#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১২)
আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ছড়াছড়ি! যেকোনো সময় আকাশের বুক ছিঁড়ে বৃষ্টি নামবে। বলতে বলতেই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেছে। বারান্দায় অগোছালো ভাবে বসে আছে শুভ্রতা। রান্না বান্না কিছু করে নি। নিজেও কিছু খায় নি। একমনে নিজের জীবনের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। অতীতের পাতা উল্টিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই ফেলো না। বাতাসের ঝাপটার সাথে সাথে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শুভ্রতাকে। কিন্ত সেদিকে মেয়েটার কোনো ধ্যানই নেই। সে অন্য ভাবনায় মত্ত। এলোমেলো ভাবে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। কলিংবেলের আওয়াজও তার ধ্যান ভাঙ্গাতে সক্ষম হয় নি। বারংবার বেল বেজে যাচ্ছে। কিন্ত সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
‘শুভ্র! শুভ্র! কই তুমি?’ রুমে ডুকতে ডুকতে শুভ্রতাকে চিল্লিয়ে ডাকছে মেঘ। এদিক ওদিক খুঁজেও মেয়েটাকে না পেয়ে বারান্দায় উঁকি দেয়। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে। শুভ্রতাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেঘ। অতঃপর শান্ত কন্ঠে শুভ্রতাকে ডাক দেয়।
‘এখানে এভাবে বসে আছো যে? কতোবার বেল বাজালাম ডাকলাম,শুনলে না যে? আর এভাবে বসে আছো কেনো? ভিজে যাচ্ছো তো। ওঠো!’
মেঘের এতো কথায় শুভ্রতার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে একমনে সামনে তাকিয়ে আছে। মেঘ হাটু গেড়ে শুভ্রতার পাশে বসে। তারপর শুভ্রতার কাঁধে স্পর্শ করে বলে,,’কি হয়েছে শুভ্র?’
মেঘের কথায় শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকালো। চোখ দু’টো টকটকে লাল হয়ে আছে। বৃষ্টির জন্য কিনা ঠিক বুঝলো না মেঘ। কিন্ত কিছু একটা যে হয়েছে সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মেঘ।
‘কি হয়েছে শুভ্র?’ মেঘ বেশ নরম গলায় প্রশ্ন করে।
‘আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি তাই না? অন্য সবার মতো আপনিও আমায় ছেড়ে চলে যাবেন তাই না? সবার মতো আপনিও আমাকে খারাপ মেয়ে মনে করেন তাই না?’ আকস্মিক শুভ্রতার প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় মেঘ।
‘কি বলছো কি শুভ্র? তোমার মাথা ঠিক আছে?’
‘আপনি সত্যি আমাকে মেনে নিতে পারেন নি তাই না?’
‘শুভ্র আর ইউ গোন মেড? কি বলছো তুমি? কি হয়েছে? দেখি ওঠ এখান থেকে তোমার মাথা ঠিক নেই। উঠো না!’ শুভ্রতাকে উঠানোর চেষ্টা করে মেঘ বলে। মেঘ শুভ্রতাকে একপ্রকার টেনেই উঠিয়ে নেয়। শুভ্রতা মেঘের চোখের দিকে এক’দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। মেঘ শুভ্রতার দু’গালে হাত দিয়ে বলে,,’শুভ্র! কি হয়েছে তোমার? আমাকে খুলে বলো! না বললে আমি বুঝবো কি করে?’
‘আপনি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানেন তো?’ শুভ্রতার কথায় মেঘ শুভ্রতাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে,,’তোমার কোনো সন্দেহ আছে?’
‘তবে আমাকে নিজের স্ত্রীর স্বীকৃতি দিন। আমাদের সম্পর্কটা আর পাঁচ’টা স্বামী স্ত্রীর মতো করুন!’ শুভ্রতার কথায় মেঘের হাত আলগা হয়ে আসে। শুভ্রতা তা দেখে মাথা উঁচু করে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,’কি হলো?’
মেঘ দু’টো ঢোক গিলে বলে,,’শুভ্র তুমি নিজের মধ্যে নেই। চলো ভেতরে চলো। ফ্রেশ হবে। খেয়েছো কিছু?’
‘আপনি একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেন না। আমি বুঝে গেছি আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মানেন না বলেই স্বীকৃতি দিতে চাইছেন না!’
শুভ্রতার কথায় মেঘ কি বলবে বুঝতে পারছে না। কিন্ত আপাদত শুভ্রতাকে শান্ত করা প্রয়োজন। তাই মেঘ শুভ্রতার দু’গালে হাত দিয়ে বলে,,’সব হবে শুভ্র! কিন্ত এখন বাইরে থেকে এসেছি ফ্রেশ হবো তো। তুমিও চেঞ্জ করো নি। ভিজে গেছো তো। চলো আমরা আগে ভেতরে যাই। তারপর না হয়!’
মেঘের কথার বিপরীতে শুভ্রতা আর কিছুই বললো না। চুপচাপ রুমে চলে গেলো। মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও ভেতরে গেলো।
সময়ের সাথে সাথে বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে। তার সাথে দু’জন মানব মানবীর সম্পর্কটা আরো একধাপ বেড়ে চলেছে। দু’জনে আবদ্ধ হতে চলেছে নতুন সম্পর্কে,এক নতুন অনুভূতিতে।
শুভ্রতার ব্যবহারে মেঘ আজ ভীষণই অদ্ভুত। আজ যেনো সে এক নতুন শুভ্রতাকে আবিষ্কার করছে। শুভ্রতাকে তখন বুঝিয়ে রুমে পাঠালেও শান্ত করতে পারে নি মেঘ। কিন্ত শুভ্রতার অদ্ভুত আচরণেরও কোনো সমাধানে পাওয়া যায় নি।
_________________
সূর্যের তীর্যক রশ্মি নিজের চোখে মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় শুভ্রতার। কারো উষ্ণ ছোঁয়ায় ঘুমটা ভারী হয়ে আসছে। কিন্ত চোখে আলো পড়ায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। ফিটফিট করে চোখ খুলে খানিকক্ষণ ঝীম ধরে রইলো। কালকের সকল ঘটনা মস্তিষ্কে একবার সাজিয়ে নিলো। তারপর মেঘের মুখের দিকে তাকালো। শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে আছে। শুভ্রতা মেঘের মুখে হাত বুলিয়ে বলে,,’আই এম সরি মেঘ। কাল যদি আপনাকে জোর না করতাম তাহলে যে আমার ভয় কাটতো না। আমি চাই না আরো একবার বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভোগ করতে। আমি চাই না আপনাকে হারাতে। কালকের পর হয়তো আপনার আমাকে ছেঁচড়া মনে হয়েছে,কিন্ত কি করবো বলুন। ভেবেছি যদি আপনি আমাকে স্ত্রী অধিকার দিন তবে আমাকে আর ছেড়ে যাবেন না। আমি আর হারাতে পারবো না। বিশ্বাস করুন হারাতে হারাতে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি! কাল ওই মানুষটাকে দেখার পর আবারও আমার বুক কেঁপে উঠেছে। যদি আপনি আমায় অবিশ্বাস করে দূরে ঠেলে দিন আমি তা সহ্য করতে পারবো না!’ নিজে নিজে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছে শুভ্রতা। কাল সে খুব ভয় পেয়ে গেছিলো।
‘তোমাকে যদি ছেড়ে যাওয়ার হতো তবে তোমায় বিয়ে করতাম না। তুমি তো আমাকে সবই বলেছিলে যদি ছেড়ে যাওয়া হতো সেদিনই চলে যেতাম! আমি ভাবি নি এতো দিনে আমার প্রতি তোমার এইরকম একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। আমি হয়তো ব্যর্থ!’ আকস্মিক মেঘের গলায় হকচকিয়ে যায় শুভ্রতা। সে তো কথাগুলো আনমনেই বলে ফেলেছে। ভেবেছিলো মেঘ ঘুমিয়ে আছে। কিন্ত মেঘ যে এভাবে জেগে শুনে ফেলবে তা ভাবতে পারে নি। শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকালো। মেঘও শুভ্রতার দিকেই তাকিয়ে ছিলো বলে চোখাচোখি হয়ে গেলো। শুভ্রতা ভাবলো মেঘের কাছে লুকাবে না।
তাই নিজে বলে,,’আসলে কাল আমি ওকে দেখেছিলাম। ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি আমায় ভূল বুঝবেন,বিশ্বাস করতে চাইবেন না।’
‘তা এখন আপনার ভূল ভেঙ্গেছে ম্যাডাম?’ মেঘ বেশ রসাত্মক স্বরে কথাটা বলে। এতোক্ষণ লজ্জা না লাগলেও শুভ্রতার এখন বেশ লজ্জা লাগছে। মাথা নুইয়ে বলে,,’ফ্রেশ হবো ছাড়ুন!’
‘এতোক্ষণ তো বেশ ভালোই ছিলে এখন এতো তাড়া!’ মেঘের হেয়ালি কথায় শুভ্রতা এবার জোর করে মেঘের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
_____________________
শুনো যেটা দিবে একেবারে শিওর হয়ে দেবে। আন্দাজে মার্ক করবা না। কারণ এখানে ভূল মার্ক করলেও নাম্বার কাটা যায়। যতোটা পারো দিবা। প্রয়োজনে সব দিবা না কিন্ত আন্দাজে কোনো কাজ করবা না। ওকে?’ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে শুভ্রতাকে এক নাগাড়ে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে মেঘ। আজ শুভ্রতা এডমিশন টেস্ট।
সকাল থেকেই সে বেশ নার্ভাস। মেঘ শুভ্রতার নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য বিভিন্ন কথা বলছে। মেঘের এবার ঘড়ির দিকে তাকালো। সময় হয়ে আসছে। শুভ্রতাকে সব বুঝিয়ে হলে পাঠিয়ে দিলো। শুভ্রতার জন্য সে বাইরে অপেক্ষা করবে। আজ অফিস থেকে অনেক কষ্টে ছুটি মেনেজ করেছে। তাও হাফ ডে। শুভ্রতার এক্সাম শেষ হলে আবার অফিস যাবে। শুভ্রতা বিদায় নিয়ে হল রুমের দিকে গেলো। বুকটা বেশ কাঁপছে। এতোদিনের তৈরি করা স্বপ্নের শেষ সীড়িটা আজ অতিক্রম করবে। যদি তা অতিক্রম করতে পারে তবে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। ‘আমি নিশ্চয়ই পারবো। পারতে আমাকে হবেই। মেঘের জন্য,আমার জন্য!’ নিজের মনে কথাগুলো বলে চলে যায় শুভ্রতা।
#চলবে?
(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)