#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০৪
#Eshika_Khanom
আয়াত তখনই আদ্রাফের কথার মাঝে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল,
“আমি বাবার সাথে দেখা করবো!”
আদ্রাফ সরু চোখে আয়াতের দিকে তাকালো। মেয়েটাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে হাজারো চিন্তা মাথায় খেলছে তার। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। আদ্রাফ দুষ্টুমি স্বরে বলল,
“যদি যেতে না দেই?”
আয়াত আদ্রাফের কাছে থেকে এই উত্তর আশা করেনি। মুখ ভার করে নিল সে। কোথা থেকে যেন আদ্রাফের প্রতি কিছু অভিমান এসে ভর করল আয়াতের মনের মধ্যে। আদ্রাফ কিছুটা আন্দাজ করল বিষয়টি।
আদ্রাফ মুচকি হেসে আয়াতের বরাবর দাঁড়ালো। আলতো করে স্পর্শ করল আয়াতের কপোলদ্বয়। মৃদু কেঁপে উঠলো আয়াত এক শীতল স্পর্শে। আদ্রাফ বলতে লাগলো,
“তুমি যদি হও অভিমান
আমি হব বৃষ্টি
ভিজিয়ে দিব তোমার কষ্ট যত,
বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটায় অনুভব করবে আমার মনে আছে ভালোবাসা যত।”
আয়াত বিস্ময়ের সহিত তাকালো আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফের এই আলতো স্পর্শে ইতস্তত করতে থাকলো। আদ্রাফের বুঝতে পারলো আয়াতের অস্বস্তির কারণ। দূরত্ব বাড়িয়ে দিল নিজেদের মধ্যে।
মাথা আরও নিচু করে নিল আয়াত। আদ্রাফ বললো,
“আজকেই নিয়ে যাব তোমায়, রেডি হয়ে থেকো বিকেলে।”
এক চিলতে হাঁসি ফুটে উঠলো আয়াতের গালে। টোল পড়ল গালের এক কোণে। আদ্রাফের চোখ এড়ালো না দৃশ্যটি। অন্তরে গেঁথে গেল সেই স্নিগ্ধ মূহুর্ত। আয়াত বলল,
“আজ সত্যি যাব? কখন?”
আদ্রাফ বললো, “বিকেলে ইনশাআল্লাহ।”
আয়াত খুশি হয়ে তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে আদ্রাফকে জড়িয়ে ধরতে নিল। ঠিক জড়িয়ে ধরতে যাবে তখনই খেয়াল হলো সে কি করতে যাচ্ছিল। নিজেকে দমিয়ে নিল সে। আদ্রাফ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আয়াত পড়লো এক অস্বস্তিকর অবস্থায়। ছুটে পালাতে মন চাইলো তার। আদ্রাফ বললো,”সময়মতো তৈরি থেকো কিন্তু।”
আয়াত বলল, “হুম।”
আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না আয়াত। দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল সে। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল। লজ্জার গুটিয়ে নিল নিজেকে।
অপরদিকে আদ্রাফ ফোন বের করে কল দিল নুহাশকে। নুহাশ সাথে সাথেই রিসিভ করল। বলল,
“কি ভাই? আমায় তলব যে?”
আদ্রাফ বলল,”শোননা।”
নুহাশ বলল, “বলনা।”
আদ্রাফ বলল, “আমি না আজ তোর সাথে দেখা করতে পারবো না।”
নুহাশ অপরপাশ থেকে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল, “কেন?”
আদ্রাফ বলল, “জরুরী কাজ আছে ভাই।”
নুহাশ প্রশ্ন করল, “কি কাজ?”
আদ্রাফ বলল, “এমনি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।”
নুহাশ রেগে বলল, “বলা যায় না?”
আদ্রাফ বলল, “আসলে একটা জায়গায় যাব।”
নুহাশ বলল, “গার্লফ্রেন্ড নিয়ে? লং ড্রাইভ নাকি আদ্রাফ? কিরে আগে বলিস নাই তো।”
আদ্রাফ বলল, “আর লং ড্রাইভ? কাজ আছে ভাই।”
নুহাশ বলল, “বুঝি বুঝি কি কাজ আমি বুঝি আদ্রাফ৷
আদ্রাফ বিরক্তি নিয়ে বলল, ” ধুর!”
নুহাশ হেসে বলল, “মেয়েদের মতো লজ্জা পাস কেন?”
আদ্রাফ বলল, “ফোন রাখলাম। আল্লাহ হাফিজ। ”
নুহাশ পকেটে হাত গুজে বলল, “খোদা হাফিজ।”
.
.
.
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। সাথে নিজেদের গন্তব্যে চলছে আয়াত আর আদ্রাফ। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন ড্রাইভার। পিছনে বসে আহ আয়াত আর আদ্রাফ। দুইজনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে বেশখানিক। গাড়িতে নীরবতা বিরাজমান। প্রত্যেকে যেন আলাদা আলাদা গ্রহের প্রাণী। আয়াত জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রয়েছে, আর আদ্রাফ তাকিয়ে রয়েছে আয়াতের দিকে। দুইজন ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য দেখতেই ব্যস্ত। সময়ের সাথে সাথে তারা পৌছে গেল আয়াতের বাবার বাড়িতে। তবে বাবার বাড়ির চেয়ে আয়াতের সৎ মায়ের বাড়ি বলাই বেশ ভালো। গন্তব্যে পৌছে গাড়ি থেকে নেমে গেল দুইজন। আয়াত স্থির হয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল, আর নড়লো না বিন্দুমাত্র। আদ্রাফ পিছনে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছিল। তার মধ্যেই সে আয়াতকে ডাক দিয়ে বলল,
“আয়াত তুমি ভিতরে যাও, আমি একটু কথা বলে আসছি।”
আয়াত পিছে ঘুরিয়ে সম্মতি জানিয়ে বাড়ির মেইন গেটের দিকে হাঁটা ধরল। দরজার সামনে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার কলিংবেল বাজালো। ভিতর থেকে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কে?”
আয়াত কিছু উত্তরে বলতে চাইলেও গলায় সব দলা পাকিয়ে আসলো। পরিচয় দিতে পারলো না যে কে সে? দরকার লুকিং গ্লাস দিয়ে বাড়ির কাজের লোক টুম্পা দেখলো আয়াত এসেছে। সে দরজা খুলে খুশিমনে এক চওড়া হাসি নিয়ে প্রশ্ন করল,
“কেমন আছেন গো আপামনি?”
আয়াত ধীরে বলল, “হুম ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তুই? ”
টুম্পা বলল, “আমি ভালা আছি বেশ আপামনি। ভিতরে আসেন, ভিতরে।”
টুম্পা আয়াতকে ভিতরে ডেকে জোরে জোরে আয়াতের সৎমাকে ডাকতে থাকে,
“ও খালা আয়াত আপামনি আসছে, আয়াত আপামনি আসছে।”
টুম্পার ডাক শুনে ঘরের ভিতর থেকে আয়াতের বাবার চোখে এক খুশির রেশ ফুটে উঠে। মুখ বাঁকিয়ে ফেলেন রাহেলা। চুলটায় খোপা বেধে বাহিরে বেরিয়ে আসেন। আয়াতকে দেখে একটু উঁকিঝুঁকি মারেন তার চারপাশে। তারপর বিলাপ করতে লাগলেন,
“হায় হায় হায়, মাইয়া তুই একদিনও সংসার করতে পারলি না? জামাই ভাগায়ই দিল তোরে।”
আয়াতের চোখে মুখে থেকে রাগ যে উপচে পড়ছে। তবুও সে নিজের রাগ সংযত করে বলল,
” বাবা কোথায়?”
তিনি বললেন, “ও মুখপুড়ী এখন বাবাকে ইশারা দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ঘাড়ে চাপবি? তা হবেনা।
এরপর আয়াতের সৎ মা রাহেলা আউয়াতের বাহু ধরে বলল,
“তুই দূর হ আমার বাড়ি থেকে।”
আয়াত আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। বাহু ঝাকিয়ে নিজেকে রাহেলার কাছে থেকে ছাড়িয়ে নিল সে। রাহেলাকে বলল,
“কি বললে তোমার বাড়ি? হ্যাঁ অবশ্য বাড়িটাকে তো দোযখ খানার মতোই বানিয়ে রেখেছ। এবং দোযখখানা তোমার বাড়ি হিসেবে উপযুক্ত।”
রাহেলা হতভম্ব হয়ে গেলেন আয়াতের আচরণে। শান্তশিষ্ট মেয়েটার এমন অগ্নিমূর্তি তিনি প্রথম দেখলেন। আয়াত টুম্পাকে প্রশ্ন করল,
“বাবা কই টুম্পা।”
টুম্পা ভয়ার্ত চোখে বলল, “খালু নিজের ঘরে আপামনি।”
আয়াত আর কিছু তোয়াক্কা না করে রাহেলার পাশ কাটিয়ে চলে গেল বাবার রুমে। পিছন থেকে আয়াতকে পর্যবেক্ষণ করছিল আদ্রাফ। মেইন গেট টুম্পা আর লাগায়নি বলে ঘরের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ বাহিরে থেকে শুনা যাচ্ছিল। আর তাই আদ্রাফ জলদি ঘরের মধ্যে চলে আসে। এসে প্রথমে যেমন রাহেলার আচরণে তার রাগ উঠছিল তেমনই পরবর্তীতে আয়াতের প্রতিবাদ করাটা দেখে বেশ খুশি হল আদ্রাফ। আদ্রাফ সোজা রাহেলার সামনে এসে বলল,
” আদ্রাফের মৃত্যুর পরও আয়াতের গায়ে কেউ কোনো আঁচ দিতে পারবেনা। আর আয়াতকে তাড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য আদ্রাফের নেই।”
রাহেলা বললেন, “তা তুমি মরবা কবে তা তো হয়তো জানি, এই আয়াতরে কবে নিয়া মরবা?”
আদ্রাফ বিনিময়ে শুধুই একটা হাসি দিল। রাহেলা আদ্রাফের হাসির বিনিময়ে আদ্রাফকে আয়াতের বাবার রুম দেখিয়ে দিল। তারপর আদ্রাফ চলল আয়াতের বাবার ঘরে। সেখানে আয়াত বসে আছে তার বাবার কোলে মাথা রেখে। আয়াতের বাবা পরম আয়েশে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। পৃথিবীর খুবই সুন্দর দৃশ্য যেন এটি। আদ্রাফ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলো বাবা মেয়ের ভালোবাসা। আয়াত তার বাবার কোলে মাথা গুজে চোখ বন্ধ করে আছে। আদ্রাফকে দেখতে পেলেন আয়াতের বাবা। তখনই তিনি মোচড়া মোচড়ি শুরু করে দিলেন। চমকে উঠলো আয়াত, ঠাওড় করতে পারলো না বাবার এই অস্বস্তির কারণ। আয়াতের বাবা একদৃষ্টে আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হাঁসফাঁস শুরু করে দিয়েছেন তিনি। আয়াত উঠে বসে বাবার গাল ধরে বলল,
“বাবা কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছ কেন??”
তবে বিনিময়ে আর উত্তর পেল না আয়াত।
#চলবে
[