স্নিগ্ধ গাংচিল পর্ব -০৮

#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮

আদ্রিন অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই ঘরের ভেতর ঢুকতে নিলেই একটি মেয়েকে তার দিকেই দৌড়ে আসতে দেখলো। সে ভ্রু-কুঁচকে কিছুক্ষন সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি তার পরনে গ্রাউনটা উঁচু করে ধরে এলো-পাতাড়ি দৌড়াচ্ছে। সে তার ভ্রম মনে করে আরেকটু এগিয়ে গেল বিষয়টা ভালো করে বোঝার জন্য, নাহ,এটা তার ভ্রম নই ;সত্যিই একটা মেয়ে দৌড়ে তারই দিকে এগিয়ে আসছে। আদ্রিন বুঝতে পারলো না এই গভীর জঙ্গলে মেয়ে কোথ থেকে আসবে! সে আবারো তার ভ্রম ভেবে ঢুকতে নিলেই মেয়েটি এসে তার হাতে খামচে ধরে তারই পেছনে লুকিয়ে পড়লো।
আদ্রিনের পা থেমে গেল। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সত্যিই কেউ একজন তার হাতে জোরে খামচে ধরে আছে। সে পেছন ফিরে মেয়েটির দিকে তাকাতেই দেখল এয়ারপোর্ট এর সেই মেয়েটি তার হাত খামচে ধরে চোখ-মুখ কুঁচকে বন্ধ করে আছে। মেয়েটিকে দেখে আদ্রিন মনে মনে ‘চাঁদ’ বলে আওড়ালো। মেয়েটি ওই অবস্থায় আদ্রিনকে সামনে তাকাতে ইশারা করলো। আদ্রিন মেয়েটির ইশারা-কৃত আঙ্গুল অনুযায়ী তাকিয়ে দেখলো দূরে একটা জন্তু দাঁড়িয়ে আছে। এবার আদ্রিন যা বোঝার বুঝে ফেলল। এসব জন্তুদের খপ্পরে পড়েছিল মেয়েটি। এই জন্তুগুলোর সামনে ভয় পেলে ওরা নিজেদের সাহসী ভেবে আরো হামলা চালায় কিন্তু উল্টো ভয় না পেয়ে হাতে শিকারীর কোনো কিছু নিলে পালাই। আদ্রিন আশেপাশে তাকিয়ে হাতে একটা গাছের ঝরা ডাল তুলে নিয়ে জন্তুটার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই জন্তুটি ফ্যাচ করে এক অদ্ভুত হুঙ্কার তুলে পিছনে ফিরে চলে গেল।

আদ্রিন হাত থেকে ডালটা ফেলে দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে নিলে মুনও আদ্রিনের পেছন পেছন আসতে নিলো। তা দেখে আদ্রিন ভ্রু কুঁচকালো যার মানে হচ্ছে -তুমি কই আসছো!

মুন আদ্রিনের প্রশ্নঃবোধক চাহনি দেখে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তাকিয়ে রইল আদ্রিনের দিকে।

-‘এখানে একটা মেয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি কেমন মানুষ! মেয়েটিকে এই গভীর জঙ্গলে ফেলেই ঢুকে যাচ্ছেন!’

আদ্রিন মুনের কথা শুনে তার দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তার ভাব-ভঙ্গিমা দেখে বুঝা যাচ্ছে সে মুনের কোনো কথায় বুঝেনি।

আদ্রিনের তাকানো ভঙ্গিমা দেখে মুন আবারো পুনরায় কথাটা বলল।

মুনকে এতো কথা বলতে দেখে আদ্রিন বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক শব্দ তুলে ইংরেজিতে বলে উঠল,
-‘হোয়াট?’

আদ্রিনের কথা শুনে মুনের হুশ ফিরে এলো। মুন যে এতক্ষন ভয়ে বাংলা ভাষা বলছে তা তার হুশে ছিল না। এই ইংলিশ ব্যাটা কোনোদিন আমাদের মতো মিষ্টি ভাষাটির কদর বুঝবে নি! কাকে কী বলছে মুন তা ভাবতেই মুন নিজের মাথায় হাত দিয়ে একটা তাপ্পর মারলো।

-‘তাপ্পরটা আরো জোরে দেওয়া উচিত।’ এই বলে হনহন করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল আদ্রিন।
মুন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল রাত ঘনিয়ে এসেছে। এখানে কোনো সিন্ক্রিয়েট করলে নিশ্চিত জঙ্গলের পশুগুলোর আজকের খাবার হবে মুন। তাই সেও আর কোনো কথা না বলে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।

বাড়িটা দোতলা। নিচতলায় একটা শোবার ঘর আরেকটা বসবার ঘর। দোতলাটা চিলেকোঠার মতো। একটি ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে একটু মাত্র ফাঁক দিয়ে দোতলায় উঠা হয় তা বুঝতে পারলো মুন। জানালাগুলো কাঁচের, অনেক সুন্দর। মুন বুঝতে পারলো, শুধুমাত্র দুইজন থাকার মতোই ঘরটা বানানো হয়েছে।
বসবার ঘরে আদ্রিন একটা টুলে পায়ের উপর পা তুলে লেপটপ নিয়ে মন দিয়ে কী যেন দেখছে। মুন এদিক ওদিক তাকিয়ে আর কাওকে না পেয়ে কেঁদে দিল।

মুনের নাক টানার শব্দ শুনে আদ্রিন লেপটপ থেকে চোখ তুলে ভ্রু-কুঁচকে একফলক ওর দিকে তাকিয়ে আবারো চোখ লেপটপে দিল।

-‘এটা কান্না করার জায়গা নই। কান্না করতে হলে উপরে গিয়ে করো।’

আদ্রিনের কথা শুনে মুন মেঝেতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে জোরে কেঁদে দিল।

আদ্রিন বসা থেকে উঠে মুনের সামনে এসে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।
-‘জঙ্গলে একা একা হাঁটার সাহস পেয়েছো আর এখন কেন কান্না করছো? কান্না থামাও বলছি। নাহলে এভাবে পাঁজা-কোলা করে ঘরের বাইরে ফেলে দিয়ে আসবো।’

আদ্রিনের মুখ থেকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসার কথা শুনে মুন সাথে সাথে কান্না থামিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলল তবুও মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠছে। সে অন্ততঃ এটুকু সময়ের মধ্যে বুঝে গিয়েছে- এই ইংলিশ ব্যাটাটা ভারী তেড়া।

মুন মেঝে থেকে উঠে গ্রাউনটা ভালোমতো ঝেড়ে নিলো। আদ্রিন আবারো আগের জায়গায় গিয়ে লেপটপের দিকে চোখ দিল। মুনের খারাপ লাগলো ভীষণ -এই ভেবে যে – তাকে পাত্তায় দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ছেলেটার সাথে মুনের অনেক আগে থেকে পরিচয় এবং ওদের মধ্যে সম্পর্ক সাপে-নেওরের মতো। মুন মনে মনে বিড়বিড় করে কিছু গালি দিয়ে নিলো সামনে বসা মানুষটাকে।

সে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই ওর আড়াআড়ি বরাবর একজন মধ্য-বয়সী বৃদ্ধকে কিছু রান্না করতে দেখলো। সে এগিয়ে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি
এক গাল হেসে ইংরেজিতে মুনের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আমি তুমি আসার পূর্ব-মুহূর্ত থেকে সবকিছু দেখেছি মা। সাহেবের কথায় কিচ্ছু মনে করিও না, উনি এমনই কিন্তু মানুষটা বড্ড ভালো। তা মা, তুমি এতো গভীর জঙ্গলে এই সময় এভাবে কেনই বা!’

মুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ চাচাটাকে শুরু থেকে একে একে সব বলল।
উনি সব বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।

মুন এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলতেই বৃদ্ধ বলে উঠল, এতো রাতে এই জঙ্গলটা ভয়ঙ্কর-অনেক ভয়ানক জন্তু চলাফেরা করে তাই এখন যাওয়া অনিরাপদ, কালকে সাহেব চলে যাওয়ার সময় মুনকে একসাথে নিয়ে যেতে বলবে।
মুন বৃদ্ধ চাচার কথায় মাথা নাড়ালো। মুন আর বাধ্য করলো না। এমনিও এই গভীর জঙ্গলে আজ এই ইংলিশ ব্যাটার কারণেই মুন বেঁচে গিয়েছে নাহলে মুনের এই গভীর জঙ্গলে কী হতো বা ওই জন্তুটা মুনকে কী করতো ভাবতেই গলার পানি শুকায় যাচ্ছে মুনের।

বৃদ্ধটি মুনকে কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই মুন উত্তর দিলো, সে ক্রান্ত-একটু ঘুমাবে। উনি হাতের ইশারায় মুনকে উপরের ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরটি দেখিয়ে দিল। মুন ধন্যবাদ জানিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়িগুলো বেয়ে উপরে উঠলো।
ছোট্ট একটি রুম। দুইপাশে দুইটা ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের জানালা। সেই কাঁচ দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে ঘরের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে। সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর একটা বাড়ি।
মুন ঘুমাতে নিলেই হঠাৎ ইরাদের কথা মনে পড়লো। সে তাড়াতাড়ি তার পরনে গ্রাউনটার উড়নার এক পাশে তাকালো। সন্ধ্যায় জন্তুটার জন্য দৌঁড়াতে গিয়ে তার মনে হলো মোবাইলটা যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় পড়ে যেতে পারে কিন্তু জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার ফলে বেঁচে থাকলে যোগাযোগের জন্য মোবাইলটা লাগবেই এই ভেবে তার পরনের উড়নার এক অংশ জুড়ে মোবাইলটা গিট দিয়েছিল। মুন উড়নার কোনার অংশটা সামনে এনে দেখল মোবাইল অক্ষত অবস্থায় আছে, পড়ে যায়নি। সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল একশোর উপর কল, সব কলই ইরা, রিকদের। মোবাইল সাইলেন্ট থাকার কারণে শুনতে পারেনি। হয়ত মুনকে না পেয়ে এতো কল দিয়েছিল, মুন ইরাকে কল দিতে নিবে সেইসময় দেখল ইরার নাম্বার থেকে আবারো কল। মুন কল রিসিভ করতেই ইরা এক নিঃশ্বাসে একের পরে এক কথা অনবরত বলতে থাকল। মুন ইরাকে থামতে বলে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সব বলার পরেই ইরা শান্ত হলো। ইরা বারেবারে মুনের এই বিষয়টাতে সে নিজেকেই দায়ী করতে লাগলো যা শুনে মুন রেগে ধমক দিতেই চুপ হলো। এরপর মুন মোবাইল রেখে ক্রান্তিতে চোখ বুজলো ঘুমের রাজ্যে।

হঠাৎ কোথাও থেকে একটা স্নিগ্ধ সুর ভেসে আসতেই মুনের ঘুম ভেঙে গেল। সুরটা নিচ থেকেই আসছে, মুনের কেন জানি মনে হলো এই সুরটা আরেকটু কাছ থেকে না শুনলেই নই। তাই সে ঘুম ঘুম চোখে চিলেকোঠার তক্তার মই পেরিয়ে কয়েকধাপ নিচে নামতেই দেখল ঘরের মেইন দরজা খোলা, সেই জায়গার কয়েক ধাপ সিঁড়ির মধ্যে আদ্রিন আগের-যুগের বেহালা নিয়ে বসেছে আর তার পাশেই বৃদ্ধ চাচাটি বসে আদ্রিনের সুর শুনছে খুব মনোযোগের সহিত। সুরটা উঠা-নামা করছে। রাতের অন্ধকারে গভীর নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে সুরটা। মুনের হঠাৎ করেই পরম শান্তি লাগছে। তার এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। আদ্রিনের একটু নড়াচড়া দেখতেই মুন মই বেয়ে চিলেকোঠায় উঠে গেল। এরপর শুয়ে পড়ল।

ঘুম আসছে না মুনের। শুয়ে শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ক্রিকের পানির কুল-কুল আর জঙ্গলের শুকনো পাতার ফিসফাস শুনলো মুন চোখ বুজে। তার মনে হচ্ছে জীবনে এর চাইতে শান্তির আর কিছু নেই। ভোর রাতে আবারো ঘুম ভেঙে গেল মুনের। এবার ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনে। কান পেতে শুনলো শব্দটা, মনে হচ্ছে ছোট ছোট পা ফেলে কারা যেন দৌড়ে-বেড়াচ্ছে ছাদের উপর। কীসের শব্দ এটা! বৃষ্টি! হঠাৎ মনে হলো বৃষ্টি পড়ছে। বহুদিন বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দ শুনেনি তাই ভুলেই গিয়েছিলো এরপর শব্দ শুনতে শুনতে আবারো ঘুমের দেশে পা বাড়াল মুন।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here