছাত্র তার উপর বিভান এই পর্যন্ত কোন মেয়ের সাথে সম্পর্কে যায়নি। অদ্রিকে তার প্রথম থেকেই ভালোলাগত।
অদ্রি ও অদ্রির বন্ধুরা যখন প্রায় বিকেলে ঢাকা ভার্সিটির শহীদুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে আড্ডা দিতে দিতে যেতো তখন বিভান শুধু দেখতো রোদের আলোক ছটায় এক হাস্যোজ্জ্বল তরুণী ব্যাস্ত তার হাত দিয়ে নিজেকে রোদের থেকে আড়াল করতে। এক বছর আস্তে আস্তে মনের সুপ্ত অনুভূতিকে এক প্রশান্ত ভালোবাসার রূপ দিয়ে এরপর এক মহেন্দ্রক্ষণ বেছে অদ্রিকে নিজের মনের কথা জানায়। এমন না যে অদ্রি বুঝতোনা বিভানের চাহনি!
অদ্রি তখন প্রায় সময় বন্ধুদের নিয়ে শহিদুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে যেত শুধু মাত্র বিভানকে দেখতে। কারণ বিভান প্রায় বিকেলে শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে বন্ধুদের সাথে বসে থাকতো।
প্রেম নিবেদনের পর যখন ওদের ভালোবাসার তিন বছর পূর্ণ হয় তখন তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিভানের বড় ভাবি এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল কারণ বিভানের ভাবির ছোট বোন বিভানকে পছন্দ করতো। বিভানের ভাবি এমনিতে বিভানকে সহ্য করতে পারতো না কারণ সম্পত্তি বিভানের বাবা তিন ভাই বোনকে লিখে দিয়ে মারা গেছেন তখন মাত্র বিভানের বড় ভাই নতুন বিয়ে করেছে। বিভান তখন ছাত্র অবস্থায় থাকায় কোনো ইনকাম করতে পারতোনা, বড় ভাইয়ের টাকায় বিভান চলতো যা বিভানের ভাবির কোন কালেও পছন্দ ছিল না।
এরপর যখন বিভান বিসিএস পরিক্ষাতে উর্ত্তীন্ন হয় তখন বড় ভাবীর ছোট বোন বিভানকে বিয়ে করার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে যায়। সারাদিন বোনের বাড়ি এসে পড়ে থাকতো বিভানের ভাবির ছোট বোন শিমু।
বিভানের ভাবি ও তার ছোট বোন উঠে পরে লাগে বিভানের মা কে বুঝাতে যে বিভানের জন্য শিমুর থেকে ভালো মেয়ে আর পাওয়া যাবেনা। কিন্তু এত কিছু করেও বিভানের মা কে তারা দুই বোন টলাতে পারেনি।
বিভানের মা জানে তার বড় ছেলের বউ কেমন! তাই ছোট ছেলের জন্য সেই পরিবার থেকে মেয়ে আনতে চায়নি। তাছাড়া বিভান নিজেও শিমুকে পছন্দ করেনা। শিমু অনেকটাই গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে। শিমু তখন পর্যন্ত অনেক গুলো প্রেম করেছে, টাকা ওয়ালা বড়লোকের ছেলেদের সাথে। রুমালের মতো বয়ফ্রেন্ড পালটায় শিমু। শিমু দেখতে ফর্সা ও সুশ্রী হওয়ায় যেন তার অহংকার আকাশচুম্বি।
বিভান বড় ভাবির কথা আগ্রাহ্য করে অদ্রিকে মায়ের অনুমতিতে নিজের বউ করে বাড়িতে নিয়ে তোলে। অদ্রির সাথে বিভানের বিয়ে হবার ঠিক তিনদিনের মাথায় বড় ভাবি রিমু নিজের ছেলেকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি চলে যায়।
একমাস হয়ে যায় তাও যখন বাড়ির বড় বউ বাড়ি ফেরে না তখন বিভানের মা চিন্তায় পরে যায়। বিভানের মা বড় ছেলেকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বড় ছেলে অতি সন্তপর্ণে তা এড়িয়ে যায়। পরে একদিন শাশুড়ি নিজে যায় বড় ছেলের বউকে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু বড় ছেলের বউ সেদিন শাশুড়িকে ফিরিয়ে দেয় একসাথে থাকবে না বলে। তবে আরো পনেরো দিন পর স্বামীর কথায় শশুর বাড়ি ফিরে আসে রিমু মুখের ভাবসাব কালো করে।
অদ্রি নিজের রুমে বসে একটা সংসার ভেঙে যাওয়া দেখে। অদ্রি বা কি করবে? বিভান ও তার শাশুড়ির যেখানে শিমুকে পছন্দ না তাহলে কিভাবে করবে শিমুকে এই বাড়ির বউ।
বড় ভাই, ভাবি ও তাদের তিন বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে যেদিন নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় অন্যত্র নীড় খোঁজার জন্য সেদিন অদ্রি দেখেছিলো এক মায়ের আর্তনাদ। যেই আর্তনাদ রুহ কাঁপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেদিন শাশুড়িকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা অদ্রি খুঁজে পায়নি।
অদ্রির বিয়ের পর থেকে বিভানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী রিমু যেনো তাকে সহ্য করতে পারেনা। বিয়ের পরেরদিন বড় ভাবি রিমু অদ্রিকে নিয়ে ঘর ভর্তি মেহমানের সামনে নিজের বোন শিমুর গায়ের রংয়ের সাথে তুলনা দিয়ে অপমান করেছে। সেদিন অদ্রির প্রথমবার মনে হয়েছিল, গায়ের রং ময়লা হওয়া পাপ।
অদ্রি সেদিন বড় ভাবীর মুখের ওপর একটুও শব্দ করে নি, নতুন বউ কি না সে! বিয়ের পরপর যেই তিনদিন বাড়ির দুই ছেলের বউ একই বাড়ীতে ছিল সেই তিনদিন অদ্রি যেনো নিজেকে প্রতিনিয়ত ছোট হতে দেখেছে। দিন শেষে অদ্রির অভিযোগের পালা খুলে বসতো বিভানের সামনে। বিভান বুঝতো তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কষ্ট তবুও বড় ভাই ও ভাবিকে কিছু বলতো না কারণ তারা এটাকে ভালোভাবে নিবে না। স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সান্তনা টুকুই শুধু দিতে পারতো আর চেষ্টা করতো নিজের ভালোবাসা দিয়ে অদ্রির দুঃখ মোচন করতে।
তাছাড়া বিভানের মা নিজে এসে বিভান ও অদ্রিকে বলেছে, কিছুটা মানিয়ে নিতে। উনি তার বড় ছেলেকে নিজের থেকে দূর করতে চাননা। কোনো মা এই চায় না তার প্রথম সন্তান তাঁর থেকে দূরে যাক। অদ্রি বুঝতে পারত তার শাশুড়ির কষ্ট তাই শাশুড়ি ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বড় ভাবির সমস্ত লাঞ্ছনা মেনে নিত।
তবে মনে যদি থাকে কলুষতা তাহলে কি সংসার জমে! ঠিক ভেঙে গেলো এক মায়ের সংসার। আলাদা হয়ে গেলো তার দুই ছেলে।
বড় ভাই ও ভাবি আলাদা হয়ে যাবার পর অদ্রি নিজের ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানীর জবে জয়েন করে। যে জব সে বিয়ের কারণে ছয় মাসের জন্য বন্ধ রেখেছিলো। বিভান ও তার মা অদ্রিকে চাকরি করতে মানা করেনি। তারা দুজনেই মেয়েদের নিজ পায়ে দাঁড়ানো টাকে বিশ্বাস করে।
অদ্রি জবে জয়েন করেছে এই কথাটা শোনার পর শিমু যেনো হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। রিমুর সাথে শলা পরামর্শ করে শিমু বোনের শাশুড়ির কাছে এসে বোনের গুনগান ও বোনের অসহায়ত্ব এসব নিয়ে বলা শুরু করে। অদ্রির শাশুড়ি শিমুর কথাকে পাত্তা দিতো না প্রথমে।
এভাবে কেটে যায় অদ্রি-বিভানের বিয়ের এক বছরের বেশি কিছু সময়। ভালোই চলছে বিভান ও তার মা কে নিয়ে অদ্রির সংসার। সকাল সকাল ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে অদ্রি রান্নাবান্নার কাজ করে। সকালের নাস্তা বানিয়ে দুপুরের জন্য তরকারি রান্না করে অফিসের জন্য বের হয়ে যেতো সকাল সাতটা নাগাদ।বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য একজন ত্রিশার্ধো ছুটা বুয়া আছে। শাশুড়ির যাতে কোনো সমস্যা না হয় সব দিকে খেয়াল রাখে অদ্রি। শাশুড়িও অদ্রিকে মেয়ের মতো দেখে।
অদ্রি অফিসে যাবার পর প্রায় মাঝেমাঝে সকাল দশটা নাগাদ শিমু আসতো অদ্রির শাশুড়ির কান ভাঙ্গাতে। যখন শিমু দেখলো সে সফল হচ্ছে না তখন সে চালে তার মুক্ষম চাল। অদ্রি ও বিভানের বিয়ের তখন দেড় বছর চলে তখন শিমু অদ্রির শাশুড়ির কানে তোলে, অদ্রির বাচ্চা হয় না কেনো? সেটা। অদ্রির শাশুড়ি শিমুকে বলেছিলো, বাচ্চা নেওয়া তার ছেলে ও ছেলের বউয়ের বিষয় এবং সে এসব বিষয়ে তাদের কিছু বলতে চায় না।
এসব শোনার পরেও কি শিমু চুপ করে থাকে! না। শিমু এবার অদ্রির শাশুড়ির কানে ভরতে থাকে যে, অদ্রির হয়তো কোনো সমস্যা আছে। অদ্রির শাশুড়ি প্রথমে এটাতে পাত্তা না দিলেও অনবরত শিমুর কান ভাঙ্গানিতে প্রলুদ্ধ হয়ে একদিন অদ্রিকে বলেই ফেলে বাচ্চার কথা।
শাশুড়ির এহেনো কথায় অদ্রি প্রথমে চমকে গেলেও পরে নিজেরও কেমন যেনো লাগতে থাকে তাই নিজেই যায় তার পরিচিত ডাক্তারের কাছে। ফার্মাসিস্ট হওয়ায় অনেক ডাক্তারের সাথে চেনা জানা আছে তার।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#সমাপ্তির_পূর্ণতা
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#সূচনা_পর্ব
ভূল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।