Part 19+20
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
বাড়ি ফিরে যেতেই শুদ্ধ শুনতে পেলো ধারার দাদী অসুস্থ। ধারার বাবা খোদেজাকে ফোন করে দাদীকে দেখতে আসার জন্য ধারাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। শুদ্ধ’র কপালে খানিক চিন্তার ভাঁজ পরলো। আগামীকাল পরীক্ষা। আর আজকেই যদি ধারাকে মধুপুর গ্রামে যেতে হয় তাহলে কিভাবে কি করবে? অপরদিকে দাদী অসুস্থ। না গিয়েও তো পারা যাবে না। যেখানে ধারার বাবা নিজ থেকে খোদেজাকে ফোন করে বলেছে৷ রুমে গিয়ে দেখলো ধারা শুদ্ধ’র আসার অপেক্ষায় বসে আছে৷ এখনও ব্যাগ গোছানো শুরু করেনি। শুদ্ধ বলল,
‘ধারা, যাওয়াটা তো প্রয়োজনই। একটা কাজ করেন, সব একসাথেই গুছিয়ে ফেলেন। পরীক্ষা তো আগামীকাল বিকাল সাড়ে তিনটায়। আমরা সকাল সকালই ঢাকার জন্য রওয়ানা হয়ে যাবো৷ আপনি ওখান থেকেই সকালে বাস স্ট্যান্ডে চলে আসবেন। আমি আগে থেকেই সেখানে থাকবো৷ আমিও আপনার সাথে যেতে পারতাম কিন্তু আমার এদিকে আরও কিছু কাজ আছে। ঢাকায় যাওয়ার আগে সেগুলোও মিটাতে হবে। আপনি সময়মতো এসে পড়বেন, ঠিকাছে?’
শুদ্ধ’র কথায় সায় দিয়ে ধারা মাথা দুলালো। শুদ্ধ বলল,
‘আর শুনুন, আপনার বাবাকে বলা নিয়ে বেশি ভাববেন না। যেহেতু সেখানে যাচ্ছেন জানাতে তো তাকে হবেই। আপনার বাবা যদি একটু রাগও করে বেশি মন খারাপ করবেন না। একটু ইগনোর করার চেষ্টা করবেন। যদিও আমার মনে হয় না, সম্পূর্ণ পরীক্ষার প্রিপারেশন নিয়ে ফেলেছেন জানতে পারলে আপনার বাবা বেশি কিছু বলবে। ঠিক মতো যাবেন ধারা। আমি আমাদের পরিচিত এক অটোচালককে ঠিক করে রেখেছি। সে সোজা আপনাকে আপনাদের বাড়িতে দিয়ে আসবে।’
ধারা ব্যাগ গুছানো শুরু করলে শুদ্ধ আবারো পাশ থেকে বলল,
‘আপনার পড়া তো সব কমপ্লিট করাই, তবুও আমি যেই ইম্পর্টেন্ট নোটগুলো বানিয়ে দিয়েছিলাম সেগুলো নিয়ে যান। বারবার শুধু সেগুলোতে হালকার উপর একটু চোখ বুলাবেন। এখন বেশি চাপ নিতে হবে না। নতুন কিছুও আর পড়তে হবে না। যা পড়েছেন এখন তাই যথেষ্ঠ।’
ধারা আবারো মাথা নাড়ালো। ব্যাগ গুছানো হয়ে গেলে শুদ্ধ আবারো বলতে শুরু করলো,
‘আজকে আর বেশি রাত পর্যন্ত জাগবেন না ধারা। তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়বেন। আর নিজের খেয়াল রাখবেন। ঠিকমতো খাবার খাবেন। একটু পর পর পানি খাবেন। বুঝেছেন?’
হাতের কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো ধারা। মানুষটা আজকে এতো বকবক করছে! ধারা বলল, ‘বুঝেছি। খুব ভালো মতোই বুঝেছি। আপনি এতো ভাববেন না। আমি নিজের খেয়াল রাখবো।’
শুদ্ধ স্মিত হাসলো। একটুপর অটো চলে এলে ধারা চলে গেলো। শুদ্ধ’র খানিক খারাপ লাগলো বটে তবে সে ব্যাকুল হয়ে কালকের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ভালো মতো কালকে ধারার পরীক্ষাটা দেওয়া হয়ে গেলেই শুদ্ধ’র স্বস্তি।
__________________________________________
বাড়ি ফিরে নিজের বাবার শক্ত গম্ভীর মুখটা দেখতেই ধারার মুখের ভাব পাল্টে গেলো। কোনমতে বাবার সামনে থেকে চলে এসে নিজের রুমটায় ঢুকে পড়লো সে। এতদিন বাদে ধারা এই বাড়িতে থাকতে এসেছে বলে ভীষণ খুশি হলো আসমা। রাতুলও বড় বোনের আসায় আনন্দিত হলো। ধারা ও’র ব্যাগ থেকে রাতুলের জন্য একটা ঘড়ি বের করে বলল তার দুলাভাই দিয়েছে। গতমাসেই রাতুলের জন্য পছন্দ হওয়ায় কিনে রেখেছিল শুদ্ধ। পড়ার চাপে নিজের বাপের বাড়ি এতদিন না আসায় ধারা দিতে পারেনি। এরপর দাদীর কাছে গিয়ে বসতেই জমিরন বিবি অসুস্থ গলায় বিরক্তি ভাব নিয়ে বললেন,
‘প্রত্তম আইসাই নিজের রুমটার মইধ্যে ঢুকলি! কই দাদীরে দেখতে আইবো তা না! তুই জীবনেও কিছু শিখতে পারলি নারে ধারা। এমন যদি শ্বশুরবাড়িত করোস, পরের বাড়ির ভাত দুইদিনও খাইতে পারবি না।’
ধারা চুপ করে রইলো৷ মাথা নিচু করে বসে রইলো দাদীর পাশে। তখন আজিজ সাহেব এসে দাঁড়ালেন সেই রুমে। জমিরন বিবি হঠাৎ খুকখুক করে কাশতে লাগলো। আজিজ সাহেব তার স্বভাবগত গম্ভির স্বরে দ্রুত বললেন,
‘ধারা, তোমার দাদীকে ফ্লাক্স থেকে গরম পানি ঢেলে খাইয়ে দাও।’
আজিজ সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই ধারা যত দ্রুত সম্ভব উঠে দাঁড়ালো। তার বাবা কোন কিছুতেই বিলম্ব একদমই পছন্দ করেন না। আর এই তাড়াহুড়োর চক্করে ধারা সবসময়ই একটা না একটা গড়মিল করে ফেলে। বিশেষ করে তার বাবা যখন সামনে থাকে। যেমনটা এই মুহুর্তে করলো। আজিজ সাহেবের সামনে কোন কাজ করতে গেলে সেটাতে যাতে কোন ভুল না হয় এই প্রয়াসে ধারা এতোটাই নার্ভাস হয়ে পড়ে যে সেই মুহুর্তে তার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। দাদীর জন্য ফ্লাক্স থেকে পানি ঢালতে গিয়ে সে কাঁপা হাতে কিছুটা গরম পানি জমিরন বিবির হাতে ফেলে দেয়। ধারা ঘাবড়ে যায়। যদিও ছিটকে আসা পানির পরিমাণ ছিল খুব অল্পই এবং পানি খুব বেশি গরম ছিল না যার দরুন জমিরন বিবির হাত খুব বেশি জ্বলে না। তবুও সেই হালকা জ্বালাতেই জমিরন বিবি কঁকিয়ে উঠে বলেন, ‘আজিজ রে তোর মাইয়ারে কি আনছোস আমারে মারতে! কি করলো!’
আজিজ সাহেব বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি কি কোন কাজই ঠিকমতো করতে পারো না ধারা!’
এই বলে আজিজ সাহেব চলে যান। ধারাও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ সে মুহুর্তে তার আর বলা হয়ে ওঠে না আগামীকাল পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা। সে ভেবে নেয় রাতে বলবে। কিন্তু সেই রাতে আর আজিজ সাহেবের দেখা পাওয়া যায় না। গ্রামের এক ঝগড়া সুলভের মাতব্বরীতে যেতে হয় তাকে। ধারা অপেক্ষা করতে থাকে। গভীর রাত হয়ে গেলে অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়েও যায়। ঘুম ভেঙে সকালের আলো দেখতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। খুব বেশি বেলা হয়নি। তার বাস সকাল নয়টার। এর আগে যে করেই হোক ধারাকে সবটা বলতে হবে তার বাবাকে।
শুদ্ধ সকাল সাতটা নাগাদই চলে আসে বাস স্ট্যান্ডে। তার আশেপাশের একটা হোটেল থেকেই সকালের নাস্তা করে নেয়। উত্তেজনায় খুব একটা খেতেও পারে না শুদ্ধ। আধপেটেই পুনরায় চলে আসে বাস স্ট্যান্ডে। বাস আসতে এখনও অনেক দেরী। বাস সমিতির কি একটা ঝামেলার কারণে একদম সকালের বাস বন্ধ থাকায় শুদ্ধকে নয়টার বাসেরই টিকিট কাটতে হয়। এতেই পরীক্ষা শুরুর আগে অনয়াসেই পৌঁছানো যাবে। শুদ্ধ একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে। তবুও স্থির হতে পারে না। একটু পরপরই ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় যেন কাটছেই না। কখন আসার সময় হবে ধারার?
ধারার বাবা সকালে হাটতে বেড়িয়ে এখনো ফিরে আসেনি। ধারা আছে শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। আবহাওয়া খুব বেশি গরম না হওয়ার ফলেও খুব করে ঘামছে সে। গলা বারবার শুকিয়ে আসছে৷ কিভাবে যে কথাটা বাবার কাছে শুরু করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ধারা। তবুও বলতে তো তাকে হবেই। বাইরে দৃষ্টি রেখে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার পায়চারি করতে থাকে। জমিরন বিবি এখন বেশ খানিকটা সুস্থ। ঠান্ডা, জ্বর রাতের মধ্যেই কমে গেছে। রোদের মধ্যে মোড়া পেতে এখন বসে আছে সে। একসময় আজিজ সাহেব গম্ভীর মুখে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। ধারা নিজেকে একটু ধাতস্থ করে যেই না কিছু বলতে যাবে তার আগেই আজিজ সাহেব রাতুল বলে ডেকে একটা হুংকার ছাড়েন। আজিজ সাহেবের রাগের সাথে সেই বাড়ির সকলেই পরিচিত। সকাল সকাল এমন হুংকার শুনে রান্নাঘর থেকে আসমা, জমিরন বিবি দুজনেই ছুটে আসেন। ধারা হঠাৎ বুঝতে পারে না কি হয়েছে? রাতুল শঙ্কিত হয়ে দ্রুত বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজিজ সাহেব মেঘের গর্জনের চাইতেও গম্ভীর মুখে বলেন,
‘তুমি আগামীকাল স্কুল থেকে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলে?’
রাতুল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আজিজ সাহেব প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে রাতুল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায়। আজিজ সাহেব বরফের মতো শীতল কণ্ঠে বলেন,
‘কেন?’
রাতুল নিশ্চুপ হয়ে থাকে। কোন উত্তর না পেয়ে আজিজ সাহেব গর্জন করে বলেন, ‘বলো কেন?’
রাতুল ভয়ে কেঁদে ফেলে। আজিজ সাহেব বলতে থাকেন, ‘তোমার স্যারের সাথে আজকে সকালে আমার দেখা হয়েছিল। তুমি স্কুলের ক্রিকেট বোর্ডে নাম লিখিয়েছো। সেখান থেকে আবার ক্লাস বাদ দিয়ে আরেক স্কুলে খেলতেও গেছো। তোমাকে কি স্কুলে পাঠাই ক্লাস করতে নাকি ক্রিকেট খেলতে? ক্রিকেট খেলে তোমার কি লাভটা হবে শুনি? যে ক্লাসের থেকে তোমার ক্রিকেট বড় হয়ে গেলো?’
রাতুল কাঁদতেই থাকে। আজিজ সাহেবের চিৎকার সেখানে উপস্থিত সকলের রক্ত ঠান্ডা করে দেয়। জমিরন বিবি নাতির পক্ষে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আজিজ সাহেব থামিয়ে বলেন,
‘আম্মা, আপনি আজকে কিছু বলবেন না। এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই জানতে পারলাম না। অনেক বড় হয়ে গেছো? আমাকে জানানোর দরকার মনে হলো না! এতো সাহস এর হলো কিভাবে? আমার কাছে না জিজ্ঞেস করে কাজ করে! এতো বাড় বেড়ে গেছে! এতো বড় আস্পর্ধা?’
এই বলে অগ্নিশর্মা আজিজ সাহেব টেবিল থেকে স্টিলের জগ হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। বিকট আওয়াজ তুলে পানি সহ জগটা ঝনঝন করতে করতে ধারার পায়ের কাছে এসে পড়ে। বাবাকে জমের মতো ভয় পাওয়া ধারা এমন রূপ দেখে মুখের সমস্ত শব্দ হারিয়ে ফেলে। হাতের ফোনটা বারবার ভ্রাইবেট হতে থাকে আর ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ভয়ে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে ধারা।
সময় গড়াতে থাকে। এদিকে ধারা এখনও আসছে না দেখে শুদ্ধ উদ্গ্রীব হয়ে উঠে। স্মার্ট ফোনটা বিক্রি করে সদ্য কেনা সস্তা বাটন ফোনটা দিয়ে ধারার ফোনে ননস্টপ কল করে যায় শুদ্ধ। ধারা ফোন তুলছে না দেখে আরও বিচলিত হয়ে উঠে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে যায়। শুদ্ধ অনেক বলে কয়ে বাসকে পাঁচ মিনিটের জন্য আটকে রাখে। তারপর আবারও বলে বলে দুই মিনিট। মূলত ছেলেটার এতো ব্যাকুলতা দেখেই বাস চালক দশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করে। তারপর আর সম্ভব না বলে আফসোস করে চলে যায়। সময় নষ্ট না করে শুদ্ধ আবারও সেকেন্ড বাসের টিকিট কেটে রাখে৷ আর ধারাকে লাগাতার ফোন করতে থাকে। এতক্ষণ ফোন রিং হলেও এখন ওপাশ থেকে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। মুখের রং পাল্টে যায় শুদ্ধ’র। সে আরও দু তিনবার ফোন করে। সেই একই কথা শোনা যায়। দেখতে দেখতে দ্বিতীয়, তৃতীয় বাসটাও চলে যায়। এখন আর ঢাকার বাসে উঠলেও পরীক্ষার আগে যাওয়া কোন পক্ষেই সম্ভব হবে না। শুদ্ধ ধপ করে বসে পড়ে বেঞ্চে। একসময় ঘড়ির কাটায় বেজে উঠে তিনটা ত্রিশ। শুদ্ধ তখনও পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসেই থাকে সেই কাঠের বেঞ্চে।
#পর্ব-২০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
সারাটা দিনই বাস স্ট্যান্ডে পড়ে রইলো শুদ্ধ। বাড়ি ফিরে যাবার কোন ইচ্ছা বোধ হলো না। রাতের বেলা তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। পাশের চায়ের স্টলের এক বুড়ো লোক শুদ্ধ’র গায়ের জ্বর দেখে নিজের ঝুপড়ি মতো ঘরটায় আশ্রয় দিলো। নিজের দূর্বল হাতের সেবায় জ্বর নামানোর প্রয়াসও করলো। শেষ রাতের দিকে জ্বর নেমে গেলো বটে তবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ নেতিয়ে রইলো। যতোটা না শরীরে, তার চাইতেও বেশি মনে৷ সকাল নাগাদ সে ফিরে এলো নিজ বাড়িতে। খোদেজা তখন দাওয়ায় কুলো পেতে মড়া চাল বাছতে বসেছিল। শুদ্ধ’র এমন উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে চিন্তামুখে প্রশ্ন করলো,
‘কিরে মাহতাব, এতো তাড়াতাড়িই চলে আসলি যে! রাতের বাসে রওনা দিছিলি? বউ কই?’
শুদ্ধ আস্তে করে মায়ের পাশে বসে পড়ে। ফ্যাকাসে একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘ধারা পরীক্ষা দিতে আসে নাই আম্মা।’
খোদেজা অবাক হয়ে বলল, ‘আসে নাই মানে?’
কথা বলতে বলতে শুদ্ধ’র গলা হঠাৎ ধরে এলো। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে শুদ্ধ ধরা গলায় বলল, ‘আমি ধারার উপর ভরসা করেছিলাম। ও আমার ভরসা রাখতে পারে নাই আম্মা। রাখতে পারে নাই!’
কথাটা বলতে বলতে শুদ্ধ’র চোখ বেঁয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। যে অশ্রুতে মিশে থাকে এক বুক হাহাকার।
এরপর সময় গড়ায়, দিনের পরের দিন যায়। শুদ্ধ ধারার প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলে না। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ব্যস্ত করে ফেলে কাজে। খোদেজা ধারাকে নিয়ে যখনই কিছু বলতে যায় শুদ্ধ পাশ কাটিয়ে যায়। এমনিতেও যথেষ্ঠ সময় অপচয় করে ফেলেছে সে। নিজের কাজ ব্যতীত এখন আর অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চায় না। ধারাকে নিয়ে তো একদমই না। খোদেজা বিচলিত বোধ করে। ওদের সম্পর্কটা কি কোনদিনও ঠিক হবে না?
__________________________________________
আসমা বেশ কিছুদিন ধরেই দুশ্চিন্তায় ভুগছে। দুশ্চিন্তা তার মেয়েটাকে নিয়ে। ধারাকে নিয়ে। ধারা আজকাল শুধু বিষন্ন হয়ে থাকে৷ ঠিকমতো খায় না। রাত হলেই তার রুম থেকে শুধু কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। বেশ কিছুদিন এই কান্নার শব্দ ধারার রুমের বাহিরে শুনেছে আসমা। ধারাকে এ নিয়ে খোলাখুলি কিছু জিজ্ঞাসা করলেও ধারা কিছু বলে না। নানা কথায় পাশ কাটিয়ে যায়। এমন না যে ধারা সবসময়ই হাসি খুশি থাকা মেয়ে। সে চুপচাপ স্বভাবেরই। বাড়িতেও খুব একটা কথা বলে না। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। হঠাৎ কি এমন হলো আসমা ভেবে পায় না। শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পরও তো ঠিকই ছিল। তারপরই হঠাৎ কি হলো! আসমা মনে মনে মেয়ের জন্য একবুক প্রার্থনা করে আল্লাহ’র কাছে। মেয়েটার জন্য তার ভারী কষ্ট হয়। কখনো কারো কথার বাইরে যায় না ধারা। তবুও এ বাড়ির সবার তার প্রতি শত শত অভিযোগ। এখানে মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় যেন প্রাণটা হাতে নিয়ে ঘুরে। একটু মন খুলে কথা বলতেও যেনো কত সংকোচ। আর হবেই বা না কেন? এ বাড়ির পরিবেশটাই এমন। আসমা গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হাতের কাজ সেড়ে ধারাকে খুঁজতে যায়।
ছাদের কোণে স্টিলের দোলনায় বসে আছে ধারা। আজ তিন, চারদিন হয়ে গেলো ধারা এ বাড়িতে। সেদিন সেই যে শুদ্ধ পরীক্ষার দিন ধারাকে অনবরত ফোন করেছিল তারপর থেকে আর একটা ফোনও করেনি। ধারারও আর শুদ্ধ’র সামনে দাঁড়ানোর মতো কোন মুখ ছিলো না। তাই শত ইচ্ছার পরও সেও ফোন করতে পারেনি। আর না পেরেছে ও বাড়িতে ফিরে যাবার কথা ভাবতে। সে যা করেছে তার পর আর কিভাবেই বা শুদ্ধ’র সামনে দাঁড়াবে ধারা! তবুও কিছুটা সাহস সঞ্চার করে ধারা গতকাল রাতে শুদ্ধকে ফোন করেছিল। একবার, দুইবার তারপর বারবার। কিন্তু শুদ্ধ তার ফোন ধরেনি। একবারের জন্যও না। ভাবনার ভেতরেই যা ছিল আদৌও তাই ঘটার পরও যন্ত্রণা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলো। দিনের আলোয় ছাদে নিরিবিলি বসেও ধারা এতক্ষণ সেই নিরর্থক প্রয়াসই করছিল। তখন আসমা এলো তার পেছনে। ধারার কাঁধে হাত রাখার পর ধারা মাথা ঘুরাতেই দেখলো মেয়ের কানে ফোন আর চোখে অনবরত ঝরে পড়া অশ্রুমালা। আসমা আঁতকে উঠে বলল,
‘কি হয়েছে ধারা?’
ধারা মায়ের কোমর জাপটে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি এমন কেন হলাম মা? কেন এমন হলাম? দাদী আমাকে নিয়ে যা যা বলে ঠিকই বলে। আমাকে এক্ষুনি রূপনগরে নিয়ে যাও মা।’
__________________________________________
খোদেজা মাটির চুলায় রান্না চড়িয়েছে। চারপাশে এলোমেলো হয়ে আছে রান্নার সরঞ্জাম। কাজে তার মন নেই। সর্বক্ষণ উদ্গ্রীব ছেলের জন্য। তার প্রিয় মাহতাবের জীবনে একটার পর একটা এসব কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। আজ গরমটা যেন একটু বেশিই। রোদের তেজ কমার নামই নিচ্ছে না। খোদেজা আঁচল দিয়ে একবার কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নেয়। ঠিক সেই সময় তার উঠোনে এসে হাঁক পারে এক ফকির বাবা। রান্না ঘর থেকে উঁকি দিয়ে খোদেজা দেখে নোংরা একটা লম্বা জামা গায়ে এলোমেলো চুল বড় বড় নখের এক লোক এসে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা কাপড়ের পুটলী ঝুলানো। গলায় আর হাতে অনেকগুলো তাবিজ। খোদেজা বাইরে বেড়িয়ে এলে ফকির বেশের লোকটি বলে,
‘এক গ্লাস পানি খাওয়াও মা।’
লোকটাকে বেশভূষায় খোদেজার সাধারণ মনে হয় না। সে এসব ফকির তাবিজে বিশ্বাসী। অপরিচিত লোকটাকে গন্য করে সে ভেতর থেকে পরিষ্কার এক গ্লাসে পানি নিয়ে আসে। ফকির লোকটা খোদেজার ঘরের দাওয়ায় বসে সময় নিয়ে পানি খায়। তারপর খোদেজার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
‘তুই নিশ্চয়ই কোন অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস। সমস্যার সমাধান এখনই না করলে সামনে তোর ঘোর বিপদ।’
খোদেজার মনের দুশ্চিন্তা তার চেহারায় স্পষ্ট। শুধু ফকির বাবা না যে কেউ দেখলেই বুঝে যাবে। কিন্তু এতটুকু তেই ফকির লোকটার প্রতি খোদেজার বিশ্বাস পাকা পোক্ত হয়ে যায়। তার ছেলের জীবনে এতো ঝামেলা হচ্ছে বলে সে একবার ভাবে যদি এর কোন সমাধান ফকির বাবার কাছে থাকে! তাই খোদেজা অনুরোধের সুরে বলে, ‘আপনি ঠিকই বলতাছেন। আমার ছেলেটার জীবনে কিচ্ছু ঠিক হইতাছে না। একটার পর একটা অশান্তি হইতাছে। আপনের কাছে কি এর কোন সমাধান আছে?’
ফকির লোকটা গাম্ভীর্য্যের ভাব ধরে থম মেরে খোদেজার সব কথা শুনে বলে,
‘হুম, বুঝতে পারছি। চিন্তা করিস না। একটা তাবিজ দিলেই ঠিক হইয়া যাইবো। আমি এক্ষুনি প্রস্তুত কইরা দিতাছি। তাবিজের দাম পাঁচশো টাকা। এইটা লাগাইলে তোর পোলার সব বালা মুছিবত কাইটা যাইবো।’
খোদেজা রাজী হয়ে যায়। পুকুরপাড় দিয়ে ক্ষেত থেকে তখন ফিরছিল শুদ্ধ। উঠোনে মায়ের সাথে ফকির বেশের লোকটাকে দেখেই তার কিঞ্চিৎ বিরক্তি হয়। তার মা আবার এসব মিথ্যা ভন্ডামীর চালে পড়ছে! শুদ্ধ ভেবে নেয় লোকটার সামনে গিয়েই একটা আচ্ছা মতো ধমক লাগাতে হবে। সে দ্রুত পা চালায়।
এইদিকে ফকির লোকটা তার পুটলি থেকে একটা তাবিজ আর কালো সুতা বের করে বলে,
‘কাজটা কিন্তু অতো সহজ না। এর জন্য তোর পোলার জন্ম তারিখ, সাল আর মায়ের নাম মানে তোর নাম বলতে হবে। শোন, মায়ের নামটা কিন্তু একদম আসল টা বলবি। যেটা বাপ মায়ের দেওয়া। ডাক নাম টুক নাম কিন্তু হইবো না।’
খোদেজা কেমন যেন ইতস্তত বোধ করলো। আস্তে আস্তে করে শুদ্ধ’র জন্ম তারিখ বলল। আর মায়ের নামের জায়গায় খুব সময় নিয়ে বলল, ‘নুরুন্নাহার।’
ফকির লোকটির দৃষ্টি হঠাৎ খোদেজার পাশে গেলো। দেখলো একটি ছেলে অবাক মুখে খোদেজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফকির লোকটির দৃষ্টি অনুসরণ করে খোদেজাও তাকালো সেদিকে। দেখে তার হুঁশ উড়ে গেলো। বাড়িতে পুরুষের উপস্থিতি দেখে এই ফাঁকে কেটে পড়লো ফকির লোকটি। দ্রুত দু কদম খোদেজার দিকে এগিয়ে এলো শুদ্ধ। সন্ধিগ্ন চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আম্মা, তুমি আমার মায়ের নামের জায়গায় তোমার নাম না বলে নুরুন্নাহার বললে কেন?’
প্রশ্ন শুনে খোদেজার গলা শুকিয়ে এলে। চেহারাটা মুহুর্তের মধ্যেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো তার।
চলবে,