Part 24+25
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
কিছু বুঝে উঠার আগেই ধারাকে টেনে বারান্দায় নিয়ে আসা হলো। অস্পষ্ট অবয়বটিতে চাঁদের আলো পড়তেই ধারা হতভম্ব হয়ে গেলো। সামনের মানুষটির মুখে সেই সুন্দর টোল পড়া হাসি ফুটে উঠতেই ধারা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। পৃথিবীর সবচাইতে প্রশান্তিময় জায়গাটিতে স্থান পেয়েই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো৷ শুদ্ধ আলতো করে ধারার মাথায় হাত রাখলো। কাঁদতে দিলো ধারাকে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা শুদ্ধকে ছেড়ে উদ্গ্রীব হয়ে বলে উঠলো,
‘আপনি এখানে এতো রাতে কিভাবে এলেন?’
শুদ্ধ একবার মিথ্যা আফসোসের ভঙ্গি করে বারান্দার সিমেন্টের উঁচু বেদির সাথে হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘ভেবেছিলাম তো পাইপ বেঁয়ে উঠে একটা ঝাক্কাস হিরোর মতো এন্ট্রি নেবো। কিন্তু তা আর হলো কই! আমার শ্বশুড় মশাই যে আমার জন্য বাড়ির পেছনে একটা মই ফেলে রেখেছেন। শেষমেশ শ্বশুরবাড়ির কদর রাখার জন্য সেই মই বেঁয়েই চলে এলাম। আর এই যে ম্যাম, আপনি আপনার বেলকনির রুমের দরজা আটকিয়ে ঘুমান না কেন? বুঝলাম আজকে আমি এসেছি। কিন্তু রোজ রোজ তো আর শুধু জামাই আসবে না। মাঝে মধ্যে চোরও চলে আসতে পারে।’
ধারা অপলক তাকিয়ে রইলো শুদ্ধ’র দিকে। আজ কতদিন পর তারা এভাবে স্বাভাবিক হয়ে কথাবার্তা বলছে মনে করার চেষ্টা করলো। ধারা খুব ভালো মতোই জানে শুদ্ধ তার মনের ভার কমানোর জন্যই এমন মজা করে কথা বলছে। নয়তো শুদ্ধ’র মনেও যে কতোটা দুশ্চিন্তার বন্যা বইছে তা আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন না। শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে ধারা আবেগ্লাপুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ ধারার হাত টেনে নিজের সামনে বসাতে বসাতে বলল,
‘বসুন এখানে। কি অবস্থা করেছেন নিজের চেহারার! এতো কাঁদতে হয়?’
এই বলে শুদ্ধ ধারার চোখের পানি মুছে দিলো। তারপর বলল, ‘নিশ্চয়ই কিছু খাননি! আর আমিও তো কথাটা তখন ফোনে শেষই করতে পারলাম না। তখনই বুঝেছি আজকে আর আপনার খাওয়া হয়েছে! সকালেও যেমন তেমন খেয়েছেন। দুপুরের আশা তো ছেড়েই দিলাম। আরবএখন রাতেও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনাকে নিয়ে কি যে করি না ধারা!’
শুদ্ধ হাতের ব্যাগটা থেকে একটা বাটার নান বের করলো। নিজের হাতে ধারার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। ধারা শুদ্ধ’র চোখে চোখ রেখেই একটা কামড় বসালো নানে। তার চোখে আবারও পানি চলে এলো। শুদ্ধ খুব যত্ন করে ধারাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ ধারা শুদ্ধ’র একটা হাত ধরে বলল,
‘আপনি আমার উপর আর রাগ করে নেই তো?’
শুদ্ধ মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
‘না। আপনি আজ এতোই বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছেন যে আপনার পূর্বের দূর্বলতার কথাগুলো আর মনে পড়ছে না।’
তারপর ধারার ধরে রাখা হাতটা শুদ্ধ তার দু হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘জানেন ধারা, আজকে আমি আপনার থেকেও একটা জিনিস শিখেছি। যে, আমাদের কখনো আশা হারাতে নেই। যেটা আমি আপনার ক্ষেত্রে করেছিলাম। এই কথাটা আজকে আপনি প্রমাণ করেছেন। আমিও কিছুদিন আগেই আম্মার থেকে এই সত্যিটা জেনেছিলাম৷ বলাবাহুল্য আমিও ভেতর থেকে খুব নড়ে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু আপনি আজ যেই কথাগুলো আপনার বাবাকে বলেছেন সেই কথাগুলো আজ আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে। ধন্যবাদ ধারা। ধন্যবাদ!’
‘আপনি যদি এতটুকুর জন্যই বারবার এভাবে ধন্যবাদ জানান তাহলে আমি কি করবো? আমার তো তাহলে ধন্যবাদ বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে যাবে। কারণ আপনি আমার জন্য যা যা করেছেন!’
শুদ্ধ হেসে ফেললো। সাথে ধারাও। তার চোখে এখনও পানি চিকচিক করছে আর ঠোঁটে হাসি। কিছুক্ষণ এভাবেই কাটার পর শুদ্ধ বলল,
‘ধারা, এমন কিন্তু আর কখনো করবেন না। সময় মতো খাওয়া দাওয়া করবেন। নিজের ঠিকমতো খেয়াল রাখবেন। খাওয়া ছেড়ে দেওয়া কখনো কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। যদি হতো তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই ছেড়ে দিতো৷ কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি জানেন? খাবার খাওয়াও আমাদের জন্য এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সমস্যাই মুখে এই খাবার জোটানোর চক্করেই সৃষ্টি হয়। এখন আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যেখানে সবকিছুই এতো হুটহাট হচ্ছে যে সবার জন্যই এতোকিছু মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমাদের সবাইকে একটু সময় দেওয়া উচিত। সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি আমরা ঠিক থাকি।’
ঐ প্রসঙ্গ উঠতেই ধারার মন আবারো খারাপ হয়ে গেলো। তা লক্ষ করে শুদ্ধ নিজের স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘এই যে মিসেস ধারা, আপনি যেন আমাকে একদিন কি বলেছিলেন আপনার খেয়াল আছে?’
ধারা অবাক হয়ে মাথা তুলে বলল, ‘কি?’
‘এই যে আপনি কোনদিন আমার প্রেমে পড়বেন না। কতো জোর গলায় বলেছিলেন মনে আছে? আপনি আপনার কথা রাখবেনই রাখবেন। শেষমেশ এটা কি হলো ধারা? আপনি তো আপনার কথা রাখতে পারলেন না!’
ধারা লাজুক হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। শুদ্ধ বলল, ‘কথা না রাখাটা আমি একদম পছন্দ করি না। আর আপনি সেই কাজটাই করলেন। এখন কিন্তু এর জন্য আপনাকে পানিশমেন্ট পেতে হবে।’
ধারা সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তাই! কি এর পানিশমেন্ট?’
শুদ্ধ তার টোল পড়া গালটি ধারার মুখের সামনে এগিয়ে দিলো। আঙ্গুল দিয়ে গালে দুটো টোকা দিয়ে ইশারা করে ঠোঁট চেঁপে দুষ্ট হাসি হাসতে লাগলো। ধারা ভীষণ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। হৃদস্পন্দন বহু গুণে বেড়ে গেলো তার। আরেকবার চোখ তুলে তাকালো সামনে। শুদ্ধ’র সেই টোল পড়া গাল! ধারার বহুদিনের আকর্ষণ। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো তার গালদুটো।
ওদিকে শুদ্ধ তাড়া দেবার গলায় বলে উঠলো,
‘তাড়াতাড়ি! যতো দেরি করবেন পানিশমেন্ট কিন্তু তত দ্বিগুণ হবে।’
রক্তিম মুখে ধারা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শুদ্ধ’র আরেকটু কাছে আসতেই মুখের হাসি প্রসারিত হলো শুদ্ধ’র। নিজেকে শুদ্ধ’র আরো একটু কাছে এগিয়ে নিতেই লজ্জায় হেসে ফেলে ধারা এক দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে এলো। শুদ্ধ পেছন থেকে ‘আরে!’ বলে উঠে ধারাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও পারলো না। ধারার পাতলা ওড়নাটা তার হাতের তালুতে এসেও চলে গেলো নাগালের বাইরে।
__________________________________________
আজিজ সাহেব এবং শাহেদ দুজনে ড্রয়িং রুমে বসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছেন। এতো দিনেও তারা ধারাকে রাজী করাতে পারেনি। এটাই তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়। রাতুল স্কুলে গেছে। আসমা আর জমিরন বিবি বসে আছে রান্নাঘরে। ঠিক তখনই বাইরে থেকে ধারা ঘরে ঢুকলো। তার কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। আজিজ সাহেব ভ্রু কুঞ্চিত করলেন ধারাকে দেখে। ধারা যে এতক্ষণ বাড়িতে ছিল না সেটাই তো জানতো না সে। তাই ধারাকে থামিয়ে বলল,
‘কোথায় গিয়েছিলে?’
ধারা দাঁড়িয়ে পরে বিনীতভাবে বলল,
‘আমি ভর্তি হতে গিয়েছিলাম বাবা।’
‘ভর্তি হতে গিয়েছিলে মানে? কোথায় ভর্তি হতে গিয়েছিলে?’
‘কলেজে। অনার্সের জন্য এপ্লাই করে আসলাম। সাবজেক্ট হিসেবে বাংলা নিয়েছি।’
শাহেদ চোখ কপালে তুলে দাঁড়িয়ে বলল,
‘বাংলা নিয়েছিস মানে? তোর মাথা ঠিক আছে? তুই আমাদেরকে না জিজ্ঞেস করে এপ্লাই করতে গেলি কেন? আর করেছিসই যখন সাইন্সের কোন সাবজেক্ট নিলি না কেন?’
ধারা বিনয়ের সাথে উত্তর দিলো,
‘আমি যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তখন আপনারা কেউ বাসায় ছিলেন না কাকা। আজকেই এপ্লাইয়ের লাস্ট ডেট ছিল। তাই আমাকে যেতে হয়েছে৷’
আজিজ সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন,
‘বাংলা নিলে কেন?’
‘সাইন্স পড়তে আমার ভালো লাগে না বাবা। যেটা পড়তে আমার ভালো লাগে না সেটা নিয়ে পড়ে আমি ভালো কিছু করতে পারতাম না। তাই যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়েছি।’
‘দুনিয়া তোমার ভালো লাগা দিয়ে চলবে না। চলবে সেটা দিয়েই যেটা বেস্ট।’
‘সাবজেক্ট কখনো বেস্ট হয় না। বেস্ট হয় মানুষের চেষ্টা। একটা মানুষের চেষ্টা আর অধ্যাবসায়ই একটা সাবজেক্টের মধ্য দিয়ে তার সফলতা নিয়ে আসে।’
শাহেদ বলল, ‘এইসব হাবিজাবি কথা তোকে কে বলেছে? এইসব বইয়ের পাতাতেই মানায়। আসল জীবনে এমন কিছু হয় না। প্রাক্টিকেল হও।’
‘শুদ্ধ বলেছে কাকা। আর যেখানে কথা প্রাক্টিকেল হবার, আসল জীবনে আমরা যদি প্রয়োগ করি তাহলেই হবে।’
আজিজ সাহেব বললেন, ‘ঐ ছেলেই তোমার মাথা নষ্ট করেছে। পাগল হয়ে গেছো তুমি! তোমাকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াই আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল।’
ধারা স্মিত হেসে বলল, ‘এর জন্য আপনার কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো বাবা। আপনার এই ভুলটি আমার জীবন সাজিয়ে দিয়েছে।’
এই বলে ধারা সেখান থেকে চলে এলো। আজিজ সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। শাহেদ থামিয়ে বলল, ‘বাদ দেন ভাইজান, এখন এর থেকেও বড় সমস্যা আমাদের মাথার উপরে আছে। আগে সেটাতে মনোযোগ দিতে হবে। ধারাকে যে করেই হোক ঐ ছেলের থেকে আলাদা করতে হবে। দেখেছেন তো সঙ্গদোষে কতোটা অধঃপতন হয়েছে আমাদের ধারার। এখন সবথেকে জরুরী কি জানেন? এভাবেই ওদের দুজনকে দেখা করতে দেওয়া যাবে না। কয়েকদিন দূরে দূরে থাকলেই ধারার মাথা থেকে ঐ শুদ্ধ নামের ভূত নেমে যাবে। তারপর ঠিকমতো বোঝালেই আমাদের ধারা ঠিক বুঝে যাবে। এরপর তাই করবে যা আমরা করতে বলবো।’
আজিজ সাহেব কিছু বললেন না। কপালে ভাঁজ ফেলে কিছু একটা ভাবতে লাগলোন।
ধারা রুমে এলে আসমাও তার পেছন পেছন চলে এলো। ধারাকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
‘ধারা, এসব কি হচ্ছে আমাকে বুঝিয়ে বলতো।’
ধারা বলল, ‘মা, যেই সাবজেক্ট আমি ঠিকমতো বুঝি না সেটা নিয়ে আমি কিভাবে পড়বো বলো তো!’
‘আমি সাবজেক্টের কথা বলছি না। তোর সিদ্ধান্তের কথা বলছি। তুই যে তোর বাপ চাচার বিরুদ্ধে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতাছোস তুই জানোস তো তুই কি করতে যাইতাছোস?’
ধারা মায়ের হাত ধরে বলল, ‘জানি মা। খুব ভালো করেই জানি। মা, শুদ্ধ অনেক ভালো মানুষ। তার মতো মানুষ শুধু আমি কি, আমি নিশ্চিত তুমিও তোমার জীবনে কোনদিন দেখোনি। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার অনেক যত্ন করে। আজ পর্যন্ত উনি আমার জন্য কি কি করেছে তুমি ভাবতেও পারবে না মা। তার কাছে আমি অনেক ভালো থাকবো৷ তার মতো ভালো আমাকে কেউ রাখতে পারবে না।’
আসমা অনেককিছু বলবেন বলে ভেবে এসেছিলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। শুদ্ধ’র কথা বলার সময় ধারার মনে যে খুশি, আনন্দের ঝলক ফুটে উঠছিলো, এতোটা খুশি সে তার মেয়েকে আজ পর্যন্ত কখনও দেখেননি। একটা মায়ের এর চাইতে বেশি আর কি চাই! ধারা শুদ্ধকে নিয়ে আরও অনেক কিছু বলে যেতে লাগলো তার মাকে। আসমা শুধু নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন মেয়ের মুখের দিকে। তার চোখে পানি চলে এলো। আর কিছু বললেন না। শুধু দোয়া করলেন তার মেয়ে যেটাতে সুখী হবে সেটাই যেন হয়।
__________________________________________
রাত অনেক হয়েছে। ধারা এখনো জেগে আছে। বসে বসে শুধু বারবার বারান্দার দরজায় চোখ বুলাচ্ছে। রোজ রাতেই শুদ্ধ আসে। এই রাতের বেলাতেই শুধু সবার চোখের আড়ালে দেখা হয় তাদের। নয়তো পুরো দিনেই চলতে থাকে নিরবিচ্ছিন্ন দূরত্ব। এই রাত হওয়ার জন্যই তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ধারা। জমিরন বিবি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই৷ ধারা একবার সেদিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এভাবে বেশিক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকলে দাদীর ঘুম ভেঙে যেতে পারে। ধারা লাইট বন্ধ করে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ তার চোখ আবারো বারান্দার দরজায় পড়লো। দরজা খোলা। শুদ্ধ অনেকবার ধারাকে নিষেধ করেছে এভাবে দরজা খোলা রেখে না ঘুমাতে। সে আসলে ফোনে মেসেজ করবে। ধারা সে কথা রাখতেই দরজা বন্ধ করে দিল। ছিটকিনিটা লাগাতেই হঠাৎ পেছন থেকে জমিরন বিবি বলে উঠলো,
‘কিরে! আজকে দরজা লাগায় রাখতাছোস কেন? তোর ভাতারে আজকে দেহা করতে আইবো না?’
দাদীর গলা শুনে ধারা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। মুহুর্তেই আত্মা শুকিয়ে এলো তার। দাদী দেখি সব জেনে ফেলেছে। এখন কি হবে?
#পর্ব-২৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
পেছন থেকে দাদীর গলা শুনে ধারার চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো। দাদীকে ধারা খুব ভালো মতোই চিনে। না যেন এখনই চেচাঁমেচি করে সবাইকে জানিয়ে দেয়! ধারা একটা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। জমিরন বিবির মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু এর পরেই ধারাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করে জমিরন বিবি হেসে উঠে বললেন, ‘কিরে ছেড়ি! সোয়ামীর লগেই তো দেহা করোছ কোন নাগরের লগে তো আর না! এতো ডরানির কি আছে?’
দাদীর হাসি শুনে ধারা ঝট করে মাথা তুলে তাকালো। তার দাদী হাসছে! সত্যি?
জমিরন বিবি হাসি থামিয়ে বললেন, ‘হোন ছেমড়ি, সাবধানে থাকিস। তোর বাপ চাচায় যা শুরু করছে! দেইখা ফেললে কিন্তু মেলা ঝামেলা করবো। একটা কথা মনে রাখবি, বিয়ার পর কিন্তু মাইয়া গো স্বামীই সব। স্বামী ভালা হোক খারাপ হোক হের লগেই থাকতে হইবো। ঐ বাড়িই এহন তোর বাড়ি। এইয়া সব পর। আমার পোলাগুলার মাথার তার ছিড়া গেছে। বেশি পইড়া বেশি বুঝা শিখখা গেছে। ওগো লইয়া ভাববি না। স্বামী যা কইবো তাই করবি। বুঝছোস?’
ধারা খুশির সাথে ছলছল চোখে মাথা দুলিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরলো। দাদী তার পক্ষে থাকবে এটা ধারা কখনো আশা করেনি। জমিরন বিবিরও প্রথম থেকেই তার দুই ছেলের সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি। তিনি আগেকার দিনের মানুষ। তালাক শব্দের সাথে ততোটা অভ্যস্ত নন। তার নাতনী স্বামী বাড়ি ছেড়ে আসবে তারপর তাদের তালাক হবে ভাবতেই রুহু কেঁপে উঠে জমিরনের। তিনি বিশ্বাস করেন বিয়ের পর মেয়েদের স্বামী বাড়িই সব। যাই হয়ে যাক তাদের সেখানেই থাকা উচিত। তাই নিজের নাতনীর সংসার বাঁচাতে মনে প্রাণে চান ধারা আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাক। আবার সব ঠিক হোক। তাই বলেই তো মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে ধারা শুদ্ধ’র গোপন সাক্ষাৎ সম্পর্কে অবগত হয়েও তিনি কাউকে কিছু বলেননি।
ধারা দাদীকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ পর জমিরন বিবি বললেন, ‘ছাড় ছেমড়ি, এতো জোরে ধরছোস কে? মাইরা লাইবি নাকি! এতো কান্দন লাগবো না এহন। ঘুমায় থাক। নইলে তোর ভাতারে আইলে তার লগে পিরিতি আলাপ করবি কেমনে?’
ধারা চোখের পানি মুছে দাদীকে ছেড়ে হেসে ফেললো। জমিরন বিবি বললেন,
‘তোমরা কি মনে করছো? বুড়া মানুষ দেইখা
রাইতের আন্ধারে কি হয় আমি কিছু টের পাই না। এই চুল কি পাকছে বাতাসে?’
ধারা লজ্জা পেলো। জমিরন বিবি বললেন,
‘হইছে আর শরম পাইতে হইবো না। এমন দিন আমাগোও গেছে।’
এরপর তিনি মাথায় ঘোমটা টেনে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করার আগে বললেন,
‘আর একটা কথা, তোর সোয়ামী রাতের বেলা খালি হাতেই হউরবাড়ি আইয়া পড়ে কেন? জানে না হের একটা দাদী হাউড়িও আছে। হেরে কবি আমার লেইগা মিডা পান নিয়া আইতে। জমিরন বিবিরে খালি হাতে পডানি যাইবো না।’
এই বলে দাদী চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। খুশির সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো।
__________________________________________
সকাল বেলা তালুকদার বাড়ির সবাই একসাথেই টেবিলে খেতে বসলো। ধারার মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে আছে। আজ শাহেদ বাড়িতে থাকবে না। তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে। এদিকে আজিজ সাহেবও কি একটা কাজে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকবেন। এই সুযোগে ধারা আজ শুদ্ধ’র সাথে দেখা করবে। ঘুরতে যাবে তারা দুজন। হাতে তো সারাটা দিন আছেই৷ আসমাকে ধারা বলে রেখেছে। জমিরন বিবিও জানেন। অতএব তেমন কোন সমস্যা হবে না। এখন শুধু সময় যাওয়ার অপেক্ষা। কখন সবাই ঘর থেকে বেড়োবে! শাহেদ আর আজিজ খাওয়া বাদ দিয়ে জমিয়ে আলোচনায় নেমেছে। সামনের নির্বাচনই মূল প্রসঙ্গ। হঠাৎ তারা কথায় কথায় ধারার বিয়ের প্রসঙ্গে চলে এলো। তারপর তাদেরকে আলাদা করা নিয়ে। ধারার ভেতরে যেই খুশিটা ছিল তা নিমেষেই মিলিয়ে গেলো। শাহেদ শুদ্ধ’র ব্যাপারে যা না তা বলতে লাগলো। ধারার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না। ইচ্ছা করলো সব বাদ দিয়ে এক ছুট কাঁদতে। এতো ভালো মানুষটা! তবুও তাকে নিয়ে রোজ কতো খারাপ কথা শুনতে হয় ধারাকে। ধারার ভীষণ কষ্ট লাগে। ওদেরকে আলাদা করা নিয়ে খোলামেলা এমন কঠিন কঠিন কথা হতে লাগলো যা ধারার পক্ষে শোনা খুবই কষ্টকর। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো। আজিজ সাহেব তা দেখে বললেন,
‘এসব কান্নাকাটি করে লাভ নেই। তুমি তাই করবে যা আমি বলবো।’
ধারা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই আসমা টেবিলের নিচ দিয়ে ধারার হাত ধরে থামিয়ে দিলো। আজিজ সাহেব আর শাহেদ চলে গেলে ধারা খাওয়া বাদ দিয়ে উঠতে গিয়েও উঠলো না। কান্না সমেত খেতে লাগলো। শুদ্ধ বলেছে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে। শুদ্ধ’র কথা সে ফেলবে না।
__________________________________________
দিনটা সুন্দর। মেঘলাটে ভাব। আকাশ পরিষ্কার হলেও রোদের তেজ নেই। মৃদুমন্দ বাতাস মন ফুরফুরে করে রাখে। শুদ্ধ অনেকক্ষণ ধরে স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তাটিতে বাইক নিয়ে ধারার জন্য অপেক্ষা করছে৷ তার গায়ে হাতা ফোল্ড করে পড়া ব্রাউন কালারের একটা চেক শার্ট। এবং হোয়াইট জিন্স। হাতে একটা সাধারণ কালো বেল্টের ঘড়ি। বাইকটা তার নয়। আজকের সারা দিনের জন্য এক বন্ধুর থেকে ম্যানেজ করেছে। রাস্তাটা নির্জন। তেমন কারো চলাফেরা নেই। মাঝে মধ্যে এক দুটো যান বাহন চলাচল করছে৷ খানিক পর ধারা এলো। ধারাকে দেখে শুদ্ধ হাসিমুখে কিছু বলার আগেই হঠাৎ তাকে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো ধারা। শুদ্ধ অবাক হলো৷ ধারার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে ধারা? আপনি কাঁদছেন কেন?’
ধারা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে চাই না শুদ্ধ। আমাকে তোমার সাথেই নিয়ে চলো। যতো সময়ই যাক না কেন? কিচ্ছু ঠিক হবার না। আমি আমার বাড়ির লোকদের চিনি। আমার আর ভালো লাগছে না।’
শুদ্ধ ধারার মাথা তুলে কপালের সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলল, ‘ধারা, এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি একবার বলেছি না সব ঠিক হয়ে যাবে যদি আমরা ঠিক থাকি। হার মেনে নিলে কি করে হবে?’
‘কিন্তু শুদ্ধ, আমরা তো স্বামী স্ত্রীই না? আমরা যদি একসাথে থাকতে চাই তাহলে আমার পরিবারের নিষেধ আমাদের মানতে হবে কেন?’
‘সেটাই তো ধারা। আমরা স্বামী স্ত্রী। এখন যদি আপনার ও বাড়ি থেকে চলে আসতে হয় তাহলে আসতে হবে লুকিয়ে৷ আমাদের একটা হালাল সম্পর্ক। আমরা কেন লুকিয়ে পালিয়ে আসবো? সমস্যা থেকে ভাগলে সেটা কখনোই ঠিক হবে না। সারাজীবন এর বোঝা টেনে যেতে হবে। তাই না ভেগে সমস্যার সামনাসামনি হয়ে তার সমাধান করতে হবে। আর আমরা যদি এখন এমন একটা স্টেপ নেইও তাহলে আপনার পরিবার হয়তো আপনার সাথে কোনদিন আর যোগাযোগও রাখবে না। আমার মূল ভয়টা এদিকেই।’
ধারা কেঁদে বলল, ‘না রাখলে না রাখুক। আমার দরকার নেই।’
শুদ্ধ ব্যগ্র দিয়ে বলল, ‘এটা কেমন কথা ধারা! আপনাকে আমি পরিবারের সামনে নিজের মতটা প্রকাশ করতে বলেছি। তাদের বিরোধিতা করতে তো বলেনি। বাবা মা আমাদের জন্য অনেক ইম্পর্টেন্ট। তাদের মনে কখনো কষ্ট দিবেন না। যাই হোক না কেন, সেটা আপনার পরিবার। আপনি এই পর্যন্ত বড় হয়েছেন তাদের জন্যই। একটা পূর্ণাঙ্গ পরিবার পাওয়াও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ধারা। এভাবে তাকে হেলাফেলা করবেন না। তাদেরকে আপনার পয়েন্ট অফ ভিউটা বোঝান। একবার ব্যর্থ হলে আরেকবার বোঝান। বারবার বোঝান। তবুও তাদেরকে রাজী করিয়ে তারপর আসুন। আমি চাই না আমার কারণে আপনার পরিবারের সাথে আপনার সম্পর্ক খারাপ হোক৷ আপনি পারবেন না ধারা?’
ধারা অপলক শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বাড়ির লোক শুদ্ধকে শত অপছন্দ করলেও শুদ্ধ কতোটা শ্রদ্ধার সাথে তাদের নিয়ে কথা বলছে। তাদেরকে সমর্থন করছে। শুদ্ধ তো শুদ্ধই। ধারা তো বুঝে। না জানি তার পরিবার কবে বুঝবে! কবে শুদ্ধ’র জন্ম পরিচয়ের চাইতে তার ব্যক্তিত্বটা তাদের কাছে বড় হবে! ধারা আলতো করে মাথা দুলিয়ে বলল সে পারবে। শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল,
‘আপনি অযথাই এতো ভয় পাচ্ছেন। আপনি যদি না চান তাহলে আপনাকে কিভাবে আমার থেকে আলাদা করবে? আইনের নিয়মকানুন বলেও তো একটা কথা আছে৷ নাকি আপনি আবার ততোদিনে আমাকে না চাইবেন।’
শেষের কথাটা শুদ্ধ মজা করে বলেছিল৷ ধারা চোখের পানি মুছতে মুছতে কপট রাগ নিয়ে শুদ্ধ’র গায়ে মৃদু বারি দিয়ে বলল,
‘তোমার মনে হয় আমি এমনটা করবো!’
শুদ্ধ ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল, ‘মনে তো অনেক কিছুই হয়৷ কিন্তু সব তো আর বলতে পারি না। বাই দা ওয়ে, আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? আজকে আপনি আসার পর থেকে আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন।’
ধারা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে বলল,
‘ইশ! মোটেও না।’
শুদ্ধ ধারার সামনে এসে বলল, ‘মোটেও না মানে! এই মাত্রই তো আবার বললেন। সোজা সাপ্টা বললেই হয়, আপনার মধ্যে আজকাল বউ বউ ফিলটা খুব ভালো করেই জাগছে। সমস্যা নেই, আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।’
‘তাহলে আপনি আমাকে আপনি আপনি করেন কেন?’
‘সেটা তো বলি আপনি বলেন বলে। ইকুয়ালিটি!’
‘আমি বললেই আপনাকে বলতে হবে! অনেক ওয়াইফরা তো হাজবেন্ডদের ‘আপনি’ করে বলেই। এর জন্য কি হাজবেন্ডরাও ‘আপনি’ বলে? এমন ভাবে আপনি আপনি করতে থাকেন যেন মনে হয় আপনি নিজের বউয়ের সাথে না কোন অ্যান্টির সাথে কথা বলছেন।’
ধারার ভোতা মুখের কথা শুনে শুদ্ধ’র খুব হাসি পেলো। সে মুচকি হেসে বলল,
‘আমার তো সেটাই মনে হয়।’
ধারা আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো করে বলল, ‘সেটাই মনে হয় মানে? আমি অ্যান্টির মতো? একটা ঊনিশ বছরের মেয়েকে আপনার অ্যান্টির মতো মনে হয়? এটা আপনি বলতে পারলেন!’
কপট রাগ দেখিয়ে ধারা শুদ্ধ’র থেকে মুখ ঘুরিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ পেছন থেকে ধারার কানের কাছে মুখ নিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা সরি! ভুল বলেছি। আপনাকে অ্যান্টির মতো লাগে না। বউয়ের মতোই লাগে। আর এখন থেকে আমি আমার বউয়ের মতো করেই কথা বলবো। সহ্য করতে পারবে তো?’
লজ্জায় ধারার গালদুটো লাল হয়ে এলো। সে দ্রুত কথা কাটিয়ে ঘুরে বলল, ‘এখন সারাদিন কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন না?’
এই বলে ধারা বাইকের কাছে এসে দাঁড়ালো। শুদ্ধ বাইকে উঠতে উঠতে অলস ভঙ্গিতে বলল,
‘বাহ! ভালো সুবিচার করলে। আমাকে প্রথমে রাজী করিয়ে এখন নিজেই পাল্টি মেরে নিলে। এখনও ‘আপনি!’
ধারা পেছনে বসতে বসতে রক্তিম মুখে খুবই সময় নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আস্তে চালিয়ো।’
শুদ্ধ একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে জোরে বাইক স্টার্ট দিলো। মাঝে যতোটুকুও বা দূরত্ব ছিল সবটা পূরণ হয়ে ধারা একদম আকস্মিক শুদ্ধ’র গায়ে লেপ্টে পড়লো। কপালে হাত দিয়ে ভাবলো, এই ছেলে এখনই যা শুরু করেছে। এখনও তো সারাটা দিনই বাকি। না জানি তখন কি করে!
চলবে,