বারান্দায় অসহায়ের মতো ঝুলছে কায়াসা।সে না উপরে যেতে পারছে আর না নিচে নামতে পারছে।উপরে গেলে আদ্রিক নামের রাক্ষসটা তাকে খেয়ে ফেলবে আর নিচে নামেও কোন লাভ নেই।কারণ গার্ডরা তাকে এই রাক্ষসপুরী থেকে বের হতে দেবেনা বরং তাকে আদ্রিক রাক্ষসটার কাছে দিয়ে আসবে।
কায়াসা একবার নিচের দিকে তাকাই তো একবার উপরের দিকে।সে এতোক্ষণে এসে বুঝতে পারছে যে এখানে এসে কত বড় ভুল করেছে।এদিকে আদ্রিক র্নিলিপ্ত ভাবে কায়াসার দিকে তাকিয়ে আছে।
” উপরে আসবে নাকি আমি চাদরটা খুলে দেবো?”
” না আসবোনা কি করবেন?”
” ওকে,না আসো আমার কি?আমার তো শুধু আমার বিছানার চাদরটা চাই।তুমি থাকো,সারাদিন এভাবেই ব্যাঙের মতো ঝুলে থাকো।”
আদ্রিক যখনিই চাদরের গিটটাতে হাত দেবে তখনিই কায়াসা চিৎকার করে উঠে।
” একদম চাদরে হাত দেবেন না।দিলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”
” কি করবে শুনি?” বাঁকা হেসে বলে আদ্রিক।
কায়াসা ভাবতে থাকে সে এখন কি বলবে।সে ভাবতে ভাবতেই আদ্রিক বলে,
” আমি থ্রি পর্যন্ত কাউন্ট করবো।এরমধ্যে যদি তুমি উপরে উঠে না আসো তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।ওয়ান…..টু……”
” আরে বাবা দাঁড়ান না।এতো তাড়াতাড়ি কাউন্ট করছেন না?আসছি আমি,দাঁড়ান।”
কায়াসা চাদরটা ধরে আস্তে আস্তে আবারো উপরে উঠতে থাকে।
” এভাবে তাকিয়ে না থেকে আমাকে উপরে উঠে আসতে সাহায্য করুন।”
আদ্রিক বিরক্তকর মুখ নিয়ে কায়াসাকে টেনে উপরে তোলে।কিন্তু কায়াসা ব্যালেন্স রাখতে না পেরে আদ্রিক গায়ের উপর এসে পড়ে আর কায়াসার হঠাৎ করে গায়ে পড়াতে আদ্রিকও নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারেনা।যার কারণে দুজনেই ধপ করে নিচে পড়ে।কায়াসা ভয়ে চোখ বন্ধ করে আদ্রিকের শার্টের খামচে ধরে।কায়াসার কাজে আদ্রিক কপাল কুঁচকে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ধাক্কা দিয়ে কায়াসাকে সরিয়ে দেয়।নিচে পড়ে কায়াসা আবারো চিৎকার করে উঠে।
” আব্বু,আমি গেলাম গো।হায়….আমার হাত।আব্বু আমি এই কোন রাক্ষসের খপরে পড়লাম?আমাকে এখন কে বাঁচাছে?”
” এই ইডিয়েট মেয়ে চুপ করো বলছি।”
তবে আদ্রিকের বলায় কোন কাজ হয়না,কায়সা তখনো চিৎকার করেই যাচ্ছে।
” আই সে স্টপ সাউটিং।” এবার চিৎকার করে বলে আদ্রিক।আদ্রিক চিৎকার শুনে কায়াসা চুপ হয়ে যায় আর একদম দেয়ালের সাথে মিশে যায়।
” এই মেয়ে তোমার মাথা কি খারাপ?তখন এভাবে বিছানার চাদর দিয়ে বারান্দায় ঝুলছিলে আর এখন চিৎকার করছো।”
” প্লিজ আমাকে মারবেন না।আমি কিছু শুনি।সত্যি বলছি আমি কিছু শুনি।”
” কি শুননি তুমি?”
” আপনি কিছু জানেন না?”
” কি জানবো আমি?”
” ও কিছুনা।”
” সত্যি করে বলো তুমি কি শুনেছো?”
” কিছুনা,কিছু শুনিনি আমি।” দেয়ালের সাথে আরো লেগে কায়াসা।
” আমি লাস্ট বার জিজ্ঞেস করছি কি শুনেছো তুমি?”
তবুও কায়াসা কিছু বলেনা।সে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সে কিছু শুনেনি।কিন্তু আদ্রিক বুঝে গিয়ে কায়াসা নিশ্চয়ই কিছু শুনেছে।
” আমি কি বলছি তোমাকে? কি শুনেছে তা আমাকে বলো,ইডিয়েট মেয়ে।” চিৎকার করে বলে আদ্রিক।
আদ্রিকের কথা শুনে কেঁপে উঠে কায়াসা।সে ভয়ে গড়গড় করে সব বলে দেয় যে সে কি শুনেছে,এসব বলতে বলতে সে কান্না করে দেয়।কায়াসার কথা শুনে চোখ বন্ধ করে আদ্রিক কিছুভাবে,তবে কয়েক সেকেন্ড পর সে চোখ খুলে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে কায়াসার দিকে তাকাই।কায়াসা এখনো গুটিসুটি মেরে দেয়ালের সাথে লেগে আসে।
” তুমি অনেক বেশি কিছু জেনে গিয়েছো বেবি।এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।”
” আমি সত্যি বলছি আমি ইচ্ছে করে শুনিনি।ভুলে হয়ে গিয়েছে।”
” ভুল যখন করেছো এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে জান।”
শাস্তির কথা শুনে কায়াসা ভয়ে আরো কুঁকড়ে যায়।
আদ্রিক কায়াসার হাত ধরে তাকে তোলার জন্য কিন্তু কায়াসা শক্ত হয়ে সেখানে বসে থাকে।
” আমি যাবো না,প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।আমি কাউকে কিছু বলবো না।সত্যি বলছি,প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।”
কায়াসা আরো অনেক কিছু বলে আদ্রিকের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু কায়াসার কোন কথায় যেন আদ্রিকের কানে ঢুকছেনা।সে কায়াসাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।কায়াসা অনেকবার চেষ্টা করে নিজের হাতটা আদ্রিকের থেকে ছাড়ানোর কিন্তু আদ্রিক এতো শক্ত করে তার হাতটা ধরেছে যে সে ছাড়াতেই পারছেনা।
আদ্রিক কায়াসাকে একটা রুমের মধ্যে নিয়ে আসে।পুরো রুমটা অন্ধকার,কিছুই দেখা যাচ্ছে না।এই অন্ধকারে হাঁটার সময় কায়াসার মনে হচ্ছে সে এখনই পড়ে যাবে কিন্তু আদ্রিক নিলিপ্ত ভাবে হেঁটেই যাচ্ছে।একসময় আদ্রিক কায়াসার হাত ছেড়ে দেয় তবে তাকে ছাড়েনা।কায়াকে একজায়গায় বসিয়ে দেয় আদ্রিক,তারপর কিছু একটা তার একহাত পড়িয়ে দেয়।অন্ধকারের কারণে কায়াসা দেখতে না পারলেও সে বুঝতে পেরেছে আদ্রিক শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছে।এটা বুঝতে পেরেই কায়াসা আবারো চিৎকার করে বলে উঠে,
” এসব আপনি কি করছেন?ছাড়ুন আমাকে,ছেড়ে দিন।আমি আপনার কোন পারসোনাল সম্পত্তি নয় যে এভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবে।খুলে দিন আমার হাত।”
কায়াসা অনেক ছোটাছুটি করে হাতটা ছড়ানোর জন্য কিন্তু কোন লাভেই হয়না।কায়াসা চিৎকর করতে থাকে কিন্তু আদ্রিকের কোন সাড়াশব্দ নেই।অবশেষে সে বুঝতে পারলো এখন হাজারো চিৎকার করেও কোন লাভ হবেনা তখন কায়াসা চুপচাপ হয়ে যায়।
” প্রয়োজন থেকে বেশি কিছু শুনে ফেলার ফল এটাই।তুমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছো জান।” কায়াসার কানের কাছে কথাটা বলে আদ্রিক।আদ্রিকের কথা শুনে কায়াসার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।আদ্রিক উঠে দাঁড়ায় আর চলে যেতে থাকে,একসময় তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়।আদ্রিক চলে যেতে কায়াসা আবারো শিকল থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে তবে এবারো সে ব্যর্থ হয়।অন্ধকারে কায়াসা আশেপাশে হাতরাতে থাকে যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশায়।কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও হাতের নাগালে সে কিছুই পায়না।একসময় কায়াসা হাল ছেড়ে দেয় আর ভাবতে থাকে এই রাক্ষসটার সাথে তার কিভাবে দেখা হয়েছে।
ফ্ল্যাসবেক,
অজোর বৃষ্টিতে রাস্তায় বেগতিকভাবে দৌড়াচ্ছে কায়াসা আর তার পেছনে দৌড়াচ্ছে কয়েকটা ছেলে।তখন প্রায় অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে যার কারণে রাস্তা মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
আজ কায়াসার বান্ধবী ইতির বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী ছিল,তাই কায়াসা তার বাসায় গিয়েছিল।কিন্তু কে জানতো ফিরতে এতোটা রাত হয়ে যাবে।এই ঢাকা শহরে কায়াসার আপন বলতে কেউ নেই।সে দু’বছর আগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এসেছিল পড়ার শোনা করার জন্য।অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এসেও যখন কায়াসা কোন রিকশা পায়না তখন সে সিদ্ধান্ত নেই বাকিটা পথ হেঁটেই যাবে,তাই সামনে এসে রিকশা পেলেও সে রিকশা নেয় না।কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তই যেন তার কাল হয়ে দাঁড়ালো।কয়েকটা মাতাল ছেলে তার পেছনে পড়ে গেলো।এখন সেই মাতাল ছেলেগুলো থেকেই বাঁচতে কায়াসা প্রাণপণে ছুটছে।
দৌড়াতে দৌড়াতে কায়াসা এসে পড়ে একটা গাড়ির সামনে।গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে সে নিচে পড়ে যায়,সে হাতেও কিছুটা ব্যথাও পাই তবে কায়াসা সেদিকে ওতোটা পাত্তা দেয়না।কারণ এখন তার সম্মান বাঁচানোটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।কায়াসা নিচে থেকে তাড়াতাড়ি উঠে গাড়িটার দরজার জোড়ে জোড়ে নক করে দরজাটা খুলতে বলে।গাড়ির ভিতরের লোকটা কিছুই বুঝতে পারছেনা তবে কায়াসার অবস্থা দেখে লোকটা দরজা খুলে দেয়
দরজা খোলার সাথে থেকে কায়াসা ভিতরে ঢুকে পড়ে।
” প্লিজ তাড়াতাড়ি গাড়িটা স্টার্ট করুন,প্লিজ।নয়তো ওই ছেলেগুলো খারাপ কিছু করে ফেলবে,প্লিজ।”
লোকটা একবার কায়াসার দিকে তাকিয়ে গাড়ির স্টার্ট করে।কায়াসা গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখে ছেলেগুলো আসছে কিনা,না কেউ নেই।এটা দেখে কায়াসা স্বস্তির নিশ্বাস নেয়।তবে পরক্ষণেই তার মনের মধ্যে আবারো ভয় হতে শুরু করে।কায়াসা ভয়ে ভয়ে তার পাশের লোকটা দিকে তাকাই।সে ভয়ের কারণে একজন অপরিচিত ব্যক্তির কারে ঢুকে গিয়েছে এটা ভাবতেই কায়াসা নিজেকে গুটিয়ে নেয়।সে একদম গাড়ির দরজার সাথে চেপে বসে।কায়াসা পুরোই বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছে।গাড়িতে এসিও চালানো যার কারণে সে ঠান্ডায় কাঁপছে।লোকটা হঠাৎ এসিটা বন্ধ করে দেয় আর কায়াসার দিয়ে টিস্যুর বক্সটা এগিয়ে নেয়।কায়াসা চোখ না তুলেই কাঁপা কাঁপা হাতে টিস্যুর বক্সটা নেয়।তবে সে চিন্তা আসে সে টিস্যু ব্যবহার করবে কিনা।অবশেষে বক্স থেকে একটা টিস্যু বের করে মুখটা মুছে নেয় সে,তবে যতক্ষণ টিস্যুটা তার মুখের কাছে ছিল সে ততক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে ছিল,এই ভয়ে যে যদি টিস্যুতে কিছু মেশানো থাকে।মুখ,হাত মুছে কায়াসা টিস্যুর বক্স সাইডে রেখে আবারো নিজে গুটিয়ে নেয়।দৌড়াতে দৌড়াতে সে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে তাই সে সিটে মাথা এলিয়ে দেয়।
চলবে…….
#সুঁই_সুতোর_আসক্তি
#পর্বঃ০১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি