হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব -০৫

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

সকালের সোনালী রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলিয়ে ধারার মুখে পড়তেই ধারার ঘুম ভেঙে গেল। ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখজোড়া খুলতেই লাফিয়ে উঠলো। অনেক বেলা হয়ে গেছে! এতক্ষণ কিভাবে ঘুমিয়ে রইলো সে? ঝটপট বিছানা থেকে নেমে মাথার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে বেড়িয়ে দেখলো বাড়িতে কেউ নেই। উঠোনের কোণায় চোখে পড়লো শুদ্ধকে। একটা নাম না জানা গাছের চারা নিয়ে কি যেন করছে সে। শুদ্ধদের বাড়ির সামনেই একটু বা দিকে মাটির রান্নাঘর। রান্নাঘরের সামনেই টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া ডিপ কলের গোসলখানা। এর পর থেকে পাশের বাড়িগুলোর সীমানা শুরু। ডান দিকে বড় বড় মেহগনি গাছ দাঁড়িয়ে জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। তারপরেই স্বচ্ছ পানির পুকুর। শুদ্ধ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ধারা একবার রান্নাঘরের ভেতর উঁকি দিল। শুদ্ধ নিজের কাজে মগ্ন থেকেই বলল, ‘আম্মা গেছে পাশের বাড়ি। চুমকি গেছে স্কুলে। পাবেন না কাউকে এখন।’

ধারা একটু থতমত খেয়ে গেলো। এই লোকটার কি কোনভাবে মানুষের মন পড়ে ফেলার ক্ষমতা আছে? ধারা যখনই যা ভাবে সবটা কিভাবে ঠিকঠাকই বলে দেয়! ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ ধারাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে চলে গেল। ফিরে এলো একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। ধারার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এর মধ্যে দুটো থ্রি পিছ আছে। শাড়ি পড়ায় যেহেতু অভ্যস্ত নন পড়তে হবে না।’

ধারা এবারও অবাক হলো। সারাক্ষণ শাড়ি পড়ে থাকতে তার সত্যিই অসুবিধা লাগছিল। বিয়ের আগে তো তেমন পড়া হয়নি। কিন্তু এই কথাটা তো সে কাউকে বলেনি। তাহলে জানলো কি করে?

শুদ্ধ বলে উঠলো, ‘শাড়ি পড়ে যেভাবে হাঁটেন দেখলেই বোঝা যায়। এটা মুখ ফুটে বলতে হয় না।’

ধারা এবার সাংঘাতিক চমকে উঠে ব্যাগটা ধরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। এই লোকটার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। এ তো দেখছি সে যা ভাবে সবই ধরে ফেলে। শুদ্ধ চলে যেতে নিয়েও আবার দাঁড়িয়ে ধারাকে বলল, ‘গোসলখানা এদিকে। সাবধানে যাবেন। দেখবেন, আবার অজ্ঞান হয়ে যান না যেন! আপনি তো আবার কথায় কথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কুকুর দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারপর আবার আমাকে আপনার শাড়ি পাল্টে দিতে হবে আর আপনি জ্ঞান ফিরে আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো এক্সপ্রেশন দিবেন।’

শুদ্ধ চলে যেতে নিল। ধারা ঝট করে ঘুরে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। এই লোকটা এমন কেন? ধারা এখন ভালো মতই জানে সেদিন রাতে শুদ্ধ তার শাড়ি পাল্টায়নি। তবুও এখনও এমন ভাবে বলছে যেন সেই করেছে। ধারা দ্রুত বলে উঠল,
‘আমি জানি আপনি সেদিন আমার শাড়ি পাল্টাননি। চুমকি বলেছে।’

শুদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছনে ধারার দিকে ঘুরে ঠোঁটের রেখা প্রসারিত করে মৃদু হাসির ঝলক তুলে বলল,
‘বাহ! আপনাকে কেউ বলল আর আপনি সত্যিই নিজের থেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছেন! অবিশ্বাস্য! না মানে এইবার আপনাকে কেউ বলে দেয়নি যে এটা বিশ্বাস যায় কি করা যায় না? একা একাই বিশ্বাস করে ফেললেন? ইমপ্রেসিভ!’

শুদ্ধ চলে গেল। আর সেদিকে তাকিয়ে ধারা সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। দু তিন বাক্যের একটা কথাতেও ধারাকে কয়বার ঠান্ডা ভাবে খোঁচা মেরে দিল লোকটা। খোঁচা মারার একটা সুযোগও ছাড়তে চায় না। খোঁচা মারার রাজা যেন! এর নাম শুদ্ধ না রেখে খোঁচারাজ রাখা উচিত ছিল। ধারা বিরবির করে বলে উঠলো, ‘খোঁচারাজ!’

একটু পর ধারা শুদ্ধ’র দেওয়া একটা থ্রি পিছ পরিধেয় করে আরেকটা থ্রি পিছ আর গামছা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। সকালে উঠার পর থেকেই কেমন যেন ভ্যাবসা গরম লাগছে। ভাবলো গোসলটা তাড়াতাড়িই করে নেয়া যাক! কিন্তু গোসলখানার সামনে যেতেই ধারা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। গ্রামের বাড়ির কল। বেড়ার গায়ে দরজায় শুধু একটা কাপড়ের পর্দা ঝুলানো। বাড়ির আশেপাশের মানুষ জন একটু পরপরই এই আসছে আর যাচ্ছে। কেউ খাবার পানি নিতে আসে, কেউ জামা কাপড় ধুতে আসে। ধারার ভীষণ সঙ্কোচ হতে লাগলো৷ গ্রামে হলেও ওদের নিজেদের বাড়িটা পাকা দালানের। ঘরের মধ্যেই পাকা বাথরুম, গোসলখানা। ছোট বেলা থেকেই তাই ব্যবহার করে আসছে সে। এখন হঠাৎ করে এমন খোলা গোসলখানায় গোসল করতে ধারার কেমন যেন লাগছে। গোসল করার সময় যদি কেউ এসে পড়ে! গ্রামের মহিলাদের কাছে এসব তো আবার কোনও ব্যাপারও না। এরা একজনের গোসলের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে। যদিও মেয়েরা মেয়েরাই। তবুও ধারার তো অভ্যেস নেই এসবের। ও’র ভীষণ অস্বস্তি হয়। শুদ্ধ বাড়ির পাশে ঐ চারাটা লাগিয়ে ক্ষেতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ধারাকে এভাবে কলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো কিছু বুঝতে পারলো। ক্ষেতে যাওয়া বাদ দিয়ে তাই সে ধারার কাছে এসে বলল,
‘ধারা, কোন সমস্যা?’

হঠাৎ শুদ্ধ’র কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ধারা খানিকটা চমকে উঠলো। তাকিয়ে বলল,
‘না। কিছু না।’

শুদ্ধ একবার গোসল খানার দিকে তাকিয়ে কিছু ভেবে বলল, ‘আপনার ওড়নাটা দেখি, দিন তো।’

ধারা ও’র গায়ের ওড়নাটা হাত দিয়ে চেঁপে ধরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘কি?’

ধারা কি ভেবেছে বুঝতে পেরে শুদ্ধও একটু লজ্জাবোধ করে দ্রুত বলল, ‘আরে! আপনার হাতের ওড়নাটার কথা বলেছি। যেটা গোসলের পর পড়বেন। গায়ের ওড়নার কথা বলিনি।’

ধারা ভীষণ লজ্জা পেলো। আনত মুখে হাতের সুতি ওড়না টা শুদ্ধ’র হাতে দিল। ওড়না নিয়ে শুদ্ধ টিনের বেড়ার পর্দা ভালো মতো টেনে দিয়ে তার উপর আবার ওড়না দিয়ে দিলো। পর্দার কোনা টেনে টিনের বেড়ার গায়ে আটকে দিলো যাতে বাতাসে না উড়ে যায়। তারপর ধারাকে বলল,
‘এখন বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাবে না। আপনি যান। কেউ আসবে না। আসলে আমি মানা করে দিবো। আপনার গোসল না হওয়া পর্যন্ত আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো।’

‘না থাক! আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে….!’

ধারাকে থামিয়ে দিয়ে শুদ্ধ আবারও বলল,

‘আপনি যান।’

ধারা আর কিছু বলল না। গোসলখানার ভেতরে গিয়ে হাতের জামা কাপড় টিনের বেড়ার উপরে রেখে দিল। বেড়া ভালোই উঁচু করে দেওয়া। বাইরে থেকে তাকালে শুধু ধারার চোখ দেখা যাবে এমন। মাথার উপর খোলা আকাশ। দিনের আলোতে ভেতরটা একদম ফকফকে উজ্জ্বল। ধারার জন্য এমন পরিবেশ একেবারেই নতুন। ও’র ভীষণ লজ্জা হতে লাগলো। নিজেকে অনাবৃত করে লাজুক মুখে ওঁ একবার বাইরে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। হাতে একটা ডাল নিয়ে আনমনেই লোকটা নিচের দিকে তাকিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করছে। তখন থাকতে মানা করলেও শুদ্ধ থেকে যাওয়ায় ধারার কাছে ভালোই লেগেছে। একটু আশ্বস্ত তো হতে পারলো। এরপর অনেকটা সময়ই কেটে যায়। ধারা যখন বসে বসে বালতি থেকে মগ দিয়ে গায়ে পানি ঢালছিল তখন হঠাৎ ও’র কানে আসে কারো পায়ের শব্দ। মনে হচ্ছে যেন গোসল খানার দিকেই এগিয়ে আসছে সে। ধারা খেয়াল করলো অনেকক্ষণ ধরেই শুদ্ধ’র কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এতক্ষণ তো তবুও গাছের ডালের নাড়াচাড়ার খানিক শব্দ আসছিল। এখন তো ঐ পায়ের শব্দ ছাড়া সবই নিশ্চুপ। শুদ্ধ কি তবে চলে গেল? কে আসছে কে জানে! পায়ের শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। আতঙ্কে জমে গিয়ে ধারা সিমেন্টের পাকা থেকে ভেজা জামাটাই গায়ে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক তখনই ও’র কানে আসে শুদ্ধ’র কণ্ঠ। শুদ্ধ কাউকে বলছে,
‘ভাবী, প্লীজ এখন যাবেন না। ধারা গোসল করছে। একটু পরে আসুন।’

পাশের বাড়ির বড় বউ নাজমা কাঁধ থেকে কলসিটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘তাতে কি হইছে ভাই? আমি কি পুরুষ মানুষ নাকি! আমি গেলে কি অসুবিধা? পানিটা যাইয়া নিয়া আসি গা। বেশিক্ষণ লাগবো না।’

কথাটা বলে নাজমা আবারও কলসি নিয়ে এগোতে নিল। শব্দ পেয়ে ধারা জামা পেঁচিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুদ্ধ তাড়াতাড়ি নাজমাকে আটকে বলল, ‘না ভাবী। একটু পরে আসুন প্লীজ। ধারা লজ্জা পায়। আসলে ও’র অভ্যেস নেই তো। আপনি না হয় কলসটা রেখে যান। দরকার পড়লে আমি গিয়ে পানি ভরিয়ে আপনাকে দিয়ে আসবো।’

নাজমা ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ ও…বুঝলাম এখন ভাই, তুমি তাইলে দাঁড়ায় দাঁড়ায় বউরে পাহাড়া দিতাছো। বউরে একলাই একলাই দেখবা। অন্য কাউরে আর দেখতে দিবা না!’

ভেতর থেকে ওদের কথা শুনে ধারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। শুদ্ধ আর কি বলবে? এখন যে করেই হোক নাজমার গোসলখানায় যাওয়া আটকাতে হবে। অন্য ভাবে কিছু বললে আবার সেটা নিয়ে মাইন্ড করে বসতে পারবে। তাই নাজমার কথাতেই তাল মিলিয়ে মুখের হাসি প্রসারিত করে লাজুক ভাব ধরলো। নাজমা দুষ্টুমির ছলে বলতেই লাগলো,
‘আচ্ছা তাইলে আমি যাই। তোমার আর আমারে কষ্ট কইরা পানি ভইরা দিতে হইবো না। আমি কলস নিয়াই যাই। দেবর গো দিয়া কি আর এতো কাজ করাইতে পারি! তুমি না হয় তোমার বউরেই পাহাড়া দাও।’

নাজমা চলে যাওয়ার পর আরো দু তিন জন মহিলা এলো। সবাইকেই একইভাবে আটকালো শুদ্ধ। শেষমেশ সবাইকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে শুদ্ধ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধারা মৃদু হাসলো। না! মানুষটা কথা দিয়ে কথা রাখে। ধারাকে একা ফেলে যায়নি। একে বিশ্বাস করাই যায়।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here