#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_২৩
সোহানের জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল। আধো চোখে আস্তে আস্তে তাকিয়ে রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিজের মাকে দেখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বেঁচে আছে সেটা ভেবে খুশিতে আত্নহারা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। সোহানের জ্ঞান ফিরে আসাতে সোহানের মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
দাঁড়ানো থেকে বেডের উপরে বসে মাথার চুলগুলো টেনে দিচ্ছে সোহানের। সোহানের শরীরটা ব্যাথায় জ্বলছে। চোখ যেনো ঝাপসা হয়ে এসেছে। সোহানের কপালে টপ করে পানির ফোটা পরছে। সোহান বুঝতে পারল এটা কোন পানি না তার মায়ের চোখের জল। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না সে। তবুও আবেগ ভরা কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল,
– মা জান্নাত কোথায়? ওকে তো দেখছি না। জান্নাত কী আসেনি? কিছুক্ষণ পরে সোহানের সেদিন রাতের সমস্ত ঘটনা মনে পরে গেল। বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠলে শোয়া ছেড়ে উঠে মাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল সোহান। কাঁদো কাঁদো হয়ে রাতের সমস্ত ঘটনা মাকে খুলে বলে।
কথা বলার সময়ে সোহান পুরোপুরি উত্তেজিত হয়ে যায়।
মা তাকে বহু কষ্টে থামিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে। সোহান মায়ের কোন কথা কানে লাগাচ্ছে না সে নিজের মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে। সোহানের কান্নার আওয়াজ শুনে সাথী ভিতরে আসল। সোহান সাথীকে দেখে আরও জোরে কাঁদতে লাগল। ভাইয়ের কান্না দেখে বোনের পরাণ যেনো বেরিয়ে যাচ্ছে। ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা নেই সাথীর। তবুও বলল, ভাইয়া এভাবে কাঁদলে কী হয় বলো? তাছাড়া পুরুষ লোকের কাঁদাটা শোভা পায় না। পরিস্থিতি যতই প্রতিকুলে থাকুক না কেন ধৈর্য ধরে মোকাবেলা করার মনমানসিকতা থাকতে হবে।
সাথীর কথা শোনার পরে সোহান মাকে বলল, মা জান্নাত কোথায়? ও কী আমাকে দেখতে আসেনি?
– “………..”
– ঠিকাছে তোমার বলা লাগবে না আমি নিজে জান্নাতকে কল করে জিজ্ঞেস করছি যে, আমাকে হসপিটালে দেখার জন্য কেন আসেনি? স্ত্রী হয়ে কীভাবে স্বামীর কাছে না এসে বাসায় একা একা বসে আছে। হুম এবার আসুক তাইলে ভালো করে বুঝিয়ে দিব এত অভিমাণ কীভাবে করে? কথা বলতে বলতে বালিশের পাশে নিজের মোবাইলটা দেখতে পেয়ে তারপর হাতে নিয়ে পাওয়ার অন করল। তখন মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তারিখের দিকে চোখ পরলে আৎকে উঠল সোহান। সোহানের মনে পরল সেদিন তো সোমবার ছিল অথচ আজ বৃহস্পতিবার। তার মানে মাঝে দুইদিন আমার জ্ঞান ছিল না। তাইলে এই দুইদিন আমি কোথায় ছিলাম? অনেকক্ষণ ভাবার পরে সোহান মাকে বলল, মা বলো না তো জান্নাত আসলো না কেন? আমাকে তুমি কোথায় পেলে? আমার তো কিছুই মনে পরছে না। আমি কেমন করে হসপিটালে আসলাম। ওই লোকটা তো আমাকে মেরে ফেলার কথা বলেছিল। কিন্তু আমার মাথায় এটা কাজ করছে না আমাকে ওরা কেন মারতে চেয়েছিল?
– সোহান তুই শান্ত হও বাবা তোকে তো রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার উপরে একজন পথচারি পেয়ে হসপিটালে এডমিট করে। তোকে যখন হসপিটালে আনা হয় তখন তোর বন্ধু রবিন তোকে দেখতে পেয়ে সাথে সাথে আমাকে ইনফম করে। রবিনের কল পেয়ে আমরা ছুটে আসি হসপিটালে। দুইদিন তোর কোন হুশ ছিল না। ডাক্তার বলেছিলেন যদি জ্ঞান না ফেরে তাইলে তুই কোমায়ও চলে যেতে পারিস। খুব ভয় পেয়েছিলাম আর আল্লাহর কাছে একটাই ফরিয়াদ করেছিলাম যেনো আমার বুক থেকে তোকে কেড়ে না নেয়। আল্লাহ আমার দোয়ার কবুল করেছেন তাই তার দরবারে লক্ষ লক্ষ শুকরিয়া জানাই। সোহান এবার আর শুয়ে থাকল না নামার জন্য পা বাড়তে গেলে সাথী বাঁধ সাধল।
– ভাইয়া তুমি নামছ কেন? শুয়ে থাকো। ডাক্তার তোমাকে পুরো একমাস বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। তোমার শরীর থেকে এতটাই রক্ত পরেছে সেটা পরিমাপ করা যাবে না।
সোহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সাথীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
– জান্নাত আমাকে দেখতে আসলো না কেন? ও সুস্থ আছে তো?
সাথী সোহানের হাত ধরে কাঁদো স্বরে বলল,
– ভাইয়া, ভা,,,,,,,গলাটা যেনো আটকে আসছে সাথীর।
সাথীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কাঁদছিস কেন বোন কী হয়েছে?
– ভা….ভাবী তো আজকে সকালে চলে গেছে।
– জান্নাত চলে গেছে মানে? কী বলছিস এসব? জান্নাত কোথায় গেছে?
মা সাথী এসব কী বলছে জান্নাত কোথায় চলে গেছে?
– সাথী ঠিকি বলেছে জান্নাত তার বাবার বাসায় চলে গেছে। সেখানে গিয়ে কিছুদিন পর তোকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।
– মা তুমি এসব কী বলছ? জান্নাত আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে না। তুমি বলো মা তুমি যা বললে সব মিথ্যা বলেছ?
– আমি কোন মিথ্যা বলছি না। জান্নাত আজকে সকালের বাসে করে বাবার বাসায় চলে গেছে। যাওয়ার আগে খুব করে কেঁদেছে। তবে জান্নাত যা করেছে ভালোই করেছে। তোর মতো কুলাঙ্গারের সাথে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো। জান্নাতের জায়গায় আমি থাকতে আরও আগেই চলে যেতাম।
আমার এখন খুব ঘৃণা লাগছে এটা ভেবে যে আমার পেটে তোর মতো সন্তানের জন্ম হয়েছে বলে। জান্নাত যাওয়ার সময় তোর সমস্ত কুকর্মের কথা বলে গেছে। ছিঃ আমার তো ভাবতেও লজ্জা লাগছে তুই এমন জঘন্য কাজ করতে পারিস! তুই আমার এতদিনের সমস্ত বিশ্বাস ধুলোয়া মিটিয়ে দিছিস।
মায়ের কথা শুনে সোহানের চোখ কপালে উঠল। সোহান কল্পনাও করতে পারেনি জান্নাত সব কিছু এভাবে বলে দিয়ে হুট করে বাবার বাসায় চলে যাবে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে জান্নাতের নাম্বারে কল দিবে তখনি মা বলে উঠল কাকে কল দিবি জান্নাতকে?
কোন লাভ নেই কল করে জান্নাত এক কাপড়ে চলে গেছে। সাথে করে তোর দেওয়া একটা সুতাও নেয়নি মেয়েটা। জান্নাতের মতো মেয়ে যদি তোর সংসার করতে না পারে তাইলে এমন কোন মেয়ে হয়নি যে তোর মতো বদমেজাজি, রাগি স্বামীর ঘর করবে। কয়েক মাসের সংসারে জান্নাত নিজেকে এতটা গুছিয়ে নিবে যেটা আমি ভাবতেও পারিনি।
মায়ের কথা শুনে পানিতে চোখ টলটল করছে। নিজেকে এখন খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জান্নাতের চলে যাওয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সোহান।
জান্নাত মাত্র তার বাবার বাসায় চলে আসে। সারা রাস্তায় শুধু নিরবে চোখের পানি পড়েছে জান্নাতের।
অটোরিকশা এসে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
– ভাবি এসে গেছি।
রাসেল ভাইয়ের কথা শুনে ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে রিক্সা থেকে নামল জান্নাত।
– ধন্যবাদ রাসেল ভাই। এতটা কষ্ট করে এত রোদের ভেতরে বাসায় দিয়ে যাওয়ার জন্য।
– কী যে বলেন না ভাবী? এসব ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যান ঘরে গিয়ে রেস্ট নিন।
– হুম।
চারিদিকে যোহরের আজান শোনা যাচ্ছে তখনি দরজায় ধাক্কা দিল জান্নাত।
– আসছি (জান্নাতের মা সখিনা বেগম)
– এত দুপুরবেলা কে এলো আবার। (শিরিন)
– সেটাই তো। (সখিনা বেগম)
– দেখো তো চাচি কে এসেছে। আমি এখন গোসলে যাবো। (শিরিন)
– ঠিকাছে তুই যা আমি দেখছি কে এসেছে।
– আচ্ছা চাচি।
দরজা খোলার পরে জান্নাতকে দেখে সখিনা বেগম তো অবাক। জান্নাতকে এইভাবে দেখে তিনি পুরো অবাক হয়ে যায়। জান্নাতকে পুরো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। এমনভাবে জান্নাতকে দেখবে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি।
– মা তুই! তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আসার আগে একটা কল করে তো বলতে পারতি? এতটা পর করে দিবি কল্পনাও করতে পারিনি।
জান্নাতের বাবা জাহিদুল সাহেব দৌঁড়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। মেয়েকে এভাবে ভরদুপুরে একা দেখে এদিক ওদিক চোখ বুলালো।
– জান্নাত তুই কী একা এসেছিস? জামাই কোথায়? (জাহিদুল সাহেব)
– ভেতরে আসতে বলবা না বাবা। ( জান্নাত)
– আয় মা ভেতরে আয়।
– জান্নাত তোর এ কী হাল করেছিস? মুখের দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না। একা একা আসলি যে জামাই বাবা আসেনি?
– না বাবা, সোহান আর কখনও আসবে না বাবা।
কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরে জান্নাত। তারপর হুট করে মাটিতে বসে পরে।
– কী সব পাগলের মতো বলছিস? জামাই আসবে না মানে কী? তুই কী রাগ করে চলে এসেছিস?( সখিনা বেগম)
– ও মা, মাগো আমি সোহানের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য চলে এসেছি। তার সাথে এক ছাদের নিচে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব না। এতদিন অনেক সহ্য করেছি কিন্তু আর পারছিলাম না বলে চলে এসেছি। মাগো আমি আজকে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
মেয়ের বুকফাটা আর্তনাদ দেখে সখিনা বেগম অসুস্থ হয়ে পরে। মেয়ের এমন কান্না দেখে জাহিদুল সাহেব ফ্লোরে মেয়ের পাশে বসে পরল।
মেয়েকে কোন রকমে শান্ত করে নিজের রুমে নিয়ে যায় সখিনা বেগম। জাহিদুল সাহেবও মেয়ের পিছু পিছু যায়। রুমে গেলে শিরিন দৌঁড়ে আসে। জান্নাতকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জান্নাত শিরিনকে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগল।
অনেকক্ষণ কাঁদার পরে বিবাহিত জীবনের ঘটনা সবাইকে খুলে বলল জান্নাত।
মেয়ের কান্না দেখে কেউ ঠিক থাকতে পারল না।
#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_২৪
জান্নাতের বাবা বরাবরই শান্ত স্বভাবের। যেকোন খারাপ সংবাদে অতি সহজে ভেঙে পরে না। তবুও আজ কেন জানি তার ভীষণ খারাপ লাগছে। যতই হোক নিজের মেয়ের সংসার ভাঙার কথা কোন বাবার পক্ষে মেনে নেওয়া এতটা সোজা নয়। নিজেকে খুব করে সামলে নিয়ে জান্নাতের মাথায় হাত রেখে বলল,
– জান্নাত তুই যদি চাস তাইলে আমি নিজে গিয়ে জামাই বাবার সাথে কথা বলে দেখি সম্পর্কটা জোরা লাগানো যায় কিনা! তোদের ভেতরে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটা দূর করে আবারও নতুন করে ভাঙা সংসার জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে দেখতে পারি।
– না বাবা আমি চাই না তুমি আমার কারণে সোহানের কাছে দেখা করে কথা বলো। যার প্রতি একবার ঘৃণা জন্ম নেয় আর যাই হোক সেটা আর কোনদিন ভালোবাসায় পরিবর্তন হয় না।
– তাই বলে এভাবে সব কিছু শেষ হয়ে যেতে দেখব? তুই এত সহজে ওকে ছেড়ে দিবি।
– এমনি ছাড়তে হবে ওদের অনেক টাকা বাবা। টাকার অহংকারে কাউকে মূল্য দিতে জানে না। বিশেষ করে সোহান।
আমি অনেক টিকে থাকার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি বাবা। তাই জীবন যুদ্ধে হার মেনে নিরবে চলে এলাম। যার কাছে আমার কোন মূল্য নেই তার কাছে সারাজীবন থেকে কী হবে বাবা?
তোমাদের কাছে আমার খুব করে জানতে ইচ্ছে করে কী কারণে আমার জীবনটা এভাবে নরক বানিয়ে দিলে? আমি কী তোমাদের কাছে খুব বড় বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম? আমার বেশি ভালো করতে গিয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সূচনাটা তোমরাই করেছ। মাঝে মাঝে ভাবতাম এত বড়লোক পরিবারে আমাকে বিয়ে না দিয়ে যদি রিক্সাওয়ার সাথে বিয়ে দিতে তবুও স্ত্রীর সম্মানটুকু অন্ততপক্ষে পেতাম। মা- বাবার কাছে মেয়েরা হল একটা বোঝা যেটা তোমরা আবারও প্রমাণ করেছ।
– এখন কী করবি জান্নাত? ( সখিনা বেগম)
– কী আর করব উপযুক্ত সময়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিব।
– তাইলে তোর কী হবে মা?
– কী হবে আবার? কষ্ট হবে! জীবনটাই একটা কষ্টের জায়গা তাই কষ্ট ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না।
– কিন্তু মা, স্বামী ছাড়া এত অল্প বয়সি মেয়ে একা থাকাটাকে তো এই সমাজ মেনে নিতে চাইবে না। সবাই তো পিছনে বসে টিপাটিপি করবে আর হাসবে।
– মা তোমাদের একটা কথা বলি, আমাকে নিয়ে যদি তোমাদের কোন সমস্যা হয়ে থাকে তাইলে বলতে পার আমি চলে যাব। দুনিয়াটা অনেক বড় কোথাও না কোথাও থাকার জন্য একটু ঠাঁই হয়ে যাবে।
– কীসব বলছিস এসব? তোর বাপ মা কী মরে গেছে নাকি যে তোকে তাড়িয়ে দিবে?
– না মা তোমরা মরে যাবে কেন? দোয়া করি আল্লাহ তোমাদের নেক হায়াত দাণ করুক।
জান্নাতের কথায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মেয়ের কথায় যুক্তি আছে কিন্তু এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। জান্নাত তুই ফ্রেশ হয়ে আয় একসাথে খাব।
জান্নাত ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি দিয়ে বসা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকল। একটুপরে বেরিয়ে এসে দেখে মা এখনো রুমে পায়চারি করছে।
মাকে দেখে পিছন থেকে জরিয়ে ধরে বলল,
– তুমি এখানে কী করছ? খেতে চল! খুব খিদে পেয়েছে।
– হুম চল। আজ আমি তোকে নিজের হাতে দিব।
মায়ের সাথে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখে সবাই টেবিলে অপেক্ষা করছে। জান্নাতের কেমন জানি লজ্জা লাগছে।
তার জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে সেটা সে কখনও ভাবতেও পারেনি।
টেবিলের কাছে গেলে শিরিন চেয়ার টেনে বলল, এখানে বোস, অনেকদিন একসাথে খাই না।
জান্নাত চেয়ারে বসল। ভাবছে সবাই কী তার দিকে করুনার চোখে দেখছে নাকি স্বাভাবিকভাবে। কিছু বুঝতে পারছে না কারণ সবাই এখন ভীষণ চিন্তিত তাই এই মূহুর্তে কিছুই বলা বা বুঝা যায় না।
খাওয়া- দাওয়া শেষ করে রুমে গেল জান্নাত।
রাতে সখিনা বেগম রুমে আসল। জান্নাত বিছানার সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। মাকে দেখে শোয়া ছেড়ে বসল।
– জান্নাত তুই এখনো সজাগ আছিস যে? এখনো ঘুমাসনি কেন?
– ঘুম যে আসছে না মা।
– ঘুম আবার না এসে পারে?
– তুমি এদিকে আসো, আমি একটু তোমার কোলে শুই। অনেকদিন হলো শুই না।
– আয় মা আয়। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি যাতে তোর ঘুম চলে আসে। অনেক রাত হয়েছে এখন না ঘুমালে শরীর খারাপ লাগবে।
– অনেক রাত নির্ঘুমভাবে কাটিয়েছি মা। প্রথম প্রথম শরীরটা খারাপ লাগত। ঘুমানোর জন্য শরীরটা শুধু বিছানা খুঁজত কিন্তু এখন আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি তাই এখন রাতে না ঘুমালেও শরীর খারাপ লাগে না।
মেয়ের এমন কথা শুনে বুক ফেটে কান্না আসছে সখিনা বেগমের। সাথে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে, সেদিন এই বিয়েতে যখন জান্নাতের মত ছিল না তখন আরেকটু খোঁজ খবর নিলে হয়তোবা আজকে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হতো না। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখ পরল জান্নাতের পিঠের উপরে। ফর্সা পিঠে দাগ পরে আছে।
– জান্নাত তোর পিঠে এসব কিসের দাগ? কী হয়েছে এখানে?
– কিছু হয়নি মা। কপালে যা লেখা ছিল তাই হয়েছে.।
– জামাই তোর গায়ে হাত তুলেছে। এভাবে কুকুর বিড়ালের মতো মেরেছে। জান্নাত তুই আসার পরে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম এটা ভেবে হয়তো জামাইয়ের সাথে রাগ করে চলে এসেছিস এই কারণে। তোর যে রাগ তাতে করে তুই চলে আসতেই পারিস কিন্তু এখন বুঝতে পারছি তুই এসেছিস ভালোই করেছিস ওর মতো ছোটলোকের সংসার করার চেয়ে না করাই ভালো।
কী এমন হলো যে জামাই এতটা নিচে নামল? আমার তো বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।
– তুমি আমার মা হও তাই তোমাকে কী করে সোহানের কার্যকলাপের কথা বলব বুঝতে পারছি না। তবুও বললাম, মা যখন একজন পুরুষ মানুষের টাকার অহংকারে মাটিতে পা রাখতে পারে না সে আর যা হোক কাউকে মূল্য দেয় না।
– জান্নাত এখন ঘুমানোর চেষ্টা কর আমি তোর পাশে আজকে ঘুমাব।
– ঘুমাও মা তাইলে তো ভালোই হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে জান্নাত ঘুমের মাঝে তলিয়ে যায়। অনেকদিন পরে আজকে মায়ের পাশে শান্তিতে ঘুমাতে পারছে।
পরেরদিন সোহান বাসায় ফিরে আসে। শরীর ভীষণ উইক। ডাক্তার একদম চিন্তা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সোহান। এসিটা চলছে তবুও পুরো দমে ঘামছে। রুমের চারদিকে হাত বুলিয়ে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে। সোজা হয়ে হাতটা চোখের উপরে দিয়ে শুয়ে পরল। সোহানের মাথায় শুধু জান্নাতের কথা ঘুরছে।
হঠাৎ করে ঘুমের ভেতরে জান্নাত বলে চিৎকার দিয়ে উঠল সোহান। জান্নাতের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে পরে মূহুর্তেই মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে টাওয়াল দিয়ে ভালো করে মুখ মুছল সোহান। বিছানার পাশে জান্নাতের শাড়ি পরে আছে। বেচারি যাওয়ার সময় কিছুই নেয়নি।
চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে সোহানের। সেদিন রাতের কথাগুলো মনে পরে সোহানের ভীষণ খারাপ লাগছে কী মার টাই না মারল জান্নাতকে। জান্নাতের চলে যাওয়াতে সোহান খুব ছটফট করছে মনে হচ্ছে বুকের উপরে কে যেনো বিশাল বড় একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে যার ভার সহ্য করতে পারছে না।
সোহান মাকে ডাক দিলে সাথী দৌড়ে আসে।
– ভাইয়া তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সোহান বলল,
– আমার শরীর খারাপের চেয়ে মনের দিকটা ভীষণ খারাপ। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। জান্নাতের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না।
– ভাইয়া একটা কথা বলব, যদি তুমি অনুমিত দাও।
– হুম বল।
– তুমি এভাবে কষ্ট না পেয়ে ভাবীকে গিয়ে নিয়ে আসো। তোমার ভুলের জন্য ক্ষমা চাও দেখবে ভাবি অভিমাণ করে থাকতে পারবে না।
চলবে……….
চলবে……..