#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
রাতে কেউ একজনের দরজা নক করার শব্দে মুনের অতীত ভাবনার ব্যাঘাট ঘটলো। সময় পেলেই সে ব্যালকনিতে গিয়ে পাশের ব্যালকনিটার দিকে তাকিয়ে রই। আজ দুদিন যাবৎ একসাথে পাশাপাশি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করা হয় না। মনে হচ্ছে যেন অনেকদিন হয়ে গেল। মুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে দরজা খুলতেই দেখতে পেল বড়ো বাবা দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো বাবা সাধারণত কারো রুমে যাই না, যা বলার ড্রয়ইং-রুমে সবাইকে একসাথে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে কিন্তু আজ স্বয়ং মুনের রুমে!
মুন বড়ো বাবাকে ডেকে মুচকি হাসলো।
-‘আসো, বাবা।’
আফজাল শেখ রুমে ঢুকে মুনকে ইশারায় বিছানায় বসতে বলল। মুন গিয়ে বসতেই এরপর তিনি একটা টুল টেনে মুনের সামনাসামনি বসলো।
-‘শোন মা। তোকে আমি বারণ করবো না বাইরের দেশে গিয়ে পড়ার জন্য। আমি নিজেও চাই আমার মেয়েগুলো যেন শক্ত মনের হয়। আমার পুরোপুরি ভরসা আছে তোর উপর কিন্তু তোর কী ওই সুদূর দেশে যেতেই হবে?’
-‘আমি এখানে থেকে কোনোদিনও পারবো না কিছু করতে বাবা। কোনো ইচ্ছেই তো তুমি অপূর্ন রাখোনি বাবা, আমার এই ইচ্ছেটাও পূর্ণ করো বাবা।’
আফজাল শেখ কিছুক্ষন মুনের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর নরম কণ্ঠে বলল,
-‘আমি জানি তুই এটা কেন বলছিস। আমি এটাও জানি যে আমার মেয়ে নরম নই, সে চাইলে এই সবকিছুকে দূরে সরিয়ে দিয়ে মনকে শক্ত করতে পারবে। তোর এই ইচ্ছেটাকেও আমি অপূর্ন রাখবো না।’
মুন হেসে আফজাল শেখের পাশে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখলো।
-‘আমি জানতাম বাবা। তুমি কোনোদিনও বারণ করবে না। তাই তো কাল রাতেই সবকিছু ঠিক করে ফেলেছি।’
আফজাল শেখ মুনের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিল,’তোরা আমার ভাইয়ের একমাত্র সম্বল। সবসময় চায় এই বাসায় তোদের যেন কোনো কষ্ট না হয়, সব ইচ্ছেই যেন পূর্ণ হয়। কোন দেশে এপলাই করেছিস?’
-‘নিয়ইয়র্ক, বাবা।’
-‘এতো দূরে তুই নিজেকে মানাতে পারবি মা?’
-‘অবশ্যই পারব বাবা, আমার যে পারতেই হবে। শুধু তোমার এই মেয়েটার জন্য একটু দোয়া করো।’
-‘ওখানে কার সাথে থাকবি এতো বড়ো একটা ভিনদেশে?’
-‘চিন্তা করো না। আমার ছোট বেলার এক বান্ধবী ওখানে সেটেল। ওই যে ইরা ছিল যে? সেই। বাবার সাথে ও মাধ্যমিক শেষে চলে গিয়েছিলো। ওর সাথে আমার যোগাযোগ আছে। সে-ই সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। আমি ওর সাথেই থাকব আপাতত, সমস্যা হবে না।’
-‘পারবি তো?’
-‘হ্যাঁ,২০০%’
-‘আচ্ছা, আমি কালকে থেকেই সব ব্যবস্থা করে ফেলবো।’
এরপর মুন হেসে আফজাল শেখের বুকে মাথা রাখলো। এই মানুষটার বুকে মাথা রাখলে বাবা নামক মানুষটার বুকে মাথা রাখার মতো অনুভব হয়। ছোট থেকেই এই মানুষটাই মুনের সবকিছু বাবার মতো করেই দেখেছেন। কোনো কিছুই অপূর্ণ রাখেনি। বড়ো বাবা কোনো অন্যায় কাজ সহ্য করতে পারে না। মুন জানে না, সেই জায়গায় রিফাত ভাইয়ার অন্যায় কাজটা কীভাবে সহ্য করে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। কী জানি! হয়ত বা ছেলে বলে বাড়িতে জায়গা দিয়েছে। মুন আর কিছু না ভেবে বড়ো বাবার বুকে চোখ বুজে রইল। এরপর আর কখন এভাবে বুকে মাথা রাখতে পারবে সেটা মুন জানে না। এই মানুষটাকে সে কখনো ভুলবে না। সবসময় ছায়ার মতো পাশে ছিল।
রুমের বাইরে দরজার আড়াল থেকে আফজাল শেখ আর মেয়ের কথোপকথন শুনে রাশিদা ইসলাম আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলো। আজ ভীষণ করে মুনের বাবার কথা মনে পড়ছে। তার চাঁদ মা যে অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে। ছোট বেলায় তিনি মুনের ছোট ছোট হাত-পা ধরে বলতো ‘কখন যে আমার এই চাঁদ মা’টা বড়ো হবে! আমার বুকে মাথা রাখবে! আমাকে বাবা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরবে।’ অথচ আজ মুন বড়ো হয়ে গিয়েছে অনেক কিন্তু তিনি অনেক দূরে। এসব ভাবতেই পুরোনো স্মৃতিরা আবারো হানা দিতে থাকলো। তিনি আঁচল দিয়ে মুখ চেপে নিজের রুমে চলে গেলেন।
——————-
এরপর দুদিন মুন আর রুম থেকে বের হয়নি। সে রিফাতের সামনে পড়তে চায় না, রিফাতের সামনে পড়লেই পুরোনো স্মৃতিরা হানা দেয় তাই রুম থেকে বের হয়নি। সবকিছু রুমেই করতো। এদিকে আফজাল শেখ মেয়ের জন্য সব ব্যবস্থা অতি দ্রুতের সহিত করতে লাগলো। তিনি মুনের রুম থেকে বের না হওয়ার বিষয়টা খেয়াল করেছেন তাই তো তিনদিনের মাথায় রিফাতকে ব্যবসার কোনো একটা কাজের বাহানা দিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই কয়দিন রিফাতকে পরিবারের সাথে মোবাইলে কারো সাথে কোনো কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এমনকি রিফাতের বৌয়ের সাথেও। এতদিন চুপ মেরে থাকলেও এবার আস্তে আস্তে রিফাত তার শাস্তি ভোগ করবে। তার মেয়েকে তার থেকে আলাদা করার শাস্তি মুন চলে যাওয়ার পর পুরোপুরি শাস্তিটা পাবে। আর রিফাত মুন যাওয়ার সময় বাসায় থাকলে মুনের মন খারাপ হতে পারে ভাবে তিনি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। রিফাতকে তিনি চাইলে সেদিনই বাসা থেকে বের করে দিতে পারতো কিন্তু তিনি সেটা চায়নি, কারণ ওদের দুজনকে বের করে দিলে ওরা বাইরে অন্য কোথাও ঠিকই সংসার করবে। রিফাত সাবলম্বী ছেলে, তার চলতে কোনো কষ্ট হতো না। কিন্তু আফজাল সাহেব চান নিজের কাছে রেখেই শাস্তি দিতে। রিফাত যেকোনোভাবে বৌকে কল করবে তাই নতুন বৌয়ের কাছ থেকেও তিনি মোবাইল নিয়ে নিয়েছেন। ফল একজন কেন ভোগ করবে, দুজনেরই শাস্তি আছে।
~’পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়েও একে-অপরের কাছ থেকে আলাদা থাকার কষ্ট এই দুনিয়ায় আর নেই।’~আর যোগাযোগ না থাকলে তো কোনো কথাই নেই।
রিফাতের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ের দুদিনের মাথায় বৌকে ফেলে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে। তার উপর বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা, রিফাত যেন ভুলেও পরিবারের কাওকে এমনকি বউকেও কল না দেয়। তার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মুনের সাথে দুই বছর ভালোবাসার অভিনয় করে ওকে ঠকাতে এতো কষ্ট লাগেনি, যতটা এখন লাগছে। সে বুঝতে পারছে, সামনে তাকে আরো কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
–
–
রিফাত ভাইয়াকে বড়ো বাবা কোনো একটা কাজে কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে পাঠিয়েছে শুনে মুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক অন্তত বাসায় যতদিন আছে ততদিন সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পারবে মুন।
মুন নিচে নামার আগে যথেষ্ট নিজেকে পরিপাটি করে নিল। যতই উপরে বলুক না কেন মুন আর এসব ভাববে না কিন্তু দিন শেষে আবারো পুরোনো বিশ্রী অনুভূতিটা হানা দেয়। ব্যালকনিতে গেলে আরো বেশি খারাপ লাগে কারণ এই ব্যালকনিতেই পাশাপাশি তারা গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতো। মুনের তখন মনে হতো – সেই মনে হয় সুখী। অথচ সব না-কি মিথ্যে ছিল। মুন তাচ্ছিল্য হাসি দিল। মুন আর কিছু না ভেবে নিজের তিক্ত অনুভূতিটাকে হাসির আড়ালে ঢেকে সবার সাথে আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিচে নামলো। তার ভাবতেই কান্না পাচ্ছে আর কয়েকদিন পর এই মানুষগুলোকে ছেড়ে থাকতে হবে।
মুন স্বাভাবিক ভাবে কাজিনদের আড্ডায় গিয়ে বসলো। অন্যরা আর ঘাটলো না কারণ আফজাল শেখের কড়া নিষেধাজ্ঞা – মুনের দিকে না তাকানো, স্বাভাবিক ভাবে যেন সবাই থাকে নাহলে মুনের মনে খারাপ লাগা কাজ করবে।
মুন কাজিনদের কাছে যাওয়াতে সবার স্বাভাবিক ভঙ্গিমা দেখে তার নিজেরও ভালো লাগলো। হয়ত সবাই ভুলে গিয়েছে। মুন এতক্ষন সংকোচে আসতে পারছিলো না যদি কেউ আগের কথা তুলে এই ভেবে কিন্তু এমন কিছু হয়নি ভাবে সে নিজেও স্বাভাবিকভাবে সবার মাঝখানে বসে আড্ডায় মেতে উঠলো। কাজিনদের আড্ডাতে বসতেই তার আগের আড্ডাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আগে রিফাত আড্ডার মাঝখানে মাঝখানে মুনের দিকে তাকাতো আর তা দেখে মুন মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলত আর এখন,,! কত তফাৎ! এসব ভাবতেই মুনের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। অন্যরা বিষয়টা খেয়াল করতেই মুনকে ওদের আড্ডার মাঝখানে রেখে হাসির হাসির কথা বলে আড্ডায় মেতে উঠলো।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(