হৃদমাঝারে তুমি পর্ব -১১

#হৃদ_মাঝারে_তুমি
#পর্ব_১১
#Written_by_Mehebin_Nira (ছদ্মনামী)

নিরা যেই না আপেল নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় ওমনি কেউ তার হাত পেছন থেকে খপ করে ধরে নেয়। আর ‘চোর চোর’ বলে হালকা চিৎকার দেয়..! নিরা ভয় পেয়ে হকচকিয়ে যায়। ফ্রিজ থেকে সরে ডাইনিং টেবিলের সামনে আসাতে নিরা আর তার সামনে থাকা অন্যজনের উপরেও আলোক রশ্মি ঝলমলিয়ে এসে পড়ে। ফলস্বরূপ দুজন-ই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দুজন কে! যে নিরা কে চোর বলে তার হাত খপ করে ধরে ফেললো সে আদ্রাজ। বেচারা রাতুলের উপর রাগ করে নিচে আসতেই দেখলো ফ্রিজের সামনে একটা কারো ছায়া হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছায়ামানব সোজা এসে ফ্রিজের বা দিক থেকে সামনে দাঁড়ায়। আদ্রাজ ভাবলো চোর টোর হবে হয়তো। নাহলে এমন চোরের মত খাপটি মেরে কি করছে ওখানে? যদি দরকার ই ছিলো তবে লাইট জ্বালালো না কেন? ভেবে আদ্রাজ ও দুল টা পকেটে নিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে সেদিকে আসে। এমন ভাবে আসে যাতে করে ঐ ব্যক্তি কিচ্ছুটি টের পেলো না। আদ্রাজ হাত ধরেই চোর চোর বলে চিৎকার করায় নিরা ভয়ের সাথে অবাক ও হয়। এখনো আদ্রাজের হাতে নিরার সেই হাত বন্দি। আদ্রাজ খুব শক্ত করেই হাত টা ধরে রেখেছে। যার জন্য বিপরীত জন চেষ্টা করেও ছুটাতে পারছিলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে নাক মুখ চেপে তাকালো নিরা। বিপরীত জন তা দেখে বলল,

‘তুমি?’ [এমন ভাবে বললো যেন এই জায়গায় নিরা কে দেখবে ভাবে নি]

‘ঐ আপনার কোন দিক দিয়ে আমাকে চোর মনে হয়?’

‘চোর ই তো! নাহলে তুমি এখানে চুপিচুপি কি করো?’

‘তা আপনাকে বলতে হবে?’

‘অফকোর্স!’

‘সরি টু সে আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই!’

‘কি বললে?’

‘আমার হাত!’

আদ্রাজ দেখলো সে এখনো নিরার হাত টি ধরে আছে। দেখা মাত্রই হাত টা ছেড়ে দেয় আদ্রাজ। তার পূর্বের কথা মনে পড়ে যায়। সে তো মনে মনে ঠিক করেছিলো নিরা কে ইগনোর করে চলবে তাহলে এটা কি হলো? কথা টা মনে পড়া মাত্রই সে পেছন ফিরে যায়। নিরা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো! নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো কয়েক টা পানির ফোঁটা দেখা যাচ্ছে! সে তো পানি এখনো স্পর্শ করে নি তাহলে তার হাতে পানি এলো কোথা থেকে? আদ্রাজের দিকে একটু তাকাতেই দেখলো তার চুল গুলো ভেজা দেখা যাচ্ছে। আদ্রাজের চুল গুলো নিরার খুব প্রিয়। সত্যি বলতে তাদের দুজনার পরিচয়ের শুরু টা ঝগড়া দিয়ে হলেও আদ্রাজের উপর ছোটখাটো একটা ক্রাস খেয়ে বসে ছিলো নিরা। ক্রাসের সাথে ইচ্ছে করেই ঝগড়া করতে তার ভালো লাগতো বলেই সে এটা কনটিনিউ রাখতো। তার এই গোপন কথা টা আশা ও জানে না! শুধু সে জানে! এই কথা একদম গোপন যা নিরা ইচ্ছে করেই প্রকাশ করতে চায় নি। নিরা শুনেছে চোখ সুন্দর হলে নাকি সব কিছুই দেখতে সুন্দর লাগে। আদ্রাজের হেয়ার কাট টাও ফেভারিট নিরার। নিরা সেদিন ই বুঝে গিয়েছিলো বেচারা নিজের চুল গুলোর প্রতি কতো কেয়ার করে। গুছিয়ে রাখা চুল গুলো এখন এলোমেলো হয়ে আছে। টপটপ করে পানি কপাল বেয়ে পড়ছে। নিরা বুঝলো এই পানি ফোঁটার রহস্য কি! কিন্তু আদ্রাজ হুট করে পিছন ফিরে গেলো কেন?

আদ্রাজ নিরার হাত ধরে ফেলায় পেছন থেকেই বললো,
‘সরি!’

আর তারপর হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। নিরা বোকার মতো তা দেখলো!

‘সরি বলে চলে গেলো কেন? অদ্ভুত!’

নিরা ফ্রিজ থেকে সামান্য কিছু ফল খেয়ে রুমে চলে আসে। এই মুহুর্তে পেটের ক্ষুধা নিবারণ তো হয়েছে ঠিক ই তবে দু চোখে ঘুমের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এক্ষুনি না ঘুমাতে পারলে চোখের পাতা খুলে রাখে কার সাধ্য? দরজা টা কোনো ভাবে লাগিয়ে। বেডে নিরার পাশে শুয়ে পড়ে সে। আর ধীরে ধীরে ঘুম রাজ্যের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়!

আদ্রাজ মনে মনে বলল,
‘এসব কি হচ্ছে টা কি আমার সাথে? আমি যা চাই তার বিপরীত টা হয়েই চলছে! বুঝেছি সব দোষ এই মেয়েটার! ওহহো কিছুই ঠিক হচ্ছে না! সব কিছুতে গন্ডগোল পাকাচ্ছে! কুল আদ্রাজ কুল! তোকে এভাবে দুর্বল হলে কিছুতেই চলবে না! ‘বি স্ট্রং!’

রাতুল দেখলো আদ্রাজ ৪ মিনিটের মধ্যেই আবার রুমে ব্যাক করেছে আর মুখে কিসব যেনো বিড়বিড় করছে। তাকে ভীষণ চিন্তিত ও দেখাচ্ছে!

‘কি ব্যাপার এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি?’

‘হ্যাঁ নিচে ঐ মেয়েটা…

বলতে গিয়ে মুখে তালা মেরে দেয় আদ্রাজ। কারণ তার সামনে ড্যাব ড্যাবে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে রাতুল। যে কিনা সর্বক্ষণ তাকে পঁচাতে ব্যস্ত থাকে।

‘কোন মেয়ে?’

‘আ-ব-কই কোন মেয়ে?’

‘তুই তো বলছিলি ঐ মেয়ে! ইয়েস ব্রো ঐ মেয়ে মানে নিরা রাইট?’

‘থামবি তুই? তোরা দুজনে মিলে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিস অলরেডি! শুধু মাত্র এই জন্যই আমার মন যা চায় তার একটাও হচ্ছে না।’

‘কি হচ্ছে না?’

‘চুপচাপ ঘুমা। সকালে অনেক কাজ বাকি আছে! আর তুই না ঘুমালে আমাকে অন্তত একটু ঘুমাতে দে প্লিজ ভাই!’

‘ওকে ওকে!’

আদ্রাজ শুয়ে পড়ে। একটা সময় রাতুল ও শত দুষ্টুমিময় একটা সন্ধ্যা রাত শেষে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু আদ্রাজের চোখে ঘুম আর ধরা দেয় না! জোড় করে চোখ জোড়া অনেকক্ষণ বন্ধ রাখার পর ও ঘুম আসছে না দেখে চোখ খুলে ফেলে সে। বেডের পাশে টেবিল ল্যাম্প টার নিচ থেকে হাতড়ে ফোন টা নিয়ে দেখলো রাত ৩ টা ১০ বেজে গেছে! সারাদিন এতো দৌড়াদৌড়ি করার পর ও ঘুম আসছে না দেখে সে নিজেও অবাক! কেন এমন হচ্ছে চিন্তা করতে গিয়ে শুধু একজনের নাম ই মাথায় আসছে! আর সেটি শুধুমাত্র নিরা! নিরা বেহুঁশ হয়ে যাওয়া, তার সাথে আসবে না বলে জেদ করে বসা, তাই জোড় করে কোলে করে নিয়ে ফেলে দেওয়ার নাম করে গাড়ি তে বসানো, এসব কিছু ভাবতেই চোখ আপোসে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যরকম এক ভালো লাগা হৃদ মাঝারে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে! যখনি ভাবলো নিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়েছিলো চোখ আচমকা খুলে ফেলে।

‘উফ এসব কি বন্ধ হবে না? কেন এতো ওকে নিয়ে ভাবছিস আদ্রাজ? ভুলে যা সব! ঐ মেয়েটাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ কর ব্যাস!’

মাথা এপাশ ওপাশ নেড়ে এবার ঘুমাবে বলে মনের উপর জোড় দিয়ে নিজেকে ভাবনা মুক্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। এই রকম লড়াই করতে করতে শেষে সেও ঘুমিয়ে পড়ে! তবে আজকে এই সন্ধ্যা থেকে রাত সব কিছু ব্যতিক্রম ছিলো! সব কিছু তার আয়ত্বের বাহিরে ছিলো! যা আদ্রাজ শত চেষ্টা করেও আয়ত্বে রাখতে পারে নি! ঘুমিয়ে পড়ে আদ্রাজ!

___________________

রাতের কালো অন্ধকার কে হারিয়ে আবারো পৃথিবীর বুকর নতুন এক ভোর হয়ে ধরা দেয় দিনের আলো! শুরু হয় নতুন এক প্রহর! নতুন একটি দিন! আর সঙ্গে শুরু হয় সব কিছুর তোড়জোড়। আজ প্রিয়ার বিয়ে বলে কথা! রিলেটিভ সকল কে খুঁজে খুঁজে নাস্তার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কাজে নিরা আর আশা ও জড়িয়ে যায়। প্রিয়া সকাল হতেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে! প্রিয় মানুষের সাথে বিয়ে হচ্ছে বলে এতো হাসি খুশি আনন্দে হৈচৈ করতে থাকা মেয়েটা এখন একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে! বিদায়ের সময় যত ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে ততই প্রিয় জন প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে যাওয়ার এক চাপা কষ্ট ধীরে ধীরে তাকে ক্রমশই গ্রাস করে চলেছে। যে কষ্ট টা তাকে ভেতর থেকে মন টা কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে! সে একা একাই রুমে বসে আছে!

নিরা আর আশা একে একে সকল কে চা নাস্তা দিয়ে আসে। যারাই ঘুম থেকে উঠেছে তাদের আরো কয়েক জন মিলে আপ্যায়ন করে।

‘আশা শুন!’

‘হু বল!’

‘প্রিয়া আপু নাস্তা করেছে?’

‘আমি তো তোর সাথেই আছি কিভাবে জানবো বল!’

‘মনে হয় করে নি! চল আমরা এবার আপু কে নাস্তা দিয়ে আসি! তাছাড়া কালকে আপুর সাথে তেমন কথা হয় নি আর!’

‘ওহ ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস এই তুই গতকাল ভাইয়ার সাথে কোথায় গিয়েছিলি বললি না তো?’

‘এখানে চায়ের সাথে তোর ভাইয়া আসলো কিভাবে?’

‘হেঁটে হেঁটে আসছে! চুপ এখন বল আমাকে!’

‘তোর ঐ ভাইয়া কে আর তোকে আমি একসঙ্গে চায়ে ডুবিয়ে মারবো!’

বলে নিরা রেগে চলে যায়। আশা হাসতে থাকে। হঠাৎ আশা কে প্রিয়ার মা ডাকে কাকে যেনো চা দিয়ে আসার জন্য। তা দেখে পেছন থেকে আশা চিল্লিয়ে বলে,

‘নিরু তুই প্রিয়া আপুর কাছে যা আমি একটু পর আসবো কেমন!’

‘হুহ!’

নিরা চা নাস্তা নিয়ে সোজা প্রিয়ার রুমে ঢুকে। প্রিয়া বেডের একোাশ জড়সড় হয়ে বসে আছে।

তা দেখে নিরা তার হাতের ট্রে টা একটা টেবিল নিয়ে তার উপর রাখে। শব্দ হওয়ায় ভিমড়ি খেয়ে প্রিয়া সেদিকে তাকায়। নিরা কে দেখে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ও নিরা তুমি!’

‘হু। পিয়াস ভাইয়া এসেছে ভেবেছিলে নাকি?’ [দুষ্টুমি করে]

প্রিয়া কিছু বললো না। যা নিরা খেয়াল করে। ভ্রুঁ কুঁচকে একবার ভালো করে প্রিয়া কে পরখ করে নিয়ে দেখলো প্রিয়া প্রতিদিন এর মতো আজ একটু ও হাসছে না! অথচ প্রতিদিন সে নিরার দুষ্টুমি গুলো দেখে হো হো করে প্রাণ খুলে হাসতো! নিরা গিয়ে প্রিয়ার পাশে বসে!

‘আপু?’

‘হ্যাঁ নিরা!’

‘মন খারাপ?’

জোড় করে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘কই নাতো!’

‘তাহলে নাস্তা করে নাও!’

‘আমার না এখন নাস্তা করতে একদম ইচ্ছা করছে না!’

‘তা বললে কি করে হবে শুনি? বুঝেছি তোমার মন খারাপ! আগে নাস্তা করে নিবা দ্যান মন খারাপ করবা ওকে আসো?’

‘না!’

‘চা টা অন্তত খাও! এতো কষ্ট করে নিয়ে আসলাম আর তুমি খাবে না? আশা তো চা পছন্দ করে না! তাই আমি ও তোমার সাথে চা খাবো ভেবে নিয়ে এসেছিলাম ধুর!'(মন খারাপ করে)

‘আচ্ছা দাও!’

নিরা মুচকি হেসে প্রিয়ার হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। প্রিয়া কয়েক চুমুক দিয়ে রেখে দেয়। গলা দিয়ে তার কিছুই যেনো নামছে না। সব কিছু কেমন যেনো লাগছে! নিরা সেটা উপলব্ধি করতে পেরে তাকে ছোট বোনের ন্যায় শান্তনা দিতে গেলে প্রিয়া হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়! বহু কষ্টে যা এতোক্ষণ নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিলো সে!

চলবে———————

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here